লেখক : পিউ দত্ত
শীতের সময় শহর জুড়ে এক খুশির আমেজ ছড়িয়ে রয়েছে। প্রকৃতিতে এক অপূর্ব মাধুরী মিশে রয়েছে। গ্রাম থেকে শহরের প্রতিটি আনাচে কানাচে তার উপস্থিতি প্রত্যক্ষভাবে লক্ষ করা যায়। এমনি একটি সময়কে কেন্দ্র করে গল্পের প্রেক্ষাপট গড়ে উঠেছে। তবে ঘটনাটি খুব বেশি দিনের পুরানো নয়, বলা যায় সাম্প্রতিক কালের। যে শহরকে কেন্দ্র করে গল্প গড়ে উঠেছে, সেই শহরের নাম না জানলেও পাঠকের তেমন কোন ক্ষতি হবে না। তবে পাঠককে বঞ্চিত করব না তাই শহরটির একটি কাল্পনিক নাম দিলাম রতনপুর। গ্রামগুলির প্রধান শহর বলতে রতনপুর খুবই পরিচিত। আশপাশের কিংবা দূর দূরান্ত গ্রামের লোকের সমাগম এই শহরে প্রতিনিয়ত লেগেই আছে।কেউ পুত্র কন্যা নিয়ে শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে ছুটে এসেছে, কেউবা চিকিৎসা ব্যবস্থা তাগিদে এই শহরে এসেছে, কেউবা আইন আদালতে মামলার তাগিদে , কেউবা আবার দু-মুঠো পেটের ভাতের জোগারে জন্য কোন কাক ভরে ওঠে এই শহরে এসেছে। ভিন্ন মানুষ ভিন্ন কারণে এসেছে তার শহর রতনপুরে। তেমনই একটি আশা নিয়ে আমিও রতনপুর শহরে এসেছি, আসল কথাটা খুলেই বলি আমার এক নেশা আছে সেই নেশার খোরাক জোগাতে। গল্প একটু অগ্রসর হতেই আশা করা যায় পাঠক নিজে থেকেই বুঝে যাবেন অনায়াসে নেশাটা কি।
কোনো এক শীতের দিনে মেঘলা কুয়াশায় ঢাকা সূর্যের আঁকিবুকি আড়ালে রতনপুরে এসে পৌঁছালাম। রাস্তার ফুটপাত দিয়ে হেঁটে চললাম। চারিদিকে জনতার কোলাহল, হাজারো মানুষের ব্যস্ততায় পরিপূর্ণ।
শহরের দু’ধারে কত সহস্র দোকান। দোকানে নানা রকমের জিনিস দু-চোখ ধাঁধানো নেশা জাগানো এক মায়াবী পরিবেশ, গাড়িগুলো অনবরত নিজের গন্তব্যের উদ্দেশ্যে ছুটে চলেছে। একে অন্যকে পেছনে ফেলে।
শহরের এক মস্ত অংশজুড়ে বসেছে মেলা। খোলা আকাশের নিচে সবুজ ঘেরা মাঠে রয়েছে কতগুলো তিরপলের ছাউনি করা ছোট ছোট ঘর। ঘরগুলো মানুষের বসত কর না হলেও বইয়ের বসত করা অনায়াসেই বলা যায়।
সেখানে দেখা মিলল নানা বেদ, পুরাণ, উপনিষদ, নানা গল্পে নানা ছলে কৌশলে ছবি রঙের তুলিতে, রান্নার, আলপনার বহু কাব্য উপন্যাস নাটকে সমাহারের। রবীন্দ্রনাথ-বঙ্কিম-রামমোহন-বিদ্যাসাগর-মাইকেল মধুসূদন দত্ত মতো আরো কত উজ্জ্বল নক্ষত্রেরা তাদের সাফল্য মন্ডিত সাহিত্যফলে দোকানগুলি সজ্জিত রয়েছে। আকর্ষিত করেছে দর্শকের আরো সহজ করে বলা পাঠকের দৃষ্টি।
আমার এই বর্ণনাতে পাঠক অনায়াসেই বুঝতে পারে কিসের কথা বলে চলেছি। নিজের প্রাণের সাথে প্রাণ মিলিয়ে কিছু অমূল্য সৃষ্টিকে নিয়ে এলাম আমার সঙ্গে করে। মনের রসনাতৃপ্তির পর বাড়ি ফেরার জন্য বাস ধরার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছি। হঠাৎ পিছন থেকে এক ডাক শোনা গেল- দিদিমনি শুনছেন….।
পিছন ফিরে দেখি। সাইকেলের তিন চাকা ওয়ালা একটি ছাউনি গাড়ি। গাড়ি ঠিক বলব না রিক্সা বলাই শ্রেয়। সেই রিক্সার উপর ক্লান্ত, শান্ত, উজ্জ্বলহীন এক মানুষ বসে আছে। বয়স তার আন্দাজ করা বড়ই কঠিন। তবে তাকে দেখে অনায়াসেই যে কেউ বুঝে নেবে সে জীবনের ভারে সে ক্লান্ত। আমি সেই রিক্সা চালককে বললাম বলুন দাদা কিছু কি বলছেন?
