লেখক : মলয় সরকার
অলোকেশের এই মাঠটার ওপর একটা নস্ট্যালজিয়া আছে। আজ অনেকদিন পর এখানে এসেছে ও । নস্ট্যালজিয়া থাকার কারণ নিশ্চয়ই আছে।
এই মাঠটা, অবশ্য এখন আর সেই মাঠ নেই, উন্নতির জোয়ারে গা ভাসিয়ে, এটা এখন ঝাঁ চকচকে পার্ক। যখন সত্যিই মাঠ ছিল তখন এখানে কত খেলাই না খেলেছে অলোকেশ। এ মাঠের প্রতিটি ঘাসকে ও চেনে। এই মাঠের সবুজ গায়ে মেখে বড় হয়েছে ও। আজ না হয় সেসব অনেক পিছনে ফেলে বার্ধক্যের ভারিক্কিপনায় চেহারায় অনেক পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু এই মাঠে এসে বাইরের পোশাকি চেহারাটাকে ভুলে ও ফিরে গেছে সেই ফেলে আসা সবুজ দিনগুলোতে।
তখন ক’টাই বা ঘর ছিল এ গ্রামে। চার পাশে ক’টা ছড়িয়ে ছিটিয়ে ঘর; এক পাশে একটা পুকুর তার মাঝে এই একটা বড়সড় মাঠ। আর বড় সমান মাঠ গ্রামের মধ্যে থাকলে যা হয় আর কী – ছেলেরা দুপাশে বাঁশের গোলপোষ্ট পুঁঁতে এটাকে ফুটবল মাঠ করেছিল। আর তখন কতই বা আর বয়স অলোকেশের – সেভেন এইটে পড়া হাফ প্যাণ্ট পরা বাচ্চা ছেলে , গোঁফও ওঠেনি। স্কুল থেকে চারটের ঘণ্টা বাজলেই ব্যাগটাকে গলায় ঝুলিয়ে দৌড় বাড়িতে। বাড়ি ঢোকার আগে থেকেই বাইরে থেকে চেঁচাতে চেঁচাতে আসত, মা খেতে দাও শিগগির —
মা রাগ দেখিয়ে বলত, তোর জন্যে কি বাড়ির বাইরে খেতে দিয়ে আসব? ব্যাগটা কোনমতে ছুঁঁড়ে ফেলে, কোথায় পড়ল তা আর দেখার সময় নেই, দুটি নাকে মুখে গুঁজে এক ছুটে মাঠে হাজির। অন্য সব বন্ধুদেরও সেই একই দশা। সবাই, কে কার আগে আসতে পারবে তার জন্য প্রতিযোগিতা। একজন ফুটবল নিয়ে মাঠে হাজির। আসলে, তাড়াহুড়োর কারণটা আর কিছুই নয়। দল ভাগাভাগি হবে তো – আগে গেলে পছন্দসই দলে ঢোকা যাবে। তাই –
যেদিন অলোকেশরা জিতত, চেঁচিয়ে পাড়া মাথায় করত, আর হারলে মাঠে বসে বসে ঘাস চিবোনো আর আকাশের দিকে চেয়ে বিষন্ন মুখে ধীরে ধীরে সন্ধ্যা নামতে দেখা, এটাই ছিল রোজের দিনলিপি।
হঠাৎ একদিন চোখ পড়ে গেল, গোলপোষ্টে গোল মারতে গিয়ে, ঠিক উলটো দিকের বাড়ির দরজায় ফ্রেমে আঁটা ছবির মত ফ্রক পরা একটি মুখ; ব্যস, চোখ গোলপোষ্টের দিকে না দেখে সেই ছবির গায়ে আটকে গেল। আর ফল যা হবার হল, বল আর গোলে না ঢুকে সোজা অন্য দিকে বেরিয়ে গেল। সবাই এসে ঘাড়ের ওপর চেঁচামেচি – ফাঁকা গোলে বলটা গোলে মারতে পারলি না। মাথা নিচু করে সব বন্ধুদের সব গালাগালি হজম করেছিল ও নিঃশব্দে। তখন তার থেকেও বড় ধুকপুকুনি চলছে বুকের মধ্যে। এ কথা কাউকে বলতে পারছে না। সেদিন আর খেলতে ভাল লাগেনি। মনের মধ্যে কী একটা তোলপাড় – এরকমটা কোনোদিনও হয়নি; ঠিক কাউকে বোঝাতেও পারেনি। তারপর থেকে খেলার মাঠ অন্য ভাবে টানত।
