লেখক : মিত্রা হাজরা
হু হু করে গাড়ি ছুটছে, মাথার মধ্যে শূন্যতা। এক জলোচ্ছ্বাসের আবেগ নিয়ে কাল থেকেই বড় মন কেমন করছে ঝোরার জন্য। এতদিন পর গিয়ে কী বলবে মেয়েটাকে? কেন সেদিন সকালের আলো ফুটতে পালিয়ে এসেছিল তাকে কিছু না জানিয়ে! বিছানার নিচে কয়েক হাজার টাকাও রেখে এসেছিল। পরে ভেবেছে ওটা ঠিক হয়নি। ঝোরা কী ভাবল তার সম্বন্ধে! সেই শাল পিয়াল ছাওয়া মাটির ঘর, আর মাটির কন্যা ঝোরা। বকবক করে যেত অকারণে। ঝোরা একটু চুপচাপ বোসো তো, নড়ছ কেন। পা টানাচ্ছে রে আঁকবাবু !
এখানে প্রকৃতির টানে, কিছু ছবি আঁকার টানেও বটে সে গাঁয়ে এসেছিল। মেয়েটা তখন জঙ্গলে কাঠ-পাতা কুড়োচ্ছিল, অদ্ভুত তার চোখদুটো, দেখেই তার মুখটা আঁকতে ইচ্ছে করে সুমনের। নাম কী তোমার? ঝোরা বটেক! ঝোরা! বাহ্ বেশ নামটা! আমাকে একটু জল খাওয়াবে? চল তবে মোর ঘর, এই নজদিক আছে। গাছ পালা ছাওয়া মাটির বাড়ি, ঝকঝকে তকতকে। তার নাম দিয়েছিল — আঁকবাবু ! ঝোরার টানে না ছবি আঁকার টানে সে রয়ে গেল গাঁয়ে।
আরে ভুখ নাই তোর? আয় খাইয়া লে, শাল পাতায় চালে ডালে ফুটিয়ে খিচুড়ি খাওয়াত ঝোরা। পাতা থেকে একটা মিষ্টি গন্ধ বের হত। তা রান্নার না রাঁধুনির কে জানে! কখনও শুধুই ডালকড়াই শাক সিদ্ধ। বলত — মোরা এই খাই রে আঁকবাবু, কিছু কিনে চাল ডাল মাছ দিতে গেলে মুখ ভার হত মেয়েটার। বলত — জানি রে বাবু, তুর খাইতে তকলিফ হয়, লেকিন এহি তুকে খাইতে হবে। ওর মরদ বনমালি ওর রকম দেখে হো হো করে হাসত। একদিন একটা বড় মাছ বনমালি ধরে এনেছিল কোন নদী থেকে। সেদিন ঝোরা অনেক কিছু রান্না করেছিল। যখন খেতে দিল পাতায় করে, খুশিতে ওর কালো মুখ জ্বলজ্বল করছিল। অতিথিকে খাইয়ে ওরা দুজনে বেশ তৃপ্তি পেয়েছে বোঝা গেল। তবুও সুমনকে বড় ভাবাত, ওদের আর্থিক সঙ্গতি অত নেই, আবার সে ভাগ বসাচ্ছে ওদের খাবারে। মন মানত না।
ভেবেছিল যাবার সময় বেশ কয়েক হাজার টাকা ওদের ঘরেই লুকিয়ে রেখে যাবে। নাহলে বেচারারা তাও নেবে না। ওদের মন অনেক উদার আর অবারিত। শহরের মানুষের মত নয়, যেখানে স্বার্থ ছাড়া কেউ এক পা-ও চলে না।
আজ অভিনন্দনের জোয়ারে ভাসছেন চিত্রকর সুমন ঘোষ। আনন্দের হাট বসেছে। রক্তগোলাপের গুচ্ছ, সুদৃশ্য আতরের শিশি, আরো কত কী উপহারে ভরে গেছে তার স্টুডিও। তার বন্ধুরা — শেখর, মহতাব, অঞ্জলি, মহুয়া হৈ চৈ করছে। তার পেন্টিং “আলোকঝোরা” পুরস্কার পেয়েছে।