লেখক: রানা চক্রবর্তী
ছোটবেলায় স্কুলে অংক পরীক্ষা দিয়ে ফিরলে অনেকেই জিজ্ঞাসা করতেন, ‘অংকে ১০০-র মধ্যে ১১০ পাবে তো?’ কথাটির মানে তেমন বুঝতাম না। এখনও বিজ্ঞাপনে বলতে দেখি, ‘১০০-র মধ্যে ১০০ পেয়েছি আর কী করে বেশী নম্বর পবো’? তবে সত্যিই এমন একজন মানুষ ছিলেন যিনি কথাটি সত্যি প্রমাণ করেছিলেন। অথবা বলা যায় তাঁর জন্যই কথাটি প্রচলিত হয়েছে। আর তিনি-ই সত্যেন্দ্রনাথ বসু। হিন্দু স্কুলে এন্ট্রান্সের টেষ্ট পরীক্ষায় সত্যেন্দ্রনাথ অঙ্কের সব প্রশ্নগুলির উত্তর তো করেছিলেনই, উপরন্ত জ্যামিতির প্রশ্নগুলি একাধিক উপায়ে সমাধান করে দেন। অংকের শিক্ষক শ্রী উপেন্দ্রনাথ বকসী খুশি হয়ে তাঁকে ১০০-র মধ্যে ১১০ দিয়েছিলেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রিডার হিসেবে যোগদানের পর সত্যেন্দ্রনাথ বসু তত্ত্বীয় পদার্থ বিজ্ঞান ও এক্সরে ক্রিস্টালোগ্রাফির ওপর কাজ শুরু করেন। এছাড়া তিনি শ্রেণিকক্ষে কোয়ান্টাম বলবিদ্যা পড়াতেন। সত্যেন্দ্রনাথ বসুকে আজ সারা দুনিয়া সমীহ করে কেবল মাত্র একটি অঙ্ক ভুল করার কারণেই। সত্যিই কিন্তু তিনি যদি অঙ্কটি ভুল না করতেন তবে হয়তো আজ পদার্থবিজ্ঞানের গুরুত্বপূর্ণ কিছু কণার নাম ‘বোসন’ হতো না। ব্যাপারটি কিন্তু বড্ড অদ্ভুতুড়ে!
একদিন ক্লাসে আলোকতড়িৎ ক্রিয়া ও অতিবেগুনি রশ্মি বিপর্যয় পড়ানোর সময় তিনি শিক্ষার্থীদের বর্তমান তত্ত্বের দুর্বলতা বোঝাতে এই তত্ত্বের সঙ্গে পরীক্ষালব্ধ ফলাফলের পার্থক্য তুলে ধরেন। ঠিক ঐ সময় তত্ত্বটিকে অঙ্কের মাধ্যমে বোঝাতে গিয়েই তিনি ভুলটা করে ফেলেন। পরে দেখা যায় তার ঐ ভুলের ফলে পরীক্ষার সঙ্গে তত্ত্বের অনুমান মিলে যাচ্ছে! তিনি তখন মনে মনে ভাবলেন, সে ভুল নিশ্চয় কোনো ভুল নয়। শুরু হলো তার উপর নিজের মতো করে গবেষণা। প্রথম প্রথম কেউ তার কথা মানতে চাননি। বসু পরে তার ঐদিনের লেকচারটি একটি ছোট নিবন্ধ আকারে ‘Planck’s Law and the Hypothesis of Light Quanta’ নামে প্রকাশ করেন।
পরবর্তীকালে সত্যেন্দ্রনাথ হতাশ চিত্তে গবেষণাপত্রটি আইনস্টাইনের কাছে পাঠিয়ে দিলেন। আইনস্টাইন পুরো ব্যাপারটি বুঝে ফেলেন এবং সেটি জার্মান ভাষায় অনুবাদ করে প্রকাশ করেন। বসুর সেই ভুল অঙ্কটিই এখন বোস-আইনস্টাইন সংখ্যাতত্ত্ব নামে পরিচিত। মানুষ হিসেবে এই অঙ্কের যাদুকরটি ছিলেন একেবারেই যাকে বলে ‘বাঙালি’।
আবার স্বভাবে ছিলেন একজন আত্মভোলা কবি। কিন্তু পোশাক পরিচ্ছদের ব্যাপারে ছিলেন মাত্রাতিরিক্ত উদাসীন। প্রায়শই পরনের ফতুয়া ভুল করে গায়ে না জড়িয়ে কাঁধে চাপিয়ে রাখতেন। জুতোর অবস্থাও ছিল এমন যে প্রায় সময়ই দু’পায়ে দু’রকম জুতো পরে সবখানে ঘুরে চলে আসতেন। মাথায় তো চিরুনী বোলানোর কথা তার সজ্ঞানেও আসতো না হয়তো বা। কিন্তু এই খেয়ালি মানুষটি যখন অঙ্ক কষতে বসতেন তখন আর সময়জ্ঞান হিসেবে থাকতো না তার। আবার কখনও কখনও জটিল ধারার অঙ্ক থেকে ছুটি নিয়ে ডুবে যেতেন সাহিত্য এবং সঙ্গীতের জগতে। বিজ্ঞানের পাশাপাশি সঙ্গীত এবং সাহিত্যেও ছিল তার আন্তরিক আগ্রহ ও বিশেষ প্রীতি। প্রায়ই তাকে দেখা যেত সদ্য প্রকাশিত ফরাসি বইয়ের মধ্যে গভীরভাবে ডুবে থাকতে।