অলোকেশ ভাবছিল এ মাঠে তো ও এতদিন খেলছে, কোনোদিন তো একে দেখেনি, কী ব্যাপার। ভাল করে খোঁজ নিয়ে জানল, মেয়েটির নাম অনু, অনুরাধা। এখানে থাকত না, মামার বাড়িতে থাকত। বড় হচ্ছে, তাই বাবা-মা নিজেদের কাছে এনেছে, এখন থেকে এখানেই থাকবে।
ব্যাপারটা তো পরিষ্কার হল, কিন্তু মনের দিক থেকে এক সমস্যায় পড়ে গেল ও। সবসময়ই ঐ মুখটা মনে ভাসতে লাগল, বইয়ের পাতায় মন বসে না, হাঁটতে চলতে সবসময়ই ওই এক মুখ মনে ধাক্কা লাগায়। এ রকমটা তো আগে কখনও হয়নি, কেমন যেন অবাধ্য হয়ে পড়েছে মনটা। নিজের মন যে আর নিজের বশে নেই, এমনটা যে হতে পারে সেটা ঠিক আগে জানা ছিল না।
পড়াশোনায় মোটামুটি ভালই ছিল অলোকেশ, অন্ততঃ ওদের স্কুলে বা গ্রামে তার একটা সুনাম ছিল। ক্লাশের পড়ার ব্যাপারেও কেমন যেন একটু ঢিলে পড়ে যাচ্ছিল যেটা স্কুলের মাষ্টার মশাইদেরও চোখে পড়েছিল। তবে কারণটা কেউ অনুমান করতে পারেনি। সেটার খবর রাখত কেবল আকাশ, বাতাস আর রাতের বিছানা, যেখানে শুয়ে ঘুম আসছে না বলে কেবলই এপাশ ওপাশ করতে হত।
পার্কটা ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগল অলোকেশ। কোথায় গোলপোষ্ট পোঁতা হত, কোথায় সেন্টার হত এইসব। ও প্রতিটা পা ফেলে আর সেদিনের এক একটি তুচ্ছ ঘটনাও চোখের সামনে জলজ্যান্ত হয়ে ভেসে উঠতে থাকে। মনে হতে থাকে এই তো মাত্র সেদিনের কথা, এর মধ্যেই এতদিন হয়ে গেল। বিশ্বাসই হতে চায় না। এই তো সেই জায়গাটা যেখানে পিন্টুর সাথে একটা ফাউল করা নিয়ে কত মারামারি হয়েছিল। ওর মনে পড়ল, মারামারি হয়েছিল কিন্তু ঝগড়া বা কথা বন্ধ তো কই হয়নি। পরদিনই এক সংগে খেলা গল্প হয়েছিল। মাঝে একবার ওর সাথে যোগাযোগ হয়েছিল। সেদিন হঠাৎ খবর পেল পিন্টু দিল্লীতে রিটায়ার করে থাকত। হঠাতই হার্টফেল করে মারা গেছে। ছেলেবেলার বন্ধুরা এক এক করে অনেকেই চলে গেছে। কে যে কোথায় ছিটকে পড়েছে সব জানা-ই নেই। বয়সটা কী করে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেছে, মাথার চুলে কখন যে, মেঘের ধারে যেমন রোদের আলো লেগে রূপোলী রেখা দেখা যায়, তেমনই রূপোলী রঙ লেগেছে খেয়ালই হয়নি। কাজ, অফিস আর সংসারের চাকায় কখন যে এতটা পথ চলে এসেছে খেয়ালই হয়নি।
