লেখক : মৌলি কুণ্ডু
(১)
সম্প্রীতি আজকে সারা দুপুর ধরে ছুটছে। প্রায় পঞ্চাশ ডিগ্রি ছুঁই ছুঁই গরমে, জঙ্গুলে পথে ছুটতে ছুটতে তার প্রাণ ওষ্ঠাগত। তবু বিরাম নেই, যেভাবেই হোক তাকে আজকে রাতের মধ্যে পৌঁছতেই হবে রসুলপুর পুলিশ স্টেশনে। তার মনে পড়ছে দাদুর মুখে শোনা একটা গল্প, থুলুক্কা নাচিয়ার গল্প। গল্প শোনার সময় কখনও কি সম্প্রীতি ভেবেছিল এমন এক অবস্থায় সে নিজেও কোনোদিন পড়বে। প্রায় আটশো বছর আগে প্রেমের জন্য প্রাণ দিয়েছিল শাহজাদী সুরাথানি ওরফে থুলুক্কা নাচিয়া। সে প্রেম মানবিক নয় ঐশ্বরিক। আজ সম্প্রীতির প্রেমও বিপদের দোলাচলে দোদুল্যমান। সে বুঝতে পারছে না, এই প্রেম মানবিক নাকি ঐশ্বরিক। সতেরো বছরের সম্প্রীতি ছুটতে ছুটতে মনের ভেতরে যেন দাদুর বলা সেই গল্পের দৃশ্যগুলো স্বচ্ছ চিকের পর্দার আড়াল থেকে দেখতে পাচ্ছে।
দিল্লির মসনদে তখন আলাউদ্দিন খিলজীর রাজত্ব। তার আদেশে লাল কালো ঝড়ের মেঘের মতো ধেয়ে চলেছে মালিক কাফুরের সুলতানী সেনাবাহিনী। তাদের হাতে নানা রকমের অস্ত্র। কাড়া নাকাড়া আর রণডঙ্কার ঝঙ্কার তুলে তারা এগিয়ে চলেছে। মত্ত হস্তী পিঠে বড় বড় কাঠের গুঁড়ি আর হাতুড়ি সঙ্গত করে তারা এগিয়ে যাচ্ছে। কোনো মন্দির, দেবালয় আর আস্ত রাখবে না সুলতানী সেনা। ধুলোর মতো গুঁড়ো করে মিশিয়ে দেবে মহাকালের মহাজঠরে। লুট করে নিঃশেষিত করবে দেবালয়ের সমস্ত সম্পদ। মন্দিরের স্বর্ণবিগ্রহ তাদের কাছে একদলা সোনার তাল মাত্র। শত শত মন্দির এভাবেই তারা ধ্বংস করেছে। মন্দিরের দেবদাসীরা তাদের হাতে লাঞ্ছিত, নির্যাতিত হয়েছে। রেহাই পায়নি পুরোহিত আর ভক্তরাও। তাদের কুটি কুটি করে কেটেছে সুলতানী সেনা। অবশেষে তারা এসে পৌঁছল কাবেরী আর কালিডোম নদীর মাঝে একটা দ্বীপে। শ্রীরঙ্গপত্তনমে রঙ্গনাথস্বামীর মন্দিরের কাছে। সে এক বিশাল মন্দির চত্বর। মালিক কাফুরের সেনা, সে মন্দির দেখে হাঁ হয়ে গেল। মন্দিরে তখন উৎসবের মেজাজ কিছুদিনের মধ্যেই রঙ্গনাথস্বামীর স্নানযাত্রা উৎসব। চারিদিকে সাজ সাজ রব। ইতিমধ্যে মন্দিরের প্রধান পুরোহিত খবর পেলেন মালিক কাফুরের সেনা মন্দিরের সীমানায় উপস্থিত হয়েছে। প্রধান পুরোহিত সেবায়েতদের আদেশ দিলেন,
“মন্দিরের চারদিকে বিশাল দেওয়াল তুলে দাও। দেওয়ালের ওপর থেকে অস্ত্র, পাথর ছুঁড়ে আমরা সেনাদলকে দূর করে দেব।”
