পাঠ প্রতিক্রিয়া: শুদ্ধসত্ত্ব ঘোষের রঙ্গমঞ্চ

লেখক: অরিত্র চট্টোপাধ্যায়

  • বইয়ের নাম: রঙ্গমঞ্চ
  • লেখক: শুদ্ধসত্ত্ব ঘোষ
  • প্রকাশক: ফ্যাভ বুক্জ পাবলিকেশন্স
  • সংস্করণ: প্রথম সংস্করণ, মে ২০১৮
  • দৈর্ঘ্য: ২৬২ পাতা

বাংলার নট-নটীদের কথা বলতে মনে পড়ে ছোটবেলায় বাবার মুখে শোনা কিছু নটরাজদের নাম – গিরিশচন্দ্র, শিশির ভাদুড়ি, শম্ভু মিত্র, অজিতেশ প্রমুখ। আর রঙ্গমঞ্চ বলতে চোখে ভাসে কতগুলো আবছায়া ছবি – স্টার, মিনার্ভা ইত্যাদি। পরে অবিশ্যি “প্রথম আলো” এর সুবাদে একটু ঘনিষ্ঠতা বাড়ে গিরিশ ঘোষ, বিনোদিনী, অমৃতলালদের সঙ্গে। সেই স্মৃতি ফিকে হবার আগেই হঠাৎ হাতে এসে পড়ে শুদ্ধসত্ত্ব ঘোষের “রঙ্গমঞ্চ” – খানিক রোমাঞ্চিত বোধ হয়!

প্ৰথম কয়েক পাতা পড়তে গিয়ে বুঝি লেখক সহজে ছাড়বেন না পাঠককে। পুরো লেখা জুড়ে আছে এক অমোঘ আকর্ষণী শক্তি যা আমার মত আলস্য-বিলাসী পাঠককেও বাধ্য করে নাগাড়ে দুই শতাধিক পাতা পড়ে ফেলতে। শৈলেশের চরিত্র খুব যত্ন নিয়ে এঁকেছেন লেখক – সুনিপুণ চিত্রশিল্পীর মতো। রঙ্গমঞ্চের পথে চলতে চলতে কখন জানি একাত্ম হয়ে পড়ি শৈলেশের সঙ্গে – ফুটবল প্রেম পরিণতি না পেলেও যিনি নাট্যপ্রেমকে আঁকড়ে রেখেছেন জীবনব্যাপী দৈনন্দিনতার বিরুদ্ধে লড়াই করে। গিরিশ ঘোষের যুগ শেষ হয়েছে তখন। ছেলে দানীবাবুও অস্তগামী সূর্য প্রায়। শৈলেশের উত্থান শিশির-অহীন্দ্র যুগে। শৈলেশের চোখ দিয়ে দেখেছি নাট্যশালার অন্দরমহল – অগুনতি গুণী শিল্পির অধ্যবসায়, নিষ্ঠা ও অক্লান্ত পরিশ্রমের ছবি; অথচ বাইরের দুনিয়া পেয়েছে শুধু সুরার গন্ধ, অবৈধ সম্পর্কের রসালো রসায়ন! নীহারবালা-শৈলেশ…এক অদ্ভুত টানাপোড়েনের গল্প! এক সময়ের দেহপোজীবিনী নীহার আসে শৈলেশের কাছে কোনো এক চরিত্রে অভিনয়ের অনুরোধ নিয়ে। শৈলেশ তখন রীতিমতো স্টার। তবুও নীহার বোঝে সেই সুযোগ দেওয়া শৈলেশের কম্ম নয়। সরে আসে সে। আর এই সরে আসা শৈলেশের কাছে রীতিমতো অপমানজনক মনে হয়। অন্য এক নাটকে সুযোগ বুঝে সেই অপমানের শোধ তুলে আনন্দ পায় শৈলেশ ঠিকই, কিন্তু ভেতরে ভেতরে শুরু হয় ভাঙ্গন। এরই পাশাপাশি চলে আদি বোস, মালখানির বিষয়কেন্দ্রিক ঘৃণিত ষড়যন্ত্র যার ধাক্কায় ক্ষত-বিক্ষত হয় শৈলেশের শিল্পী-সত্ত্বা, বিপর্যস্ত হয় পরিবার। শৈলেশের পরিবারহীন জীবন, মদ বা নারীতে অনাসক্তি কোথাও টানে নীহারকে, নিজেকে ভাঙতে ভাঙতে শৈলেশের সাথে একরকম জুড়ে যায় সে। কিন্তু তা বলে বেশ্যাকে বিয়ে করা চলে? আবার দ্বন্দ! এই টানাপোড়েনের মধ্যেই হঠাৎ খুন হয়ে যায় নীহারবালা! আর দিশেহারা, বিধ্বস্ত শৈলেশ আদি-অনুগামী গুপ্ত-মিত্রের প্ল্যান বাঞ্চাল করে নিজেও স্বাগত জানায় মৃত্যুকে – ‘মৃত্যুকেও সাজতে হয়। না সাজলে তার যথাযথ স্বীকৃতি মেলে না’!

