লেখক : অভি সেখ
রুদ্র বসে আছে তার চেম্বারে। দেওয়ালে টাঙানো সার্টিফিকেটগুলো প্রমাণ করে, সে একজন অভিজ্ঞ মনোবিজ্ঞানী। কলকাতার অভিজাত এলাকায় তার এই চেম্বারে প্রতিদিন অনেক রোগী আসে—কেউ অবসাদে ভোগে, কেউ অতীতের ভয়াবহ স্মৃতি থেকে বেরোতে পারে না, আবার কেউ বাস্তব আর কল্পনার পার্থক্য ভুলে ফেলে।
কিন্তু আজকের রোগীটি অন্যদের চেয়ে আলাদা। সামনের চেয়ারে বসে থাকা মেয়েটির চোখ ফাঁকা, গলার স্বর শীতল। নাম মীরা সেন। বয়স পঁচিশ কি ছাব্বিশ, তবে চেহারায় যেন দুশ্চিন্তার ছাপ চিরস্থায়ী হয়ে বসেছে। মেয়েটির চুল এলোমেলো, চোখের নিচে কালি, ঠোঁট ফাটল ধরা। রুদ্র হাতের খাতায় লিখল, “রোগী: মীরা সেন। সম্ভাব্য মানসিক অবস্থা: প্যারানয়েড স্কিজোফ্রেনিয়া।”
— “আপনার সমস্যাটা বলুন, মীরা,” রুদ্র গম্ভীর স্বরে বলল।
মীরা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। তারপর নিচু স্বরে বলল, “আমি একটা মানুষের ছায়া দেখতে পাই । আমি জানি না সে কে, কিন্তু সে সর্বদা আমার আশেপাশে থাকে।”
রুদ্র নোট নিতে নিতে বলল, “এই ছায়া আপনার সঙ্গেই কথা বলে?”
মীরা মাথা নাড়ল। “না, সে কথা বলে না। শুধু থাকে। আর যখনই সে আসে, কোথাও না কোথাও একটা খুন হয়।”
রুদ্র এবার থামল। “মানে?”
মীরা চোখ তুলে তাকাল। তার ঠোঁট কাঁপছে।
“গত ছয় মাসে শহরে যত খুন হয়েছে, আমি সবগুলো টের পেয়েছি। ঘটনার আগেই। ছায়াটা যখন আসে, আমি জানি কিছু একটা ঘটতে চলেছে। প্রথমে আমি ভয় পেতাম। এখন অভ্যস্ত হয়ে গেছি। কিন্তু আপনি কি জানেন সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যাপারটা কী?”
রুদ্র আগ্রহ নিয়ে তাকাল। মীরা ফিসফিস করে বলল, “ছায়াটা আমাকে অনুসরণ করে না । আমিই ছায়াটাকে অনুসরণ করি!”
রুদ্র চুপ করে রইল কিছুক্ষণ। মীরার চোখে এমন একটা অদ্ভুত ভয়, যা সে বহু রোগীর চোখে দেখেছে—কিন্তু এই ভয়টা যেন অন্যরকম।
— “আপনি কী বোঝাতে চাইছেন?” রুদ্র ঠান্ডা গলায় বলল।
মীরা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। “আমি জানি না এটা কীভাবে সম্ভব। কিন্তু যখনই ছায়াটা আসে, আমি বুঝতে পারি কিছু একটা ভয়ানক হতে চলেছে। প্রথমে ভেবেছিলাম আমার মানসিক সমস্যা হয়েছে, কোন হ্যালুসিনেশন হচ্ছে। কিন্তু বারবার যখন আমার আশঙ্কাগুলো সত্যি হতে লাগল, তখন বুঝলাম এটা কাকতালীয় নয়।”
রুদ্র কিছু লিখে রাখল। “আপনি বললেন, ছায়াটা আপনাকে অনুসরণ করে না—আপনি ছায়াটাকে অনুসরণ করেন । এর মানে কী?”
মীরা এবার ঠোঁট চেপে ধরল। কয়েক সেকেন্ড নীরব থাকার পর বলল, “আমি স্বপ্ন দেখি, ডাক্তার। কিন্তু সেই স্বপ্নগুলো স্বপ্ন থাকে না। সত্যি হয়ে যায়।”
রুদ্র কপালে ভাঁজ ফেলে তাকাল। “আপনার স্বপ্নে ঠিক কী দেখেন?”
মীরা এবার নিচের দিকে তাকাল, যেন নিজের মনে কথা বলছে। “একটা অন্ধকার ঘর… ধোঁয়াটে… সেখানে একটা মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু আমি তার চেহারা দেখতে পাই না, শুধু তার ছায়াটা দেখি। তারপর আমি দেখি কেউ একজন মরতে চলেছে। কখনও অজানা কেউ, কখনও পরিচিত কেউ। আমি বুঝতে পারি কী ঘটতে যাচ্ছে, কিন্তু কিছু করতে পারি না। তারপর সকালে খবরের কাগজ খুললেই দেখি সেই মানুষটা সত্যিই খুন হয়েছে।”
রুদ্র এবার গম্ভীর হয়ে গেল। মীরার চোখের ভাষা মিথ্যা বলছে না, অথচ এই গল্পের ব্যাখ্যা বাস্তবের সঙ্গে মেলানো কঠিন।
— “আপনার আগে থেকে বোঝার ক্ষমতাটা কি সবসময় ছিল?”
মীরা মাথা নাড়ল। “না। এটা শুরু হয়েছে ছয় মাস আগে, প্রথম হত্যাকাণ্ডের পর। তখনও আমি এটাকে স্বপ্ন বলে উড়িয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ খুন যখন একইভাবে ঘটতে লাগল, তখন আমি বুঝলাম এটা Coincidence না।”
রুদ্র কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার আগেই মীরা ফিসফিস করে বলল, “কাল রাতে আমি আবার সেই স্বপ্ন দেখেছি, ডাক্তার। আজ রাতে আবার একটা খুন হবে।”
রুদ্র এবার মীরার দিকে ভাল করে তাকাল। তার নোটবুকের পাতায় তখন শুধু একটা লাইন লেখা—“রোগী ভয়াবহ মানসিক সমস্যায় ভুগছে।”
রুদ্রের মনে হালকা অস্বস্তি জাগল। সে বহু মানসিক রোগীর গল্প শুনেছে—কেউ নিজেকে ঈশ্বর ভাবে, কেউ মনে করে ভিনগ্রহের প্রাণীরা তাকে অনুসরণ করছে। কিন্তু মীরার কথাগুলো অন্যরকম। কোন অযৌক্তিক আতঙ্ক নেই তার কথায়, বরং এক ধরনের নিশ্চিত বিশ্বাস। সে শান্ত গলায় বলল, “আজ রাতের খুন সম্পর্কে কিছু জানেন?”
মীরা শ্বাস নিল ধীরে।
“একজন পুরুষ। বয়স চল্লিশের কাছাকাছি। গলায় ছুরি চালানো হবে।”
রুদ্র নোট লিখতে লিখতে বলল, “লোকটিকে চেনেন?”
মীরা মাথা নাড়ল। “না। শুধু ছায়াটা দেখেছি। কাল রাতের স্বপ্নে আমি একটা সংকীর্ণ গলি দেখেছি। ভেজা রাস্তা, পাশের দেওয়ালে পুরনো পোস্টার ছেঁড়া অবস্থায় ঝুলছে। বাতির আলো কম। আর সেই ছায়াটা ধীরে ধীরে একটা মানুষের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে…”
তার কণ্ঠস্বর থেমে গেল, যেন কিছু মনে পড়েছে। রুদ্র একটু ঝুঁকে বলল, “তারপর?”
মীরা এবার ঠোঁট চেপে ধরল, চোখে ভয়। তারপর ফিসফিস করে বলল, “ডাক্তার, ছায়াটা মুখ ঘুরিয়ে একবার আমার দিকেও তাকিয়েছিল।”
রুদ্র এবার একটু নড়েচড়ে বসল। “মানে?”