সেটা ছিল এক রথের মেলা। গ্রামেরই মেলা প্রতি বছরই হয়। নতুন কিছু নয়। আর অলোকেশরা বন্ধু-বান্ধবরা মিলে মেলায় গিয়ে হৈ হৈ, নাগরদোলা, পাঁপড়ভাজা, ঘুগনি এসবই করে। স্কুলের ছুটিও থাকে। কিন্তু এবারের এই রথের মেলাটা একটু অন্য রকম হয়ে উঠেছিল। অলোকেশরা যখন নাগরদোলায় উঠছিল, তখনই সেখানে অনুরাধাও নাগরদোলায় উঠতে এসেছিল দাদার সাথে। উঠেওছিল ওদের পরের দোলনাটায়। ঘোরা শুরু হতে একবার ওপর একবার নীচে হতে হতে দু-দলেরই চেঁচামেচিতে অলোকেশও তাল মেলাচ্ছিল। ঘোরা থামতে নামার সময়, তখনও ঘোর ছিল কিনা কে জানে, অনু হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল। যদিও ওর পাশে ওর দাদাও ছিল, তবু ঠিক রিফ্লেক্সের মত অলোকেশ, পাশ থেকে, কিছু ভেবে কিছু করার আগেই, ওকে তুলে ফেলল। তাই বিশেষ কিছু চোট লাগার সময় পেল না। মেয়েটি একটু লজ্জিত হয়ে তাকিয়েই মাথাটা নিচু করল। ওর দাদা কৃতজ্ঞ হয়ে বলল, তুমি ঠিক সময়ে ধরে ফেলেছিলে তাই লাগেনি খুব। না হলে আমার কপালে আজ দুর্গতি ছিল।
-কেন?
-বোনের কিছু হলে বাবা আমাকে আস্ত রাখত না। আজ বাবা সঙ্গে আসেনি। অনেক করে বলে দিয়েছে বোনকে আগলে রাখতে। আর যদি ওর গায়ে কাটা-ছেঁড়া দেখত, আমার এর পর আর উলটোরথে আসা বন্ধ হয়ে যেত। যাক, তুমি খুব বাঁচিয়ে দিয়েছ।
-না না । এমন কোন ব্যাপার নয়।
অনু লজ্জিত মুখে তীব্র কটাক্ষের তীর ছুঁড়ে মাথা নিচু করল।
ঘটনাটা এইটুকুই। কিছুই না, খুবই সাধারণ ঘটনা। কিন্তু আমরা কি জানি কোন তুচ্ছ ঘটনা কত বড় বড় ঘটনার জন্ম দেয়। ঈশ্বরের হাতে লেখনী। কোন সূক্ষ্ম ঘটনার শিকড়ে কোন বৃহৎ ঘটনার বৃক্ষ তিনি গেঁথে রেখেছেন সে তিনি আর ভবিষ্যত ছাড়া কেউ জানে না।
এর পর নানা ছলে, নানা তৈরি করা দরকারে এ বাড়িতে যাতায়াত একটু বেড়েই গিয়েছিল। ব্যাপারটা বাড়ির বড়দের চোখে পড়তে দেরি হয়নি।
কিন্তু এ নিয়ে একদম সোরগোল না করে, এমনকি অলোকেশকেও কিছু বুঝতে না দিয়ে, ওর বাবা ওর ভবিষ্যত উজ্জ্বল চকচকে করার জন্য, পাঠিয়ে দিয়েছিলেন অনেক দূরে কোলকাতার নামী স্কুলে। থাকতে হত একটা হস্টেলে। এখানে নতুন পরিবেশে মানিয়ে নিতে যথেষ্ট কষ্ট হলেও কাউকে কিছু বলতে পারেনি। মনের মধ্যে চিনচিনে একটা ব্যথা ঘুরপাক খেতে খেতে একেবারে পাকাপাকি ক্ষতের সৃষ্টি করে তুলেছিল। তবু এ কথা কাউকে বলা যায় না, যায়নি। যদিও অনুর সাথে তেমন করে, যাকে প্রেম বলে তেমন কিছুই গড়ে ওঠেনি বা এ’ধরনের কোন কথাও কেউ কাউকে বলেনি, তবু তখন দুজনে কাছাকাছি হলে সান্নিধ্যই একটা অন্য ধরণের বিদ্যুৎ শিহরণের কাজ করত, একটা তীব্র আকর্ষণের সৃষ্টি করত, সেটা যে কী, তা কেউ তখনও বুঝে উঠতে পারেনি।
