লেখক : অম্লান রায় চৌধুরী
ভূতোদা নেই – ঠেকটা ফাঁকা। রবিবারের সকাল, কারুরই দেখা নেই। অসীম কে চা দিতে বলে, ফোন লাগালাম ভূতোদাকে। লাইন নেট ওয়ার্কের বাইরে। বেশ কয়েকদিন ধরে ভূতো দা আসছেনা ঠেকে।
পাড়াতে ভূতোদাকে সচরাচর দেখাও যাচ্ছেনা। খবর , কয়েকজনের সাথে দেখা হয়েছে রাস্তায়। ভীষন গম্ভীর। মনে হয় একটা চাপা উত্তেজনায় ভুগছে। দেখলেই বলছে, মানুষ নিজ নিজ প্রবৃত্তির দাস কিন্তু কেন অন্যর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবে মানুষের প্রবৃত্তি? এটা মানুষের সঠিক ভাবে বাঁচা নয়। শুধু মেনে নেওয়া। ভূতোদা নাকি ভাবছে , মানুষ যেন – ফেলে দেওয়া মানব সভ্যতার আস্তাকুঁড় থেকে উঠে আসা এক প্রজাতি। বাঁচা কেবল অনুগ্রহর উপর।
যারা শুনেছে তাদের কাছে অদ্ভুত লাগছে ভূতোদার কথা। এ এক যেন অন্য ভূতোদা ।
টেবিলে পায়ের ধাক্কা লেগে ভূতোদার ঘুমটা ভেঙে যায়। বিশাল এক স্বপ্ন। স্বপ্নে এক নতুন জগতের দায়িত্ব পাওয়ানো হল তাকে। এখন তাই নিজের বর্তমান কে অকর্মণ্য মনে হচ্ছে। ঘুম থেকে উঠে পড়ল। দুদিন বাড়ী থেকে বেরই হলোনা একান্তই কিছু ব্যাক্তিগত কাজ ছাড়া। ভূতোদার বিশেষ অনুগত দেবুকে ডেকে পাঠানো হলো , যাকে ভূতোদা ক্যাপ্টেন ‘স্পার্ক’ বলে ডাকে। দেবুকে পুরো বিষয়টা জানাল।
পরের রবিবার ঠেকে এলো ভূতো দা। সবাই খুশী, অসীম স্পেশাল চা নিয়ে এলো। জমিয়ে বসল সবাই। স্বপ্নর খবর সবাই জেনেছে কিন্তু স্বপ্নের চমকটা কেউ জানেনা । ওটাতে নাকি চমক আছে। ওটা নাকি এক যুগকে নির্দেশ করছে, বিচার চাইছে – খোল নলচেরাও নাকি বিচারের কাঠগড়ায়।
দেবু , ভূতোদার মুখপাত্র, প্রস্তুত হল বলার জন্য ।
দেবু ভূতোদাকে সামনে রেখে বলা শুরু করল সেখান থেকে যেখানে স্বপ্নে ভূতোদার মনে হল যে স্বপ্নের আদেশ টাকে – escalate করার প্রয়োজন । তাই – পালক পিতাদের কাছে যাওয়াটা মনস্থ করল। গেলও, দেবু শুরু করল। ভূতোদা গিয়ে দেখল ওখানে তখন সাক্ষাৎ চলছে এক স্থানীয় কর্মীর। তাকে কিসের ভিত্তিতে সেখানে গ্রহণ করা হবে সেটাই বোঝা হবে সাক্ষাতের মাধ্যমে। তারই পরিকল্পনা।
এমন সময় সেখানে ভূতোদা হাজির সেই সাক্ষাৎ সভায়।
ভূতোদাকে দেখে , ‘আমার কাছে কি চাই তোমার?’ প্রশ্ন হল।
আমি আপনার কাছে, যার সাক্ষাৎ নিচ্ছেন তার পক্ষ হয়ে আসিনি, হেসে জবাব দিলো ভূতো দা, ‘ এসেছি এক কালের বার্তা নিয়ে, এই সময়কার প্রার্থী কূলের পক্ষ হয়ে – যারা আপনাদের বানানো কালের দড়িতে বেমক্কা আটকে রয়েছে।
-‘বুঝিয়ে বল, পরিস্কার হলোনা বিষয়টা।
-এর ব্যাখ্যা সহজ, তবে তার আগে আপনাকে বলি, ঐ ব্যক্তিটি, যার সাক্ষাৎ বা বিচার হচ্ছে, তার যেন অবিচার না হয়।