চিত্রসমালোচকরা অকুন্ঠ প্রশংসায় ভরিয়ে দিয়েছে তাকে। শুধু এক মহিলা সাংবাদিক প্রশ্ন করেন — এতো মায়াময়ী মেয়েটি কে? রহস্যময়ী মাটির কন্যা, প্রকৃতি অনেক যত্ন নিয়ে ওকে গড়েছে। খন্ড জোছনায় শাল পিয়ালের মধ্যে দু’চোখে মায়াময়তা, কে তাঁর প্রেরণা? স্তব্ধ হয়ে গেলেন চিত্রকর। তাঁর প্রেরণা, প্রেম সবকিছুই তো ঝোরা। কোথায় সে, কেন সে নেই? আজ তার চারপাশে কাদের ভিড়! এর পরই ক্লান্ত এই অজুহাতে সে নিজের ফ্ল্যাটে ফিরে এসে ঘরে দরজা বন্ধ করেছে। সারারাত অস্থির অবস্থায় কেটেছে। সকালেই ড্রাইভারকে সাথে নিয়ে সে পলাশতলী চলেছে ঝোরাকে জানাতে। তার পরিশ্রম, ঝোরার আতিথেয়তা, ভালবাসা বৃথা যায়নি। তাকে কাছে পেতে খুব মন চাইছে আজ।
সেদিন দড়ির খাটিয়ায় বাইরে শুয়ে ঝোরার ঘরের কাজ দেখছিলেন চিত্রকর। হাঁস-হাঁসিগুলোকে খেতে দিল, আঙন ঝাড়ু দিল। ঝোরা, আজ বনমালি এখনো এল না কেন? সে বলল — উ তো মৌমাচির পেচন পেচন জঙ্গলে ঘুমছে। বড়া বড়া পেড়কে নিচে ধূয়া দিবে, পিনপিন করে মৌমাচি ভাগবে। তা বাদে মধু ভাঙবে। উয়ার ফিরতে সাঁঝ হয়ে যাবে আঁকবাবু। তুমি তো তাহলে খাওনি ঝোরা এখনো? মোদের সাঁঝই খানে কা সময় বাবু, তু শো যা। নারে আজ আর রেস্ট নয়, অল্প একটু বাকি আছে। তুই খেয়ে সামনে একটু বোস, হয়ে যাবে।
সে চিত্রকর, ছবি আঁকাই তার কাজ। কত মানুষের বা বলতে পারে কত নারীর সান্নিধ্যে এসেছে। কখনো কারো জন্য তো এত বেদনার পুঞ্জ জমা হয়নি জীবনে। ক্ষণস্থায়ী এ জীবন, আর তার চেয়েও ক্ষণস্থায়ী কিছু মুহূর্ত থাকে জীবনে। এ যেন সেই ক্ষণ, স্থির চিত্র হয়ে মনের মণিকোঠায় লুকিয়ে ছিল। শীতকালের কাঁচামিঠে রোদের মত তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করা হয়নি কখনও। ঝোরার ঠোঁটদুটো মনে পড়ছে সুমনের। ছবির দিকে তাকিয়ে ঠোঁট টিপে চোখ বড় করে অদ্ভুত ভাবে তাকাতো ঝোরা। কী দেখছ অত? তসবির দেখছি আঁকবাবু, ই তো মেরাই হ্যায়, লেকিন অলগ। “কি করিলে বল পাইব তোমারে, রাখিব আঁখিতে আঁখিতে”! আজ ছুটে চলেছে চিত্রকর দিগ্বিদিক শূন্য হয়ে।
তুম জানতে হো আঁকবাবু — উ যো শিশম কা পেড় হ্যায়, উ মেরে সাথ বাত করতা হ্যায়।
পাগল একটা! কী বলে?
উ বোলতা হ্যায় আঁকবাবু দো দিনকা মেহমান। যতন করো, খাতিরদারি করো। হাম নে বোলা — হাঁ তো, তসবির বহুত আচ্ছা বানাতা হ্যায়। মেরে লিয়ে একঠো বানা দোগে আঁকবাবু? মাথার উপর দিয়ে এক ঝাঁক টিয়া টি টি করে উড়ে গেল তখনই। দেখো — কর লো বাত! উ নীলাকে উপর কালারঙ কিউ দিয়া রে বাবু?
তুমি একটু চুপচাপ বসো তো ঝোরা। আমার মন অন্য দিকে গেলে আঁকব কীভাবে!
