লেখক : সন্দীপ লায়েক
এক
পুরো পরিকল্পনাটা ছিল ২০১৭-র পুজোর। কিন্তু গুরুং মামা হঠাৎ গোঁসা করলেন। দাদা-দিদিরা ফায়দা লুটতে কচকচিতে মাতলেন। এসব দেখে প্রকৃতিও বুঝি রুষ্ট হলেন। গিন্নীর খুশিমাখানো মুখে নিকষ কালো মেঘ জমলো, আর আমার মন গ্রাস করল একরাশ বিরক্তি।
কিন্তু উপায় কি? ট্রেনের বুকিং তড়িঘড়ি ক্যানসেল করলাম। তাই বলে হোমস্টের বুকিং ক্যানসেল? কভি নেহি। করিনি। কারণ সেটা হলে যদি যাওয়া না হয়! ওরা পড়ে থাক রাজনীতি নিয়ে। কিন্তু এ যে আমার সাধের দার্জিলিং, বারবার ফিরে যেতে আমায় হবেই।
দুই
গ্রুপে একদিন একটা পোস্ট করলাম। লেপচাজগতে কি কি দেখবো? শেয়ার গাড়ি মিলবে কি না?
তা কিছুজন উৎসাহ দিলেন। ফুচকাপ্রেমী ও ম্যালপ্রেমীরা বললেন, “একদম যাবেন না। লামাহাটা যান, লাভা যান… ওখানে কিস্যু নেই।”
আমি বুঝলাম সঠিক জায়গাই নির্বাচন করেছি। এমনটাই যে আমি চাই, যেখানে পরম শান্তি আছে, পাইন বনের ফাঁকে চুইয়ে পড়া আলো আছে, চোখজুড়ানো কাঞ্চনজঙ্ঘা আছে, কুয়াশা মাখা পথ আছে, লোকজনের নিখাদ ভালবাসা আছে।
চার বছরের আদুরি কন্যা তথা সহযাত্রীনীর কথা ভেবে নতুন করে পরিকল্পনায় আঁটলাম। ফেব্রুয়ারীর শুরুতে যাব, শীতটা ততদিনে একটু কমে আসবে।
তিন
দার্জিলিং মেলে লুচি আলুভাজা আর মিষ্টি পেটে পুরে ট্রেনের দুলুনীতে দুলতে দুলতে একসময় সাড়ে নয়টায় সপরিবারে পৌঁছে গেলাম নিউ জলপাইগুড়ি। সেখান থেকে অটো ধরে শিলিগুড়ি বাসস্ট্যান্ড। তারপর শেয়ার গাড়িতে আড়াই জনের জন্য চারটা সিট বুক করে সোজা মিরিক। পথের বাঁকে বাঁকে বানর পরিবার, পাহাড়ী মানুষদের হাঁটাচলা, পাহাড়ের নিচে ভেসে থাকা ছোট ছোট ঘরবাড়ি, ও নয়নাভিরাম বাঁকের শোভা দেখতে দেখতে যখন মিরিক পৌঁছলাম, তখন ঘড়ির কাঁটা দুপুর বারোটা ছড়িয়েছে। মিরিক লেকের পাশে আধঘন্টা ঠান্ডা হাওয়া গায়ে লাগিয়ে নিজেদের রিসার্ভড কারে উঠে বসলাম লেপচাজগতের উদ্দেশে।
মিরিক ছাড়াতেই পথের দৃশ্যপট এতটাই সুন্দর হয়ে উঠল, যে তা ভাষায় প্রকাশ করা আমার সাধ্যাতীত। দুর্দান্ত সব চা বাগান আর আবেগ মাখা বাঁক – দুচ্ছাই মুন্নার! পথে যেতে যেতে গোপালধারা চা বাগানে কিছুক্ষণ কাটিয়ে উল্টোদিকের দোকানে দার্জিলিং চায়ে চুমুক দিতেই মন শান্তিতে ভরে উঠল। আবার স্টার্ট নিয়ে এগিয়ে চলল আমাদের গাড়ি। থামলো এসে নেপালের পশুপতি মার্কেট সীমান্তে।