-‘তুমি কে এই বিষয়ে মতামত দেবার, তুমি কতটুকু জান–ওর সম্বন্ধে।
-‘না, জানি না, তবে উনিই সম্ভবত শেষ ব্যক্তি – আপনাদের কাছে আসবেন তাদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করতে। আপনাদের বানানো জমকালো আবাসন ফাঁকা পড়ে থাকবে। সস্তা হোস্টেলের মতন বাড়ী তৈরি হচ্ছে কালের কল কাকলিতে। বুঝছেন কিনা জানিনা, সবাই এখনকার এই অবস্থাটাকে বিশৃঙ্খলা বলছ। ভূতো দা বলে চলল, বলপ্রয়োগে প্রবৃত্তি দমন, স্বতঃস্ফূর্ততায় আঘাত, এই কিম্ভুত অবস্থায় – ক্লান্ত সবাই। এখনই চূড়ান্ত ও পূর্ণা-ঙ্গ সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় হয়েছে। এটাই শেষ সুযোগ আপনাদের ক্ষমতা দেখাবার -তাই ওনাকে অবিচার করে শেষবারের মতন ক্ষমতার অপব্যবহার করবেননা।
ভূতো দা বলল, আমি আপন আনুগত্যে এগুলো জানাতে এসেছি, যাতে আপনারা আমার বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদী, বুদ্ধিজীবী, হঠকারিতা’ র দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার অভিযোগ না আনতে পারেন। ভাবুন, হয়তবা আপনাকেও কোনোদিন দেখব আসন্ন অনুগামীদের লাইনের শেষ প্রান্তে। সেই অপেক্ষায় রইলাম।
-‘শোনো তুমি যেইই হওনা কেন , তোমাদের এখানে এই ভাবে আসাটা নতুন নয়। অনেকেই এসেছে তোমার মতন নিজেকে বাঁচানোর তাগিদে-আঘাত খেয়ে বাঁচার তাগিদ। কিন্তু কোনো বড় আঘাতের খবর তো নেই আমাদের কাছে যে মনে হবে গোটা সমাজটাই আঘাত প্রাপ্ত। গোটা সমাজ একসাথে তো আঘাত খায় না – নিশ্চয়ই । তাহলে আঘাতকারী কে হবে ? কাজেই তুমি যা কিছু ভাবছ, বলছ বা বলতে পার তার সবই আগে নীতিবাগিশদের মুখে বহুবার শোনা। বিষয়টা দুর্বল। তোমার যদি বিষয়টাকে নতুন দৃষ্টিতে বলার মতো যথেষ্ট রসদ বা মৌলিকতা না থাকে, তাহলে সবচেয়ে ভাল হচ্ছে চুপ করা। দেখ, আমার অনুগতদের চেহারায় কেমন নিঃস্পৃহতা। হ্যাঁ , আর একটা কথা , তুমিকি বিষয়টা আমাকে জানাতে এসেছ, না কি অনুমোদন নেওয়ার জন্য ।
-জানাতেই কেবল। এসব ক্ষেত্রে অনুমোদনের প্রয়োজন নেই। স্বতঃস্ফূর্ততাই আজ্ঞা বহন করে সর্বজনীনভাবে , ভূতোদা বলল। আমার কোনো প্রশ্ন নেই , কেবল কিছু অভিমত আছে আজকের অবস্থাকে মান্যতা না দিয়ে – কারণ আমি মনে করি এই অবস্থার একটা প্রাসঙ্গিকতা আছে। আপনি কি চান আমি ফিরে এসে আপনাকে পরিবর্তিত অবস্থাটা অবহিত করি – কেমনভাবে ঘটল সেটা বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য’।
-‘না না তার প্রয়োজন হবে না। শুধু বলো কেন, এতকাল নিজেদের অসন্তুষ্টর মন্ত্রে দীক্ষিত রেখে আজ নতুন ভাবনার উদয় হল – এত সময় লাগল কেন ?’