মীরা এবার গলা নামিয়ে বলল, “আগে কখনও এমন হয়নি। ছায়াটা সবসময় খুনির পাশে থাকত, কিন্তু কাল রাতে সে যেন বুঝতে পেরেছে আমি ওকে দেখছি।”
রুদ্র এবার সত্যিই অস্বস্তি অনুভব করল, মেয়েটি স্কিজোফ্রেনিয়ায় ভুগছে।
— “আপনি কি পুলিশকে জানিয়েছেন?”
মীরা হেসে উঠল—একটা ফাঁকা, বিদ্রূপাত্মক হাসি। “আমি গিয়ে কী বলব? যে আমি খুন হওয়ার আগেই খুন দেখে ফেলি? ওরা আমাকেই পাগল বানিয়ে ছাড়বে!”
রুদ্র সত্যিই কিছু বলতে পারল না। তবে তার মনে একটা কৌতূহল কাজ করতে লাগল। মীরার কথা সত্যি না ভুল, সেটা যাচাই করা দরকার।
সে গম্ভীর গলায় বলল, “আজ রাতের খুনের সময় ও স্থান সম্পর্কে কিছু বলতে পারবেন?”
মীরা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, “শুধু একটা জিনিস মনে আছে। ‘হলুদ আলো’।”
রুদ্র ভ্রূ কুঁচকালো। “হলুদ আলো?”
মীরা মাথা নাড়ল। “হ্যাঁ। হয়তো সেটা কোন দোকান, হয়তো রাস্তার নাম—আমি জানি না।”
রুদ্র গভীর চিন্তায় ডুবে গেল। তবে একটা বিষয় সে নিশ্চিত হয়ে গেল, এই কেসটা সাধারণ না।
রাত প্রায় সাড়ে এগারোটা। ডেস্কের ওপর রাখা ফাইলগুলো রুদ্রের চোখের সামনে এলোমেলো হয়ে আছে, কিন্তু সে সেগুলোর দিকে একবারও তাকায়নি। মীরার কথাগুলো তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে—“হলুদ আলো ”। এটা কি কোন জায়গার নাম? নাকি কোন সংকেত? কৌতূহল চেপে রাখতে না পেরে সে ল্যাপটপ খুলে কলকাতার কোন এলাকায় “হলুদ আলো” নামে কোন হোটেল, রাস্তা, বা স্থাপনা আছে কি না, খোঁজার চেষ্টা করল। কিছু পেল না।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে চেয়ার থেকে উঠল। এখনও যদি সময় থাকে, তাহলে ঘটনাটা খতিয়ে দেখা দরকার।
রুদ্র গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। রাতে রাস্তাগুলো শুনসান হয়ে যায়, মাঝে মাঝে কিছু স্ট্রিটলাইটের হলুদ আলো ঝিমিয়ে জ্বলে। কিন্তু কোথায় যাবে, সেটাই বুঝতে পারছে না। তবে মীরার বলা কিছুটা দৃশ্য মনে পড়ল—ভেজা রাস্তা, ছেঁড়া পোস্টার, কম আলো। এমন জায়গা তো কলকাতায় অসংখ্য আছে। কিন্তু ঠিক কোন জায়গাটা হতে পারে?
সে এলোমেলোভাবে শহরের পুরনো অংশের দিকে গাড়ি চালাতে লাগল। হঠাৎ, একটি মোড়ে এসে তার নজরে পড়ল একটা পুরনো রাস্তার ল্যাম্পপোস্ট, যার আলো কেমন যেন হলদেটে। আশেপাশের অন্য বাতিগুলো সাদা বা কমলা রঙের হলেও, এই একটা লাইট পুরো গলিটাকে একটা রহস্যময় সোনালি ছায়ায় ঢেকে রেখেছে।
রুদ্রের বুক ধক করে উঠল। গলিটা প্রায় ফাঁকা, শুধু দূরে দু’-একজন পথচারী হেঁটে যাচ্ছে। জায়গাটা অস্বাভাবিক নীরব। সে গাড়ি থামিয়ে নেমে পড়ল।
গলির ভেতরে ঢুকতেই একটা অদ্ভুত অনুভূতি হল রুদ্রের। বাতাস ভারী, যেন এখানে কোন কিছু একটা অপেক্ষা করছে। সে ধীরে ধীরে সামনে এগিয়ে যেতে লাগল। তার কানে শুধু নিজের পায়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে। হঠাৎ, কোথাও একটা সাইরেন বেজে উঠল। তারপর…
একটা শোঁ শোঁ শব্দ! যেন বাতাস কেটে কিছু ছুটে গেল! রুদ্র মুহূর্তের মধ্যে গলির এক পাশে দেওয়ালের আড়ালে লুকিয়ে পড়ল। বুকের মধ্যে ধুকপুকানি বেড়ে গেছে।
দূরে একটা ছায়ামূর্তি দেখা গেল। কেউ একজন ধীরে ধীরে হাঁটছে, আর তার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে আরেকজন—পিছন ফিরে থাকা মধ্যবয়সী এক পুরুষ। ছায়ামূর্তিটি তার দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে। রুদ্রের মাথার ভেতর মুহূর্তের মধ্যে সবকিছু দপদপ করে উঠল।
“আজ রাতে একটা খুন হবে!”
সে দ্রুত ফোন বের করে পুলিশে কল করতে চাইল, কিন্তু তার আঙুল থমকে গেল।
ছায়ামূর্তিটি এবার তার হাতে কিছু একটা তুলল। একটা চকচকে ব্লেড! রুদ্রের শ্বাস আটকে এল।
এখন কি কিছু করা উচিত? চিৎকার করবে? দৌড়ে গিয়ে বাধা দেবে? নাকি অপেক্ষা করবে? তার শরীর স্থবির হয়ে গেল। এক সেকেন্ড, দুই সেকেন্ড, তারপরেই—
ধপ! মানুষটা মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। কয়েক মুহূর্তের জন্য চারপাশ যেন নিঃশব্দ হয়ে গেল।
রুদ্র কিছু বুঝে ওঠার আগেই, ছায়াটা হঠাৎ ঘুরে তাকাল তার দিকে! রুদ্র নিঃশ্বাস বন্ধ করে তাকিয়ে রইল।
গলির আলো কমে এসেছে, কিন্তু তবুও সে বুঝতে পারছে, ছায়ামূর্তিটি তার দিকেই তাকিয়ে আছে। কিন্তু, মুখটা দেখা যাচ্ছে না! এমন নয় যে মুখটা অন্ধকারে ঢাকা, বরং মনে হচ্ছে সেখানে কোন মুখই নেই!
রুদ্রের শরীর কেঁপে উঠল। পালানোর ইচ্ছা হচ্ছিল, কিন্তু পা যেন মাটিতে আটকে গেছে। ছায়াটি কিছুক্ষণ স্থির দাঁড়িয়ে থাকল। তারপর ধীরে ধীরে তার দিকে এগিয়ে আসতে লাগল।
রুদ্রের মাথায় এখন একটাই চিন্তা, “পালাতে হবে।” সে ধীরে ধীরে পিছোতে লাগল। কিন্তু তখনই একটা শব্দ শুনতে পেল, পায়ের নীচে কী যেন একটা কচকচ করে উঠল। সে তাকিয়ে দেখল, রাস্তার মাটিতে রক্তের ছোপ ছড়িয়ে পড়েছে, আর তার জুতোর তলায় চাপা পড়েছে একটা ভাঙা চশমা। মাটিতে পড়ে থাকা মৃতদেহের মুখ তখনো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল না, কিন্তু চশমাটা চিনতে রুদ্রের এক মুহূর্তও লাগল না। এটা সেই ব্যক্তির, যে কয়েক সেকেন্ড আগেই দাঁড়িয়ে ছিল, আর এখন মাটিতে নিথর হয়ে পড়ে আছে। তার পেটের নিচে ছড়িয়ে থাকা রক্ত গলির পিচঢালা রাস্তায় একটা অদ্ভুত ছায়া তৈরি করেছে—একটা দীর্ঘ, বিকৃত ছায়া, যা ধীরে ধীরে নড়ছে!
