এই যাঃ! মরে গেল!

লেখক: অয়ন মৈত্র

কেরালার মালাপ্পুরামে পোয়াতি হাতিকে বারুদ ভর্তি আনারস গিফ্ট করা হল, আর সেই আনারস ফেটে বাচ্চা শুদ্ধু হাতি বোম ফট্। চারদিকে একেবারে হাহাকার পড়ে গেল। যেন বিশ্বে এমন আইটেম প্রথম লঞ্চ হল। মানুষ এমনটা পারে কী করে, এই প্রশ্নে করোনা ফরোনা সব কাঁথা টেনে খাটের তলায় লুকিয়ে পড়ল। জেগে রইল কেবল ‘হাতির অন্তরাত্মার হুহু করা হাহাকার’। বুকের ভেতর মরচে ধরা পেরেক হয়ে ফুটতে লাগল ‘বিবেকের কামড়’।

সাইজ ম্যাটার্স কাকা, সাইজ ম্যাটার্স। সঙ্গে যদি আবার একটু ইমোশনাল টাচ থাকে, তাহলে তো কথাই নেই। পুরো মাখন! ট্রিপল এক্স এল হাতির সাথে হবু মায়ের মিক্সচার! সঙ্গে আনারসি উপায়ে বেনারসি বারুদ। এমন ট্র্যাজিক এন্ডিং না অ্যারিস্টটল না শেক্সপীয়ার কারও মুরোদে কুলোয়নি। এখন কথা হচ্ছে যে কারণে এত জনরোষ তা কি প্রথম নাকি মনুষ্যজাতির ইতিহাসে? সেগুড়ে বালি কাকা।

কেরালার মালাপ্পুরাম এই ধরণের অভিনব উপায়ে প্রাণী হত্যায় জি.আই ট্যাগ দাবী করতে পারে। বিখ্যাত পশু-অধিকার কর্মী মেনকা গান্ধীর দাবী অনুযায়ী এই মালাপ্পুরামে প্রতি তিনদিন অন্তর একটা করে হাতি খুন হয়। রাস্তায় বিষ ছড়িয়ে রাখা হয় যাতে একেবারে ৩০০-৪০০ পশু পাখি মারা যায়। হাতি আকারে ডাবল এক্স এল তায় আবার পোয়াতি। আচরণটাও নির্ভেজাল ভদ্রমহিলা টাইপ। তাই নিমেষে ভাইরাল। কিন্তু কুকুর মারাতে কেরালা যে ভারতখ্যাত সে খবর রাখেন কি?

কেরালায় নেড়ি কুকুরের সংখ্যা এবং অত্যাচার অন্য রাজ্যের তুলনায় বেশ বেশিই একথা অস্বীকারের উপায় নেই। রোজই কেউ না কেউ কুকুরের কামড়ের শিকার হয়। একবার হল কি কুকুরের কামড়ে এক নব্বই বছরের বৃদ্ধ মারাই গেলেন। ব্যস! জনতার সহ্যের বাঁধ গেল ভেঙ্গে। ৪০টা কুকুরকে একরাতে যমের দক্ষিন দুয়ারে চালান করে দিল স্থানীয় অধিবাসীরা। কেরালার সেন্ট টমাস কলেজের ওল্ড স্টুডেন্টস ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশান তো ২০১৬ সালের ১০ ডিসেম্বরের মধ্যে যে ব্যক্তি সর্বাধিক নেড়ি কুকুর মারতে পারবে তাকে সোনার কয়েন পুরস্কার দেওয়ার ঘোষণা করল। এখানেই থেমে নেই তারা, একধাপ এগিয়ে পাখি মারার জন্য প্রথমবার এয়ার গান কিনবে যারা তাদের ১০% ভর্তুকি এবং ২৫% ভর্তুকি ঘোষণা করে যারা নেড়ি কুকুর মারার অপরাধে পুলিশ কেসে জড়িয়েছে তাদের মামলা লড়ার খরচের ওপর। তিরুভনন্তপুরমে একবার কুকুরের কামড়ে এক বৃদ্ধার মৃত্যুকে কেন্দ্র করে কেরালার ইয়ুথ ফ্রন্ট পার্টি ১০টা কুকুরকে মেরে তাদের মৃতদেহগুলোকে বাঁশে বেঁধে সদলবলে রাস্তায় পদযাত্রা করে কোট্টায়ামের রাস্তায়।

