ঈশ্বরের ইতিবৃত্ত : ধর্মটা আসল সমস্যা নয়

লেখক: রুবাই শুভজিৎ ঘোষ

ঈশ্বর নিয়ে আমার আগ্রহ সেই ছোট থেকেই। আমি ঈশ্বরে বিশ্বাসী হলেও ঠিক যেভাবে ধর্মগুরুরা ঈশ্বরকে ব্যাখা করে, তার সাথে আমি সহমত নই। আমার মতে তিনি বিজ্ঞানেও আছেন, নির্বোধের মধ্যেও আছেন। তাঁকে যেমন আমি ব্যাখা করি নিজের মত করে, আমি তাঁকে খুঁজিও নিজের মত করে, আবার তাঁকে নিয়ে আবার অভিযোগগুলোও নিজের মত করে। তাঁকে নিয়ে আমার চিন্তাভাবনা গুলোই এখানে তুলে ধরছি “ঈশ্বরের ইতিবৃত্ত” লেখায়।

ঈশ্বর বলতেই প্রথমে আসে ধর্মের কথা। এবং বর্তমান সময়ে বিভিন্ন সমস্যার মধ্যে একটা অন্যতম সমস্যা হল ধর্ম বা আরও ভালোভাবে বললে বলা উচিত ধর্মের গোঁড়ামি। যাই হোক, এর ফল কমবেশি সবাইকেই ভুগতে হচ্ছে। এর জন্য প্রচুর মানুষ ধর্মকে দোষারোপ করছে। তাঁদের দাবী ধর্মই যদি না থাকত তাহলে এই সমস্যাই থাকত না। কিন্তু আমার মনে হয় ধর্মটা আসল সমস্যা নয় । এই যে ধর্ম নিয়ে এতো ঝগড়া বা যুদ্ধ সেগুলো যতটা না ধর্মনির্ভর, তার চেয়ে সেগুলো অনেক বেশি ক্ষমতার লড়াই।  আর এসব লড়াই সাধারণ মানুষের ধর্মীয় আবেগে সুড়সুড়ি দিয়েই হয়েছে। সাধারণ মানুষও মেতে ওঠে খুব সহজেই, কারণ তারা ধর্ম কী সেটা বোঝে না, তাদের যা ভুল বোঝানো হয়, তারা তাই বোঝে।  সমস্যাটা এখানেই। 

এই ব্যাপারে আমার ছোটবেলায় শোনা একটা জোকসের কথা মনে পড়ল। যদিও বিষয়টা পুরোপুরি এক নয়, কিন্তু অনেকটা কাছাকাছি। একজন ব্যক্তি বিলেত থেকে তার পুরনো গ্রামের বাড়িতে এসেছে। একদিন তাকে নিয়ে একটা সভা হয়, সেখানে সে ইংরাজিতে বক্তৃতা দেয়। মানুষ শুনে দারুণ আপ্লুত। এখন গ্রামের একজন হিংসুটে লোক আছে সে ইংরাজি কিছু কিছু জানে, সে ওই সভায় আসে এবং বলে তার ইংরাজি প্রশ্নের উত্তর দিতে পারলে তবে সে মানবে আগন্তুক ইংরাজি জানে। আগন্তুক বলল সে রাজি। তখন হিংসুটে লোকটা জিজ্ঞেস করল, “বলো তো আই ডোন্ট নো মানে কি?”
আগন্তুক বলল “আমি জানি না”
ব্যাস, সবাই ভাবল সে  ইংরাজি জানে না এবং এতক্ষণ সভায় ভুলভাল কিছু বলছিল।

এখন কথা হল এই লোকটার বোঝানোতে কি ইংরাজি ভাষার অর্থ বদলে গেল? না তো? লোকে বুঝল না কারণ তাদের ভুল বোঝানো হয়েছে। এখন এই ভুল বোঝাবুঝির থেকে মুক্তির একটা উপায় হল ওই গ্রামে ইংরাজি এড়িয়ে চলা। এমনিও সেই গ্রামে ইংরাজি না জেনেও কাজ চলে যাচ্ছিল। কিন্তু সেই হিংসুটে লোকটার স্বভাবে কি পরিবর্তন আসল এতে? 