রুদ্র আর দেরি করল না। এক ঝটকায় পিছন ফিরে দৌড় দিল গলির বাইরে। তিন-চার কদম যাওয়ার পরেই পিছন থেকে শোঁ শোঁ শব্দ এলো, যেন বাতাস কেটে কিছু একটা এগিয়ে আসছে।
রুদ্র পিছন ফিরে তাকাতেই শ্বাস বন্ধ হয়ে গেল। ছায়াটা তার একেবারে সামনে! এত কাছ থেকে দেখার পরেও রুদ্র বুঝতে পারল না এটা মানুষ নাকি অন্য কিছু! মুখের জায়গাটা সম্পূর্ণ ফাঁকা, চোখ নেই, নাক নেই, কেবল একটা অন্ধকার শূন্যতা। কিন্তু তবুও মনে হচ্ছে সে তার দিকে তাকিয়ে আছে। রুদ্র পিছু হটতে গিয়েও পা সরাতে পারল না। চারপাশে কোন শব্দ নেই, বাতাসও যেন থেমে গেছে। তখনই সেই ছায়াটা একটা কথা বলল। কিন্তু শব্দটা মানুষের মত শোনাল না। শব্দটা মনে হল যেন তার নিজের মাথার ভেতর বাজছে।
“তুমি এখানে কেন এসেছ, রুদ্র?“
রুদ্র চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকল। সে তার নাম জানে? তার শরীর ঠান্ডা হয়ে গেল। গলা শুকিয়ে আসতে লাগল। কোনও মতে ফিসফিস করে বলল, “কে, কে তুমি?”
কয়েক মুহূর্ত নীরবতা। তারপর সেই বিকৃত, অশরীরী কণ্ঠস্বর আবার বলল,
“তুমিই তো আমাকে খুঁজছিলে, তাই না?”
রুদ্র এবার গলা শুকিয়ে আসা কণ্ঠে বলল, “আমি জানি না তুমি কে। আমি শুধু, আমি শুধু…”
কিন্তু সে নিজেই জানে না কী বলতে চায়। তারপর হঠাৎ একটা জিনিস খেয়াল করল—
গলির মধ্যে এখন আর কোন মৃতদেহ নেই! সে চোখ ঘুরিয়ে দেখল—রক্তও নেই, চশমাটাও নেই! রুদ্র হতভম্ব হয়ে পড়ল। মাত্র কয়েক সেকেন্ড আগে সে যা দেখল, সেগুলো তাহলে কই গেল? তার হাত কাঁপছে। এই মুহূর্তে একটা জিনিস নিশ্চিত—এটা বাস্তব নয়।
ছায়ামূর্তিটি আর এক ধাপ এগিয়ে এল। তারপর বলল, “তুমি আমাকে অনুভব করতে পারছ, তাই না?”
রুদ্রের মাথা চক্কর দিয়ে উঠল। সে চোখ বন্ধ করল এক মুহূর্তের জন্য। আর যখন আবার চোখ খুলল— সামনে কেউ নেই। শুধু ফাঁকা গলি। শুধু হলুদ নিস্তব্ধ আলো। শুধু ঠান্ডা বাতাসের ফিসফাস। রুদ্রের শরীর থরথর করে কাঁপছিল। গলির ভেতর আর কোন লাশ নেই, রক্ত নেই, সেই ছায়ামূর্তিও নেই—কিন্তু অনুভূতিটা যেন এখনও তার গায়ে লেগে আছে। যেন একটা ঠান্ডা, অদৃশ্য হাত তার মনের ভেতর নখ বসিয়ে দিয়েছে। এটা কী হচ্ছে? মীরা কি সত্যিই ঠিক বলেছিল? তার আগেই ছায়াটা তাকে দেখে ফেলেছিল, আর তারপর?
রুদ্র কাঁপা কাঁপা হাতে ফোন বের করল। দ্রুত মীরার নাম্বার খুঁজে ডায়াল করল। কিন্তু কল কানেক্ট হচ্ছে না। সে তখনই বুঝল, এই রাতে কিছু একটা খুব ভুল হচ্ছে। সে আর দেরি করল না। গাড়িতে উঠে দ্রুত মীরার ফ্ল্যাটের দিকে রওনা দিল।
মীরার ফ্ল্যাট একটা তিনতলা বিল্ডিংয়ের দ্বিতীয় তলায়। জায়গাটা বেশ অন্ধকার, কারণ আশেপাশের স্ট্রিটলাইট বেশির ভাগই নষ্ট।
রুদ্র গাড়ি থেকে নেমে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কলবেল চাপল। কোন উত্তর নেই। সে আবার চাপল। তবুও কিছুই হ’ল না। ভেতরে একদম নিস্তব্ধতা।
রুদ্র এবার মৃদু ধাক্কা দিল দরজায়। তালাবদ্ধ নয়। দরজা ধীরে ধীরে কিঁচ কিঁচ শব্দ করে খুলে গেল। রুদ্রের গলার ভেতর শুকিয়ে এলো। সে ধীরে ধীরে ভেতরে ঢুকল।
ড্রয়িংরুমটা অন্ধকার। শুধু জানালার বাইরে থেকে একটা ফ্যাকাশে আলোর রেখা ভেতরে পড়ছে। মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে কিছু কাগজপত্র, একটা উল্টে যাওয়া চেয়ার, আর মেঝের কোণায় একটা গ্লাস গড়িয়ে পড়ে আছে—তাতে আধা খাওয়া পানি। কিন্তু সবকিছুর মধ্যেও সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ল দেওয়ালের দিকটা। রুদ্রের দৃষ্টি হিম হয়ে গেল। দেওয়ালে বিশাল একটা লেখা আছে। কিন্তু রঙ দিয়ে নয়, রক্ত দিয়ে। লেখাটা একদম বিশৃঙ্খল। মনে হচ্ছে, কারো কাঁপা হাতে লেখা। তাতে লেখা—
“সে এখনও তাকিয়ে আছে।”
রুদ্রের বুকের মধ্যে ধক করে উঠল। সে জানত না কি করবে। তার পুরো শরীর যেন অসাড় হয়ে গেল মুহূর্তের জন্য।
তারপরই হঠাৎ ভেতরের ঘর থেকে একটা শব্দ এল! একটা চাপা গোঙানির মত!