এরপর মাঝে মাঝে কখনও গ্রামের বাড়িতে ছুটিছাটায় গেলেও সেই আগেকার মত দেখা সাক্ষাত হত না দুজনের। তারপর তো গঙ্গা দিয়ে অনেক জল গড়িয়ে গেল। অনু একটু বড় হতেই চলে গেল কলেজে।আর তারপর কোথায় হারিয়ে গেল কে জানে । অলোকেশ স্কুল ছেড়ে গেল বাংলার বাইরে নামী একটা কলেজে পড়তে। দুটো জীবন চলে গেল ভিন্ন ভিন্ন আবর্তে ভিন্ন বৃত্তে। কেউ আর কারোর খোঁজ পায়ওনি, রাখার প্রয়োজনও মনে করেনি। কিন্তু বাল্যের এই ব্যাপারটা অলোকেশ কখনো ভোলেনি।
অলোকেশ ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে মাস্টার্স করতে গেল বাংলার বাইরেই। তার পর যোগ্য চাকরি পেতেও অসুবিধা হয়নি। যোগ্যতাও ছিল অলোকেশের যথেষ্ট। কাজেই চাকরি ক্ষেত্রে সুনাম অর্জন করতেও অসুবিধা হয়নি। ফল যা হবার তাই। ধীরে ধীরে যোগ্যতা অনুসারে এগোচ্ছিল ধাপে ধাপে। একটা দুটো ধাপ এগোতেই নতুন এক ধাপে এগিয়ে পড়ল। গাঁটছড়া বাঁধা পড়ল মায়ের পছন্দ করা তনিমার সঙ্গে। তনিমাকে পেয়ে জীবনটা আর এক নতুন খাতে বইতে লাগল।
দিন ঠিক বয়ে যাচ্ছে নিস্তরঙ্গ – সূর্য উঠছে নামছে নিজের নিয়মে। পৃথিবীতে কত ঘটনা নিত্য ঘটে যাচ্ছে কে তার খেয়াল রাখে। কত বড় বড় ঘটনা দুর্ঘটনা বন্যা মহামারী নিত্য ঘটে যাচ্ছে তা-ই কেউ বেশি দিন মনে রাখে না। আর কোথায় অলোকেশের কৈশোরে কী একটা ছোট্ট জলবুদবুদের মত ঘটনা কিংবা তা-ও নয় সে কে কোথায় মনে রেখেছে। কিন্তু পাথর চাপা ঘাস বেশি দিন থাকলে সাদা হয়ে যায় ঠিকই, হয়ত তার বৃদ্ধিও কমে যায়, কিন্তু আবার পাথরটা সরে গেলেই নতুন আলো জল পেলে আবার সে নতুন উদ্যমে সবুজ হয়ে তরতর করে বেড়ে ওঠে।
যতবার তনিমাকে তনু বলে ডাকে ততবার মনে হয় তনুর আড়ালে ও অনুকেই ডাকছে।
বেশ চাপা পড়েছিল ছবিটা মনের নিচে, আবার যেন আজকাল একটু সজীব হয়ে উঠছে। কে জানে আজ সে কোথায়, কত বড় হয়েছে। এতদিনে হয়ত সেও নিশ্চয় বিয়ে করে অন্য কারোর ঘরে তার সংসার আঁকড়ে গৃহিণী হয়ে বসেছে। অলোকেশই ভাবছে, কারণ সেই ছবি সে আজও ভুলতে পারেনি তাই, তাই বলে কি অনুরও আজ ওকে মনে আছে? সেটা সম্ভবই নয়। আর ঘটনাটা অলোকেশের মনে একটা দাগ কেটেছিল বলে অনুর মনেও যে একই ভাবে দাগ কাটবে, এর তো কোন মানে নেই।
যাই হোক তনু এসব কিছু জানে না – জানার উপায়ও নেই। তবে অলোকেশের মাঝে মাঝে নিজেকে অপরাধী লাগে। মনে হয় ও অজান্তে তনুর সরলতাকে ঠকাচ্ছে না তো। ও আরও বেশি করে তনুর ঘনিষ্ঠ হবার চেষ্টা করে। নিজের মনের সাথে লড়াই করে তনুর বিশ্বস্ততা অর্জনের চেষ্টা করে।