কুকুরদের ওপর এই রাগ কেরালার মানুষের রক্তে একেবারে মিশে আছে। কিছু শ্রমিক একবার একদল কুকুরকে মেরে তারপর তাদের মৃতদেহগুলো বাঁশের খুঁটিতে বেঁধে প্রকাশ্য রাস্তায় নেমে নেড়ি নিয়ন্ত্রণে সরকারী ব্যর্থতার প্রতিবাদ জানায়। কত আর বলব! কুকুর মারার এমন নেশা যে মালাপ্পুরম জেলার এক বাড়িতে ছয় মাসের কুকুর ছানার রাতের অন্ধকারে চোখ উপড়ে, পা ভেঙে, নাড়ি ভুঁড়ি বের করে দেয় স্থানীয় মানুষ। দোষ কি ছিল তার! কুকুর হয়ে জন্মানো। একবার তো ১৫০ কুকুর মেরে একটি প্রাথমিক স্কুলের গেটের সামনে বাচ্চাদের দেখার জন্য প্রদর্শনীর ব্যবস্থাও করে কেরালার এক শহরের বাসিন্দারা।

শুধু কুকুর নয়, হাতির ওপর অত্যাচারেও কেরালা অতুলনীয়। প্রতি বছর জানুয়ারি থেকে এপ্রিল অবধি কেরালায় ত্রিশুরপুরম, ভেলা প্রভৃতি মন্দির উৎসব চলে। আর এই উৎসবের সাথে হাতির যোগ থাকবেই। ত্রিশুরের ভাডাক্কুমনাথন মন্দিরে এই উৎসবের সময় কম করেও ৭০টা হাতি থাকবেই। এই হাতিগুলোকে ওই প্রচন্ড গরমে ঘন্টার পর ঘন্টা আগুন গরম পিচ রাস্তার ওপর দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। কখনওবা না খাইয়ে মাইলের পর মাইল হাঁটিয়ে এনে মন্দিরের গরম উঠোনে আবার ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। পায়ে এত শক্ত ভাবে দড়ি বাঁধা থাকে যে দড়ির ঘষা লেগে লেগে ঘা হয়ে যায়। কিন্তু তাতে অবশ্য কারও ভ্রূক্ষেপ থাকে না।

রেনে দেকার্তের ধারণাই ঠিক। মানুষ নিজেকে বাদে বাকি সমস্ত কিছুকে অটোমাটা হিসেবে
ধরে – অর্থাৎ অনুভূতি, যুক্তি এবং আত্মাহীন এক জটিল যন্ত্র। এখন যদি প্রশ্ন করি হাতিকে বারুদ ভরা আনারস কেন খাওয়ালেন, উত্তরটা কী আসবে? সিম্পল! রগড় দেখব বলে।

প্রাণীদের যে প্রাণ আছে সে আমরা জানি এবং মানিও। বুদ্ধি আছে তাও জানি। কেবল ওদের যে ব্যাথা, যন্ত্রণা, কষ্ট এসব হয় এগুলো একদম ঢপের কথা মনে হয়।
তাইতো দিল্লীর এক বাস ড্রাইভার গর্ভবর্তী কুকুরের ওপর বাসটা চালিয়ে দেয় মজা পাবার জন্যে। বাস বারবার সামনে পিছনে চালাতেই থাকে ওই কুকুরটির ওপর যতক্ষণ না শরীরটা টুকরো টুকরো হয়ে ছিঁড়ে ভেতর থেকে ছিন্ন ভিন্ন ভ্রূণটা বেরিয়ে না আসে। মহারাষ্ট্রের থানেতে ছটি কুকুর ছানার মায়ের মাথায় সজোরে ব্যাট হাঁকরাতে দুবার ভাবতে হয়না। চেন্নাইয়ের মাধা মেডিক্যাল কলেজের ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র গৌতম সুদর্শন মোবাইলে ভিডিও রেকর্ডিং অন করে তার পাঁচ মাসের কুকুর ছানাটিকে ৯তলার ওপর থেকে হাওয়ায় ভাসিয়ে দেওয়ার ভিডিও রেকর্ড করে ইউটিউবে আপলোড করে। আমেরিকার এক ব্যক্তিকে তার পছন্দের ওষুধ দেয়নি এক ওষুধের দোকান। বাড়ি ফিরে রাগে পোষা খরগোশটাকে মাইক্রোওভেনে ঢুকিয়ে তন্দুর বানিয়ে ফেললেন তিনি।