রুদ্রের দম বন্ধ হয়ে আসছিল। সে ধীরে ধীরে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। দরজাটা ভেজানো ছিল, কিন্তু ভেতর থেকে ঠেলা দিতেই ফাঁক হয়ে গেল। তারপর সে যা দেখল, তাতে তার গা শিউরে উঠল।
মেঝেতে পড়ে আছে …মীরা! তার শরীরে একাধিক আঘাতের চিহ্ন, হাত-পা শক্ত হয়ে আছে, আর ঘরের মাঝখানে ছড়ানো আছে ভাঙা কাঁচ, ফাঁস লাগানোর দড়ি, আর ছোপ ছোপ রক্ত। তার দেহ একদম নিথর। কিন্তু রুদ্র কিছু একটা খেয়াল করল। মীরার এক হাতে শক্ত করে ধরা আছে একটা কাগজের টুকরো। রুদ্র ধীরে ধীরে সেটা তুলল। তাতে মাত্র তিনটি শব্দ লেখা: “তোমাকে পালতে হবে।”
তারপরই হঠাৎ বাতাসে যেন শোঁ শোঁ শব্দ বেজে উঠল। রুদ্র ঘুরে তাকাতেই মনে হল, দেওয়ালের ছায়াগুলো নড়াচড়া করছে। রুদ্রের হাত থেকে কাগজটা পড়ে গেল। তার মাথার ভেতর যেন শূন্যতা। শব্দ নেই, চিন্তা নেই—শুধু এক অদ্ভুত অনুভূতি, যেন পুরো পৃথিবী হঠাৎ করে কুয়াশায় ঢেকে গেছে।
সে মাথা ঝাঁকাল, কোনভাবে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করল। পুলিশে কল দেওয়া দরকার! সে ফোন বের করল। কিন্তু, ফোনের স্ক্রিনে “No Service” লেখা ঝলসে উঠল।
চারপাশটা যেন আরও গাঢ় হয়ে এল। সে মনে করতে পারছে না শেষবার কবে এখানে এসেছিল। সে কি সত্যিই মীরাকে চিনত? কেন যেন মনে হচ্ছে, সে অনেক দিন ধরেই এই শহরে নেই। হ্যাঁ, সে কলকাতায় থাকে, কিন্তু… কিন্তু ঠিক কতদিন ধরে? সে মাথায় চাপ দিল। কিন্তু না! কিছুই মনে পড়ছে না! রুদ্র চারপাশে তাকাল। ঘরটা একদম অপরিচিত লাগছে। অথচ সে কি এখানেই আসেনি? সে শেষবার কবে কোথায় গিয়েছিল? তার নিজের নাম পর্যন্ত এক মুহূর্তের জন্য অচেনা লাগছিল। সে ড্রয়িংরুমের দিকে এগোল। শোবার ঘরের দেওয়ালে রাখা একটা ছোট আয়নায় তাকাল। তার নিজের মুখও কেমন যেন অদ্ভুত লাগছিল। মনে হল, যেন সে এই মুখ অনেক দিন ধরে দেখেনি। তার হাত কাঁপছে। সে কি স্বপ্ন দেখছে? ঘরের বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে। সে দরজার দিকে এগোতে গিয়েও থমকে গেল। একটা দীর্ঘশ্বাসের শব্দ শুনতে পেল। একেবারে পিছন থেকে। ঠান্ডা, ভারী, ধীর নিঃশ্বাস। সে দ্রুত ঘুরে তাকাল। কেউ নেই। কিন্তু তার শরীরের লোম দাঁড়িয়ে গেল। সে অনুভব করতে পারছিল—কেউ তাকে দেখছে! সে দরজার দিকে দৌড় দিল।
সে রাস্তায় বেরিয়ে এল। চারপাশটা অন্ধকার, যেন শহরটা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। কিন্তু.. এই শহরটা অচেনা লাগছে কেন? কোথায় যাবে সে? কোন রাস্তা ধরে ফিরবে? সে কি সত্যিই এই শহরের কেউ? না কি তার এখানে থাকার কথা ছিল না? রুদ্র রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে। শহরটাকে কেমন যেন অদ্ভুত লাগছে। এটা তার শহর , কিন্তু কিছু একটা ঠিক নেই। রাস্তার লাইটগুলো খুব ম্লান, যেন কুয়াশার ভেতর ঢাকা। দূরের বিলবোর্ডের লেখাগুলো অস্পষ্ট, এমনকি গলিগুলোও মনে হচ্ছে কোথাও মিশে গেছে। সে রাস্তার পাশে একটা দোকানের সাইনবোর্ড দেখতে পেল। কিন্তু যখন সে নামটা পড়তে গেল—অক্ষরগুলো এলোমেলো! লেখাটা ঝাপসা হয়ে আছে, যেন কোন অদৃশ্য শক্তি তার দৃষ্টির সঙ্গে খেলা করছে। তার শ্বাস আটকে আসছিল। সে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা এক রিকশাচালকের দিকে এগিয়ে গেল।
“ভাই, এটা কোন এলাকা?” রিকশাচালক তাকাল না। সে বোবা দৃষ্টিতে সামনে তাকিয়ে রইল।
রুদ্র এবার একটু জোরে বলল, “ভাই, আমি কোথায় আছি?” কিন্তু কোন উত্তর এল না। রিকশাচালক একদম স্থির, যেন সে এখানে নেই।
রিকশাচালক ধীরে ধীরে তার মাথা ঘোরাল, কিন্তু মুখটা একদম ফাঁকা! চোখ নেই, নাক নেই, মুখ নেই—শুধু একটা ফাঁকা মসৃণ চামড়ার টুকরো! রুদ্র এক ঝটকায় পিছনে হটল। শরীরের রক্ত জমে আসছে। তারপর চারপাশের মানুষগুলোও থমকে দাঁড়িয়ে গেল। রাস্তার সব লোক একসঙ্গে ঘুরে তাকাল রুদ্রের দিকে। আর সবার মুখ একদম ফাঁকা!
রুদ্র চিৎকার করতে চাইল, কিন্তু গলা দিয়ে কোন শব্দ বের হ’ল না। সে দৌড় দিল। শহরের রাস্তা ধরে ছুটতে লাগল, কিন্তু কিছুক্ষণ পর বুঝতে পারল—সে একই রাস্তায় ফিরে আসছে! এই রাস্তাটা যেন চক্রের মত ঘুরছে! সে বাঁদিকে গেল—কিন্তু সামনেই আবার সেই দোকান! ডানদিকে গেল—রিকশাচালক ঠিক আগের জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে! এটা কী হচ্ছে?
হঠাৎ দূরে একটা পুরনো পাঁচতলা বাড়ি চোখে পড়ল। বাড়িটা অন্য সবকিছুর চেয়ে অনেক পুরনো মনে হচ্ছে, যেন এক শতাব্দী ধরে এখানে দাঁড়িয়ে আছে। দেওয়ালে ফাটল ধরেছে, জানালার পর্দা ছেঁড়া, আর প্রবেশদ্বারের সামনে একটা কালো দরজা। অদ্ভুতভাবে মনে হল, দরজাটা যেন ডাকছে তাকে। তার মাথার মধ্যে তখনও সেই প্রশ্নগুলো ঘুরপাক খাচ্ছে—সে কে? সে এখানে কীভাবে এল? তার আগের জীবন কোথায়? সে আস্তে আস্তে দরজার দিকে এগোল।
দরজায় হাত রাখতেই মনে হল, শরীরের ভেতর দিয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে যাচ্ছে। ভেতরে পুরো অন্ধকার। কিন্তু হঠাৎ একটা চাপা কণ্ঠস্বর শোনা গেল, যেন অনেক গভীর থেকে আসছে, “তুমি সত্যি জানতে চাও, রুদ্র?”
সে থমকে দাঁড়াল। তার হাত ঘামছে। সে কি ভেতরে যাবে? নাকি পিছিয়ে আসবে? কিন্তু পিছনে ফিরে তাকাতেই দেখল—রিকশাচালকসহ সব মুখহীন মানুষ এখন একসঙ্গে তার দিকে এগিয়ে আসছে! রুদ্রের নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসছে। ওর চারপাশে মুখহীন মানুষের দল ধীরে ধীরে ঘিরে ফেলছে ওকে। একজন…দু’জন…না, অনেক! ওদের শরীরের কোন নড়াচড়া নেই, কেবল মাথাগুলো ধীরে ধীরে একসঙ্গে কাত হচ্ছে, যেন সবাই এক অদৃশ্য নির্দেশের অপেক্ষায় আছে। রুদ্র পিছোতে চাইল, কিন্তু ওর ঠিক পিছনেই সেই কালো দরজা। ওর সামনে এখন দুইটাই পথ—এই বিভীষিকার মাঝে আটকে থাকা, নাকি সত্যের দিকে এগিয়ে যাওয়া! রুদ্র এক মুহূর্তের জন্য চোখ বন্ধ করল। তারপর দরজার ভেতরে ঢুকে গেল! ওর মধ্যেই দরজাটা বিকট শব্দে বন্ধ হয়ে গেল! চারপাশ একদম নিঃশব্দ।
রুদ্র এক পা এগোতেই ঘরের বাতাস বদলে গেল। তার সামনে এক অদ্ভুত করিডর, যেন একটা অনন্ত অন্ধকার সুড়ঙ্গ। কিন্তু সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যাপার ছিল—দেওয়ালজুড়ে ঝুলছে শত শত আয়না! প্রতিটা আয়নায় ওর প্রতিবিম্ব আছে, কিন্তু প্রতিটি রুদ্রের মুখ আলাদা! কোথাও সে এক বৃদ্ধ, কোথাও সে কিশোর, কোথাও তার চোখ শূন্য, কোথাও সে ভয়ংকরভাবে হাসছে! রুদ্র ধীরে ধীরে হাঁটতে লাগল। তখনই পিছন থেকে সেই কণ্ঠস্বর আবার এল।
“তুমি জানতে চেয়েছিলে, রুদ্র। এবার সত্যিটা দেখো!”