লো কর লো বাত! খিল খিল হাসিতে ভেঙে পড়ল মেয়েটা। রঙের তুলিটা ডুবিয়ে এক পোচ দিয়ে দিল তার কপালে। তবে রে মেয়ে! ঝোরার পিছনে ছুটতে ছুটতে কখন যেন জঙ্গলে অনেকটা ভিতরে চলে গিয়েছিল সেদিন। আকাশে চাঁদ উঠেছিল। সেগুন, শাল গাছের পিছনে জায়গাটা মনোরম চাঁদ জোছনা ছেয়ে ছিল। ঝোরা একটা গাছের গুঁড়িতে হাত রেখে হাঁপাচ্ছিল। পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই বলল — চলরে আঁকবাবু, বনমালী জরুর আ গিয়া হোগা। বনমালী কিন্তু সে রাতে ফেরেনি। কেন ফেরেনি তা জানে না সুমন। ঘরে ফিরে আর ঝোরাকে দেখতে পায়নি সুমন। বাইরেই খাটিয়ায় শুয়ে পড়েছিল। যেন ঘুম এসে গিয়েছিল চোখে। তবে কখন সে ঝোরার কাছে গেল, তাকে জড়িয়ে ধরে কখন গহীন অন্ধকারে তলিয়ে গেল? রাতের অদ্ভুত এক মোহিনী শক্তি আছে, পাশে যদি ঝোরার মত অরণ্যকন্যা থাকে। জোয়ার প্রবল হলেই তো নদীর পাড় ভাঙে।
তার ছবি আঁকা শেষ প্রায় হয়েই গিয়েছিল। তাই ভোরে ঝোরার সাথে নিজেকে আবিস্কার করে সে অদ্ভুত দোটানায় পড়েছিল। ঘুমন্ত ঝোরাকে অপূর্ব লাগছিল। কিন্তু নিজেকে টেনে নিয়ে, সে সেখান থেকে চলে এসেছিল, বা পালিয়ে এসেছিল কে জানে? শারীরিক সম্পর্ক হওয়ার পর এত তীব্র অনাসক্তি কেমন করে এল? সে কী মানসিক ভাবে দুইজনে দুই বিন্দুতে তাই! তাদের শিক্ষা, সংস্কৃতি আলাদা বলে? সুখের সংজ্ঞা আলাদা বলে? আজ তবে ঝোরার জন্য এতো কষ্ট হচ্ছে কেন? ঝোরা কি তাকে তাড়িয়ে দেবে আজ?
আর গাড়ি যাবে না স্যার, ড্রাইভার গাড়ি থামাল। সামনে এবড়োখেবড়ো লাল মাটির পথ। সুমন নেমে এল, বিশু তুমি গাড়ি নিয়ে ফিরে যাও।আপনি? আমার ফিরতে দেরি হবে। গাড়ি গ্যারেজে রেখে তুমি বাড়ি চলে যেও। লাল মাটির পথ ধরল সুমন। ঐ তো সেই শিশু গাছটা। পাশেই সোনাঝুরি গাছ। ঝোরার ঘরের সামনে এল সুমন। এ কী অবস্থা ঘরটার। পাতা ভরা উঠোন, বোঝা যায় কতদিন ঝাঁট পড়েনি এ উঠোনে। চাল খসে গেছে। ঝোরা বলে ডাকতে গেল, গলা দিয়ে আওয়াজ যেন বের হচ্ছে না। আশেপাশে তাকালো, কেউ নেই। ভূতের মত বাড়ির উঠোনে পাতা মাড়িয়ে ঘুরতে লাগল সুমন। বাবু তুমি কাকে খুঁজছ? সামনে এক পাগড়ি পরা বুড়ো মানুষ।
বনমালি, ঝোরা? ওরা তো এখানে থাকে না বনমালি দুসরা গাঁও মে রহতা হ্যায় আভি, সাদি ভি কিয়া ফিনসে।
আর ঝোরা?
বাবু উসকী দিমাগ গড়বড় হো গয়া থা। কত কী বকতো! কভি বলতো — শিশম পেড় সব খবর জানে, কভি বলত উ সবসে অলগ হ্যায় — কেয়া কেয়া বাত। একদিন কহা যো চলা গিয়া, সব কোই ঢুঢ়া, মগর মিলি নহী।
নিঃস্ব হয়ে গেল চিত্রকর। ঝোরা শূন্যতার মাঝে তাকেও কি টেনে নিল? এখন সে কী করবে? ঝোরাকে খুঁজে বের করবে নাকি নিজেকেই খুঁজতে বের হবে? বুঝতে পারছে না। কানে বাজছে ঝোরার গলা – আঁকবাবু আঁকবাবু!
লেখক পরিচিতি : মিত্রা হাজরা
প্রাক্তন শিক্ষিকা ডি এ ভি পাব্লিক স্কুল চাই বাসা।