বসু একজন ভালো সঙ্গীতজ্ঞও ছিলেন বটে। উচ্চমানের সঙ্গীত শোনার জন্য তিনি রাতের পর রাত জেগেই কাটিয়ে দিতেন। তিনি খুব ভালো এস্রাজ বাজাতেন। মন খারাপের সময়গুলো কাটাতেন এস্রাজের সুর-সাধনার জগতেই। যখন তিনি কোনো বিষয় নিয়ে গভীরভাবে চিন্তামগ্ন থাকতেন তখনই বেজে উঠতো তার এস্রাজের সুর। ঢাকা থাকার সময় তার এই অভ্যাস নিয়মিতই ছিল। অনেক সময় তিনি তার নিজস্ব পদ্ধতিতে সঙ্গীতের সুর নিয়ে গবেষণা করতেন। নতুন করে তিনি সুর সৃষ্টি করতে চেষ্টা করতেন। তিনি সম্পূর্ণ সচেতনতার সঙ্গে এবং বিজ্ঞানসম্মতভাবে শেখার চেষ্টা করতেন ঠিক যেমন একই স্বভাব ছিল তার গবেষণা কর্মের ক্ষেত্রে।
বাগান করা ছিল তার কাছে শখের ঘরানা ব্যাপার। সময় ও সুযোগ পেলেই তার শখের বাগানের পরিচর্যায় ব্যস্ত হয়ে পড়তেন। সাহিত্যজগতে আনাগোনার মধ্য দিয়ে তার পরিচয় ঘটে সাহিত্য জগত দিকপাল বুদ্ধদেব বসুর সাথে। আর তার সে পরিচয় কালের আবর্তে পৌঁছে গিয়েছিল কোলকাতার ২০২ রাসবিহারী অ্যাভিনিউ ‘কবিতা ভবন’ দ্বারপ্রান্তে। সেখানে প্রায় সময় সত্যেন্দ্রনাথ যেতেন, আড্ডা দিতেন, সময় কাটাতেন। আড্ডার আসরে তিনি ছিলেন মধ্যমণি। শোনা যায়, তিনি বুদ্ধদেব বসুর ‘মেঘদূত’ এবং বদলেয়ার অনুবাদ নিয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ মতামত দিয়েছিলেন।
ভাষাবিদ সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ও অনেক সময় তাঁর মতামত নিতেন। তিনি গান গাওয়া, এস্রাজে সুর তুলে গণিতজ্ঞদের নিয়ে অনেক মজার রসিকতায় কবিতা ভবন মাতিয়ে তুলতেন। তাছাড়া গায়িকা রাজেশ্বরী দত্তের সঙ্গে অনর্গল জার্মান আর ইতালীয় ভাষায় মজার অনেক গল্পও করতেন।
বাংলা সাহিত্যের উপর তার ছিল অগাধ পড়াশুনা। বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন বিষয়ের প্রতি ছিল তার সবিশেষ ঝোঁক। এ নিয়ে একটা গল্প বেশ প্রচলিত আছে। একবার সত্যেন্দ্রনাথের ঢাকার বাড়িতে অন্নদাশঙ্কর রায় গিয়েছিলেন। দেখেন কি, মশারির ভেতরে শুয়ে শুয়ে ‘প্রোফেসর’ বই পড়ছেন। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে তার পড়া বইগুলোর কোনোটি কিন্তু বিজ্ঞানের বই নয়। আরেকদিন তাকে দেখেছিলেন প্রাকৃত ভাষায় লেখা ব্যাকরণ বই পড়তে। সত্যেন্দ্রনাথের লেখালেখিতে পাওয়া যেত এক পুরোদস্তুর সাহিত্যিকের ছোঁয়া। তাঁর বিভিন্ন লেখা পড়লে তা সহজেই বোঝা যায়।
প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়ার সময়কার ঘটনা। সে সময় তিনি একটি রোমান্টিক গল্প এবং একটি প্রবন্ধ লিখে ভীষণ বাহবা পেয়েছিলেন। তার আরেকটি খেয়াল ছিল টেনশান কাটাতে ইনডোর খেলা। আই এস সি তে থাকাকালীন তিনি নতুন নতুন ক্যারম খেলা শিখেছিলেন। পরে সে খেলায় দিনরাত এক করে খেলতে শুরু করেন, তাতে অবশ্য মায়ের বকুনি কোনো অংশেই কম শুনতেন না, অথচ ক্যারমের নেশা যেন তাকে ছাড়েই না! এত বুঁদ হয়ে খেলার পরেও কিন্তু পরীক্ষার রেজাল্টে কোনো হেরফের হতো না। বরঞ্চ প্রথম শ্রেণীতে তিনি প্রথম