পরক্ষণেই তিনি আমার কথায় বলে বসলেন স্টেশন যাবেন আমি পৌঁছে দেবো। আপনার সময়ের মধ্যেই একটুও দেরি হবে না। আমি অবাক হয়ে বললাম আমি তো আপনাকে বলিনি। উনি বললেন চলুন, না হয় দশ টাকাই দেবেন। আর কিছু না ভেবে উঠে বসলাম রিক্সায়। তখনই তার মুখে ফুটে উঠল এক উজ্জ্বল হাসি। প্রাণপণে রিক্সা ছুটে চলেছে। কিছুটা সময় আসার পর আমি কথা শুরু করলাম জিজ্ঞাসা করলাম আচ্ছা আপনার বাড়িতে কে কে আছে?
উনি নির্দ্বিধায় বললেন কেউ নেই। আমি আবারও বললাম আপনার বাড়িতে বাবা-মা কেউ নেই উনি বললেন না কেউ নেই, আমি একা। তখন আবার বললাম বিয়ে করেনি, বউ- ছেলে-মেয়ে কেউ নেই। উনি আবারও বললেন না কেউ নেই।
আমি আবার প্রশ্ন করলাম কেন?
তিনি বললেন নিজেরই ভালো দু-বেলা খাবার জোটানো দায় সেখানে কোন সাহসে ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখবো বলুন?
তার প্রতিটা কথার মধ্যে একটা কোথাও যেন হতাশার স্বাদ রয়েছে। এই জীবন নামক যুদ্ধে লড়াই করতে করতে আজ সে ক্লান্ত। সংসার না বাধার আক্ষেপ। এই রিক্সা চালিয়ে এখন আর সংসার চলে না দিদি।
একটা সময় ছিল জানেন তখন এই রিক্সা গাড়ির কত চাহিদা , তখন কত টাকা উপার্জন করেছি দু-মুঠো দু-বেলা পেট ভরে খেতে পেয়েছি। আর এখন নতুন সকল গাড়িতে শহর ভরে গেছে। আমাদের পায়ের গতির প্রতি কেউ আর ভরস রাখতে পারেন না, আমাদের মত রিক্সাওয়ালাদের দিকে কেউ আর ফিরেও তাকায় না। আমার রিক্সা গাড়ির উপর তেমন করে আগের মত কেউ আর চড়তে চায় না। সবার একটাই কথা তাড়াতাড়ি যেতে হবে তাড়াতাড়ি যেতে হবে। এই কথা বলতে বলতে বৃদ্ধের দুটি চোখ জলে ভিজে গেল।
তার কান্না না বলা কত অতীতের কথা অনায়াসে আজ আজ আমাকে বলে দিল। আমি জিজ্ঞাসা করলাম আচ্ছা সারাদিনে তাহলে এখন কত টাকা রোজগার করতে পারো। কত আর ওই শ-দুশো। এতে কি আর এখন দু-বেলার ওষুধ-পথ্যি, দুবেলা পেট ভরে খাবার, নিজের ছেলে মেয়ে নিয়ে সংসার এসব প্রতিপালন করা যায়?
