সিক্রেট

লেখক : অরিত্র চ্যাটার্জি

জুন মাসের এক বিকেলবেলায় পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নামতে গিয়ে আচমকা বাঁ পা-টা পিছলে গেল অনীকের। এক্ষেত্রে বেশ বড়সড় একটা ক্ষতি হতে পারত। ঢালের একপাশে খাদও ছিল বেশ গভীর মতন, তবু শেষ মুহূর্তে হাত দিয়ে কোনরকমে একটা পাথর জাপটে ধরায়, সাথের ব্যাগটা তালগোল পাকিয়ে গিয়ে খাদের থেকে ফুট খানেক দূরত্বে সে আটকে গেল। খানিক পরে অনেক লোকজনের আওয়াজ, কৌতুহলী উঁকিঝুঁকির ভিতর দুজন সহৃদয় ব্যক্তি যখন তাকে টেনে দাঁড় করাল, অনীক টের পেল ডান হাতে আর কোনও সাড় নেই তার। এছাড়া এদিক সেদিক খুচরো কাটাছেঁড়ার দাগ, সেসব থেকে সামান্য রক্তের আভা, এসব ছিলই। সেদিকে অবশ্য তখন তার খেয়াল ছিল না।

কথায় আছে বেশ বড়সড় শক পেলে প্রথমটায় মানুষ কেমন চুপ করে যায়। অনীককে দেখে সে শক পেয়েছে কিনা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল না, কারণ অনেকের প্রশ্নের উত্তরে সে প্রায় কিছুই উচ্চারণ করেনি। তবে বেশ কয়েকজনের সাহায্যে অবশেষে উপরে উঠে তাকে যখন একটা জায়গায় বসানো হল, তার একমাত্র সচল হাতটা দিয়ে বাঁ পায়ের জুতোটা সে সবার আগে খুলে ফেলল। কেউ কেউ ভেবেছিল, হাতের মতই তার পায়েও হয়ত কিছু হয়েছে, কিন্তু তাদের দিকে ভ্রূক্ষেপ না করে, খুব মনোযোগ দিয়ে জুতোর তলাটা অনেকক্ষণ ধরে দেখল অনীক। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

জুতোর সোলটা ক্ষয়ে যায়নি, ঠিকই আছে। বরং ভুলটা তার, পা ফেলার সময় টাল সামলাতে পারেনি সে। হিসেব ভুল হয়ে গেছে তার। বাকিদের এইবার ধন্যবাদ দিয়ে সে উঠে পড়ার উপক্রম করছিল নিজে নিজেই, তবু একরকম জোর করে, এই পাহাড়ি উপত্যকার একটা ছোট হেলথ সেন্টার অবধি লোকগুলো পৌঁছে দিল তাকে। সে তাদের ধন্যবাদ জানাল আবারও। এবং সত্যি বলতে, মন থেকেই। ছোট হেলথ সেন্টার, রোগীরও তেমন ভিড় নেই, কাজেই খুব বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না তাকে। ঘন্টাখানেক বিভিন্ন পরীক্ষা করার পর ডাক্তারবাবু যা বললেন তার সারমর্ম খানিক এই, অনীকের কপাল ভাল, হাত পা ভাঙেনি। খুব সম্ভবত হাতের পেশিগুলোতে জোর টান পড়েছে, অল্প ছিঁড়েও যেতে পারে কিন্তু তা এখানে পরীক্ষা করা সম্ভব নয়। এমনি কাটাছেঁড়া যা আছে সেরে যাবে। হাতের ব্যথার কিছু ওষুধ তিনি লিখে দিলেন। বললেন সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যে না সারলে যেন শহরে ভাল ডাক্তার দেখিয়ে পারলে একবার এম.আর.আই. করিয়ে নেয়। এবং বিশ্রাম। অন্তত কয়েক সপ্তাহ।

ব্যাঙ্গালোর ফিরে গিয়ে অফিসে যখন অনীক সপ্তাহ তিনেকের ছুটি চাইল, তার ম্যানেজার বিশেষ আপত্তি করলেন না। অনীককে সম্ভবত ভদ্রলোক খানিক পছন্দ করেন, অফিসে কাজের ছেলে বলে খানিক নামও আছে তার। কাজেই তার অবস্থা দেখে, ছুটির দরখাস্তে সই করতে করতে তিনি বললেন, আর ক’দিন বেশি লাগলেও অসুবিধা নেই। দরকার হলে তুমি বরং ওয়ার্ক ফ্রম হোম ক’রো। একটা সৌজন্যমূলক হাসি হেসে সে বাড়ি ফিরে এলে।