হয়েছিলেন। বসুর সাথে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মাদাম কুরি, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের নিয়মিত যোগাযোগ হতো। রবীন্দ্রনাথ নিজের ‘বিশ্বপরিচয়’ বিজ্ঞানগ্রন্থ, অন্নদাশঙ্কর রায় তাঁর ‘জাপানে’ ভ্রমণরচনা ও সুধীন্দ্রনাথ দত্ত তাঁর ‘অর্কেস্ট্রা’ কাব্যগ্রন্থ সত্যেন্দ্রনাথকে উৎসর্গ করেছিলেন। দুঃখজনক হলেও সত্যি যে তার আবিষ্কৃত তত্ত্বের উপরে কাজ করে অনেকেই নোবেল পেলেও সত্যেন্দ্রনাথ বসুকে কিন্তু নোবেল দেওয়ার কথা কেউ তোলেননি।
আত্মভোলা এক মানুষ ছিলেন বসু। এ নিয়ে তার জীবনে রয়েছে নানা মজার ঘটনা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালীন একটি ঘটনা। একদিন বসুর মেয়ে সিনেমা দেখতে যাওয়ার বায়না ধরলো। বসু তখন গণিতের একটা জটিল সমস্যা সমাধানে চিন্তামগ্ন। তারপরও মেয়ের জোরাজুরিতে রাজি হলেন। মেয়েকে নিয়ে ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে গেলেন সিনেমা হলে। গাড়ি থেকে নেমে গাড়োয়ানকে টাকা দিতে গিয়ে দেখেন মানিব্যাগ বাসায় ফেলে এসেছেন। চিন্তিত মুখে মেয়েকে সিনেমা হলের সামনে অপেক্ষা করতে বলে একই ঘোড়ার গাড়িতে বাসায় ফিরে এলেন। টেবিলের ওপর থেকে মানিব্যাগটা তুলতে গিয়ে তার দৃষ্টি পড়লো কিছুক্ষণ আগে শেষ করতে না পারা বৈজ্ঞানিক সমস্যাটির সমাধানের ওপর। তারপর হলো কি, ভুলে গেলেন সিনেমা দেখার কথা! মেয়েকে যে সিনেমা হলের সামনে একা ফেলে এসেছেন ভুলে গেলেন তাও। সবকিছু ভুলে গিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন সমস্যাটির সমাধানে।
এদিকে গাড়োয়ান অপেক্ষা করে আছে। কাউকে যে সে বলবে তাকে গাড়িভাড়া দিয়ে বিদায় করার তেমন কোন মানুষও খুঁজে পাচ্ছিলও না গাড়োয়ান। এত বড় বিজ্ঞানীর বাড়িতে হাঁক-ডাক করারও জো নেই। দু’ঘন্টা পরেও যখন বিজ্ঞানী বের হচ্ছেন না তখন গাড়োয়ান সাহস করে ঘরে ঢুকে দেখে বসু চেয়ারে বসে অংক কষছেন। গাড়োয়ান যখন ডাক দিল বসু চমকে উঠলেন, “কী হলো?” গাড়োয়ান সিনেমায় যাওয়া আর মেয়ে সিনেমা হলে একা অপেক্ষা করছে বলাতে বসু সম্বিত ফিরে পেলেন এবং নিজের ভুল বুঝতে পারলেন।
বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু শুধুমাত্র বাংলায় বিজ্ঞানচর্চার প্রবল সমর্থকই ছিলেন না, সারা জীবন ধরে তিনি বাংলায় বিজ্ঞানচর্চা প্রসারের জন্য বিভিন্ন কর্মকান্ডও হাতে নেন। এইসময় বাংলায় বিজ্ঞানচর্চার প্রসারের লক্ষ্যে ‘বিজ্ঞান পরিচয়’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন তিনি। তার একটি বিখ্যাত উক্তি হলো, “যারা বলেন বাংলায় বিজ্ঞান চর্চা সম্ভব নয়, তারা হয় বাংলা জানেন না অথবা বিজ্ঞান বোঝেন না।”
তথ্যসূত্র:
সত্যেন্দ্রনাথ বসু রচনা সংকলন, বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ
লেখকের কথা: রানা চক্রবর্তী
রানা চক্রবর্তী পেশায় সরকারী কর্মচারী। নেশা ইতিহাসের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে পড়াশোনা আর লেখালিখি। নিজেকে ইতিহাসের ফেরিওয়ালা বলতে ভালবাসেন।