দেওয়াল তোলার কাজ শুরু হল। তিনদিন ধরে কাজ চলল। কিন্তু কাজ শেষ হবার ঠিক আগের মুহূর্তে বাঁধ ভাঙা বন্যার জলের মতো ধেয়ে এলো মালিক কাফুরের সেনা। নিমেষের মধ্যে তারা মন্দিরের নিরীহ সেবায়েত আর পূজারীদের আক্রমণ করে শেষ করে দিল। লুঠ করে নিল সমস্ত মন্দিরের ঐশ্বর্য, গয়নাগাটি, সোনার মূর্তি। প্রধান পুরোহিতের অনেক অনুনয় বিনয়ে মন্দির অবশ্য ভাঙা হয়নি। সব লুঠ করা জিনিস নিয়ে যাওয়া হয় দিল্লিতে, সুলতান আলাউদ্দিন খিলজীর কাছে। খিলজী সেইসব সোনা গলিয়ে রাজকোষে জমা করতে বললেন। সেই সময়ে সেখানে এসে উপস্থিত হল আলাউদ্দিনের কন্যা শাহজাদী সুরাথানি। মন্দির থেকে লুঠ করা জিনিসপত্রের ওপর তার চোখ পড়ল। সুলতান তাকে বললেন,
“দেখলো বেটি, ইনমেসে কুছ তুমহে চাহিয়ে তো লে সকতি হো। নেহি তো ইয়ে সব শাহী খাজানে মে জমা কিয়া যায়েগা।”
ততক্ষণে শাহজাদী সুরাথানির চোখ আটকে গেছে একটা অপূর্ব কারুকার্যময় সুন্দর মূর্তির ওপর। সে সুলতানকে বলল,
“ আব্বাহুজুর, কেয়া ইয়ে মূর্তি ভি জায়েগি আপকে খাজানে মে? কেয়া আপ তোড় দেঙ্গে ইসে?”
“ইরাদা তো ইয়েহি হ্যায় বেটি। কেয়া তুমহে ইয়ে চাহিয়ে?”
“হাঁ আব্বাহুজুর। কেয়া হাম ইসসে খেল সকতে হ্যায়?”
“বেশক, লে যাও ইসে, খেলো।”
শাহজাদী প্রফুল্ল চিত্তে মূর্তিটা নিয়ে চলে গেল। সুলতান মনে মনে হাসলেন। ভাবলেন দুদিন খেলবে, তারপর এরও জায়গা হবে শাহজাদীর বাতিল খেলনার দলে। আরও কিছুদিন পরে তো বড়ই হয়ে যাবে শাহজাদী। তখন নিজের আস্ত একটা সংসার থাকবে খেলার জন্য। কিন্তু ঈশ্বরও বোধহয় আড়ালে তখন হেসেছিলেন। তার যে সুরাথানিকে নিয়ে তখন অন্য পরিকল্পনা।
শাহজাদী সুরাথানি নতুন পুতুল পেয়ে তাকে নিয়ে এক নতুন খেলায় মশগুল হয়ে পড়ল। সে সারাদিন ধরে রঙ্গনাথস্বামীকে স্নান করায়, খাওয়ায়, নানারকম পোশাক পড়ায়, গান গেয়ে ঘুম পাড়ায়, নাচ দেখায়। এরকম কিছুদিন চলার পর সুরাথানির সাথে ঘটল এক অদ্ভূত ঘটনা। রাতে মহলে সবাই ঘুমিয়ে পড়লে শাহজাদীর খেলনা মূর্তিতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা হলো। রাতে এক সুন্দর শাহজাদার বেশে মূর্তি ডেকে উঠল,
“উঠো শাহজাদী।”
শাহজাদার মনোমুগ্ধকর রূপে সুরাথানি মোহিত হয়ে পড়ল। তারা দুজনে লিপ্ত হয় নতুন এক খেলায়। শাহজাদীর জীবনে আগমন হয় এক নতুন বসন্তের। এই অদ্ভূত খেলার নায়ক রঙ্গনাথস্বামী। তার কখনো গরু চড়ানো গোয়ালার বেশ, কখনো সে বংশীধারী ত্রিভঙ্গ মুরারি, আবার কখনো তার রাজবেশ। সুরাথানি প্রতি রাতে নতুন নতুন রূপে তাকে পায়। কিন্তু নিয়তি যে বড়ই নিষ্ঠুর। কিছুদিনের মধ্যেই সুরাথানির ওপর বিচ্ছেদের নিদারুণ অভিশাপ নেমে আসে।