এক ঝলক আলো চারপাশকে ভাসিয়ে দিল। রুদ্র হঠাৎ বুঝতে পারল, সে আসলে কারও স্মৃতির ভেতরে আছে! তার সামনে দৃশ্যগুলো দ্রুত বদলাতে লাগল
—একটা ছোট ছেলে কাঁদছে, পাশে এক বৃদ্ধ দাঁড়িয়ে।
—একটা কফিন নামানো হচ্ছে কবরস্থানে, যেখানে সব লোকেরা কাঁদছে, কিন্তু রুদ্রের মুখ হাসছে।
—একটা হাসপাতালের বিছানায় কেউ শুয়ে আছে, তার মুখ অন্ধকারে ঢাকা।
—একটা কিশোর আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে আছে, তার দেহ অস্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে!
রুদ্র যেন নিজের শরীরের নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে। তাকে কিছু একটা টেনে নিয়ে যাচ্ছে! ওর মাথায় প্রচণ্ড যন্ত্রণা শুরু হল, যেন কেউ ওর মস্তিষ্কের ভেতর ঢুকে সব কিছু কেটে কেটে বের করে আনছে! ওর গলা দিয়ে একটা চাপা গোঙানি বের হ’ল।
“নাহ… এটা সত্যি হতে পারে না! আমি… আমি কে?”
তারপর হঠাৎ সব কিছু ভেঙে গেল। গভীর এক শূন্যতা ওকে গিলে ফেলল। সে অনুভব করল, ওর শরীরটা যেন বাতাসে ভেসে যাচ্ছে। কোথাও আলো নেই, কোথাও শব্দ নেই, কেবলই এক বিশাল শূন্যতা।
রুদ্রের চোখ খুলল, সে বিছানায় শুয়ে আছে। নিজের ঘর! পরিচিত সিলিং, পরিচিত জানালা, পরিচিত পর্দা! তার কপাল ঘামে ভিজে গেছে। তার হৃদস্পন্দন এখনও দ্রুত চলছে। সে দ্রুত ফোনের দিকে তাকাল। তারিখটা দেখে ওর বুকের রক্ত যেন জমে গেল। এক বছর পেরিয়ে গেছে! সে শেষবার যা মনে করতে পারছে, তার থেকে এক বছর কেটে গেছে! রুদ্রের শরীর ঠান্ডা হয়ে গেল। সে কি সত্যিই স্বপ্ন দেখছিল? নাকি কিছু একটা হারিয়ে গেছে ওর স্মৃতির মধ্যে? রুদ্রের মাথায় এখনও ঝিম ধরে আছে। ঘড়ির কাঁটায় সময় ৭:৩০ AM। সে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের দিকে তাকাল।চোখের নিচে ক্লান্তির ছাপ, গালের হালকা দাড়ি, শরীরটা কেমন যেন ভারী লাগছে। এক বছর কেটে গেছে? কিন্তু কীভাবে? সে মাথা ঝাঁকাল, এসব নিয়ে এখন ভাবার সময় নেই। ওকে ক্লিনিকে যেতে হবে। বেডসাইড টেবিল থেকে গাড়ির চাবিটা তুলে নিল।
রুদ্র গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বেরিয়ে পড়ল। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই সে বুঝতে পারল— শহরটা একটু অদ্ভুত লাগছে! গলি, রাস্তা, দোকানপাট—সব আগের মতই আছে, কিন্তু মনে হচ্ছে সবকিছু একটা নিখুঁত প্যাটার্নে চলছে! সে স্টিয়ারিং চেপে ধরল।
একটা চায়ের দোকানের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় চোখ আটকে গেল। এক বৃদ্ধ চায়ের কাপ নিয়ে বসে আছে। ঠিক পিছনের চেয়ারটাতে এক যুবক বসে ফোন স্ক্রল করছে। অদ্ভুত কিছু নয়।
কিন্তু একটু দূরে যেতেই রুদ্র আবার ঠিক একই দৃশ্য দেখল! আবার একটা চায়ের দোকান, এবং ওখানে একই ভাবে, একই পজিশনে লোকগুলো বসে আছে। এক বৃদ্ধ চায়ের কাপ নিয়ে বসে আছে। ঠিক পিছনের চেয়ারটাতে এক যুবক বসে ফোন স্ক্রল করছে।
“এটা কীভাবে সম্ভব?”
সে সামনে তাকিয়ে দেখল—একটি মা তার বাচ্চার হাত ধরে রাস্তা পার হচ্ছে। আর একটু এগোতেই সে স্তব্ধ হয়ে গেল— আরেকজন মা তার বাচ্চাকে নিয়ে, একইভাবে রাস্তা পার হচ্ছে! সব কিছু যেন রিপ্লে হচ্ছে! কিন্তু মানুষগুলো আলাদা আলাদা।
সে ধীরে ধীরে ক্লিনিকের দিকে এগোল। সবাই একই রকম পোশাক পরে আছে, একই রকম হাসছে, একই কায়দায় তাকে শুভ সকাল জানাচ্ছে! তার রিসেপশনিস্ট রুবিনা প্রতিদিনের মতই বলল, “গুড মর্নিং, স্যার! আজকের প্রথম অ্যাপয়েন্টমেন্ট ৯টায়!” কিন্তু আজ রুদ্র প্রথমবার লক্ষ্য করল, তার চোখে কোন অভিব্যক্তি নেই! এতদিন ধরে সে প্রতিদিন এই অফিসে এসেছে, এই মানুষগুলোকে দেখেছে, কিন্তু আজ মনে হচ্ছে তারা নিখুঁত একটা চক্রের মধ্যে আটকে আছে। রুদ্র ধীরে ধীরে নিজের চেম্বারে ঢুকল।
চেয়ারে বসে মাথা দু’হাতে চেপে ধরল। রুদ্রের দম বন্ধ হয়ে আসছিল। সে চেয়ারের পিছনে হেলে পড়ল, আর তখনই চেম্বারের দরজায় ধীর শব্দ হ’ল।
টোক, টোক, টোক—কেউ এসেছে! কিন্তু আজ কি আসলেই কারও অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিল? সে ধীরে ধীরে বলল, “ভিতরে আসুন।”
দরজা খুলে গেল। একজন নারী ধীরে ধীরে ভেতরে ঢুকল। মীরা সেন! কিন্তু, সে তো… রুদ্রের হাতের তালুতে ঠান্ডা ঘাম জমতে লাগল।
মীরা ধীরে ধীরে চেয়ার টেনে বসে বলল, “আমার মনে হচ্ছে, আমি একটা দুঃস্বপ্নে আটকে আছি, ডাক্তার।”
রুদ্র স্তব্ধ হয়ে গেল। তার ঠোঁট কাঁপছিল। সে কোন কথা বলতে পারছিল না। মীরা তাকিয়ে বলল, “আমি কি পাগল হয়ে যাচ্ছি?”
রুদ্র উঠে দাঁড়াল। তার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসছে। মীরা সেন এখানে কীভাবে? সে এক মুহূর্ত অপেক্ষা না করেই চেম্বারের দরজা ধাক্কা দিয়ে বেরিয়ে এল।
“এটা সত্যি হতে পারে না! এটা সম্ভব না!”
চোখের সামনে সব কিছু কেমন যেন ঘোলাটে লাগছে। সে দ্রুত করিডর পেরিয়ে রিসেপশনের দিকে ছুটল। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হল, তার স্টাফরা এতটুকুও চমকাল না, একটুও নড়ল না। রুবিনা ঠিক আগের মতই ডেস্কে বসে আছে, কম্পিউটারের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে। বাকি কর্মচারীরাও তাদের নির্দিষ্ট কাজে মগ্ন। রুদ্র থমকে দাঁড়াল।
“এরা কি মানুষ? নাকি নিছক প্রোগ্রাম করা চরিত্র?”
না, এসব ভাববার সময় নেই! সে আর এক মুহূর্তও এখানে থাকবে না। সে দ্রুত দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এল। বাইরে বিকেলের আলো ম্লান হয়ে আসছে। রুদ্র এক দৌড়ে নিজের গাড়ির দিকে এগোল। গাড়িতে উঠে দরজা বন্ধ করল, চাবি ঘুরিয়ে স্টার্ট দিল। ইঞ্জিনের গর্জন তার বুকে এক অদ্ভুত সাহস এনে দিল। “শহর ছাড়তে হবে! যত দ্রুত সম্ভব!” সে রাস্তার দিকে গাড়ি এগিয়ে দিল। সামনে হাইওয়ে, যেখানে শহরের সীমানা শেষ হয়। গাড়ির গতি বাড়তে লাগল রুদ্রের নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসছে। সে জানে না কেন, কিন্তু তার ভেতরে একটা প্রবল ভয় জন্মেছে। এ শহর ছেড়ে যেতে হবে! এখনই!