হাতটা পুরোপুরি ঠিক হতে দিন দশেক লাগল তার। একেবারে সোজা মাথার ওপর তুলতে গেলে, কিংবা ভারী ব্যাগ বইতে হলে এখনও একটা ব্যথা হয় বটে, কিন্তু এ বাদে আর সামনে থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই। কাটাছেঁড়ার দাগও মোটামুটি শুকিয়ে এসেছে ইতোমধ্যে। আয়নায় নিজের মুখ, গা, হাত পা অনেকক্ষণ ধরে দেখছিল সে। নিজের ব্যাপারে অনেক কিছু সে আবিষ্কার করেছে এই কদিনে। তার বাঁ হাঁটুতে সব মিলিয়ে চারটে তিল, দাঁতের নিচের পাটির মাড়িতে আঙুল দিয়ে জোরে চাপ দিলে, একটা দুটো দাঁতের গোড়ায় সামান্য রক্ত দেখা যায়, এইসব। মুখ ধুয়ে ফেলে সে নিজেকে বলল, আই নিড টু লিভ ইন দ্য প্রেজেন্ট; ইন দিস ভেরি মোমেন্ট।

ঘটনাটার কথা অফিসের বস ছাড়া আর কাউকে জানায়নি সে। বন্ধুদের, বাড়িতে কিংবা রাহিকেও নয়। তবু তার শরীরের অবস্থা স্বাভাবিক হতেই বাড়িতে ফোন করে জানাল সে বাড়ি আসছে , থাকবে সপ্তাহখানেক। জানাল রাহিকেও, যাতে দেখা হয় তাদের। বাড়ি ফিরে তার হাঁটাচলা নিয়ে মা বাবার কাছ থেকে কোন প্রশ্ন না পেয়ে অনেকটা নিশ্চিন্ত হল অনীক। তারা কিছু বুঝতে পারেনি। রাহি অবশ্য অনেক বুদ্ধিমান, এসব ব্যাপারে সে চট করে একটা কিছু আঁচ করে ফেলে , তবু একটা চান্স নিয়ে অন্তত দেখা যেতে পারে, এমনটা ঠিক করল সে। এতদিন ধরে তো সে তৈরি করেছে নিজেকে তা ভেবেই।

কথাটা শুনে বেশ অবাক হল রাহি। তার মুখ চোখ বলছিল, এমন হঠাৎ করে সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব সে আশা করেনি। মনে আছে, একটা সময় সে নিজেই এ’কথা  বলেছিল, তারপর অনীকের দ্বিধা দেখে সরে আসে। তারপর কেটে গেছে বেশ কিছুটা সময়, এ নিয়ে আর কথা হয়নি তাদের। তারপর আজ হঠাৎ… হলটা কী? জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে সে খানিক দেখল অনীকের দৃষ্টিতে যে বিদ্যমান শূন্যতা, তা তার উপস্থিতিতে আদৌ পূরণ হবে কিনা। তারপর সময় চাইল খানিক। মাসকয়েক।

মোটামুটি নির্ঝঞ্ঝাট ভাবেই মিটে গেল ব্যাপারটা। বাড়িতে কথা তুলতে দু’পক্ষেই সেরকম আপত্তি তো করলেনই না, বরং খানিক নিশ্চিন্ত হয়েছেন বলেই মনে হল। কথাবার্তা পাকাপাকির দিকে এগিয়ে গেল দ্রুত, দিনক্ষণও পাওয়া গেল একটা মনোমত, মাস ছয়েকের মধ্যে। এমনকি অনীকের বুড়ো খুনখুনে ঠাকুমা, যাকে নিয়ে সবাই ভেবেছিল রাহি বয়সে মাস ছয়েকের বড় হওয়ায় জন্য বাদ সাধবেন, তিনি অবধি জীবদ্দশায় নাতির বিয়ে দেখে যেতে পারবেন, এই আশায় দিব্যি রাজি হয়ে গেলেন। এমনকি সব কিছু ঠিক হওয়ার পর অনীক যখন প্রস্তাব দিল বিয়ের আগে তারা দুজন একটু ঘুরে আসবে নিজের মতন, তখনও খুব একটা সমস্যা হল না। সে কি অবাক হয়েছিল এসবে? কে জানে!