নিজেদের সচিত্র পরিচয় পত্র দেখিয়ে আরেকটা গাড়ি রিসার্ভ করে ঢুকে পড়লাম আমাদের পড়শী রাষ্ট্র নেপালে। দেখে নিলাম পশুপতি মন্দির ও পশুপতি মার্কেট। এই মন্দির কিন্তু নেপালের ভয়ংকর ভূকম্পনে দিব্যি রেহাই পেয়েছে। পশুপতি মার্কেটে জিনিসপত্রের দাম অভাবনীয় কম। কিন্তু এটাও জানা ছিল, যে চীনা নকল দ্রব্য সেখানে আজ রমরমিয়ে রাজত্ব করছে। তাই কয়েকটা ছোটখাট কয়েকটা জিনিস কিনে আবার উঠে পড়লাম গাড়িতে।
পশুপতি সীমান্ত পেরুতেই ঠান্ডার প্রকোপ ক্রমশ বাড়তে শুরু করল। টুপির উপর জ্যাকেটের হুডটা মাথায় তুলে দিয়ে ব্যাগের ভেতর গ্লাভসগুলো হাতড়াতে লাগলাম। এবার গাড়ি এসে থামলো ভিউ পয়েন্টে। সেখানে হু-হু ঠান্ডার সাথে হাল্কা শিরশিরে হাওয়া শরীর বিকল করে দিতে লাগল। শিরশিরিয়ে ঠান্ডা হাওয়া তখন জ্যাকেটের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করতে উদ্যত।
বাঁকের উপর সারি সারি বৌদ্ধ পতাকাগুলো পতপত করে অবিরাম নড়ে চলেছে। নিচে মেঘেরা যেন গাভীর মত চরে। মেঘের ফাঁক দিয়ে দেখা যায় স্বপ্নের মধ্যে ভেসে থাকা ছোট ছোট বাড়িঘর।
চার
এদিকে ক্ষিদেও লেগেছে প্রবল। ঝুপড়ির দোকানে গরম গরম ঝাল মোমোয় কামড় দিতে শরীরটা বুঝি একটু গরম হল। পাশেই কাঠের আগুন জ্বেলে ঘিরে বসে আছে দুজন। কাছে যেতেই তাঁরা দিব্যি আমাদের আপন করে নিলেন। কিছুক্ষন হাত-পা গরম করে উঠে আবার চড়ে বসলাম গাড়িতে।
গাড়ি যতই ছুটতে লাগল, ঘন কুয়াশা আমাদের দৃষ্টিপথে বাধা দিতে থাকল। রাস্তার নিচে গভীর খাদ থেকে মাথা উঁচু করে উঠে এসেছে সারি সারি পাইনের জঙ্গল। তাদের পায়ের তলায় সূর্যের আলো কখনও পৌঁছেছে কিনা সন্দেহ!
কিছুক্ষন পর মেন রোড থেকে বাঁক নিয়ে চড়াই বেয়ে গাড়িটা উঠতে লাগল। পথে অজস্র খানাখন্দ পেরিয়ে মিনিট দশ পরে হাড়গোড় আলগা করে আমরা এসে থামলাম জোড়পোখরির গেটের সামনে। “জোড়” কথার অর্থ হলো দুই আর “পোখরি”র অর্থ হলো পুকুর। ঠিক তাই। সামনেই দেখা গেল একটি সুন্দর পুকুর, তার মধ্যিখানে মুখ তুলে বিশালাকার এক সাপের অবয়ব, আর তার চারিদিকে পর্যটকদের জন্য ছড়িয়ে ছিটিয়ে পেতে রাখা ধাতব চেয়ার। একটু দূরেই গোর্খা কটেজ, নিচে ঘন কুয়াশার মিশে পাইনের গহন অরন্য।
শুনেছিলাম এখান থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা নাকি দারুণ দেখা যায়, কিন্তু এই কুয়াশায় সেই সৌভাগ্য আমাদের ছিল না।
আবহাওয়া দেখে দিন না রাত সেটা বোঝার কোন উপায় নেই! মোবাইল স্ক্রিন ছুঁতেই ডিজিটাল ঘড়িতে ফুটে উঠল বিকেল চারটে দশ। আর না। যত দ্রুত সম্ভব সেখান থেকে আমরা গাড়িতে উঠে পড়লাম। উফ, গাড়ির গরমে কি স্বস্তি!