দিন যায় । ক্রমে নতুন স্বামী থেকে দায়িত্বশীল বাবায় রূপান্তরিত হয় অলোকেশ। এক ছেলে আর এক মেয়ের সুখী বাবা। অফিসের বাংলো ধরণের বাড়ির সামনে গ্যারেজে দামী গাড়ি নিয়ে অলোকেশ এখন মিষ্টার অলোকেশ চৌধুরী। আকাশপথে যখন তখন তার বিচরণ – কখনো ফ্রান্স, কখনও জার্মানী আবার কখনও বা নিছকই ছেলে মেয়ে বৌ নিয়ে ছুটি কাটাতে নিউইয়র্ক।
স্মৃতির ছবির ওপর আরও এক পরত ঘটনার প্রলেপ পড়েছে এতদিনে। চট করে আর নিত্যদিনের মত পুরানো ছবিটা মনের চিকের আড়াল সরিয়ে উঁকি মেরে যায় না। কালেভদ্রে কখনও বা ক্ষণিকের দেখা দেয়। কিন্তু সমুদ্রের উত্তাল ঢেউ আর ওঠে না।
চারপাশে একটা পুরানো বাড়িও নেই যার পরিবর্তন হয়নি। কেউ দোতলা বা তিনতলা হয়েছে। কেউ মাটির বাড়ি থেকে গ্যারেজওয়ালা বাংলো হয়েছে। সব-ই নতুন প্রজন্মের হাতে পড়ে হয়েছে। আজ আর পুরানো দিনের কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে কি না কে জানে, যে অলোকেশকে দেখে চিনতে পারবে। তাই সে চেষ্টাও ও আর করেনি। নিজের মতই আপনমনে ঘুরে বেড়াচ্ছিল পার্কে আর পুরানো দিনের স্মৃতি রোমন্থন করছিল নিজের মনেই।
এখন পার্কের পাশ দিয়ে সাঁ সাঁ করে ছেলেরা বাইক নিয়ে চলেছে। যেটা ছিল কাদা মাখা পায়ে চলা পথ, সেটা এখন অটো বা মোটর রিক্সার দাপটে ব্যতিব্যস্ত।
অলোকেশ রিটায়ারের পর ব্যাংগালোরেই বাড়ি কিনে থিতু হল একটু। চাকরি জীবনের শেষ দিকটা ওখানেই ছিল কিছুদিন। জায়গাটা ভালও লেগে গেল। আজকাল অনেক বাঙালিই এখানে স্থায়ী ঘর-বসত করে ফেলেছে। ওর এক বন্ধু মজা করে বলে, আসলে এটা আদত বাঙালিরই জায়গা। দেখছিস না জায়গার নামটা কী, বাংগালুরু, মানে কী বুঝলি, বাঙালিদেরই জায়গা। যুক্তি শুনে হেসে ওঠে সবাই। তবে হ্যাঁ, এত বাঙালি এখানে থাকে যে এক এক সময় এটাকে বাংলারই কোন শহর বলে ভুল হয়। তা ছাড়া এখানকার আবহাওয়াটাও বেশ সুন্দর। তনিমারও খুব পছন্দ হয়েছিল জায়গাটা। তাই ও আর দেরী না করে এখানেই ফ্ল্যাট কিনে ফেলল।ছেলে মেয়েদের বন্ধুুরাও এখানেই থাকে। সবাই খুশি হল। কিন্তু যে তনিমার বিশেষ আগ্রহে এখানে ফ্ল্যাট কেনা সে-ই বেশি দিন বাড়ি ভোগ করতে পারল না। তনু বলত, আমি বাবা তোমার রিটায়ারের পর তোমার ওই গ্রামের বাড়িতে যেতে পারব না। অলোকেশের এক একসময় মনে হত সারাজীবন তো বাইরে বাইরেই কাটল।রিটায়ারের পর যদি গ্রামের বাড়িতে ফিরে একট গ্রামের মুক্ত পরিবেশে টাটকা অক্সিজেন নিয়ে শরীরটাকে চাঙ্গা করা যায়। তনু ঝাঁঝিয়ে উঠত, তুমি থেকো তোমার ওই ধ্যাদ্ধেরে গ্রামে। আমি আমার ছেলে মেয়েদের কাছে থাকব।