গাড়ির ইঞ্জিন গর্জে উঠল, টায়ার ঘষটে গেল রাস্তায়। সামনে মূল হাইওয়ে, যেখানে শহর শেষ হয়। সে রাস্তা ধরে দ্রুত এগিয়ে চলল। চারপাশের বাতাস থমথমে। রাস্তার বাতিগুলো একটার পর একটা জ্বলছে, নিভছে। সিটি সেন্টার থেকে দূরে যেতে যেতে লোকজন কমে আসছে। রুদ্র একদৃষ্টিতে সামনে তাকিয়ে রইল। শহরের শেষ প্রান্তের কাছাকাছি এসে বুকের ভেতর হালকা স্বস্তির অনুভূতি এল। “এবার বেরিয়ে যেতে পারব!”
কিন্তু হঠাৎ কিছু একটা খটকা লাগল। বাম দিকে একটা মুদি্র দোকান, তার পাশে একটা পুরনো চায়ের স্টল, একটু দূরে একটা ফার্মেসি। এগুলো খুব চেনা লাগছে। কিন্তু সে তো কখনও এই রাস্তা দিয়ে শহরের বাইরে যায়নি। তাহলে এগুলো চেনা লাগছে কেন? কিছু বুঝে ওঠার আগেই সামনে একটা সিগন্যাল পড়ল। সে গাড়ি থামিয়ে সিগন্যালে দাঁড়াল। সিগন্যাল সবুজ হতেই সে আবার গতি বাড়াল। হাইওয়ের দিকে এগিয়ে চলল।
কিন্তু পাঁচ মিনিট পর… তার চোখ হঠাৎ আতঙ্কে বিস্ফারিত হয়ে গেল। বাম দিকে সেই একই মুদির দোকান, তার পাশে সেই একই চায়ের স্টল, আর একটু দূরে সেই একই ফার্মেসি! “এটা কীভাবে সম্ভব?” সে তো এই জায়গা পেরিয়ে এসেছিল! না কি ভুল দেখছে? সে মাথা ঝাঁকাল, গতি আরও বাড়াল। এইবার সোজা হাইওয়ের দিকে এগোল। কিন্তু, আরও পাঁচ মিনিট পর সে আবার সেই একই জায়গায় ফিরে এল! সেই একই দোকান, একই রাস্তা!
রুদ্রের হাত-পা ঠান্ডা হয়ে এল। সে ব্রেক কষে গাড়ি থামাল। বাইরে তাকিয়ে দেখল, সবকিছু নিখুঁতভাবে আগের মতই আছে, কোন পরিবর্তন নেই! “আমি কি কোন লুপের মধ্যে পড়ে গেছি?” সে দ্রুত গাড়ি ঘুরিয়ে উল্টো পথে চালাতে লাগল। এইবার অন্য একটা রাস্তা নিল, যেখানে সে আগে কখনও যায়নি। একটু স্বস্তি পেল, মনে হল এবার বেরিয়ে যেতে পারবে।
কিন্তু, আরও পাঁচ মিনিট পর সামনে সেই একই রাস্তা! সেই একই দোকান! সেই একই পরিবেশ! “এটা অসম্ভব! আমি তো অন্য রাস্তা নিয়েছিলাম!”
তার নিঃশ্বাস দ্রুত হয়ে আসছে। সে একবার গাড়ি থামাল, চারপাশে তাকাল। একটা লোকও নেই, শুধু শুনশান রাস্তা। সে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। গাছগুলোও যেন একরকম! তারপর সে আবার গাড়ির দরজা বন্ধ করে দ্রুত গাড়ি স্টার্ট দিল। এবার যে করেই হোক বের হতেই হবে! সে রাস্তায় গতি বাড়াল, একের পর এক মোড় ঘুরতে লাগল, যেন কোনভাবে এই জায়গা থেকে বেরিয়ে যেতে পারে। কিন্তু কোন লাভ হল না। সেই একই রাস্তা! সেই একই দোকান! সে এক অসীম চক্রের মধ্যে আটকে গেছে! রুদ্রের শরীর ঠান্ডা হয়ে এল। তার চোখ বিস্ফারিত হয়ে গেল। গাড়ির জানালা দিয়ে চেয়ে দেখল, আকাশের রঙ বদলে গেছে। সন্ধ্যার আলোয় শহরটা যেন আরও বেশি অদ্ভুত লাগছে। সে ধীরে ধীরে উপলব্ধি করল, এই শহর ছেড়ে যাওয়া সম্ভব নয়! রুদ্রের দম বন্ধ হয়ে আসছিল। গাড়ির স্টিয়ারিং শক্ত করে ধরে রেখেছিল সে, কিন্তু কিছু বুঝে ওঠার আগেই তার দৃষ্টিতে একটা ঝাপসা পর্দা নেমে এল। চারপাশের সবকিছু কেমন যেন দুলে উঠল। আর তারপর…
তার চোখ খুলল নিজের এপার্টমেন্টের বিছানায়! রুদ্র হুড়মুড় করে উঠে বসল। তার শ্বাস দ্রুত চলছে, কপাল ঘামাচ্ছে। বিছানার পাশের টেবিলে রাখা ঘড়িটা সকাল ৭:৩০ দেখাচ্ছে। বাইরে সূর্যের আলো আস্তে আস্তে উজ্জ্বল হচ্ছে। “আমি কি… আমি কি স্বপ্ন দেখছিলাম?” সে দ্রুত নিজের শরীরে হাত দিয়ে দেখল—সব ঠিকঠাক। সে বিছানায় বসে আছে, তার নিজের পরিচিত ঘরে। সবকিছু স্বাভাবিক। তার বুক ধীরে ধীরে স্বস্তির শ্বাসে ওঠানামা করতে লাগল।
রুদ্র ধীরে ধীরে বিছানা থেকে নামল।ঘরের দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এল। লিভিং রুমে সবকিছু আগের মতই সাজানো। সামনের জানালা দিয়ে সে নিচে রাস্তার দিকে তাকাল। লোকজন স্বাভাবিকভাবে হেঁটে যাচ্ছে, গাড়িগুলো চলছে, সব ঠিকঠাক আছে।
“হয়তো সবটাই দুঃস্বপ্ন ছিল।”
সে মাথা ঝাঁকাল, নিজের মনকে বোঝানোর চেষ্টা করল। সে নিজের ঘরের বাইরে বেরিয়ে রাস্তায় এসে দাঁড়াল। সে ধীরে ধীরে রাস্তা ধরে হাঁটতে লাগল। তার পাশ দিয়ে লোকজন যাচ্ছে, কিন্তু সবাই যেন একটু অদ্ভুত। কারও চোখে একটুও প্রাণ নেই। একজন লোকের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় সে লক্ষ্য করল, লোকটা কোন অনুভূতি ছাড়াই একদৃষ্টিতে সামনের দিকে তাকিয়ে হাঁটছে। আরেকটা বাচ্চা রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু সে নড়ছে না, কেবল একদিকে তাকিয়ে আছে। রুদ্রের বুক ধক করে উঠল।
“আমি কি আসলেই জেগে আছি? নাকি এখনও সেই লুপের মধ্যেই?”
তখনই তার ফোন বেজে উঠল। সে দ্রুত ফোন বের করে দেখল—অজানা নাম্বার। সে কল রিসিভ করল। ফোনের ওপাশ থেকে একটা ফিসফিসে কণ্ঠস্বর ভেসে এল—”তুমি তো এখনও বুঝতে পারনি, রুদ্র…”
রুদ্রের সারা শরীর শিউরে উঠল। রুদ্রের সারা শরীর কাঁপছে। ফোনের ওপাশের সেই অদ্ভুত কণ্ঠস্বর এখনও তার কানে বাজছে—”তুমি এখনও ঘুমোচ্ছ!” তার কপাল ঘামে ভিজে গেছে। চারপাশে তাকিয়ে দেখল, রাস্তায় সবকিছু স্বাভাবিক মনে হলেও, তার ভেতরের অনুভূতি বলছে কিছু একটা ঠিক নেই! ঠিক তখনই, তার পিছন থেকে ভারী বুটের শব্দ শোনা গেল। সে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকানোর আগেই দুইজন শক্তসমর্থ লোক তার দুই হাত ধরে ফেলল!