কিছুটা নামতেই বাম দিকে তাকাতে চোখে পড়ল নির্মায়মান এক মনেস্ট্রি। ড্রাইভার ভাই জানালো “সুখিয়া মনেস্ট্রি”। সুখিয়া পোখেরী বাজার থেকে আরও কিছুটা এগোতেই কুয়াশাটা যেন আরো ঘন মনে হ’ল। সামনে আর কিছুই দেখা যায় না। হঠাৎ হঠাৎই বিপরীত দিক থেকে লাইট জ্বালিয়ে ছুটে আসছে গাড়ি।
অবশেষে একটা ছোট্ট গ্রামের দেখা মিলল, মাত্র গোটা দশেক ঘর। প্রায় সবগুলোই এক একটা হোমস্টে। এই গ্রামের নামই লেপচাজগত, যেখানে পথ রুদ্ধ করে দাঁড়িয়ে বিশাল এক পাহাড়, যার সারা শরীর জুড়ে সাজানো পাইন গাছের সারি। গ্রামের প্রান্তে এসে বামদিকে ছোট্ট একটা বাঁক নিয়ে একটা লাল বাড়ির সামনে দাঁড়ালো গাড়িটা – “পোখরীন হোমস্টে”।
পাঁচ
হোমস্টেটি দোতলা। লোকজন বিশেষ নেই। আমাদের ঠাঁই হলো দোতলায়, যেখান থেকে বামদিকের পাল্লা খুললেই দেখা যাবে কাঞ্চনজঙ্ঘা। নিচে তাকালে হাতছানি দেয় WBFDC-র ফরেস্ট বাংলো।
রবিন তামাং-এর পরিবার এই হোমস্টে চালান। তার বৃদ্ধ বাবা-মাই মূলত সবকিছু দেখাশোনা করেন। একটি বাচ্চা মেয়ে গরম জল ও চা নিয়ে ছুটে এলো। একটু পরেই এলো প্লেট ভর্তি ভেজ পকোড়া। গিজারের গরম জলে হাত পা ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে চা আর পকোড়া নিয়ে বিছানায় উঠে বসলাম। ঠান্ডায় হাত পা যেন জমে যাচ্ছে। তাপমাত্রা শূন্যের আশেপাশে। তিনটে মোটা কম্বলকে যেন এক একটা বেডশিট মনে হচ্ছে। রবিন ভাইকে বলতে আরো একটা কম্বল দিয়ে গেলেন। সামনের দরজা খুলতেই দেখা গেল, ঘন কুয়াশায় সামনের দৈত্যাকার পাহাড়ের গা বেয়ে ফগ-লাইট জালিয়ে ছুটে যাচ্ছে এক-একটা গাড়ি। বহুদূরে পাহাড়ের নিচু ঢাল থেকে দেখা যাচ্ছে ক্ষীণ আলোর রাশি – দার্জিলিং শহর।
রাত্রিতে একটা ভাজা সব্জি, চিকেন কষা, ও রুটি তৃপ্তি করে খেয়ে দশটার মধ্যে চারটা কম্বলের নিচে সটান শরীর ঢুকিয়ে দিলাম।
ছয়
সকাল ছয়টায় একটা হইহই আওয়াজে ঘুম ভাঙল। লেপচাজগত তখনও এক অপূর্ব স্বপ্ন জগৎ। ঘুম ভাঙছে পাহাড়ের, ঘুম ভাঙছে পাখিদের, ঘুম ভাঙছে জঙ্গলের।