-এটার উত্তরে বিস্তারটা জরুরী । কারণ – ‘সময়’ বহমান – বইতে দেওয়া হয়। কেমন বইছে জানার প্রয়োজন হলেই –‘সময়ে’র উপর নজরদারী শুরু হয়। সেটাই চলছে – কারণ – ‘সময়’ মূল্যবান ও অনেকটা কালও অতিবাহিত – তাই ‘সময়ে’র মূল্যায়নের প্রয়োজন টা উপলব্ধ হয়েছে। কোনো এক ‘সময়’, ‘সময়’ কে তো পাল্টাতেই হয় , হয় নতুন কোনো ‘সময়ে’ র ডাকে অথবা চলমান ‘সময়ে’র নতুন কোনো বাঁকে – কিংবা ‘সময়ে’র নিজের ভারেই – বোধ হয় এটাই সেই “সময়” ।
-বেশ, বলো তোমাদের কার্য্য প্রণালী ও রুপ রেখা যার ভিত্তিতে তোমরা ভাবছ।
-ভুতোদা , কার্য্য প্রণালী শুধু নয় , কিছু – পরিবর্তিত অবস্থার বিবরণ দেবো ও বিশ্লেষণ করব ।
-দেবু ঘুরে দেখল ঠেকটা – সবাই উৎসুক ভাবে চেয়ে আছে দেবুর দিকে ।
-প্রস্তাবনায় বলা হলোঃ-
মানুষের প্রত্যেকটা অনুষঙ্গকেই প্রাধান্য দেওয়া হবে প্রবৃত্তির নিরিখে । প্রবৃত্তি হবে বাঁধাহীন যেমন, অহংকার, লালসা, লোভাতুরতা- এসব পুনর্বহাল করা হবে। সেই সঙ্গে ধনলিপ্সাও, যাকে অর্থনীতির জননী বলা হবে। উভয়ের মধ্যে পার্থক্য কেবল জননী হবেন হ্রষ্টপুষ্ট, আর সন্তান কঙ্কালসার। এটা যদিও বিদ্যমান – তবুও পরিশীলিত করতে হবে । ঈর্ষার ব্যাপারে বলা হবে – এটাই প্রধান গুণ – অনন্ত সমৃদ্ধির উৎস।
—– এগুলো তো মানুষের রিপু, এগুলো চালু হলে সমূহ বিপদ, রিপুর নিয়ন্ত্রণ থাকার দরকার, প্রশ্ন করল।
— কেমন রিপু, এগুলোই তো অনায়াসে যখন ব্যবহার করা হয় তখন তো কেউ এগুলোকে রিপু বলেনা। দেখছি, লালসার আগুনে কত অযথা নারী ধর্ষণ , নারী নির্যাতন। ইচ্ছাকৃত ভুল যেটা অন্যায় তাকে বালক সুলভ আচরণের অছিলা দিয়ে ঢেকে – দিব্যি চালিয়ে দেওয়া হয়। এই প্রহসনের কি প্রয়োজন আছে – তাই নিয়ন্ত্রনহীন করা হল ।
———তেমনই, বিকৃতির প্রতি ভালবাসা আর শুভের প্রতি বিতৃষ্ণা জাগাতে হবে। যেমন, অসততার কোনো সংজ্ঞা থাকবেনা । কথাটাই মূল্যহীন । কারণ এটা বহুল প্রচলিত ও ব্যাবহৃত । একে মানুষের বাম হাত বলা হবে। ডান হাত হচ্ছে শক্তি। যারা বাম ও ডান উভয়ই তাদেরকে গ্রহণ করা হবে। কিন্তু যারা কোনটাই নয় তাদের জায়গা নেই , কারণ তারাই চক্রান্তের নীরব কর্মী।
——–এতো সর্বনাশ, মানুষ তাহলে তো কেবল বিকৃতির প্রতি আকর্ষিত হবে । শিল্প , কলা, সাহিত্য, এদের কি করে সৃষ্টি হবে এই অসুন্দরের মধ্যে । এরাই তো সমাজের প্রতিচ্ছবি । সুন্দরের পরিচিতি কি হবে । সুন্দর বলে কি কিছু থাকবে । চরম অরাজকতার সৃষ্টি হবে ।
———কেনো, বিকৃতিই তো বিকোয় এখন । যত বিকৃতি ততই মূল্য । আমরা দেখি তো শিল্প , সাহিত্যে শুধু বলা হয় মানা হয়না । যে বলে সেইই লঙ্ঘন করে সবার আগে। নিয়ন্ত্রণ আছে , কথায় কিংবা মনের অগোচরে ভাবনাতে , কাজে নেই– তাই কথা আর ভাবনার রুপকাররা পুরস্কৃত । এই প্রহসনের মানে কি ? এই অবস্থাকে সুস্থ ভেবে নিয়ন্ত্রন করার কোনো মানে আছে কি – নিয়ন্ত্রনহীন করা হবে ।
——- কিন্তু এ ব্যবস্থায় তো মানুষের সমস্ত প্রবৃত্তিকেই মান্যতা দেওয়া হচ্ছে । সব প্রবৃত্তি সমাজের পক্ষে উপযোগী নয় – এটা তো জানা । কাজেই মান্যতা দেই কী ভাবে ?
