লেখক : অর্ণব কুমার মন্ডল
ভোরের ট্রেনের হুইসেলের শব্দে ঘুম ভেঙে যায় রতনের। বিগত দুই বছর যাবৎ সে নিয়ম করে ভোরে ওঠে, এরপর কিছু পুজোর ফুল আর খবরের কাগজ নিয়ে উল্টোডাঙার কাছে হাডকোর ফুটপাতের ওপরে বিক্রির আশায় প্রায় বেলা দুটো অবধি অপেক্ষা করে। কোনদিন হয়তো কিছু বিক্রি হয়, আবার কোন দিন একেবারেই না হওয়ার মতো। তারপর অভুক্ত শরীরটাকে কোনমতে নিয়ে আসে রেল লাইনের ধারে বস্তির ঘরে। এক চিলতে ছিটে বেড়ার ঘরে রতন তার মা, বোন আর পঙ্গু বাবার সঙ্গে থাকে।
বছর দুই আগেও অবস্থাটা মোটেই এমন ছিল না। করোনা মহামারীর আক্রমণের আগে রতনের বাবা মালিকের অটো চালাত, রতনের মা দুই এক বাড়ি বাসন মাজার কাজ করত। রতন ও তার বোন ফুলি দুজনেই স্কুলে যেত। আধিক্য না থাকলেও তাদের খাওয়া-পরার অভাব হত না। কিন্তু হঠাৎ মহামারীর কালো থাবা গ্রাস করল সমগ্র বিশ্বকে আর তার সঙ্গে এই চারটি প্রাণীও তার শিকার হল। প্রথমেই লকডাউন এর কারণে রুটের অটো বন্ধ হল, এরপর ধীরে ধীরে রতনের মা এর কাজও চলে গেল। একপ্রকার নিরুপায় হয়ে ফুলির বাবা ঠেলাগাড়ি করে পাড়ায় পাড়ায় সবজি বেচতে শুরু করে।
চারটে পেট লকডাউন এর সময় চালানো সত্যিই দুঃসাধ্য। মাঝেমধ্যে কোথাও কোথাও সরকারি-বেসরকারি সাহায্যে খাবার বিতরণ হয়, কিন্তু সেও লম্বা লাইন। ভোর থেকে লাইন শুরু হয়, দুপুরের খাওয়ার গাড়ি আসার অপেক্ষায় কাঠফাটা রোদ্দুরে রাস্তায় দুই ছেলে মেয়েকে নিয়ে রতনের মা ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। মহামারীর প্রকোপে চারিদিকে মৃত্যুর হাতছানি। কিন্তু পেটের জ্বালা যে বড় জ্বালা, প্রান এমনিও যায় আর অমনিও যায়। এমন করে শুরুর কটা মাস খেয়ে না খেয়ে কাটছিল। এরপর একদিন কোন এক মদ্যপ ড্রাইভারের কৃপায় রতনের বাবার ঠেলা গাড়িসহ ডান পা’টা ভেঙে গেল। মহামারীর কারণে হসপিটালে বেডের অভাব আর তার সঙ্গে চরম অর্থাভাবে রতনের বাবার চিকিৎসাই তেমনভাবে হতে পারল না। যার ফলে সে এক পায়ে চলার শক্তি হারিয়ে ফেলে, আর সেই থেকে শুরু হয় এই দশ বছরের ছেলের জীবন সংগ্রাম।
বিকেল চারটে বাজে। সারা দুপুর মা আর বোনের সঙ্গে মিলে যে ধূপকাঠি গুলো প্যাকিং করেছে, এবার রতন সেগুলো বেচতে বের হবে। যদি কোন ট্রাফিক সিগন্যালের শীততাপ নিয়ন্ত্রিত গাড়ির জানালার ফাঁক দিয়ে কেউ কোন ধূপের প্যাকেট কেনে বা কোন পথচলতি যাত্রী দয়াপরবশ হয়ে এই নন-ব্র্যান্ডেড ধূপের প্যাকেট কেনে , তাহলে সেই রাত্রের খাবার ব্যবস্থা হয়। অভুক্ত ক্লান্ত শরীর, সংসারের চাপে নুয়ে পড়া ছোট্ট দুটো কাঁধ। জীবনের অনেক মূল্যবান পাঠ রতনকে বিগত দু’বছরে শিখিয়ে দিয়েছে, যার সব হয়ত পাঠ্য পুস্তকে লেখা থাকে না।