কোথায় আর থাকল সে! ছেলে মেয়ের বিয়ের পরে, ছেলের ঘরে নাতির মুখ দেখার পর আর বেশিদিন সুখ ভোগ করতে হয়নি। একমাথা সিঁদুর নিয়ে ভরা সংসার ফেলে রেখে সে চলে গেল অন্য জগতের সন্ধানে।
বড় একলা হয়ে পড়ল অলোকেশ। ছেলের বৌ অযত্ন করে না। কিন্তু কোথায় যেন মনটা শূন্যতায় ভরে থাকে। নাতির সঙ্গে দিনের কিছুটা সময় অবশ্যই কাটে।কিন্তু তারপর আবার মনটা উদাস হয়ে যায়। কেমন যেন বারমুখো হয়ে পড়ে মনটা। বৌমা কিছুদিন লক্ষ্য করার পর বলল, বাবা কোথাও ঘুরে আসুন ক’দিন। অলোকেশও ভাবল, ঠিক কথা। কোথাও যাই। মনটার একটু পরিবর্তন হবে। ভাবতে ভাবতে মনে হল, গ্রামের বাড়িতে বহুদিন যাই না, যাই একবার ঘুরে আসি। জ্যাঠতুতো ভাইরা সব আছে ওখানে। অনেকবারই যাবার জন্য বলে, যাওয়া হয়নি। বিশেষ করে তনুর গ্রামে যাবার ব্যাপারে প্রচণ্ড অনীহা থাকায় আরও যাওয়া হয়ে ওঠেনি।
তাই এই আসা।
এই সব সাত-পাঁচ, অতীত বর্তমান সব ভাবতে ভাবতে পার্কের এ’মাথা থেকে ও’মাথা পর্যন্ত পায়চারি করছে অলোকেশ। হঠাতই বিদ্যুৎ চমকের মত মনে ঝলকে উঠল সেই মুখ, আর সংগে সংগে চোখ গেল সেই বাড়ির দরজায় যেখানে প্রথম গোলে বল মারতে গিয়ে আটকে গিয়েছিল চোখ। সেই বাড়ি আর সেই বাড়ি নেই, সেটা এখন একটা চারতলা ফ্ল্যাট। আগের বাড়ির সাথে কোন মিলই নেই, থাকা আশাও করেনি অলোকেশ। সে বাড়ির লোকেরাও কে কোথায় আছে জানা নেই। কলকাতা চলে যাবার পর আর যোগাযোগ তো রাখা সম্ভব ছিল না। এখনকার মত দিন ছিল না তখন, যে যেখানেই থাক, মোবাইল হাতে থাকলে মুহূর্তের মধ্যে তাকে কাছে পেতে বা খুঁজে বার করতে কোন অসুবিধা নেই। মনটা আবার উদাস হয়ে যায় তার। পার্কের একধারে একটা কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে ছায়ায় বেঞ্চিতে বসে পড়ে ও। আবার কোথায় ডুবে গিয়েছিল সেইসব দিনের ছোটখাট ঘটনার মধ্যে।
হঠাৎ চমকে উঠল।
-অলোকেশদা না ?
পাশ থেকে মনে হল কে যেন ডাকল। কিন্তু আপাততঃ এই নামে এখানে ডাকার মত কেউ আছে বলে জানা নেই। অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে অন্যমনস্ক ছিল ও।
ব্যাপারটা কী জানার জন্য মুখ ফিরিয়ে ঘাড় ঘোরাল অলোকেশ। সামনে এক ভদ্রমহিলা সাদা শাড়ি পরে, বেশ রুচিসম্পন্ন পোশাকে এবং গাম্ভীর্য নিয়ে দাঁড়িয়ে।ঘাবড়ে গিয়ে বেশ একটা ঘোর লাগা চোখে হাঁ করে ভদ্রমহিলার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল সে।
মুচকি হেসে ভদ্রমহিলা বললেন, আপনি অলোকেশ চৌধুরী তো?
-হ্যাঁ , কিন্তু আপনি?