——কেন এখন তো মান্যতা ছাড়াই রমরমিয়ে চলছে সমস্ত প্রবৃত্তির চরম প্রকাশ। আপনারা কেবল ব্যাক্তি ও ক্ষেত্র বিশেষে ছাড় দিচ্ছেন। এটা অন্যায় নয় । তাহলে কেন সমস্ত ব্যবস্থাটাকেই উন্মুক্ত করছেননা ।
পালক পিতার দপ্তর নিশ্চুপ হয়ে রইল, কিছু বলতে পারলনা ।
ভূতো দা আবার শুরু করল , তবে অর্থলালসার ওপর প্রচার বেশী করে করতে হবে । অর্থলালসা, অন্য সব অধিকারের চেয়ে শ্রেয়তর এক অধিকার। যেমন – তুমি তোমার বাড়ি বিক্রি করতে পার । জামা , জুতো, আসবাব বিক্রি করতে পার কারণ তুমি সেগুলোর বৈধ ও আইনসঙ্গত মালিক । তাহলে তোমার মতামত, ভাবনা, কথা , বিশ্বাস – যেগুলো তুচ্ছ বিষয় আশয়ের চেয়ে অনেক বেশি মূল্যবান কারণ সেগুলো তোমার বিবেকের, আত্মার উপকরণ – বিক্রি করা যাবে না কেন? এটা অস্বীকার মানে অযৌক্তিকতা আর অসঙ্গতিতে পতিত হওয়া। মেয়েদের চুলও তো বিক্রি হয় , রক্তও তো বিক্রি হয় – এগুলো শরীরের অংশ – নৈতিক অংশের থেকে কম মূল্যবান?
———- কিন্তু এগুলো তো মানুষের প্রবৃত্তির এক একটা গুন , এগুলোকে কেন বিকোনোর অনুমতি দেওয়া হবে – তাহলে তো সমাজ থাকবেনা । বিবেক বিক্রি মানে তো নিজেকে বিক্রি , ক্রীতদাস প্রথা তুমি ফিরিয়ে আনতে চাইছ ?