এই দু বছরে রতনের বেশ কিছু বন্ধু জুটেছে। সবারই পরিবারের অবস্থা কমবেশি সমান। ছোট্টু খবর দিল বিধাননগরের মেলায় গেলে তার সব ধুপ অবশ্যই বিক্রি হয়ে যাবে, কারণ সেখানে নাকি অনেক লোক ভিড় জমিয়েছে। আজ রবিবার মেলার শেষ দিন। রতন বিকেলে বিকেল ছোট বোনের হাত ধরে মেলায় যায়। সে ধুপ বেচবে আর সঙ্গে বোনকে মেলায় ঘোরাবে। এখানে এসে তার চোখ ধাঁধিয়ে যায়। কোথায় অভাব, কোথায় দারিদ্র, কোথায় ক্ষুধা! এখানে তো সব কিছুরই প্রাচুর্য। তাদের বয়সি ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা রংবেরঙের জামা কাপড় পরে একের পর এক দোকানে ঘুরছে আর তাদের হাতে হরেক রঙের প্যাকেট। তার মধ্যে কত বই! রতনের বোন একটা আইসক্রিমের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে পড়েছে, দুই ভাইবোন ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে দেখছে তাদেরই বয়সি ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা এমন কি বড়োরাও রংবেরঙের আইসক্রিম খাচ্ছে। রতন একবার তার বুক পকেটে হাত চালিয়ে কয়েনগুলো গুনে নেয় আর তারপর বোনের হাতটা ধরে টানতে থাকে। যত দূর থেকে ওই আইস্ক্রিমওয়ালাকে দেখা যায়, ফুলি পিছন ফিরে একবার করে দেখতে থাকে। রতন বোনের থুতনি ধরে সামনের দিকে ঘোরায়। সামনে কিছু ছেলেমেয়ে রংবেরঙের জামা কাপড় পরে গান গাইছে। দুই ভাইবোন অবাক হয়ে এদের দিকে তাকিয়ে থাকে।
গানের প্রথম কটা লাইন হল “….আমরা সবাই উন্মুক্ত ….আমরা সবাই বইমেলায় ব্যস্ত ….” । মেলাশেষে একটা হাওয়াই মিঠাই কিনে দুই ভাই-বোন খেতে খেতে বাড়ি ফিরছে আর দুজনেই মেলায় শোনা গানের কটা লাইন আওড়াচ্ছে ….“আমরা উন্মুক্ত…”
অর্ধভুক্ত বালক-বালিকার গান ছুঁড়ে দিচ্ছে একটাই প্রশ্ন , কারা প্রকৃত অর্থে উন্মুক্ত?-
ওই দুটি শিশুমন ?
যারা মেলা উপভোগ করল তারা ?
সমাজ ব্যবস্থা ?
এর মূল্যায়ন আপনাদেরই হাতে….।
লেখক পরিচিতি : অর্ণব কুমার মন্ডল
জন্ম ১৮ই শ্রাবন ১৩৮৯( ৪ঠা আগস্ট ১৯৮২)কলকাতা,ভারত।শৈশব কেটেছে দমদম ক্যান্টনমেন্টের মাটিকোল অঞ্চলে । শিক্ষা কলকাতায় । শিক্ষাগত যোগ্যতা মাস্টার্স ইন কম্পিউটার অ্যাপ্লিকেশন ।বর্তমানে তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থায় কর্মরত । ছবি আঁকা আর লেখালেখি করা শখ ।ইতিমধ্যে কিছু লেখা প্রকাশিত বিভিন্ন পত্রিকায় ।অঞ্জলি প্রকাশনীর হাত ধরে পূর্ণদৈর্ঘ্যের অলৌকিক ও ডিটেকটিভ গল্পের সম্ভার নিয়ে "চক্রব্যূহ" ও সামাজিক উপন্যাস " স্বদেশ" প্রকাশিত হয়েছে ।