ধর্মকে নিয়ে বর্তমান সমস্যাও আমি মনে করি অনেকটা এইরকম। ধর্মের অর্থ বলতে গেলে বলতে হয় আমরা যা ধারণ করি তাই হল ধর্ম। এই ধারণ পোশাকের মত শরীরের বাইরে ধারণ করা নয়, মনের ভেতরে যা ধারণ করি, এ হল তাই। আমি  যে সকল নীতি ধারণ করে বেঁচে আছি তাইই আমার ধর্ম। ধর্ম মানে শিল্প। ঈশ্বরের নামে যে উপাসনাঘর বা পুরনো স্থাপত্য আছে, সেগুলো তো শিল্পেরই নিদর্শন। ধর্ম মানে সাহিত্য। এই যে এত ধর্মগ্রন্থ, মহাকাব্য, এগুলো সাহিত্য নয় তো কি? ধর্ম মানে ইতিহাস। সভ্যতার শুরু থেকেই ধর্ম আছে। ধর্মগ্রন্থগুলো যে সময়ে লেখা সেই সময়ের কথা তারা বলছে। তাতে জড়িয়ে পড়ছে কোন না কোন বিশেষ ভূগোল, বিশেষ ভাষা, বিশেষ সংস্কৃতি।  ধর্ম নিয়ে আরও বিস্তারিত আগামী লেখাগুলোতে বলব।

কিন্তু যেভাবে মানুষকে ভুল বুঝিয়ে ধর্মের নামে লড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে তাতে ধর্ম কী না বুঝেই মানুষজন লড়ে যাচ্ছে। কিছু ভন্ড, লোভী , রাজনৈতিক বা মানসিকভাবে বিকৃত মানুষদের জন্য ধর্ম শব্দটিও বিকৃত হচ্ছে। ধর্ম অনেকটা অস্ত্রের মত, অনেকটা ওষুধের মত। এর ব্যবহার ব্যবহারকারীর হাতে। আসলে ধর্ম সম্বন্ধে আমাদের অজ্ঞতাই কিছু মানুষ কাজে লাগায়। আমরা ভুল পথে চালিত হই। ভালো করে না পড়ে, না বুঝে আমরা তথাকথিত আমাদের ধর্মরক্ষকদের কথায় ওঠাবসা করি। কিন্তু তাদের কোনো প্রশ্ন করিনা। আমরা সেই ছাত্রছাত্রীদের মত, যারা শিক্ষক বকবেন বলে প্রশ্ন করি না। কিন্তু বিজ্ঞান বা সাহিত্যের মত ধর্মেরও উপযুক্ত শিক্ষা এবং তার জন্য উপযুক্ত শিক্ষকের প্রয়োজন। অর্ধশিক্ষিত ডাক্তার যেমন ভয়ঙ্কর, তেমনই ভয়ঙ্কর অশিক্ষিত বা অর্ধশিক্ষিত একজন ধার্মিক। এক্ষেত্রে তার বিশ্বাসই তার একমাত্র পুঁজি, জ্ঞানের কোনো জায়গা নেই সেখানে। এবং সমসাময়িক সময়ে এইরকম ধার্মিকের সংখ্যাই বেশি। আমাদের প্রয়োজন শিক্ষা, আমাদের প্রয়োজন পড়াশোনা। সেটা না করে অন্য কারো মুখাপেক্ষী হয়ে পড়ে থাকলে সে আমাদের বিশ্বাসের, অজ্ঞতার সুযোগ নেবে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সেটাই হচ্ছে। আর আমরা আস্তে আস্তে বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়ছি ধর্মের প্রতি।