———আছেই তো এখন এই প্রথা । মানুষের হাতে শিকল নেই – মনন তো বাঁধা – মাপা হয় অন্য আঙ্গিকে। প্রশ্ন করা আজও নিষেধ । যারা যত জানে তারাই নিজেদেরকে লুকিয়ে রাখতে চায় – ভয়ে , কারণ নিয়ন্ত্রনের সব অস্ত্রই প্রয়োগ করা হবে এই আশঙ্কায়। আর বিবেক , সেতো কবে থেকেই নেই — নাহলে নিজের মেয়েকে কেউ বেচে দেয় মদের খরচ যোগাতে । গোটা পরিবার সম্মানীয় – মৃত্যু (হত্যা) করতে বাধ্য করে – পরিবারেরই মেয়েকে – অন্য জাতের ছেলেকে বিয়ে করতে চায় বলে । কেমন বিবেকের আচরণ । এটা যদি চলে – তাহলে আইন করতে দোষ কোথায় । অতএব ইচ্ছা মতন চলুক সব ।
ভূতোদা এবার কর্ম সংস্কৃতির উপর একটু অন্য ভাবনার কথা বলল । যেটাকে এক দেশের মেরুদন্ড আখ্যা দেওয়া হয় । শুরু করল এই ভাবে, মানুষের কর্ম-সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও বেশ কিছু নিয়ন্ত্রনহীনতা আনতে হবে সমাজের গতিকে ত্বরাণ্বিত করার জন্য । সবেতে ছাড় দেওয়া, বড় ব্যবসায়ীদের সব সুবিধা দেওয়া, যাতে তারা অর্থের যোগানটা দেয়। কারন আপনাদের মূল অর্থের যোগানে কোনও রকমের ঘাটতি থাকা চলবেনা, তাহলে আপনাদের পরিচালন করা দুঃসাধ্য হয়ে পড়বে ।
অন্য দিকে সমৃদ্ধির ভাবনায় অসংগঠিত ব্যাবসাটা আরও বাড়াতে হবে অন্য ভাবে–সংগঠিত না হতে দিয়ে – যাতে নির্ভরশীলতা বাড়ে – বেশী করে অনুগত হয় । তাহলেই টিকিয়ে রাখা যাবে । ওরা বাঁচবে – আর শুধু বাঁচার কথাই ভাববে । সেই আইনই চালু করা হবে ।
সংগঠিত না হয়ে শুধু কোনো রকমে বেঁচে থাকার কায়দাটাকে ওদের রপ্ত করাতে হবে – নানান রকমের প্রলোভন কে সামনে রাখতে হবে যাতে তারা বোঝে যে তাদের এই পথটাই একমাত্র পথ বেঁচে থাকার । এর জন্য অবশ্যই কিছু স্বল্পকালীন সুবিধার ব্যবস্থা করতে হবে – ভুলে যা বে তারা । এই জন্যই আলাদা রকমের শাসন প্রক্রিয়া হবে ।
——তা কি করে সম্ভব । অসংগঠিতকে সংগঠিত না করতে পারলে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থাটা ভেঙ্গে যাবে । মানুষের বাঁচার পথ থাকবেনা। উৎপাদন ব্যাহত হবে – জাতীয় আয় বাড়বেনা । আয় বন্টনে অসমতা , চোরা কারবারির আধিপত্য – শোষণ আরও সুসংগঠিত হবে । দারিদ্র সীমার নীচের মানুষ উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাবে । মানুষের সংগঠিত হওয়াতেও বাঁধা – মানুষ অসহায় হয়ে পড়বে ।
——কেন, আপনাদের চলছে কি করে । নির্ভরশীলতা মানেই তো ফায়দা । এদেরকে এতদিন চালালেন নিজ স্বার্থে, ব্যবহার করলেন বিভিন্ন রকম ভাবে, যদি সেই অবস্থাটাকেই আইনানুগ করা হয় অসুবিধা কোথায়, তাইই হবে ।