সত্যি বলছি আমাদের কিন্তু একটুও গায়ে লাগেনা, মনে লাগেনা, শরীরের কোত্থাও লাগেনা এই না মানুষদের ‘মানবিক’ ভাবে মেরে ফেলতে। ওহ! ভুল বললাম। সরি সরি। আমরা না… মানে সত্যিই জানতাম না, মানে ভাবিনি ওরা মরে যাবে এভাবে। ওরাও যে আমাদের মত মরে যেতে পারে এটা না কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারিনা। মানে আমার মুখে চকলেট বোমা ভর্তি কমলা লেবু ঢুকিয়ে দিলে যা হবে ওই হাতিটারও তাই হবে এ কি করে হয়! সাইজ টা একবার দেখুন ওদের আর আমাদের। আমরা ঘুমোলে গায়ে গরম পিচ ঢেলে দিলে যা হবে কুকুরের ক্ষেত্রেও তাই হবে এটা কি করে সম্ভব বলুন তো! এগুলো অন্যায় আবদার না! তারপর ধরুন পুলিশের গাড়ির চাকায় একটা বাচ্চার পা আটকে গেল রাস্তা পেরোতে গিয়ে। লোকজন জড়ো হয়ে গেল বাচ্চাটার পা ছাড়াতে। এখন পুলিশের যদি তাড়া থাকে তো সে কি করবে! তাই বলে বাচ্চাটার ওপর দিয়ে গাড়িটা চালিয়ে দেবে! পাবলিক থামতে বললেও থামবে না! এখন এটা যদি মানুষের বাচ্চা না হয়ে গরুর বাচ্চা হয় তাহলে কি আমি পুলিশের বিপক্ষে গিয়ে কথা বলব! এমনিতেই তো পুলিশের এত বদনাম! শেষে একটা বাছুর বাঁচানোর জন্য ফালতু ফালতু লেট খাওয়ার মানে হয়! তাই অনায়াসে গাড়িটা চালিয়েই দিল ছত্তিশগড় পুলিশ। সাথে সাথে থেঁতলে গেল শরীরটা।

এই রগড় দেখার লোভটা আমরা বরাবরই পালন করে এসেছি ধুমধাম করে। রাস্তায় ল্যাম্পপোস্টে চোর বাঁধা দেখলে একবার উঁকি মেরে দেখেছি চোর দেখতে কেমন, চোরকে পাবলিক পেটায় কেমন। তাই মহারাষ্ট্রের পালঘরে সাধু হত্যার ভিডিও ভাইরাল হয় কারণ কেউ ওখানে ভিডিও করার জন্য, মুহূর্তে মানুষ হত্যার এই লাইভ কভারেজ করার লোভ সামলাতে পারেনি। মানুষ হত্যা চোখের সামনে দেখাও একটা বিরল রগড়। ঠিক কিনা! এই রগড় আবার সম্মিলিত ভাবে দেখলে তা স্বাদে গুণে আরও অতুলনীয় হয়ে যায় নিমেষে। তাই পালা করে কুকুরকে আধলা ছোঁড়া, বেড়ালের গায়ে শীতকালে বরফ জল ঢেলে দেওয়া, চিড়িয়াখানায় শিম্পাঞ্জির দিকে দাড়ি কামানোর রেজর ছুঁড়ে দেওয়া এক অনাবিল মজা দেয় আমাদের। অব্যক্ত, অনির্বচনীয় উত্তেজনায় শিরশির করে শরীরটা ‘এবার কি করে ব্যাটা’ সেটা দেখার প্রতীক্ষায়।

আমরা যারা আমপাবলিক তাদের মধ্যে প্রবলভাবে একটা ইনোভেটিভ মন আছে। যে মন সর্বদা নতুন নতুন এক্সপেরিমেন্ট করতে চায়। ক্ষমতা থাকলে মানুষের ওপর করি। যেমন নাৎসিরা আউশভিৎজ ক্যাম্পে বন্দী ইহুদীদের সাথে করত। কারও বাঁ পায়ের আঙুল কেটে ডান পায়ে লাগানোর চেষ্টা হত। কাউকে আবার বরফ জলে হাত পা বেঁধে ১ ঘন্টা ফেলে রাখা হত শরীরে কী পরিবর্তন হচ্ছে দেখার জন্য। উত্তর কোরিয়ার শাসক কিম জং যেমন মৃত্যুদন্ড হিসেবে কামানের গোলায় অভিযুক্তকে উড়িয়ে দিতে পছন্দ করতেন। এত গেল ক্ষমতাবানদের রগড়। কিন্তু আমরা যারা সাধারণ তারা মজা পাই বেশি প্রাণীদের ওপর এক্সপেরিমেন্ট করে। এই যে ‘দেখি তো কী হয়’ এই উদ্ভাবনী অনুসন্ধিৎসু মনটাই দক্ষিণ চীন সাগরে ডলফিনের পেছনে স্পিড বোট নিয়ে তাড়া করে ধাক্কা মেরে শেষ পর্যন্ত রক্তাক্ত করে মেরেই ছাড়ে ডলফিন। যতবার এরকম করি ততবার হতাশ হই শেষ অবধি। ভাবি – এই যাঃ! মরে গেল!


শেয়ার করে বন্ধুদেরও পড়ার সুযোগ করে দিন

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।