তাই বলছি সমস্যাটা ধর্মের না, ধর্ম কখনই সমস্যা নয়, সমস্যাটা আমাদের অজ্ঞতার। যদি অনেক কষ্টে আমরা সমস্ত ধর্মমুক্ত হতেও পারি, তখন দেখা যাবে আমাদের  অজ্ঞতা বা বিশ্বাসকে অন্যভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। যখন মানুষের লোভ, তার পাশবিক প্রবৃত্তি  ধর্মকে ব্যবহার করতে পারবে না, অন্য কিছুকে করবে।  

উদাহরণ হিসাবে একটা বিজ্ঞানের উদাহরণ আনি, যেখানে মানুষের ভয়ানক স্বভাবের জন্য কিছু নিরীহ প্রাণীকে প্রাণ দিতে হয়। এখন আমরা যে এসি কারেন্ট ব্যবহার করছি, আবিষ্কারের সময়ে তাকে অনেক  বাধাবিপত্তির মধ্যে দিয়ে আসতে হয়। এসি বনাম ডিসি কারেন্টের যুদ্ধ এমন জায়গায় যায় যে এসি কারেন্ট কত খারাপ প্রমাণ করতে রাস্তা থেকে একাধিক প্রাণীকে ধরে এনে তাকে এসি কারেন্ট দিয়ে মারা হয়। আগ্রহী পাঠক ইন্টারনেটে খুঁজলেই বিস্তারিত পড়তে পারেন। আমি দুটি তথ্যসূত্র দিয়েছি। যাই হোক, এই যে বিজ্ঞানের এক আবিষ্কারের জন্য বেশ কয়েকটা প্রাণীকে হত্যা করা হল, এর জন্য কি বিজ্ঞান খারাপ হয়ে গেল? শুধু তাই কেন অ্যাটম বোমা আবিষ্কারের কথাও আমরা জানি। নারায়ণ সান্যালের বিশ্বাসঘাতক আমার অন্যতম প্রিয় গ্রন্থ। সেখানেই প্রথম জানতে পারি কিভাবে রাজনীতি আর লোভ নিয়ন্ত্রণ করেছিল বিজ্ঞানকে। কিভাবে বিজ্ঞানের আশীর্বাদ হয়ে গিয়েছিল অভিশাপে। কিন্তু এই ঘটনাগুলোর ফলে বিজ্ঞান কি খারাপ হয়ে গেল? সমস্যাটা কি আদৌ বিজ্ঞানের ছিল? অবশ্যই না। এবং একইভাবে আমার মনে ধর্ম কখনই সমস্যা নয় , সমস্যাটা আমাদের অজ্ঞতার, আমাদের লোভের।


তথ্যসূত্র:
1. https://en.wikipedia.org/wiki/War_of_the_currents
2. https://www.history.com/news/what-was-the-war-of-the-currents


লেখকের কথা: রুবাই শুভজিৎ ঘোষ
লেখকের জন্ম পশ্চিমবাংলায়। পেশায় একটি বহুজাতিক সংস্থার তথ্যপ্রযুক্তিবিদ। নেশায় লেখক এবং পরিচালক। বাঙালির জনপ্রিয় ওয়েবসাইট সববাংলায় এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা তিনি। কবিতা থেকে শুরু করে গল্প, প্রবন্ধ, উপন্যাস, চিত্রনাট্য সবকিছুই লিখতে ভালবাসেন। লিটিল ম্যাগাজিন থেকে শুরু করে বাণিজ্যিক বিভিন্ন ম্যাগাজিনে নিয়মিত লিখেছেন। স্রোত থেকে প্রকাশিত তাঁর কবিতার সংকলন দৃষ্টি এবং বালিঘড়ি। এছাড়া তথ্যচিত্র, শর্ট ফিল্ম বা অন্যান্য বিভিন্ন ধরনের ভিডিও পরিচালনা করেন। ধর্ম এবং বিজ্ঞান তাঁর প্রিয় বিষয়। ভ্রমণ তাঁর অন্যতম শখ। অন্যান্য শখের মধ্যে রয়েছে স্কেচ, ফটোগ্রাফি, ছবি ডিজাইন করা।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।

লেখা আহ্বান - বিস্তারিত জানতে ছবিতে ক্লিক করুন