আজ না হয় , এই প্রচ্ছন্ন শোষণের ইচ্ছাটাকে প্রত্যক্ষ করুক সবাই। খুব তফাত কি হবে এতে। আপনারাই কোনোদিন চাননি – কেউ এক জোট হোক , প্রতিদ্বন্ধি হোক – প্রশ্ন করা শিখুক । ভয় পেয়েছেন, পাছে শাসনের লাভ্যাংশে ভাগ বসাক । যদি ওটাই আইনানুগ হয় , ক্ষতি কোথায়।
ভূতোদা বলে চলল , সেই আদি প্রবৃত্তির কথা মাথায় রেখে ভাবা হল – বিনা মাশুলে অপবাদ বা নালিশ গ্রহণযোগ্য করা হবেনা, মাশুল ধার্য করা হবে । আধুনিক টেকনোলজি-কৃত – কোনো ব্যাঙ্গ – কটু কথা , তির্যক , সবই মাশুলের আওতায় পড়বে । এতে রাজস্ব বাড়বে । তবে অপবাদ বা নালিশের ওজন বিচার করা হবে কাল্পনিক ও বাস্তবতার আঙ্গিকে। কাল্পনিক বা অন্যায্যর ক্ষেত্রে মাশুলের হার একটু বেশীই হবে , তবে গ্রহণযোগ্যতা হারাবেনা। ছাড়া হবেনা মানুষের ব্যক্তিগত আচার ব্যবহারকেও — যেমন , সামাজিক ও ব্যক্তিগত শিষ্টাচারের সম্ভাব্য উপকরণ হিসেবে সব ধরনের আদবকায়দা নিষিদ্ধ করা হল । ব্যতিক্রম হলো- ব্যক্তিগত লাভের জন্য যে মোসাহেবির আবশ্যকতা – সেটা । কারন দেখা গেছে যে , ব্যক্তিগত লাভের আকাঙ্ক্ষা নিছকই চাটুকারিতায় পরিণত হয়, সুতরাং এধরনের ক্ষেত্রে কোনো কায়দা নয়, চাটুকারিতাকেই মান্যতা দেওয়া হল – এবং সেটাই গ্রহণীয় হবে ।
প্রসঙ্গটার বাস্তবতায় – কোনো প্রশ্নই উঠলনো। পালক পিতাদের দপ্তরও কিছুই বলতে পারলোনা ।
এতক্ষুণের এই অক্লান্ত বিশ্লেষণে ক্লান্ত ভূতো দা । কিছুটা সময় নিলো। দেখল অনুগতরাও প্রস্তুত । প্রয়োগের সময়ও সামনে । যাবার আগে , শুধু এগুলোর মান্যতা চাইছি। মানলে ভাল , না হলে জনগণ মানিয়ে ছাড়বে।
খসড়াটা বলা হল । বাকীটা আপনাদের হাতে ।
দেবু হতবাক, ভূতোদার এই সাবলীলতা দেখে- জিজ্ঞাসা করল, তুমি কি কোনো মন্ত্র বল পেলে। ভূতোদা বলল – না, এগুলো শুধু আমার কথা নয় , দেখনা কেমন গুঞ্জন চারিদিকে , সকলে জমায়েতে এসে গেছে – এখনই শুরু – নতুন অবস্থার ।
সময় নষ্ট না করে অনুগতদের কাছে প্রচারে বেড়িয়ে পরল – ভুতোদা। তারপর এক অভূতপূর্ব মতবাদ প্রচার করল এমন এক কণ্ঠে যা শতাব্দী-গভীরে প্রতিধ্বনিত হলো। তার অনুগতদের সমস্ত আনন্দ, যশ আর ভোগসুখের প্রতিশ্রুতি দিলো। সে হচ্ছে –ভূতোদা , নতুন এক দ্যূত। সভায় বলল , হ্যাঁ, আমি হচ্ছি ভূতো ‘ তবে খালি আড্ডা মারা , কাজ না করা – বেকার ভূতোদা নই – এক নতুন বার্তা এনেছি, মানুষের সেই অমোঘ স্বতঃস্ফূর্ত – প্রবৃত্তি – যা মানুষের হৃদয় থেকে অপসারিত করার নানান চেষ্টা চলছে – নতুন নামে আমি তাকেই পুনঃ প্রতিষ্ঠিত করতে চাই ,বলতে চাই – “প্রবৃত্তির নবীকরণ” ।
দেবু আড় চোখে দেখল , ঠেকের মধ্যে এক চাপা উত্তেজনা। সান্টু তো বেশ উসখুস করছে , উত্তেজনায় ভূতো দা’র প্যাকেট থেকেই একটা সিগারেট ধরিয়ে ফেলল।