– চিনতে পারনি তো? চেনার কথাও নয়। প্রায় পঞ্চাশ বছর পরে দেখা। আমি অনু।
চমকে উঠে অলোকেশ বড় বড় চোখ করে দেখতে লাগল, তখন, “–একি স্বপ্ন, একি মায়া–” অবস্থা।
তাই তো! সেই মুখ, গালে কালো তিলটি পর্যন্ত রয়েছে। কিন্তু স্বপ্নের মত যেন ঘটনা। স্বপ্ন কায়াবাস্তবে রূপ নেওয়ার কথা গল্পে শোনা যায়। কিন্তু সত্যি সত্যি এটা ঘটলে একটু ধন্দ লাগে বৈকি। মন বিশ্বাস করতে চায় না এমনটা সত্যি হতে পারে।
থতমত খেয়ে আমতা আমতা করে বলল, ‘হ্যাঁ, কিন্তু আপনি, মানে তুমি এখানে এখন কোথা থেকে?’
-আমি তো এখন এখানেই থাকি।
-এখানেই থাক, মানে? তোমার-
-হ্যাঁ, বিয়ের পর শ্বশুরবাড়িতে ছিলাম। ছেলে মেয়ে কেউ নেই। ওই, ভগবান দেননি আর কী। তারপর উনি চলে গেলে খুব একলা হয়ে পড়লাম। দাদা বাইরে চলে গেছে। ওরাই বলল, বাড়িটা খালি পড়ে আছে, এসে থাক। আমারও তো পিছু টান নেই কিছু। চলে এলাম। আর কী! হাতে পায়ে ব্যথা ধরছে এখন, তাই ডাক্তারের কথায় এই সময়টা একটু রোজ হাঁটি। কিন্তু তুমি?
অলোকেশ মন্ত্রমুগ্ধের মত সবটা শুনছিল। শুনছিল, নাকি ঘোর লাগা চোখে অতীত আর বর্তমানের মধ্যে এক দোলাচলে যাতায়াত করছিল। ওর কতটা কানে গেল সে নিয়ে নিজেরই সন্দেহ আছে। ও হাঁ করে অনুর মুখের দিকে তাকিয়ে সেই ফ্রক পরা ছোট্ট মেয়েটিকে খুঁজছিল। নিজেও ফিরে গিয়েছিল সেই হাফপ্যান্ট পরা বয়সে।
কথার উত্তর না দিয়ে, ও হঠাৎ যেন সম্বিত ফিরে পেল এমন ভাবে বলে উঠল, ‘অ্যাঁ , -হ্যাঁ।’
অনু ধপ করে বেঞ্চিতে পাশে বসে পড়ে বলল,
-কী ভাবছ?
– না তোমাকে দেখছি।
-সামনেই ত রয়েছি। এত কী দেখছ?
-জান অনু, একটা কথা বলব কি না ভাবছি।
-এই বয়সে এসে এখনও ভাবছ?
-জান, সারাটা জীবন তোমার ছোটবেলার ছবিটা বুকের মধ্যে সন্তর্পনে বয়ে নিয়ে বেড়িয়েছি, কখনো দেখা হবে ভাবিনি।
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে অনু মাথাটা একটু নীচু করে নীচু স্বরে আস্তে আস্তে বলল, ‘আমিও তাই।’
প্রচণ্ড বিস্ময় নিয়ে কোন সুদূরের দিকে একবার তাকিয়েই অনুর মুখে চোখটা আটকে গেল অলোকেশের।
অনুরও তাই!
দুজনের মুখে এবং বুকে তখন মন্দ্রিত স্বরে বেজে চলেছে,
“আমাদের গেছে যে দিন
একেবারেই কি গেছে
কিছুই কি নেই বাকি?
একটুকু রইলেম চুপ করে
তারপরে বললেম,
‘রাতের সব তারাই আছে
দিনের আলোর গভীরে’”
লেখক পরিচিতি : মলয় সরকার
অবসরপ্রাপ্ত ব্যাঙ্ক আধিকারিক, বহুদিন লেখালিখি, সোনালী ঘোষাল স্মৃতি অনুবাদ পুরস্কার, দেশে বিদেশে নানা পত্র পত্রিকায় নিয়মিত লেখা প্রকাশ