একটা সময় ছিল জানেন তখন সারাদিনে রিক্সা চালানোর পর রাতে পাঁচশো-সাতশো- হাজার টাকা গুনেছি। এতে কি আর দু-বেলার খাবার, ওষুধ পথ্যি, নিজের ছেলে মেয়ে নিয়ে সংসার প্রতিপালন করা যায়। আবার সে বলল কি করব বলুন বেশি দূর পড়াশোনা করতে পারিনি ওই কোনরকমে অভাব-দারিদ্র্যের মধ্যে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছি। পুঁথিগত বিদ্যাহীন পেটে, কলমহীন আঙ্গুলে কতই বা উপার্জন করব বলুন। কিন্তু পেট যে মানে না দারিদ্র্যের কাহিনী। তবে দায়িত্ব সেটা যে কখনোই এড়িয়ে যেতে পারি না, তাই নিজের প্রাণপণ চেষ্টা করি যতটুকু পারি সৎপথে খেটে দুবেলা ডাল-ভাত। তা হলেই আমরা বড় খুশি।
ইচ্ছা তো আমারও একদিন হয়েছিল সংসার করি ছেলেপুলে নিয়ে। সেইসব স্বপ্ন জীবনের চলমান নদীতে কবেই ভেসে চলে গেছে আমার থেকে বহু দূরে। আমাদের এইভাবেই বাঁচতে ইচ্ছা করে, এই ভাবেই বাঁচতে ভালো লাগে। এই জীবনে অভ্যস্ত আমরা এতে খুশি জানেন। আমাদের এতে কোন দুঃখ-কষ্ট নেই। আছে আনন্দ।
সকালে উঠে আমার এই জীবনের সম্বল রিক্সাটাকে নিয়ে বের হয়ে আসি কোন এক চায়ের দোকানে সেখানেই একটি মাটির ঘরে যা একটা বিস্কুট দিয়ে সকালের টিফিন করি তারপরেই সারাদিন ঘুরে দুপুরবেলায় কোন এক সস্তায় হোটেলে যেখানে পেট ভরে খাই ভাত-ডাল-তরকারি আহা সে কি স্বাদ সে কি পরম শান্তি। আবার রাত্রে কোন একদিন মুড়ি খাই, কোন বা একদিন রুটি-তরকারী খেয়ে রাতের খাবার পেট পুরে খায়।
সেই বৃদ্ধের প্রতিটা কথা আমি যেন গোগ্রাসে গিলে খাচ্ছিলাম। আর ভাবছিলাম সত্যি এরা কত অল্প তেই খুশি, এদের চাহিদাটাও অল্প, সামান্য। ডাল-ভাত পেলে এদের মুখে যেন হাসি আর ধরে রাখা যায় না। অথচ আমাদের মত সামান্য বেশি উপার্জনকারী-সম্মানীয় ব্যক্তি মানুষেরা প্রতিদিন নানারকমের সুগন্ধি তরকারি-মাছ-মাংস ছাড়া মুখে ভাত হাজারও ভাবনা ভাবি। আমরা কি আর বুঝবো? এদের এই স্বর্গীয় আনন্দের কথা। আমার একটা কথাই যেন বারে বারে মনে পড়তে লাগলো – ‘যারা খুশি হয় তারা অল্পতেই হয় আর যারা খুশি হতে পারে না তাদের কাছে শত শত থাকলেও খুশি হতে পারে না।’
সকালে ঘুম থেকে উঠে যাদের প্রতিনিয়ত ভাবতে হয় আজকে কি খাব। সেইসব খেটে খাওয়া, দিন এনে দিন আনা মানুষদের জীবনে নেই কোনো মস্ত বড় বাড়ি স্বপ্ন, কিংবা বড় গাড়ি কেনার চাহিদা। জীবনটাকে সুখ-স্বাচ্ছন্দের-ঐশ্বর্যের কাটানোর নেই পরিকল্পনা।
আমি আবার বৃদ্ধকে জিজ্ঞাসা করলাম আচ্ছা তাহলে যদি কখনো রোগ হয় কিংবা বড় কোন একটা অসুখ হয় তখন কি করো। বৃদ্ধ আবারও বলে চলল কি আবার করব আমাদের জন্য সরকারি হাসপাতাল আছে সেখানে রয়েছে দেব তুল্য কোন কোন ডাক্তার বাবু যার একটা বোরির ওষুধে আমরা আবার সুস্থ হয়ে উঠি।আর যদি কখনো অনেক অনেক বড় রোগ হয় তখন আমাদের মৃত্যুর দিকে পথ চেয়ে থাকা ছাড়া কোনো উপায় থাকে না।