পাঁচতলা হোটেলের ব্যালকনিতে কফি হাতে দাঁড়িয়েছিল রাহি। এখান থেকে সমুদ্র দেখা যায় বেশ, ভোরের অস্ফুট আলোয় দেখা যায় মাছ ধরার ট্রলারগুলো মাঝ সমুদ্রের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে একে একে। দৃশ্যটা অনীকের সঙ্গে ভাগ করে নেবে বলে তাকে একবার ডাকল সে। ব্যালকনির রেলিং-এর উপর ভর দিয়ে অনীক যখন ট্রলারগুলোর চলে যাওয়া দেখছে, রাহি খেয়াল করল তার বাঁ পা-টা সামান্য কাঁপছে। কী হয়েছে পায়ে? সে জানতে চাওয়ায় হঠাৎ বেশ অপ্রস্তুত হয়ে অনীক বলল, কই কিছু না তো। ওরকম হয় মাঝে মাঝে আলসে ধারে গেলে। মাত্র হাত কয়েকের দূরত্ব তাদের মধ্যে, তবু এক একটা সময়ে অনীককে বড় দূরের মনে হয় রাহির। কেমন যেন ঝাপসা, কুয়াশায় ঢাকা পড়ে যায় সে মাঝে মাঝে। কাছে থেকেও দূরে। অন্য সময় তার মাঝে মাঝে রাগ হয়, আজ হঠাৎ মানুষটার কথা ভেবে খানিক মায়াই হল তার। সে জানে ছোটবেলার পর থেকেই জীবনের অনেকটা সময় অনীকের বাইরে বাইরে কেটেছে। তার পুরোটা রাহিকে না বললেও, সবসময় যে খুব সুখকর ছিল না তা সে আন্দাজ করতে পারে।

সেদিন সন্ধ্যাবেলায় ঘোরাঘুরির পর, ঘরে ফিরে খানিক ঘনিষ্ঠ হয়ে রাহি মজার ছলেই জিজ্ঞেস করল, সেই পাহাড়ে ঘুরতে গিয়ে কী হল বলো তো তোমার? তারপর পুরো চেঞ্জ! বলি সিক্রেটটা কী?  কোনো সাধু টাধুর দেখা পেয়েছিলে নাকি ! … সাধু ? অনীক হাসে। হ্যাঁ, সাধু নয়, একেবারে রীতিমতো কাপালিক, সেই তো বাতলে দিলে সব..  তাই দেরি করলাম না আর…বলতে বলতে সে রাহিকে কাছে টেনে নেয়, আশ্রয় খোঁজে তার ভেতর। বাধা দেয় না রাহি। যেন কেউ শুনতে না পায়, সেভাবে তার মাথার ভেতর থেকে খুব সন্তর্পণে, ফিসফিস করে এমন সময় কেউ বলে ওঠে, আসলে আমি যে মারা যাচ্ছি ধীরে ধীরে, তা আমি এখন জানি।


লেখক পরিচিতি : অরিত্র চ্যাটার্জি
জন্ম ১৯৯৪ সালে। বড় হয়ে ওঠা উত্তর কলকাতার উপকণ্ঠে। পেশায় যন্ত্রবিদ, আগ্রহী জীববিজ্ঞানে, বর্তমানে বিড়লা ইন্সটিটিউট অফ সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি (BITS, Pilani)-র, হায়দ্রাবাদ ক্যাম্পাসে সহকারী অধ্যাপক। ভালবাসেন বেড়াল, পুরোনো চিঠি ও নস্টালজিয়া সংক্রান্ত যা কিছু, জীবনকে সিনেমার ফ্রেমে দেখতে এবং অবসরে তার নিজস্ব ম্যাজিক খুঁজে বেড়াতে। এযাবৎ প্রকাশিত দু'টিকবিতার বই, “সার্কিস পারজানিয়ার ডায়েরি" (২০২১), “আমাদের আশ্চর্য ভাষা (২০২৩)”।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।