ওপরের ব্যালকনি থেকে দেখি সেই বৃদ্ধ মানুষটি হোমস্টের ক্যাম্পাসে একটি বুনো শুয়োরের দিকে হাত বাড়িয়ে দেখাচ্ছেন। শুয়োরটা রাত্রে লেপার্ডের আঁচড়ে ক্ষতবিক্ষত হয়ে কোন রকমে প্রাণ বাঁচিয়ে হোমস্টের কাছাকাছি চলে এসেছে। বৃদ্ধ কিছু খাবার দিতেই সেটি সাবাড় করে ধীরে ধীরে জঙ্গলের দিকে পা বাড়ল। বৃদ্ধ জানালেন রাত্রে এখানে লেপার্ড হামেশাই চলে আসে, কিন্তু দিনের আলোয় তারা কোথায় যেন হারিয়ে যায়। এই ক’দিন আগেই তাদের পোষা কুকুর টেনে নিয়ে যেতে লেপার্ড এসেছিল। তিনি রাত্রে লাঠি নিয়ে বেরিয়ে আসতেই সেটি পালিয়ে যায়। এই জঙ্গলে ভালুক ও হরিণও আছে প্রচুর।
সকলকে ঘুম থেকে তুলে ব্রাশ সেরে ফ্রেশ হয়ে মেরি বিস্কুট সহযোগে দার্জিলিং চায়ে চুমুক দিলাম। আজ আমাদের প্ল্যান বলতে হেঁটে হেঁটে এই গ্রাম ঘুরে দেখা। সর্বজ্ঞ বন্ধুটি জানিয়ে দিয়েছেন, “একটা দিন এখানে না থাকলে এই জগতের ফিলিংসটা ধরতে পারবি না।” ভ্রমণের ব্যাপারে সে যে সত্যবাদী যুধিষ্ঠির, সে তো আজ অজানা নয়।
ন’টার মধ্যে স্নান সেরে নিচে নেমে এলাম। দেখি আলুর পরোটা তৈরি করছেন বৃদ্ধা। কিচেনে আগুনের দেশী ফায়ারপ্লেস ঘিরে বসে আছেন বৃদ্ধ ও সেই ছোট্ট মেয়েটি। আমরাও তাদের সাথে আগুন ঘিরে বসে পড়ে গল্পের আসর জমালাম। গরম গরম ফাটাফাটি আলু পরোটা, চাটনি, আর আলুরদম খেতে খেতে ভাবলাম শুধু এনাদের আন্তরিকতা ও পরোটার জন্যই বার বার হয়তো ফিরে আসা যায় এখানে।
সাত
খাওয়া সেরে এক কিলোমিটারের মধ্যে গভীর জঙ্গলে ঘুম রক দেখতে যাবার কথা বলতেই বৃদ্ধ একা একা সেখানে যেতে বারণ করলেন। প্রথমত, পথ চিনে ফেরা মুশকিল। দ্বিতীয়ত, ঘন জঙ্গলে জন্তু জানোয়ারের পাল্লায় পড়লে বিপদ হতে পারে। তাই গাইড না নিয়ে যাওয়া মোটেই ঠিক হবে না।
তারপর বৃদ্ধ হঠাৎই তার গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে বললেন, “সাহেব, চলুন আমিই যাব আপনাদের সঙ্গে।” গাড়িটা গ্রাম ছড়িয়ে ঘুম স্টেশনের পথ বরাবর কিছুটা এগিয়ে পাহাড়ের নিচে থামল। তারপর বৃদ্ধ একটা সরু পাহাড়ী পথ দেখিয়ে বললেন, “আগে এই পথে আগে গাড়ি যেত, কিন্তু ধ্বস নেমে এখন সব বন্ধ হয়ে গেছে।”
ছমছমে অন্ধকারে বৃদ্ধকে অনুসরণ করে আমরা ঘন জঙ্গলে ধীরে ধীরে এগিয়ে চললাম। নিজেরাই যেখানে ভালোভাবে হাঁটতে পারি না, সঙ্গী আবার চার বছরের কন্যে!