লেখকের দাপুটে লেখনীতে স্বচ্ছন্দে মিলেছে একাল-সেকাল। বর্তমানের দমবন্ধ করা পরিস্থিতির পাঁকে অবলীলায় জন্ম নিয়েছে অতীতের স্মৃতি-সুরভিত পদ্মের দল। কল্পনার রঙ্গমঞ্চের কোলাজে আটকে আছে বাংলার রঙ্গমঞ্চের রথী-মহারথীদের টুকরো টুকরো ছবি – যা সমৃদ্ধ করেছে এই উপন্যাসকে। হয়তো এই নট-শিরোমণিদের সাথে শৈলেশের কিছু আদানপ্রদান বা কথোপকথন রচনার মুগ্ধতা বাড়াতো খানিকটা, অন্তত পাঠক হিসেবে আমার তাই মনে হয়। হোক না সে কিছুটা কল্পনামিশ্রিত, ইতিহাসের অব্যর্থতা রক্ষার দায় তো ঔপন্যাসিকের নয়।

এই উপন্যাস একদিকে যেমন রক্ত-মাংসের, মানুষের আদিম প্রবৃত্তির; অন্যদিকে এ এক সময়কালের উপাখ্যানও বটে। উজ্জ্বল নাট্যমঞ্চের পাশাপাশি উপন্যাসকে পুষ্ট করেছে আলোর আড়ালে ঘটে যাওয়া আপাত-অদৃষ্ট ঘটনার ঘনঘটা। উপন্যাসের ধারাপথে ব্যক্তি, সংগঠন বা থিয়েটারের চেয়ে বড় হয়ে উঠেছে এক ভাবাবেগের স্পন্দন – যার নাম রঙ্গমঞ্চ!


লেখকের কথা: অরিত্র চট্টোপাধ্যায়
জন্ম মালদায় হলেও জন্ম বা কর্মসূত্রে সেরকম মাল-দার হওয়া গেল না যখন, তখন মাল বা ঐশ্বর্যের সন্ধানে সময় কাটে বই পড়ে, গান শুনে, একটু-আধটু আবৃত্তি-চর্চায়। তারই ফাঁকে ফাঁকে খাতায় চলে হিজিবিজি কাটা, সে অবিশ্যি শেষ অব্দি লেখা হয়ে ওঠে কি না সে বিচারের দায় লেখকের নয়।

শেয়ার করে বন্ধুদেরও পড়ার সুযোগ করে দিন

One comment

  1. রাজীব চক্রবর্ত্তী

    এক মনোজ্ঞ পাঠকের বিশ্লেষণ বইটির প্রতি সুবিচার করল।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।