ভূতোর ভবিষ্যদ্বাণীই সত্য হল। আগেকার সব নিয়ম ধীরে ধীরে – রূপান্তরিত হল – নতুন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তৈরিও হল। নতুন মতাদর্শ ছড়িয়ে পড়ল চারিদিকে। দুনিয়ার এমন কোন অঞ্চল, এমন কোন ভাষা বাদ রইল না যেখানে এটি প্রচার পেলনা ও অনূদিত হলনা। ভূতোর জয় জয়াকার।
কাটল বেশ কিছুকাল। অনেক টানা পোড়েন, চাপান উতোর – চলার পরে ভূতোদার গোচরে এল কিছু জিনিষ, যেটা ভাববার মতন। ভূতোদা বুঝল, অনেক মানুষ গোপনে যেন আগের ভাবনাতেই আটকে রয়েছে – আগের নিয়মেই বিচরণ করছে । বর্তমানের নীতিগুলোকে যেন তেমন ভাবে গ্রহণ করতে চাইছেনা।
রাজস্ব – অনেক বেড়ে গেছে সত্যিই , মূলত: সেই সমস্ত মানুষের কাছ থেকে যারা আগে চোরা কারবারী বলে খ্যাত ছিল, আয়কর আগের মতন ফাঁকি দিচ্ছেনা – সময় মতনও দিচ্ছে।
কখনো-সখনো, অসৎ লোকেরা নির্ভেজাল সত্যকথা বলেছে, কিন্তু নিজেদের চেহারায় প্রতারকের অভিব্যক্তি ধরে রেখেছে ধাপ্পাবাজির ধারণা দেওয়ার জন্য। কর্মস্থলে বিরাট রকমের দায়িত্ব বোধ ফিরে এসেছে। সময়ের কাজ সময়েই হচ্ছে। কেউ প্রতারিত হচ্ছেনা। অর্থের লেনদেন অনেক কমে গেছে।
কিন্তু বোঝা যাচ্ছে যে বর্তমান নীতির বিরুদ্ধাচারন হচ্ছে।
মানুষের যেন সংহতির স্পৃহা বেড়ে উঠেছে – নতুন সংগঠন তৈরি হচ্ছে – নানান জায়গায় , নানান ভাবনায় – যেগুলো প্রত্যেকটাই যেন প্রশ্ন করে। বেশ সংগঠিত হচ্ছে মানুষ। এটাও বর্তমান নীতির বিরুদ্ধতা।
অনুগতদের কাছ থেকে আরও নানান রকম টুকরো টুকরো খবর পেয়ে শঙ্কিত করে তুলল ভূতো দাকে। ভূতোদা নিজেও কাছ থেকে বিষয়টাকে লক্ষ করতে চাইল – দেখল যে অনুগতদের অনুমান নির্ভুল।
কোন কোন ঘটনা শুনে বা দেখে – গোটা ধারনাটাই যেন পাল্টে যাচ্ছে – যেমন , বাজারের ওই ওষুধ বিক্রেতার ঘটনাটি। বহুকাল ধরে একটি বিশেষ পরিবারের পুরো একটি প্রজন্মকে বিষপ্রয়োগ করে আসছিল সম্পত্তির লোভে সে, এখন হঠাৎ ক্ষতিগ্রস্তের ছেলেমেয়েদেরকে ঔষধটির antidote দিয়ে বিষক্রিয়া নাশ করতে শুরু করেছে।
সমাজের উঁচু তলার মানুষ – বড় ব্যবসায়ী বলে পরিচিত – ব্যবসাও নানান রকম antique জিনিষের – এজেন্ট সারা পৃথিবীতে । মূল কাজ চুরি করা পৃথিবীর নানা দেশের নানান রকম antique items । খবর এলো ওরা নাকি ব্যবসা গুটিয়ে ফেলেছে । আদালতে সমস্ত চুরির কথা কবুল করেছে । বলছে এমন ব্যবসা আর করতে ভালো লাগছেনা । যা আছে , যেভাবে আছে সেটা নিয়েই ভবিষ্যৎ টা কাটিয়ে দেবে।
এক লম্পট – নিজের স্ত্রীর কাছে মিথ্যা বলে রোজ এক পরস্ত্রীর কাছে যায়, শোনা গেল সে সব কিছু ছেড়ে দিয়েছে , স্ত্রীর কাছে সব কথা স্বীকার করেছে। নারীরা অনেক রাত করে বাড়ী ফিরলেও , লোভাতুর মানুষের দ্বারা লাঞ্ছিত হচ্ছেনা। কর্মস্থলে নারীরা নির্বিঘ্নে কাজ করছে।