তবে গোপনে আপনাকে একটা সত্য কথা বলি – আমাদের মত গরিব মানুষের কাছে রোগ শোক বড় একটা আসে না, কারণ তারাও বোঝে জানি যে আমাদের মনের শক্তি অনেক অনেক বেশি তাই রোগ শোক সেও আমাদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় মাঝের মধ্যে। ভগবান এটুকু আশীর্বাদ হয়তো আমাদের জন্মগতভাবেই দিয়েছেন।
বৃদ্ধের কথা শুনে আমি আবারও বুঝলাম যা বলে চলেছেন সব কথাগুলো কেমন যেন সত্যি মনে হল। সত্যিই তো আমাদের যদি কখনো কোন একটা বড় অসুখ হয়েছে তখন আমরা ছুটে গেছি শহরের সেরা নামকরা নার্সিংহোমে, নাম ডাক আছে এমন ডাক্তার বাবুর কাছে। আমরা জীবনটাকে অতটা সহজ ভাবে কখনোই মেনে নিতে পারি না। তাই জটিলতা আমাদের পিছু ছাড়ে না। কিছু ছাড়ে না জীবনের শ্রেষ্ঠত্ব হবার চাহিদা।
আমাদের কাছে যতটুকু আছে সেটুকু নিয়ে যদি আমরা প্রত্যেকে নিজের মতন করে থাকতে পারি তাহলে হয়তো সব থেকে বেশি সুখী আমরাই হবো।
কিন্তু এই চিরন্তন সত্যিকে মানতে আমরা রাজি নই। তাই প্রতিনিয়ত আমরা একে অপরের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত।সবার থেকে সেরা জিনিসটা আমার চাই। এই লড়াইয়ে আমরা প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করে চলেছি।
দেখলাম সত্যিই তো জীবনে সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য দুবেলা পেট ভরে খাবার, ঝড়-বাদলে, শীতের রাতে নিরাপদ আশ্রয় পাওয়ার মতো একটা ছোট্ট মাটির কুঁড়েঘর যথেষ্ট। যেখানে থাকবে অপার শান্তি আর নিরোগী সুস্থ সবল শরীর থাকলে আর কি চাই। বৃদ্ধের আজ এই সমাজে প্রতিযোগী মানুষদের চোখে মুখে নির্দেশ করে স্পষ্ট বুঝিয়ে দিল জীবনটা ঈশ্বরের দেওয়া আশীর্বাদ। তোমার যা আছে তাই নিয়ে উপভোগ করো আনন্দ করো আনন্দ করো। বৃদ্ধের সাথে কথোপকথনে হঠাৎ দেখি রিক্সার চাকা থেমে গেল। ততক্ষণই সূর্যের আলো অস্ত গিয়েছে। শহরটাকে যাতে অন্ধকারে ডুবিয়ে খেয়ে ফেলতে না পারে, তার জন্য চারিদিকে সরকারি ল্যাম্প পোষ্টের আলোগুলো জ্বলে উঠেছে। ট্রেনের আওয়াজ শোনা গেল। বৃদ্ধ বললেন- দিদিমনি স্টেশন এসে গেছি।
লেখক পরিচিতি : পিউ দত্ত
১৯৯৭ সালে ১৪ ই নভেম্বর পূর্ব বর্ধমান জেলার অন্তর্গত হাটগোবিন্দপুর নামক গ্রামে জন্ম। পিতার রঘুনাথ দত্ত, মাতা ঝুমা দত্ত। হাট গোবিন্দপুর মানগোবিন্দ চৌধুরী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে হায়ার সেকেন্ডারি পাস করার পর ডক্টর ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত স্মৃতি মহাবিদ্যালয় থেকে বাংলা অনার্সে বি.এ এবং পরবর্তীকালে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্গত কালনা কলেজ থেকে রেগুলার এম. এ সম্পূর্ণ করেছি। এখন বর্তমানে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি গবেষিকা হিসাবে পাঠরত।