“এই! ছাড়ো আমাকে!” রুদ্র চিৎকার করল।
কিন্তু আরও দুজন এসে তার পা চেপে ধরল! তারা সবাই সাদা হাসপাতালের পোশাক পরা, মুখে অদ্ভুত শূন্য দৃষ্টি। কেউ কোন কথা বলছে না, কেবল শক্ত করে তাকে ধরে রেখেছে। তারপর একজন একটা ইনজেকশন বের করল!
“না! না! এটা কী করছো!”
রুদ্র শেষ চেষ্টা করল হাত ছাড়ানোর, কিন্তু শক্ত হাতে তারা তাকে ধরে রাখল। ইনজেকশন তার গলায় ছুঁই ছুঁই… তারপর সবকিছু অন্ধকার হয়ে গেল।
রুদ্রের চোখ ধীরে ধীরে খুলল। তার মাথা ভারী লাগছে। সে শুয়ে আছে একটা ছোট, সাদা ঘরে। একটা একদম সাদামাটা বেড, পাশে একটা ছোট টেবিল, দেওয়ালে একটা ঘড়ি টিক টিক করে চলছে। এই জায়গাটা খুব পরিচিত লাগছে। সে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল—এটা তো তার নিজের হাসপাতালের একটা কেবিন! কিন্তু, সে এখানে কেন? না, এটা সম্ভব না! সে ধীরে ধীরে উঠে বসতে গেল, কিন্তু তখনই বুঝতে পারল, তার দুই হাত এবং দুই পা শক্ত করে স্ট্র্যাপে বাঁধা!
“এই! এখানে কেউ আছে? ছাড়ো আমাকে!”
সে চিৎকার করতে লাগল, কিন্তু বাইরে কোন সাড়াশব্দ নেই। কেবল ঘড়ির কাঁটা টিক টিক করছে, যেন সময় আটকে আছে। কেউ কি তাকে বন্দি করেছে? ঠিক তখনই দরজার ওপাশে ধীর পদক্ষেপের শব্দ শোনা গেল। কেউ একজন আসছে! রুদ্র শ্বাস আটকে অপেক্ষা করল। রুদ্র নিঃশ্বাস আটকে তাকিয়ে আছে। দরজাটা ধীরে ধীরে খুলল।
ভেতরে ঢুকল এক পরিচিত মুখ—মীরা! কিন্তু আজ তার পরনে নীল-সাদা ডাক্তারদের পোশাক। তার চোখে ভারী চশমা, হাতে একটা ক্লিপবোর্ড। রুদ্র হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।
“মীরা? তুমি এখানে?”
কিন্তু মীরা ধীরে ধীরে তার দিকে এগিয়ে এল, মুখে কো আবেগ নেই। তারপর সে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল এবং খুব স্পষ্ট গলায় বলল—
“তুমি কোন ডাক্তার নও, রুদ্র। তুমি একজন রোগী।”
রুদ্রের শরীর কেঁপে উঠল। “কী… কী বলছো? এটা কেমন রসিকতা?”
মীরার চোখে একটুও মজা নেই। সে কেবল মাথা নেড়ে বলল, “তুমি সিরিয়াল কিলার, রুদ্র।”
রুদ্রের চোখ বিস্ফারিত হয়ে গেল।
“না! এটা মিথ্যে! আমি তো একজন মানসিক রোগের ডাক্তার! আমার নিজের ক্লিনিক আছে!”
মীরা ক্লিপবোর্ডের পাতা উল্টাল। তারপর শান্তভাবে বলল, “তুমি যা ভাবছো, সবটাই তোমার মনের তৈরি একটা বিকৃত কল্পনা। এটা কোন আসল শহর নয়। এটা আসলে একটা বিশেষ চিকিৎসা কেন্দ্র, যেখানে ভয়ঙ্কর মানসিক রোগীদের রাখা হয়।”
রুদ্রের কানে যেন শব্দ ঢুকছে না। তার মাথার ভেতর সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।
“তুমি মিথ্যে বলছো! আমি তো আমার অ্যাপার্টমেন্টে থাকি! আমি তো রোজ রাস্তায় বের হই! রোজ ক্লিনিকে যাই!”
মীরা ধীর গলায় বলল, “সত্যিই কি তাই?”
রুদ্রের শ্বাস ভারী হয়ে এল। সে মনে করার চেষ্টা করল—তার অ্যাপার্টমেন্ট, তার রুটিন, তার ক্লিনিক। কিন্তু, হঠাৎই তার মনে হল, সে কি সত্যিই মনে করতে পারছে? তার ঘরের রঙ কেমন? তার ক্লিনিকের ঠিকানা কী? তার কতজন রোগী আছে? কোন কিছুই স্পষ্ট মনে আসছে না! সব যেন অস্পষ্ট ধোঁয়ার মত মিলিয়ে যাচ্ছে! মীরা আবার বলল—”তুমি গত এক বছর ধরে এই কেন্দ্রে আছো, রুদ্র। এখানে তোমার জন্যই এই শহরের মত পরিবেশ বানানো হয়েছে, যাতে তুমি স্বাভাবিক আচরণ করতে পারো। কিন্তু তুমি বারবার খুনের প্রবণতা দেখাচ্ছ। এই শহরের অনেক মানুষ আসলে তোমার অবচেতন মন তৈরি করেছে। তারা বাস্তবে নেই।”
রুদ্রের মাথা ঝিমঝিম করছে। এই হাসপাতালের ঘরটা যেন সংকুচিত হয়ে আসছে।
“না! এটা সত্যি হতে পারে না!”
কিন্তু তার মাথায় হঠাৎ করে ঝাপটা দিয়ে কিছু দৃশ্য এল—রক্তে ভেজা একটা ঘর। একটা নিথর দেহ পড়ে আছে মেঝেতে। তার হাত শক্ত করে একটা ছুরি চেপে আছে। তার নিঃশ্বাস ধকধক করছে, চোখের সামনে শুধু অন্ধকার আর লালচে রঙের দোলা।
“আমি… আমি খুন করেছিলাম?”
রুদ্র চিৎকার করে উঠল, “না! এটা মিথ্যে! আমি খুনি নই! আমি খুনি নই!” বলতে বলতে রুদ্র আবার জ্ঞান হারাল নার্সের একটা ইনজেকশনে।
রাত গভীর। রুদ্রের জ্ঞান ফিরলো হাসপাতালের করিডরে নিস্তব্ধতা। দূরে একটা হার্ট মনিটরের একটানা বিপ… বিপ… শব্দ ছাড়া আর কোন আওয়াজ নেই। রুদ্রের নিঃশ্বাস দ্রুত উঠানামা করছে। তার হাতের স্ট্র্যাপ তখনও শক্ত করে বাঁধা। সে জানে, এটা তার একমাত্র সুযোগ। কিন্তু সাদা দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে মনে হল—এখান থেকে বেরোনো অসম্ভব। সে বুঝতে পারল, বাঁধন যতই শক্ত হোক, এর একটা দুর্বল জায়গা থাকবেই। সে চোখ বন্ধ করল, শ্বাস নিল ধীরে ধীরে। তারপর শরীর আলগা করে দিল, যেন সম্পূর্ণ শিথিল হয়ে গেছে। একটা কৌশল আছে— যদি কেউ নিজের হাতকে শিথিল রেখে বাঁধন শক্ত করার সময় একটু জায়গা রেখে দেয়, তাহলে সেটি আস্তে আস্তে আলগা করা সম্ভব। রুদ্র তার হাতের কবজি ধীরে ধীরে মোচড়াতে লাগল। ব্যথা লাগছিল, চামড়ার নিচে রক্ত জমাট বাঁধছিল। কিন্তু সে জানে, এটাই একমাত্র উপায়! একটু একটু করে চামড়ার ঘর্ষণে স্ট্র্যাপটা আলগা হয়ে আসছে। স্ট্র্যাপটা প্রায় খুলে এসেছে। কিন্তু এখনও বাঁধা আছে! সে একটা ঝাঁকুনি দিল! ডান হাত মুক্ত! সে দ্রুত বাম হাতের স্ট্র্যাপ খুলে নিল। এখনও অনেক কাজ বাকি। সে এক নজরে চারপাশ দেখল—দরজার বাইরে ওয়ার্ডবয় হাঁটছে। এখন তার একটাই লক্ষ্য—এই নরক থেকে বের হতে হবে!