নাকানি চোবানি খাচ্ছি দেখে বৃদ্ধ এগিয়ে এসে কন্যেকে পিঠে তুলে তরতর করে খাড়াই পাহাড়ে চড়তে লাগলেন। আর আমরা? কোনক্রমে পাথর, সরু ডাল অবলম্বন করে হাঁপাতে হাঁপাতে অবশেষে একটা প্রকান্ড পাথরের নিচে এসে দাঁড়ালাম। ঘুম রক – যার পায়ের নিচে দাঁড়িয়ে শেষপ্রান্ত দেখতে গেলে মাথা ঘুরে যাওয়ার যোগাড়।
সেখানে কয়েকটা ছবি তুলে কোনক্রমে হামাগুড়ি দিতে দিতে নেমে এলাম পথের ওপর। গাড়িতে আমাদের হোমস্টের সামনে নামিয়ে বৃদ্ধ রওনা দিলেন সুখীয়াপোখরি বাজারের দিকে।
এদিকে আবহাওয়ার চূড়ান্ত পরিবর্তন। ঘন কুয়াশা ঘিরে ধরেছে চারিদিক। নাকের সামনে দিয়ে ভেসে বেড়াচ্ছে মেঘেদের দল! সে মেঘ হাত দিলে হাত ভিজে যায়। সে যে কি অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করা যায় না।
আমরা ধীরে ধীরে হোমস্টেগুলোর নাম দেখতে দেখতে এগিয়ে চললাম গ্রামের ভেতরে।
আট
হেঁটে হেঁটে এগিয়ে চলেছি হঠাতই কুয়াশা ফুঁড়ে এগিয়ে এলেন এক ভদ্রলোক। “তা আপনারা কোথায় উঠেছেন?”
আমি বললাম, “পোখরীন হোমস্টে।”
তারপর হোমস্টের পিছনের পাহাড়টির দিকে আঙুল দেখিয়ে বললেন, “এখানের ভিউ পয়েন্টটা দেখেছেন? এই পথ দিয়ে সোজা উঠে যান। খুব ভালো লাগবে।”
ধন্যবাদ জানিয়ে আমরা আবার পাহাড়ের পথ ধরলাম।
ভিউ পয়েন্টটি খুব উঁচু নয়। কিন্তু ঘুম রকের ট্রেকিং পায়ে ব্যথা জাগিয়ে দিয়েছে। তবু হার মানলে চলবে না। আমরা ধীরে ধীরে পা ফেলে উপরে উঠতে লাগলাম। বাঁধানো সিঁড়ি বেয়ে বেশ কিছুটা গিয়ে একটা ফ্ল্যাট পরিচ্ছন্ন জায়গায় পৌঁছলাম – লেপচাজগত ভিউ পয়েন্ট। এখানে কেউ কোত্থাও নেই, শুধু একটা দোলনা ও ধাতব চেয়ার নিস্তব্ধতা ভাঙার জন্য আমাদের আহ্বান জানাচ্ছে।
মেঘের আড়ালে থাকা কাঞ্চনজঙ্ঘা তবু চোখে ধরা দিল না। আমরা সেখানে বসে কিছুটা সময় কাটিয়ে আবার নেমে এলাম পথে।
তারপর গুটি গুটি পায়ে নেমে এগিয়ে গেলাম WBFDC-র ফরেস্ট বাংলোর দিকে। চারদিকে পাখিরা ফুড়ুৎ ফুড়ুৎ করে উড়ে বেড়াচ্ছে সেখানে। একটা বাঁক নিতেই ফরেস্ট বাংলোটা দেখা গেল। লোকজন বিশেষ নেই। কেয়ারটেকাররা দিব্যি গল্প জুড়েছেন। কিছুক্ষন সেখানে কাটিয়ে কন্যেকে পিঠে তুলে আবার হাঁটা দিলাম পোখরীনের দিকে।