রঙ্গনাথস্বামীর মন্দিরের একদল সেবায়েত পণ করে, যেভাবেই হোক ঈশ্বরকে তাঁর মন্দিরে ফিরিয়ে আনবেই। সেই উদ্দেশ্যে তারা নাচিয়ার বেশে দিল্লী রাজদরবারের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। সুলতান আলাউদ্দিনের সামনে নৃত্যগীত পরিবেশনার অনুমতিও তারা জোগাড় করে। সারা রাত ধরে চলে তাদের নাচগানের আসর। অবশেষে নাচিয়ার দল সুলতানকে খুশী করতে সফল হল। সুলতান ঘোষণা করলেন,
“বহুত খুব। মন চাহা ইনাম মিলেগা। মাঙ্গো, জো মাঙ্গনা হে।”
নাচিয়ার দল বলল,
“আমাদের আর কিচ্ছু চাই না হুজুর। শুধু আমাদের ভগবানকে ফিরিয়ে দিন।”
তখন সুলতান পড়লেন মহা ফাঁপরে। এদের ভগবান মানে তো ভগবানের মূর্তি। সেটাতো তিনি দিয়ে দিয়েছেন নিজের মেয়েকে। মেয়েকে দেওয়া জিনিস তিনি ফেরত নেবেন কিভাবে? তার ওপর তিনি শুনেছেন শাহজাদীর সেই খেলনা খুব পছন্দ হয়েছে। এক মুহুর্তও সেই খেলনা সে কাছছাড়া করে না। শাহজাদীর পছন্দের জিনিস তিনি কি করে কেড়ে নেবেন? ভেবেচিন্তে তিনি শাহজাদীর খাস বাঁদিকে হুকুম দিলেন,
“শাহজাদী যব শো যায়ে, উওহ মূর্তি উঠাকার লে আনা।”
বাঁদি সুলতানের কথা মতোই কাজ করল। ঘুমন্ত রাজকন্যার পাশ থেকে তার সাধের খেলনা তুলে নিয়ে এলো চুপিসারে। সুলতান সেই মূর্তি তুলে দিলেন নাচিয়াদের হাতে। সেই সাথে দিলেন অনেক ইনাম। নাচিয়ারা সুলতানকে অনেক সালাম জানিয়ে মূর্তি নিয়ে চলে গেল। এদিকে সুরাথানি ঘুম থেকে উঠে তার প্রিয় রঙ্গনাথস্বামীকে না দেখতে পেয়ে পাগলের মতো হয়ে গেল। সারা মহল জুড়ে ভাংচুর করতে লাগল। তার অবস্থা দেখে এক বাঁদি তাকে সব কথা জানাল। তখন সুরাথানি ভাবল আব্বাহুজুর তো আর ওই মূর্তি তাকে ফিরিয়ে দেবেন না। তাহলে উপায়? অনেক ভেবে সিদ্ধান্ত নিল যে সে নিজেই যাবে মূর্তি উদ্ধার করতে। রাতে যখন সকলে ঘুমিয়ে পড়ল, তখন সে সকলের চোখের আড়ালে একটা ঘোড়া নিয়ে বেরিয়ে পড়ল জঙ্গলের পথে। কিন্তু সকাল হতেই সে কথা আর চাপা থাকল না। কথাটা সুলতানের কানে গিয়ে উঠল। আর সঙ্গে সঙ্গে সুলতান সেনা পাঠাল সুরাথানিকে উদ্ধার করার জন্য।
অন্যদিকে নাচিয়ার দল ভেবেছিল, রাজপথে গেলে সুলতানের সেনা দেবতার মূর্তি দেখে তা কেড়ে নিতে পারে। জঙ্গলের পথে যাওয়াই ভালো। সুরাথানিকে উদ্ধার করার জন্য যে সেনাদল বেরিয়েছিল তারাও জঙ্গলের পথ ধরল। নাচিয়ার দল শুনতে পেল একদল ঘোড়সাওয়ার তাদের দিকে এগিয়ে আসছে। তারা সন্ত্রস্ত হয়ে ভাবতে লাগল কি করা যায়।