অন্ধকার ঘর থেকে বেরিয়ে সে করিডরে পা রাখল। চারদিকে নীলচে আলো জ্বলছে। সে এখন আর রোগী না। সে শিকারী! একজন ওয়ার্ড বয় করিডর দিয়ে আসছিল। রুদ্র ধীরে ধীরে দেওয়ালের ছায়ায় মিশে গেল। ঠিক যখন লোকটি পাশ কাটাল, রুদ্র তার পিছনে ঝাঁপিয়ে পড়ল! গলা চেপে ধরল—লোকটি ছটফট করছে, হাত-পা ছোঁড়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু রুদ্র জানে, চুপ থাকাটা এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। মাত্র কয়েক সেকেন্ড। লোকটি নিস্তেজ হয়ে গেল। সে লাশটা টেনে নিয়ে একটা স্টোররুমে ঢুকিয়ে দিল। তার হাতে এখন একটা ছোট্ট ধারালো অস্ত্র— একজোড়া চিকিৎসার কাঁচি। এবার সে বাইরে বেরোবে। কিন্তু ঠিক তখনই—দুইজন নার্স করিডর দিয়ে আসছিল। তারা রুদ্রকে দেখেই চমকে উঠল! একজন কিছু বলার আগেই রুদ্র ঝাঁপিয়ে পড়ল। ধারালো কাঁচিটা এক নার্সের গলায় বসিয়ে দিল! রক্তের ধারা গড়িয়ে পড়ছে ফ্লোরে… আরেকজন চিৎকার করার আগেই রুদ্র তার মুখ চেপে ধরে… ধাক্কা দিয়ে তাকে দেওয়ালের সাথে আছাড় মারল! নার্সটা ধপ করে মাটিতে পড়ে গেল। রক্তের দাগ লেগে আছে দেওয়ালে। হাসপাতালে সতর্ক সংকেত বেজে উঠল। “সতর্কতা! রোগী নম্বর ৪৩৮ নিখোঁজ! হাসপাতালের সব দরজা বন্ধ করে দিন!”
রুদ্র দ্রুত দৌড় দিল। সে জানে, এখন যদি ধরা পড়ে, তাকে আর কেউ ছেড়ে দেবে না! সে করিডরের শেষ মাথায় গিয়ে দেখল— একটা গার্ড দাঁড়িয়ে আছে, হাতে ইলেকট্রিক ব্যাটন! গার্ড বুঝতে পেরেই ধেয়ে এলো— “থামো! নইলে মেরে ফেলব!”
কিন্তু রুদ্র থামল না। সে হঠাৎ ছুটে গিয়ে গার্ডের দিকে ঝাঁপ দিল! ব্যাটন তার পেটের কাছে লাগল, বিদ্যুতের শক খেল—কিন্তু সে দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করল! তারপর গার্ডের মাথা ধাক্কা দিয়ে দেওয়ালের সাথে লাগিয়ে দিল! গার্ডের মাথা ফেটে রক্ত ছিটকে পড়ল মেঝেতে। রুদ্র এবার গার্ডের বন্দুকটা তুলে নিল। এবার সে প্রধান গেটের দিকে এগোচ্ছে। ততক্ষণে হাসপাতালের সশস্ত্র কর্মীরা ছুটে আসছে। গোলাগুলি শুরু হয়ে গেল! রুদ্র গুলি ছুঁড়তে লাগল। তিনজন কর্মী লুটিয়ে পড়ল মাটিতে। একজন ছুটে এসে পিছন থেকে রুদ্রকে চেপে ধরল—কিন্তু রুদ্র উল্টে গার্ডের হাত মুচড়ে দিল! তারপর মাথার ঠিক পিছনে বন্দুক ঠেকিয়ে ট্রিগার টিপে দিল! “বাং!” লোকটা ধপ করে পড়ে গেল।
প্রধান গেটের কাছে একজন ডাক্তার দাঁড়িয়ে, হাতে ইনজেকশন। মীরা। তার চোখে ভয় নেই। সে ধীরে ধীরে বলল, “তুমি যদি বেরোও, রুদ্র, জানো না কোথায় যাবে।”
রুদ্র এবার বন্দুক তাক করল। কিন্তু ঠিক তখনই—মীরা হাসল।
“তুমি কি নিশ্চিত তুমি এই হত্যাগুলো করছ, নাকি কেউ তোমার মনে ঢুকিয়ে দিয়েছে?”
রুদ্র এক মুহূর্তের জন্য থমকে গেল। এই সময়ে মীরা তার হাতে ইনজেকশন ঢুকিয়ে দিল! চূড়ান্ত মুহূর্ত। রুদ্রের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। রুদ্র দৌড়ে গেট খুলল। সে ছুটে বাইরে বেরিয়ে পড়ল। হাসপাতালের লাল আলো ঝলসে উঠল তার পিছনে। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা একটা লোককে ধাক্কা দিয়ে তার গাড়ি নিয়ে দ্রুত গতিতে বেরিয়ে পড়ল হাসপাতাল চত্বরের মেন গেট ভেঙে। রুদ্রের হাত স্টিয়ারিংয়ে শক্ত হয়ে আছে। তার নিঃশ্বাস দ্রুত হচ্ছে, বুকের ভেতর অজানা এক আতঙ্ক দানা বাঁধছে। ২ ঘন্টা ধরে শহরের বাইরে যাবার রাস্তা সে কতবার পেরনোর চেষ্টা করেছে, কিন্তু এখনও সে এখানেই!
গাড়ির স্পিডোমিটার ১৭০ কিমি/ঘণ্টা। চারপাশে কিছুই নেই, শুধু অন্ধকার রাস্তা, আর রাস্তার দুই পাশে অস্পষ্ট আলো ঝলসানো কিছু বিলবোর্ড। কিন্তু এবার সে ভালো করে লক্ষ্য করল—বিলবোর্ডগুলোতে তার নিজেরই ছবি!
একটাতে তার ক্লিনিকের ছবি, নিচে লেখা—”ডাঃ রুদ্র সেনগুপ্ত, সাইকিয়াট্রিস্ট”
আরেকটাতে তার নিজের মুখ, কিন্তু চোখের অংশটা অন্ধকারে ঢাকা। নিচে লেখা—”রুদ্র সেনগুপ্ত: ১৩টি হত্যার আসামী”
তারপর তৃতীয় বিলবোর্ড, এবার তার নিজের হাসপাতালের ছবি, নিচে বিশাল হরফে লেখা—”রেইভেনউড সাইকিয়াট্রিক ইনস্টিটিউট – বাস্তবতার সন্ধানে”
তার হাত কাঁপতে লাগল।
সামনের রাস্তাটা হঠাৎ বিভক্ত হয়ে গেল— একটা রাস্তা সোজা এগিয়ে গেছে অন্ধকারের দিকে। আরেকটা বাঁ দিকে, যেখানে একটা হাসপাতালের মত বিল্ডিং দূরে ঝাপসা দেখা যাচ্ছে। বাস্তব, বিভ্রম, না কি নিয়ন্ত্রণের বাইরের কিছু? রুদ্রের হাত স্টিয়ারিংয়ে স্থির। সে কোন রাস্তা নেবে? সে যদি সোজা যায়, তাহলে কি চক্র চলতেই থাকবে? আর যদি সে বাঁদিকে যায়, তাহলে কি সত্য জানতে পারবে? নাকি এটা আবার একটা মায়া?
লেখক পরিচিতি : অভি সেখ
.
সুন্দর লেখা, বেশ অন্যরকম
Thank you