ভূতোদার, অনুগত – শ্রীমোহন, এসে বলল , সরকারি কার্যালয়ে সময় মতন সমস্ত ফাইল জায়গা মতন চলে যাচ্ছে , ফলে বিভিন্ন এজেন্সিতে বিক্ষোভ , কারণ – সময়ের এই মার প্যাঁচেই তো ওদের ব্যবসার রসদ। এক চরম অব্যবস্থা। এজেন্সীরাও তাই এই ব্যবসা ছেড়ে দিয়ে অন্য ব্যবসায় চলে যাচ্ছে । চালু কথা, স্পীড মানি , উঠে গেছে কাজের স্পীডে।
এত সংখ্যায় মানুষ নিজেদের দোষ কবুল করছে যে , আদালত – প্রশাসন – এক চরম ব্যস্ততায় । জেল গুলোতে আর জায়গা নেই । আসামীদের রাখতে হয়েছে খোলা জায়গায় – অথচ কোনো আসামী পালাচ্ছেওনা । মজুতদারদের জমা মাল,শস্য, খাবার , সব বাজারে উজার করে দিচ্ছে , ফলে জিনিষ পত্র বিকোচ্ছে বিনা পয়সায় , কেনবার লোক নেই । মজুতদাররা এই সব দিয়ে সবাই ধর্মস্থানে চলে যাচ্ছে। ধর্মস্থানগুলোও লোকে লোকারণ্য।
এতক্ষুনে দেবু মাথা তুলে দেখল , ঠেকের নিস্তব্ধতায় বেশ বোঝা যাচ্ছে – যেন এক হতাশা ও আস্বস্ততার এক সুচিন্তিত মেলবন্ধন, দেবুকেও ভাবিয়ে তুলল ।
দেবু আবার শুরু করল , একমুহূর্ত নষ্ট করল না ভূতো দা।
ধাক্কাটার গুরুত্ব তাকে কোনো কিছু ভাববার সময়ও দিলো না।
আবার অতীত পালক পিতার কাছে চলে গেল সে, ক্রোধে উন্মত্ত, এরকম একটি বিরল ঘটনার গুপ্তরহস্য জানবার জন্য ব্যাকুল।
পালক পিতা , সীমাহীন সন্তোষের সঙ্গে ওর কথা শুনলেন , কিন্তু বাধা দিলেন না বা জবাবও দিলেন না, এমনকি ভূতো দার যন্ত্রণা নিয়ে উল্লসিতও হলেন না। তিনি সোজা তাকালেন ভূতোদার চোখের দিকে , বললেন: ‘তুমি কি প্রত্যাশা করেছিলে, হে আমার বেচারা ভূতো ? তোমার কাছে যেটা সুনীতি সেটাই কি নীতির শেষ কথা নাকি ঐ নীতিগুলোও চিরকালীন। তুমি কি প্রত্যাশা করেছিলে – তোমার ভাবনার ফল ফলবে ও বেঁচে থাকবে চিরকালীন হয়ে। এরকম সময় আমাদেরও ছিল , আমরাও এই ধারনা করেছিলাম। তোমার প্রস্তাবেও রাজীও হয়েছিলাম- এই ভেবে যে তুমি ফিরে আসবেই – কারণ অবস্থা বলে – এটা একটা অদ্ভুত – ‘অচলা’ – বিরোধ , – ‘সচল’ – হয় কেবল নিজের তাগিদে, কখন বা কিভাবে সেটা জানা যায়না, বোঝাও অসম্ভব। এটাকেই বলা হয় মানুষের ‘অনন্ত স্ববিরোধিতা’ – যেটা চিরকালীন – শুধু কিছু সময় লাগে – বিরোধের ভারটাকে বওয়ার জন্য – সয়ে গেলেই আবার উদ্ভব হয় এক নতুন বিরোধ।
তাই ভূতো , তোমার ভাবা ‘সঠিক’ নীতিরও ‘সঠিক’তা নিয়ে সংশয় । “সঠিক” কথাটা নিয়ে একটু ভাবার প্রয়োজন হয়ে পড়ল – এক্ষেত্রে বোধ হয় খাটলোনা। ভূতো দার স্বপ্নটাও তাই ‘সঠিকতা” দোষে দুষ্ট হয়েই রয়ে গেল ।
ঠেকের সবাই যেন আর একটা স্বপ্ন দেখে উঠল ।
বেলা দুটো – বেশ গরম – সবাই উঠে পড়ল ।
লেখক পরিচিতি : অম্লান রায় চৌধুরী
লেখক, কবি , একটা গোটা সাহিত্য নিয়ে নাড়া চাড়া করি , নানান জায়গায় প্র কাশিত , নিজের বই আছে গল্পের, কবিতার , সমাদৃত।