(২)
সম্প্রীতির চটক ভাঙল কিছু মানুষের পদশব্দ শুনতে পেয়ে। সত্যি কি চটক ভাঙল, নাকি সে তার কল্পনার জগতে এখনও বিচরণ করছে? আর শুনতে পাচ্ছে সুলতানী সেনার জঙ্গলের পথে এগিয়ে আসার শব্দ। নাঃ এ রূঢ় বাস্তব। দুর্যোগের মেঘ যেন বেদনায় বিক্ষত প্রতিমাকে চাবুক মেরে নাড়িয়ে দিয়ে গেল। সম্প্রীতি ভাবল, ক’টা বাজল এখন, গুন্ডারা কি বড়া মসজিদে পৌঁছে গেছে? আর মুস্তাক ওদের হাতে ধরা পড়েছে। আকাশে তখন গোল থালার মতো চাঁদ উঠেছে। দিনটা ছিল পূর্ণিমা। কিন্তু আকাশটা মেঘলা, তাই জোছনার তেমন জোর নেই। মেঘ অবশ্য স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকছে না, ঝোড়ো হাওয়ায় মুখে আঁচল এসে পড়ার মতো মাঝে মাঝেই চাঁদটাকে ঢেকে দিচ্ছে। সম্প্রীতি একটা বিশাল পাথরের আড়ালে লুকিয়ে পড়ল। ওই যে কালো কাপড়ে মুখ ঢাকা কিছু লোককে দেখা যাচ্ছে চাঁদের আলোয়। তারা বলাবলি করছে,
“খবর পাক্কা আছে সতু। একদল মুসলিম আমাদের প্ল্যান জানতে পেরে গেছে, তারা রসুলপুর পুলিশ ফাঁড়িতে খবর দিতে যাচ্ছে। টর্চ জ্বেলে খুঁজে দেখ ভালো করে। তারা এই পথ দিয়েই তো যাওয়ার কথা। দেখতে পেলেই একদম খতম করে দিবি।”
গুন্ডাদের টর্চের আলো অন্ধকারের জাল কেটে সব রহস্যকে আড়াল থেকে টেনে বার করে আনতে চাইল। কিন্তু কোনোভাবে সম্প্রীতি সেই আলোর আঘাত থেকে বেঁচে গেল। সে শ্বাস বন্ধ করে বসে রইল, যাতে নিশ্বাসের শব্দ পেয়েও কেউ তার অস্তিত্ব জানতে না পারে। লোকগুলো বিভ্রান্ত হয়ে অন্যদিকে চলে গেল। তখন সম্প্রীতি কোনরকমে বেড়াল পায়ে সেখান থেকে ছুটে পালাল। আরও ঘন্টাখানেক ছুটে সে পৌঁছে গেল রসুলপুর পুলিশ ফাঁড়িতে। ক্লান্তি আর অবসাদে তখন তার বুকের খাঁচা থেকে প্রাণ পাখি উড়ে বেরিয়ে যেতে চাইছে। পুলিশ স্টেশনে গিয়ে সে সামনে যে কনস্টেবলকে পেল তাকে বলল,
“তাড়াতাড়ি চলুন স্যার চাঁদপুরে। ওখানকার বড়া মসজিদ আজ রাতে উড়িয়ে দেবার প্ল্যান করা হচ্ছে।”
এটুকু বলেই সে লুটিয়ে পড়ল মাটিতে। চাঁদপুরের বড়া মসজিদ তৈরি হয়েছিল প্রাচীন এক রাধাকৃষ্ণের মন্দিরের ওপর। এই তথ্য, প্রমাণ হবার পর থেকেই একদল সন্ত্রাসবাদী গুন্ডা চাঁদপুরে দাঙ্গা লাগানোর চেষ্টা করছিল। শুধু হিংসাত্মক বক্তৃতা আর খুনোখুনিতে কাজ না হওয়ায় তারা বড়া মসজিদ ভাঙার পরিকল্পনা করছে। পুলিশের কাছে সে খবর ছিল। তবে তা যে এতো তাড়াতাড়ি হবে তা কেউ আন্দাজ করতে পারেনি। পুলিশের বড়কর্তা সাবির আহমেদ নিজে যতটা পারল ফোর্স জুটিয়ে চাঁদপুরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করার জন্য প্রস্তুত হলো। জলটল খেয়ে তখন সম্প্রীতি সামান্য সুস্থ হয়েছে। সে বলে উঠল,
