আদিম স্বপ্নের উপত্যকা – তিংভং – শেষ পর্ব

লেখক: কৃষ্ণাশীষ রায়

তিংভং এর হোমস্টে থেকে ভোরের হিমালয়

অসংখ্য ঝর্ণা, জলপ্রপাত, লেক, গা ছম ছম করা জঙ্গল, পাখি, প্রজাপতি, অর্কিড আর কিছু অসাধারণ ছবির মত সরল সুন্দর ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা লেপচা গ্রাম নিয়ে উত্তর সিকিমের জঙ্গু উপত্যকা।কাঞ্চনজঙ্ঘা বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভ সম্প্রতি ইউনেস্কোর “ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট” হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছে। তিংভং গ্রামটার একের তিন ভাগ ঘিরে রেখেছে কাঞ্চনজঙ্ঘা রেঞ্জ | মাঝে ঘাড় উঠু করে দাঁড়িয়ে আছে মাউন্ট পান্ডিম | চারিদিকে অর্কিড, পাহাড়ি ফুল, প্রজাপতি ও অসংখ্য পাখি, গ্রামটাকে প্রকৃতি দিয়েছে ঢেলে। প্রধান আয় চাষবাস। সকাল থেকে রাত্তির অবধি যা খাবেন…ভাত, ডাল, আলু, পেয়াঁজ, লংকা, কপি, বেগুন, মুলো, পালং, লেবু, পেয়ারা, মাংস (শুয়োর, মুরগি), দুধ — সবই এই গ্রামেই চাষ ও ফার্মিং। আর রকমারি অর্গানিক ফুড। এমনকি দেশি পানীয় অবধি ভেষজ পদ্ধতিতে। প্রধান রোজগার এলাচ আর দারচিনি। অর্কিড ও প্রজাপতি বিশেষজ্ঞ যদি হন, তা হলে তো কথাই নেই। দু’দিন এমনি এমনি কেটে যাবে।

পাহাড়ি শৈশব

জঙ্গু র ইতিহাস : বহু শতাব্দী ধরেই এই অঞ্চলের আদি বাসিন্দা লেপচারা। লেপচা উপজাতিদের জীবনযাত্রা, ইতিহাস, রীতি রেওয়াজ, সংস্কৃতি, ভাষা ছড়িয়ে আছে জঙ্গু উপত্যকা জুড়ে।সাথেই রয়েছে এই সংস্কৃতি হারিয়ে যাওয়ার ভয়ও। আগ্রহীরা পড়ে ফেলতে পারেন A.R. Foning এর লেখা বই ‘Lepcha: My Vanishing Tribe’।  সেই ১৯৬০ সাল থেকেই সিকিম সরকার লেপচা প্রজাতি ও তাদের সংস্কৃতি হারিয়ে যাওয়া থেকে বাঁচাতে জঙ্গুকে ‘বিশেষ লেপচা সংরক্ষিত এলাকা’ বলে ঘোষনা করেছে।

তখনো সিকিমে চোগিয়াল রাজতন্ত্র। রাজা চোগিয়াল পলডেন থনডুপ নামগয়াল আর লেন্দুপ দর্জির সাপে নেউলে সম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে আধিপত্যবাদী দখলদার ভারত পৃথিবীর মানচিত্র থেকে আর একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের মানচিত্র মুছে ফেলেছিল তার ইতিহাস।

এখানে পা ডুবিয়ে বসে থাকতে পারেন

পরদিন সকালে হোমস্টের জানলার পর্দা সরিয়েই দেখা গেল পান্ডিম, কাব্রু আর কাঞ্চনজঙ্ঘার কিছুটা অংশের অপরুপ সৌন্দর্য। তাড়াতাড়ি ব্রেকফাস্ট সেরে আজ সারাদিন ঘুরে বেড়াবো এই গ্রাম গুলোতে। দুপদেনের রান্না ঘরে প্রায় সবরকম ফলের ওয়াইন দেখেছি। লেপচারা নাকি যেকোন ফলের ওয়াইন বানাতে ওস্তাদ। সেখানকার স্থানীয় পানীয় নাম ‘চি’|

আবার আসবেন তো আমাদের সাথে সময় ভাগ করে নিতে !!!

এবারে আমাদের গ্রাম বেড়ানোর পালা | অন্যান্য টুরিস্ট স্পট এর মতো এখানে কিন্তু কোনো ‘অমুক পয়েন্ট তমুক পয়েন্ট ‘নেই | নেই কোনো গাড়িওয়ালা বা টুর অপারেটর দেড় তাড়া | দু-তিন দিন নিজের মতো ঘুরে বেড়ান। হাইকিং, ট্রেকিং…যা মন চায় করুন।গ্রামের বাচ্চারা পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে | হাঁটতে হাঁটতে দেখে আসুন, পাশের গ্রাম কুসং। গাড়ি করে, কয়েক কিলোমিটারের মধ্যে, লিংথেম, হেয়গ্যাথাং, পেনতং, থোলাং মনেস্ট্রি, লেপচা মিউজিয়াম, লিংজ্যা জলপ্রপাত। হাতে পায়ে ব্যথা। স্পা! চান করে নেবেন? আছে হটস্প্রিং।না কোনো স্পা সেন্টার নয়, একেবারে প্রাকৃতিক, বিনে পয়সায় |

একটা লেপচা পরিবারের সঙ্গে দু-তিন দিন কাটালেন। ওদের রান্না শিখলেন, আপনি শেখালেন। ওদের স্কুল, উপাসনা দেখলেন, চি (দেশি পানীয়) খেলেন, ওদের সঙ্গীত শুনলেন। ক্যামেরার শাটার টিপতে-টিপতে আঙুলে ব্যথা করলেন…মুরগির ডাকে ঘুম থেকে উঠলেন। কম কী!! প্রকৃতির আগে কখন ভার্জিন শব্দটা জুড়ে যায়, জানবেন এই দু’দিনে। ………

শুনে যেতে ইচ্ছে করছে বা স্ক্রিপ্টটা লিখতে। তা হলে লিখেই ফেলুন। শুরুটা আমি ধরিয়ে দিই! বাকিটা আপনার। “ডুপডেন লেপচা … দুই পাহাড়ে দু’টো সংসার … চার ছেলে মেয়ে … মাঝে ভেঙে গেছে সেতু … নৌকা আসে যায়” ….গল্প এগোক…!!!

(সমাপ্ত)


লেখক পরিচিতি: কৃষ্ণাশীষ রায়

কৃষ্ণাশীষ রায় একজন ভ্রমণ পিপাষু মানুষ। তিনি দেশে-বিদেশে ঘুরতে এবং সেই ভ্রমণ অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখালিখি করতে ভালোবাসেন।

শেয়ার করে বন্ধুদেরও পড়ার সুযোগ করে দিন

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।