লাইব্রেরি-প্রেম কথা

লেখক: ইচ্ছেমৃত্যু

দুপুর বেলায় গাড়ির পিছনের সীটে গা এলিয়ে দিয়ে যেতে যেতে হঠাৎ চোখে পড়ল ‘স্টেট সেন্ট্রাল লাইব্রেরি’… লাইব্রেরি দেখলে এখনও কেমন মন টানে তাই সোজা হয়ে বসে জায়গাটা খেয়াল করার চেষ্টা করলাম… একটা লাল রঙের ছিমছাম বিল্ডিং আর চারপাশে গাছগাছালিপূর্ণ একটা সবুজ পরিবেশ… ঠিক প্রেম করার উপযুক্ত… কবির মত মানসচক্ষু থাকলে হয়ত দেখতে পেতাম ওই সবুজ বনবীথি ধরে হাতে বই নিয়ে হেঁটে যাচ্ছে প্রেমিক-প্রেমিকারা… সেরম মানসচক্ষুর অভাবে এক অমল সুন্দর দৃশ্য থেকে বঞ্চিত হলাম, কিন্তু ভাবনা ঘুরতে থাকল লাইব্রেরি নিয়ে…হ্যাঁ লাইব্রেরি, গ্রন্থাগার নয়, ছোট থেকে শোনা এবং দেখার দোষে হতে পারে, গ্রন্থাগার শব্দটা আমাকে ততটা টানে না যতটা টানে লাইব্রেরি!

তা যা বলছিলাম, লাইব্রেরির ভাবনায় প্রথম এবং শেষ একটাই কথা মনে আসে সেটা হল প্রেম… হ্যাঁ, বই-প্রেম থেকেই সাধারণত নিয়মিত যাওয়া হয় বইয়ের অলকাপূরীতে… কেউ সেখানে বসে ঘন্টার পর ঘন্টা বইয়ের সাথে প্রেম করে, কেউ বা দুয়েকটা বই বদলে এনে প্রেমকে নিয়ে কাটায় ঘরের নির্জনে…আর এই বই প্রেমের সাথে সাথে অনেক সময় মানব-মানবী প্রেমও শুরু হয়ে যায় লাইব্রেরি বা বইকে কেন্দ্র করে… এই যেমন, প্রথমে একদিন কাওকে লাইব্রেরিতে দেখে ভাল লাগল, পরের দিনগুলোয় একই সময়ে লাইব্রেরিতে যাওয়া, কোন একদিন সময়ে মিলে গেলে একটু চোখাচোখি, তারপর একদিন একটু হাসি, তারপর ভাললাগার বই নিয়ে আলাপ-আলোচনা হয়ে ভাললাগাটা ভালবাসা… অথবা অনেক সময় প্রেমের শুরু হয়ত অন্যভাবে, কিন্তু লাইব্রেরি যাওয়ার নাম করে গোপন প্রেমকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াও চলে!

আমি গ্রামের ছেলে… তবে আমাদের গ্রামেও গর্ব করার মত একটা লাইব্রেরি ছিল (আছে)… লাইব্রেরি-টার নাম ‘পল্লীমঙ্গল লাইব্রেরি’ – যিনি নামকরণ করেছিলেন তাঁর ভাবনা চিন্তার কথা ভাবলে অবাক হয়ে যাই… তিনি প্রায় ৭০ বছর আগে ভাবতে পেরেছিলেন, বই দিয়ে, শুধু মাত্র অসংখ্য বই দিয়েই একটা পল্লীর মঙ্গল সাধন করা যায়… যাই হোক, আমি কিশোর বয়স থেকেই প্রায় নিয়মিত সেই লাইব্রেরি যেতাম… কবে বাপ জানতে পেরে কেলাবে এই ভয়ে লাইব্রেরি-সদস্যা কোন মেয়ের প্রেমে পড়া হয়ে ওঠেনি (কোন কিশোরী মনকে একেবারেই নাড়া দিয়ে যায়নি – সে কথা এই বয়সে হলফ করে বলতে পারছি না) কিন্তু বইয়ের প্রেমে পড়ে গেছিলাম… পরবর্তীতে কলেজ জীবনে দেখেছি, কলেজ লাইব্রেরিটা আসলেই প্রেমের বৃন্দাবন… লেডিজ হোস্টেলের মেয়েরা লাইব্রেরিতে পড়ার দোহাই দিয়ে আর বয়েজ হোস্টেলের ছেলেরা প্রেমের কারণে ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়েছে কলেজ লাইব্রেরিতে, বইটা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই উপলক্ষ্য মাত্র…দুঃখের কথা কলেজ জীবনেও (তখন যদিও বাপের চোখের আড়াল) কোন প্রেমিকা জোটাতে পারলাম না… অবশ্য এ পৃথিবীতে দুজন প্রেমিকা একই সঙ্গে এক পুরুষের সাথে (ব্যতিক্রমী ঘটনা ছাড়া) কতটুকুই বা একসাথে থেকেছে বলুন!!! তাই আমার ক্ষেত্রে ছিল – বই তুলে এনে নির্জন ঘরে প্রেম…আজকের ই-যুগে লাইব্রেরিও তার ঐতিহ্য হারাচ্ছে… আমার কাছেও বই আসে ‘পিক অ্যান্ড ড্রপ’ পদ্ধতিতে, একটি অনলাইন সাইট থেকে… লাইব্রেরি গিয়ে বই নিয়ে আসা হয়নি কত কত বছর!!

সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে প্রায়ই দেখতে পাই আমরা কী কী হারিয়েছি এই ই-যুগে… লম্বা লিস্টি যেমন টেপ, ক্যাসেট, অ্যালার্ম ঘড়ি, ক্যালকুলেটর, রেডিও, লাট্টু–লেপ্তি, চিঠি ইত্যাদি ইত্যাদি… কিন্তু কাওকে কোনদিন লিখতে দেখলাম না আমরা ক্রমশ হারাতে চলেছি লাইব্রেরি এবং লাইব্রেরি-প্রেম… হ্যাঁ, বইপ্রেম এবং লাইব্রেরি-কেন্দ্রিক মানব-মানবী প্রেম দুটোর কথাই বলছি!


লেখকের কথা: ইচ্ছেমৃত্যু
জন্ম বর্ধমানের বর্ধিষ্ণু গ্রামে। পেশায় নরম তারের কারিগর আর নেশায় – রীতিমত নেশাড়ু, কী যে নেই তাতে – টুকটাক পড়াশোনা, ইচ্ছে হলে লেখা – সে কবিতা, গল্প, রম্যরচনা, নিবন্ধ যা কিছু হতে পারে, ছবি তোলা, বাগান করা এবং ইত্যাদি। তবে সব পরিচয় এসে শেষ হয় সৃষ্টিতে – পাঠক যেভাবে চিনবেন চিনে নেবেন।

শেয়ার করে বন্ধুদেরও পড়ার সুযোগ করে দিন

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।