“আমিও যাব আপনাদের সঙ্গে।”
তাকে সাথে নিয়ে যাবার ইচ্ছা কারোর ছিল না। কিন্তু তখন আর বাকবিতন্ডার সময় নেই। তাই সম্প্রীতিকেও জিপে তুলে নেওয়া হল। ক্লান্তিতে তখন সম্প্রীতির চোখ বুজে আসছে। সে যেন চোখের সামনে দেখতে পেল সুলতানী সেনা দাঁড়িয়ে আছে নাচিয়াদের দলের সামনে। সেনাদের সামনে দেখে নচিয়ার দল জঙ্গলের মধ্যে ছত্রভঙ্গ হয়ে এদিক ওদিক ছুটতে লাগল। যার কাছে রঙ্গনাথস্বামীর মূর্তি ছিল সে মূর্তিটাকে একটা গাছের নীচে পুঁতে রাখল। এদিকে সেনারা শাহজাদীকে খুঁজে না পেয়ে ক্ষেপে ছিল। তারা নাচিয়াদের মারতে শুরু করল। মূর্তিটা যে লুকিয়ে রেখেছিল সেও সেনাদের হাত থেকে রক্ষা পেল না। সে মারা গেলে রঙ্গনাথস্বামীর মূর্তি কোথায় লুকোনো রইল সে কথা আর কেউ জানতে পারল না।
অন্যদিকে শাহজাদী সুরথানি অনেক কষ্ট করে শেষ পর্যন্ত শ্রীরঙ্গপত্তনমে রঙ্গনাথস্বামীর মন্দিরে পৌঁছায়। কিন্তু সেখানে গিয়ে লোকমুখে জানতে পারে রঙ্গনাথস্বামীর মূর্তি জঙ্গলেই লুঠ হয়ে গেছে। এতটা পথ এসে ক্লান্তিতে এমনিতেই তার প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়েছিল। এই খবর শুনে রঙ্গনাথস্বামীর শোকে সুরাথানি মন্দির চত্বরেই প্রাণত্যাগ করে। ততক্ষণে সুলতানী সেনা সুরাথানির রঙ্গনাথস্বামীর মন্দিরে আসার খবর পেয়েছে। তারা এসে দেখে শাহজাদীর মৃতদেহ পড়ে আছে মন্দির চত্বরে। তারা মৃতদেহ তুলে নিয়ে যায় সুলতানের কাছে। মেয়ের মৃতদেহ দেখে সুলতান ক্রোধে আগুন হয়ে গেলেন। আর মালিক কাফুরকে আবার মন্দির ধ্বংস করতে পাঠালেন।
শ্রীরঙ্গপত্তনমে রঙ্গনাথস্বামীর মূর্তি না পেয়ে তার স্নানযাত্রার উৎসব বন্ধ হয়ে যায়। তখন মন্দিরের প্রধান পুরোহিত স্বপ্ন দেখলেন প্রভু রঙ্গনাথস্বামী তাকে বলছেন,
“কাল সকালে ঘুম থেকে উঠে প্রথম যাকে দেখতে পাবে সেই তোমাকে আমার মূর্তির কাছে নিয়ে যাবে। আর শাহজাদী সুরাথানিকে আমি স্ত্রী হিসাবে গ্রহণ করেছি। আমার মন্দিরে তাকেও পুজো করা হবে।”
