লেখক : রাজীব ঘোষ
তুমিইতো কিছুক্ষণ আগে ভাষন দিচ্ছিলে না?
প্রশ্ন টা ছুটে আসলো তপন বাবুর কাছে।
একটা ৪৪-৪৫ বয়স্ক পাগলের কাছ থেকে। এক গাল দাড়ি, কাঁচা পাঁকা চুল গুলো সব কাধের কাছে এসে পরেছে। অত্যন্ত নোংরা জামা যার পরে পিঠের দিকে ছেঁড়া আর নিচ থেকে ছেঁড়া অংশটা ঝুলছে। বাদামি রং চটা একটা ফুল প্যান্ট তাও ডান দিকের হাঁটুর নিচ থেকে ছেঁড়া। আর একটা নারকলের দঁড়ি দিয়ে আচ্ছা মতো গিঁট দিয়ে বাঁধা কোমরে। কিন্তু চোখ দুটো খুবি বুদ্ধি দ্বীপ্ত আর বড় বড়।
তপন বাবুএকজন ব্যাঙ্কের কর্মচারী ২৫ বছর চাকরি জীবন এবং ইউনিয়ন লিডার। মাঝে সাঝে রাস্তায় দাড়িয়ে ভাষন দিতে দেখা যায় কর্মচারী দের দাবি দাবার বিষয়ে ,ভালো বক্তা।
তপন বাবু অফিস থেকে বাড়ি ফেরত পথে শিবুদার দোকানের চা টা না খেলে যেন চলেনা। সেই সাথে নানা আড্ডাও চলে তার তবে ঘন্টা খানেকের বেশি বসেন না শিবুদার ওখানে কিন্তু আজ একটু অবাকই হোলেন তপন বাবু। এই পাগল গোছের লোকটাকে তো কখনো দেখেনি সে।
পাগল টার প্রশ্ন শুনে অবাক হয়ে হাসি মুখে জিজ্ঞাসা করলো!
তুই শুনছিলিস বুঝি?
পাগলটা একটা বিজ্ঞের মতো মথাটা নাড়িয়ে হ্যাঁ বল্লো।
তপন:- কিছু বুঝলি?
পাগল:- সবটা না তবে কিছুটা।
তপন:- কোথায় থাকিস তুই?
পাগল:- ঐ দিকের বস্তিতে। বলে একটু চুপ করে তারপর আবার বলে উঠলো আমার লাল রংটা খুব প্রিয় জানো।
আমি আগে রংয়ের কাজ করতাম এই গাড়ি কখনো আলমারির রং করতাম।
তপন:- ঘুড়ে বেড়াস কেন?
পাগল:- আমার একটা ছেলে ছিল, বয়স যখন ৭ না না ৮ হবে। তখন একটা কঠিন রোগ ধরে ওকে বেশ কিছুদিন ভুগালো। কতো হাসপাতালে নিয়ে গেলাম সেদিন যখন ও খুব কষ্ট পাচ্ছিলো কিন্তু কেউ নিলোনা গো। মায়ের কোলেই কষ্ট পেয়েই মারা গেলো ছেলেটি হাসপাতালের বাইরে।
ওর মা তারপর থেকে পাথর হয়ে গেলো আর আমি…..বলে চুপ করে গেলো।
আমার একটা মাত্র ছেলে জানো আমি না ওকে লাল্টু বলে ডাকতাম। খুব ফরসা ছিলো কিনা। বলে খিল খিল করে হেসে উঠলো।
এখন সবাই আমায় বিশু পাগলা বলে ডাকে বেশ গম্ভীর হয়ে বলল।
এতক্ষন তপন বাবু চুপ হয়ে গেছিল, তারপর একটা সিগারেট ধরালো।
তপন:- তুই এখন কি করিস?
পাগল:- ঘুরে বেড়াই এখানে ওখানে যেখানে মন চায়। বৌ-টা খোঁজ পেলে আমায় ধরে নিয়ে যায়। আমায় বেঁধে রাখে জানো।
তপন:- তা এখন এই রকম করে ঘুরে ঘুরে ভাষন শুনে বেড়াস?
পাগল:- একটা কথা জিজ্ঞাসা করব? আমাকে না খুব ভাবায়।
তপন:- বলনা?
পাগল:- লড়াই আর যুদ্ধ তো একই কথা, না?
তপন:- তা- হ্যাঁ- বলতে পারিস একই কথা। কেন?
তা কি ভাবায় বল্লিনাতো?
পাগল:- অনেক কিছুই কিন্তু! আমায় ভাবায়। বড্ডো ভাবায় বলে চুপ করে গেলো।
তাকিয়ে থাকলো রাস্তার ধারে ল্যাম্প পোস্টের দিকে)
পাগল:- সেদিন তুমি যে মিছিলে ছিলে আমিও ছিলাম সবার পেছনে সেদিন। তুমি তো ছিলে সবার আগে।
সেদিন তুমি বলছিলে যুদ্ধ নয় শান্তি চাই।
কিন্তু আজকের ভাষনে কেন মেলাতে পারছিনা আমি। (বলে মাথা চুলকাতে বিস্ময়ে) ,তাই তো আমি চলে এলাম তোমার পেছন পেছন।পাগল:- আজ কেন ওখানে দাড়িয়ে বল্লে লড়াই লড়াই লড়াই চাই।
তাহলে যুদ্ধ কি লড়াই কোনটা?
তপন বাবু যেন একটু ধাক্কা খেল। কি বলবেন ওকে। ওতো পাগল ওকে তো ওর মতন করেই বোঝাতে হবে। কিছুটা অস্বস্তি, বিপন্নতা, বিস্ময় যেন শরীরে খেলে গেল। ভাবলেন, আরো বিস্ময় নিয়ে ভাবলেন তপন বাবু। এক সময় চশমা খুলে সিগারেট ধরালেন আরাকটা। চেয়ে দেখলো। পাগল টা হাতের লাঠিটা তরোয়ারির মতো ঘোরাতে ঘোরাতে হাটা লাগিয়েছে আর চিৎকার করে বলতে লাগলো লড়াই লড়াই লড়াই চাই তারপরেই আবার চিৎকার করে বলে উঠলো যুদ্ধ নয় শান্তি চাই। তারপর পাগল টা আর তার আওয়াজ টা রাস্তার ধারে অন্ধকার গলিতে মিশে গেল।
লেখক পরিচিতি : রাজীব ঘোষ
মাত্রক্সা