দুপুরে গরম গরম ভাত, আলুভাজা, ফুলকপির তরকারি, স্যালাড, ও ডিমের ঝোল নিমেষে পেটের মধ্যে চালান দিলাম। আগের দিন লাঞ্চ হয়নি, তাই দুর্দান্ত রান্নায় পেটটা কিছু বেশিই ভর্তি করে ফেলেছি। একটু গড়িয়ে নিলাম বিছানায়।
বিকেলে আলু পকোড়া সহযোগে চা খেয়ে নেমে এসে এই জগৎকে শেষ দেখা দেখতে আবার রাস্তায় নেমে পড়লাম।
নয়
কিছুক্ষন ঘুরেফিরে পোখরীনে ফিরে এসে ফায়ার প্লেসে সবাই মিলে গল্পে মাতলাম। এনাদের পরিবারের গল্প, এই স্নিগ্ধ গ্রামের গল্প, জঙ্গলের গল্প, আমাদের ফ্যামিলির গল্প হতে হতে রাত বাড়তে লাগলো।
আমাদের এটাই এখানে শেষ রাত্রি। কাল সকাল ন’টায় জলখাবার সেরে আমরা চলে যাব দার্জিলিং। এখান থেকে রিসার্ভ গাড়ির কোন সমস্যা নেই। শেয়ার গাড়ির কথা বলতে বৃদ্ধ জানালেন যে এখান থেকে ঘুম স্টেশন হয়ে দার্জিলিং শেয়ার গাড়ি সারাদিনই পাওয়া যাবে, কোন চিন্তা নেই। ভাড়া মাত্র তিরিশ টাকা। তিনিই ডেকে দেবেন। চাইলে সকাল নয়টা পর্যন্ত মিরিকের গাড়িও পাবেন, কিন্তু তারপর হয়তো নাও পেতে পারেন।
রাত্রের খাবার সেরে আবছা অন্ধকারে পাহাড়ের অবয়ব ও নিচে দার্জিলিং শহরের টিমটিমে আলো দেখতে দেখতে লেপচাজগতের কোলে মাথা এলিয়ে দিলাম। মনে মনে প্রার্থনা করলাম, ভাল থাকুক লেপচাজগত, ভাল থাকুক এখানকার মানুষজন। মনে মনে কথা দিলাম, আবার ফিরে আসব এখানে, সেবার কিন্তু কাঞ্চনজঙ্ঘা দর্শন থেকে বঞ্চিত করলে চলবে না…
কিভাবে যাবেন
এক) ৩০০ টাকা দিয়ে NJP থেকে শেয়ার গাড়িতে ঘুম স্টেশনে নেমে, আরো একটা শেয়ার গাড়িতে ৫০ টাকা দিয়ে দিব্যি চলে আসতে পারেন এখানে।
দুই) NJP থেকে টোটো বা অটোতে শিলিগুড়ি বাসস্টান্ড গিয়ে শেয়ার গাড়িতে মিরিক, জন প্রতি ১৫০ টাকা। ওখান থেকে শেয়ারে লেপচাজগত মাত্র ৩০০ টাকা (শেয়ারে সাইট সিন করতে পারবেন না)। মিরিক থেকে রিসার্ভ গাড়িতে সাইট সিন সেরে লেপচাজগত ৩,০০০ টাকার মত, যেটা আমি সাজেস্ট করব।
তিন) NJP থেকে মিরিক ছুঁয়ে রিসার্ভ কার ৪,৫০০ এর মতো, ঘুম হয়ে গেলে সেটা ৩,৫০০০ র আশেপাশে। সিজন অনুযায়ী ভাড়ার হেরফের হতেই পারে।
লেখক পরিচিতি : সন্দীপ লায়েক
পেশায় তথ্যপ্রযুক্তি কর্মী, শখে লেখক