পুরোহিত সকালে উঠে ঘরের দরজা খুলে দেখতে পেলেন একটা গরু। পুরোহিত ভাবলেন ও তাহলে নিছক একটা স্বপ্ন ছিল। কিন্তু তখনই গরুটা একটা নির্দিষ্ট দিকে চলতে লাগল। পুরোহিত তার পিছু নিলেন। গরুটা জঙ্গলের ভেতরে ঢুকল। তারপর বিরাট এক বটগাছের নিচে গিয়ে কয়েকটা পাথরের ওপর নিজের দুগ্ধ বর্ষণ করতে লাগল। পুরোহিত এবার সেখানে মাটি খুঁড়ে আবিষ্কার করলেন রঙ্গনাথস্বামীর মূর্তি। সেই মূর্তি মন্দিরে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হল। আর সুরাথানি থুলুক্কা নাচিয়া রূপে রঙ্গনাথস্বামীর স্ত্রী হিসাবে পূজো পেতে লাগল। ইসলাম ধর্মে মূর্তি পুজো নিষিদ্ধ তাই থুলুক্কা নাচিয়ার কোনো মূর্তি নির্মাণ করা হলো না। দেওয়ালে আঁকা তার একটা ছবিকেই পুজো করা হতে লাগল। রঙ্গনাথস্বামীকে ইসলাম ধর্মের রীতি অনুযায়ী লুঙ্গি পড়ানো হল আর ভোগ হিসাবে দেওয়া হতে লাগল ঘিয়ে ভাজা রুটি আর মিষ্টি। সুলতান আলাউদ্দিন খবর পেলেন তার মেয়ে মন্দিরের দেবী হিসাবে পুজো পাচ্ছে। তাই সেই মন্দির তিনি ভাঙার হুকুম তুলে নিলেন।
(৩)
হঠাৎ করে ব্রেক কষার ধাক্কায় সম্প্রীতির ঘুমটা ভেঙে গেল। জিপের সামনে রক্তে মাখামাখি হয়ে পড়ে আছে এক যুবক। জিপ থেকে নেমে পুলিশ যুবকটিকে পরীক্ষা করে দেখল, সে মৃত। এবার সম্প্রীতি তার সামনে গিয়ে আর্তনাদ করে উঠল,
“মুস্তাক, ওরা শেষ পর্যন্ত মুস্তাককে মেরে ফেলল…”
পুলিশের লোকেরা লক্ষ্য করল অদূরে বড়া মসজিদের সামনে একদল লোক জ্বলন্ত মশাল, আর মসজিদ ভাঙার যন্ত্রপাতি নিয়ে জড়ো হয়েছে। তারা এগিয়ে গেল সেই লোকগুলোকে ধরতে। লোকগুলোর কাছেও অস্ত্র ছিল। তারাও পুলিশের ওপর আক্রমণ করল। দুপক্ষের মধ্যে মারামারি আর ফায়ারিং চলল। সম্প্রীতি সেই সময় জিপের মধ্যেই ছিল। কেউ একজন সেখানে এসে তাকে দেখতে পেয়ে বলল,
“তুই পুলিশ ডেকে এনেছিস না! এবার মর।”
এই বলে তার ওপর লোকটা গুলি চালালো। তখনই একজন পুলিশ সেই লোকটাকে গুলি করে মেরে ফেলল। সম্প্রীতিকে সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হল। ডাক্তাররা অনেক চেষ্টা করলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাকে বাঁচানো গেল না। সম্প্রীতি মারা যাবার আগে পুলিশের বড়কর্তা সাবির আহমেদ তার সঙ্গে দেখা করেছিল। বড়া মসজিদ রক্ষা করা গেছে, সন্ত্রাসবাদীরাও ধরা পড়েছে এই খবরটা তাকে দিতে হবে তো। লোকগুলোর ওপর চার্জ মজবুত করতে সম্প্রীতির বয়ান নেওয়াও জরুরি ছিল। সাবিরবাবু সম্প্রীতিকে বললেন,
“যার লাশ আমরা গাড়ির সামনে পেয়েছিলাম তুমি তাকে চেনো? কারা মেরেছে ওকে বলতে পারবে?”
ভাঙা ভাঙা কন্ঠে অতিকষ্টে সম্প্রীতি বলল,
“ও মুস্তাক। ছোটবেলা থেকে ও ছিল আমার খেলার সাথী। আমরা একসাথেই বড় হয়েছি, একে অপরকে ভালবেসেছি। বড়া মসজিদের ভুলভুলাইয়ায় আমারা কতো লুকোচুরি খেলেছি। কাল সন্ধ্যে থেকে বৃষ্টি হওয়ায় আমরা রাতে মসজিদে আটকে যাই। তখন শুনতে পাই সতু গুন্ডার দলবল সেখানে এসে কথাবার্তা বলছে। ওরা দাঙ্গা লাগানোর জন্য মন্দির ভাঙার প্ল্যান করছে। গুণ্ডার দল চলে যেতেই আমি মুস্তাককে বলেছিলাম গ্রামের লোককে সকাল হলেই সব জানিয়ে দিতে হবে। কিন্তু ও বলল, গ্রামের মুসলমানরা মসজিদ ভাঙার কথা শুনলেই হিন্দুদের ওপর ক্ষেপে যাবে। তখন সতুরা যা চায় সেটাই হবে, দাঙ্গা। তার থেকে আমরা যদি পুলিশে খবর দিই তাহলে পুলিশ এসে সব সামলে নেবে।”
দম নেওয়ার জন্য একটু থামল সম্প্রীতি। তারপর আবার বলতে শুরু করল,
“আমি বলেছিলাম আমরা দুজনেই যাব পুলিশের কাছে। কিন্তু মুস্তাক বলল, গুন্ডারা মসজিদ ভাঙতে এলে তাদের পুলিশ আসা পর্যন্ত আটকে রাখা দরকার। তাই ও মসজিদে থেকে যায়। এরকম খবর ফোনে দিলে হয়তো পুলিশ গুরুত্ব দেবে না, তাই আমি নিজে গেছিলাম আপনাদের খবর দিতে। ওই গুন্ডারাই মেরেছে মুস্তাককে স্যার। দেখবেন ওরা যেন শাস্তি পায়।”
সম্প্রীতির বয়ান এই পর্যন্তই ছিল। বয়ান দেওয়ার পর আর বেশিক্ষণ প্রাণ ছিল না তার শরীরে। এরপর সেই গুন্ডাদের ওপর অনেক দিন ধরে কেস চলে। তারা শাস্তিও পায়। বড়া মসজিদের ইমাম কৃতজ্ঞ ছিলেন এই দুটো ছোট ছেলেমেয়ের কাছে। তারাই মসজিদকে রক্ষা করেছে। তিনি ফতোয়া জারি করেন মসজিদের বাইরের দিকে একটা বিশেষ জায়গায়, হিন্দুরা রাধাকৃষ্ণের নতুন মূর্তি স্থাপন করে পুজো করতে পারবে। রাধাকৃষ্ণের নতুন মূর্তির মুখে যেন ওই ছেলে মেয়ে দুটোর আদল ফুটে উঠল। সেই মূর্তি দেখে সম্প্রীতির দাদু চোখের জল মুছে বললেন,
“একসময় ওদের হিন্দু মন্দিরে মুসলিম রাজকুমারীর পুজো পাওয়ার গল্প শুনিয়েছিলাম। আজ শত শত বছর পরে কি আবার সেই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হল? ঈশ্বর ওদের আত্মার শান্তি দিক।”
লেখক পরিচিতি : মৌলি কুণ্ডু
জন্ম ২১শে অক্টোবর ১৯৯১, বর্তমানে একটি বেসরকারি আইটি কোম্পানিতে কর্মরত। ইন্দিরা গান্ধী মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কম্পিউটার অ্যাপ্লিকেশনে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী লাভ। সিরিয়াসলি লেখার শুরু 2020র মার্চ মাস থেকে। অলৌকিকের সন্ধানে ২ , ভয় শুধু ভয় নয়, গোধূলি রোদের মিছিল, অক্ষরে ইতিহাস ও পুরাণকথা প্রভৃতি গল্প সংকলনে এবং পত্রিকায় লেখা প্রকাশিত হয়েছে। কলকাতা বইমেলা ২০২৩ এ খোয়াই পাবলিশিং হাউস থেকে' সময় শকট 'ও ২০২৪ এ ' ওরা আসে অন্ধকারে ' নামক দুটি গল্প সংকলন প্রকাশিত হয়েছে।
অজানা তথ্য। খুব ভালো লাগলো