চুপ-শৈশব: ঝোল

লেখক: স্বাগতা আচার্য্য

ঠিক যখন সামনের পুকুর-মাঠ জলে থইথই, এক আকাশ মেঘ উপচে পড়ছে কালো হয়ে, কাকু জল ছপছপ করতে করতে এগিয়ে যেত ঠিক পড়ে আসা বিকেলের ঘনঘটা মেখে। হাতে থাকতো বাঁকি (চলতি কথায়), আর ছোট্ট জাল। দুটি লাঠিতে বেঁধে জাল ঘিরে দিত মাঠে। বাঁকি আধডোবা হয়ে ঝিমোতো। কাকু ফিরে আসতো তাল কুড়িয়ে। রাতভর জালে আটকা পড়ত কই, সিঙি, পাঁকাল। সকালে বাঁকি উপুড় করলেই ছিটকে উঠতো চিংড়ির দল। কখনো আটকে থাকা জলঢ়োঁড়া ধীরে ধীরে ফিরে যেত জলায়।

গুগলিরা নিশ্চুপ হয়ে নরম মাংস গুছিয়ে নিত। চিংড়িরা ডুবে যেত তেঁতুলের বানে। কাকিমা জিয়লদের সাবধানে চেপে ভরে দিত জলভরা বাতিল কলসীতে। আমরা ঢাকা দিয়ে দিতাম টালির টুকরো। লাফিয়ে বেঁচে থাকার জানান দিত তারা। অবশ্য প্রতিদিন জল বদলে দেবার সময় দেখে নিত মৃত্যুর খবর। আর যেদিন কাকু খালি হাতে ফিরতো, জমানো ব্যাংকে হাত পড়ত।

বঁটির কাঠ দিয়ে ঠুকলেই সব চুপ ! আলু কাঁচাকলায় মিইয়ে যেত তাদের অতিরিক্ত শ্বাসযন্ত্র। মেঘজমা বিকেলে দুধ কলা দিয়ে মুড়ি খেতে ইচ্ছে করতো না। মায়ের কাছে আমতেল খাওয়ার বায়না করতাম। সামনের রাস্তায় কাদায় আটকে যাওয়া রথের দড়িতে প্রাণপণে টান দিত খেয়ালখুশির দল। দিনভর গোয়ালে আটকে থাকা অবলারা খাবারের জন্য হাম্বা ডেকে উঠতো।

একবুক মেঘ নিয়ে অন্ধকার জমাট বাঁধতো। ডুবে যাওয়া ধানজমি দেখে বাড়ি ফিরতো বাবা। পড়া নামক প্রহসনকে মাদুরে বিছিয়ে একটানা আউড়ে যেতাম আমি আর ভাই। অজান্তেই খুঁটে তুলতাম মাদুরকাঠি। কালো জমতো হ্যারিকেনের কাচে।

একটানা ঝিঁঝির গোঙানির মাঝে খেতে বসতাম। নিভে আসতো আলোর শিখা। চাষ ডুবে যাওয়ার চিন্তায় মনের ঝোলে ভাত মেখে খেত বাবা-কাকু। মা উপুড় করে ঝোল ঢেলে দিত আমাদের পাতে। মায়ের দীর্ঘ ছায়ায় দাঁড়িয়ে থাকতো কাকিমা। নিরিমিষ খাওয়া ঠাকুমার পাতে লাফিয়ে পড়ত জলভেজা ব্যাঙ।

সম্বৎসরের চিন্তায় বাবার মশারিতে ধাক্কা খায় বর্ষার ঝিরিঝিরি শব্দ। আর সদ্য কোলবালিশ দিয়ে সীমান্ত ভাগ করে আমি আর ভাই তখন ঠাকুমার পাশে অতন্দ্র প্রহরায়। তালের বড়ার চুপচুপে গন্ধ কখন যে চোখের পাতায় নামতো টের পেতাম না।

সত্যিই এখনো গুগলি জীবন ! বাবা কাকুর শক্ত খোলসে নরম মাংস গুছিয়ে ঝোলে-অম্বলে রসিয়ে রশি টানছি এখনো।


ছবি: প্রণবশ্রী হাজরা


লেখকের কথা: স্বাগতা আচার্য্য
নেশায় -আবোলতাবোল পাঠিকা। পেশায় -সেবিকা। নিবাস -পূর্ব মেদিনীপুর।
লেখকের ভাষায় – “যা ভাবি লেখা আসে তার সিকি; হইচই মার্কা মনন। এলোমেলো বুনন। গুণ খুব একটা নেই। কেউ লেখা চাইলে ধড়ফড় করে কেমন। ভুল ক্রুটি নিজগুনে ক্ষমা করে দেবেন। জানাবেন অকপটে। পরের বার শুধরে দেবার আশায় আছি।”

2 Comments

  1. ঈর্ষনীয় সুন্দর লেখা–মাটির গন্ধ ভরা। এই লেখিকাকে নমীদামি পত্রিকা হয়তো কোনদিনই আপন আপন গোষ্ঠীভুক্ত করে স্বীকৃতি দেবেননা। কিন্তু, প্রতিভা আর স্বাতন্ত্র্যের সৌরভ কখনও চাপা থাকেনা।
    লেখিকাকে আন্তরিক অভিনন্দন এবং শুভকামনা জানাই এই অতুলনীয় গল্পটির এবং শক্তিশালী কলমের জন্যে।

  2. রাজীব চক্রবর্ত্তী

    স্তব্দতা মনের ঘরে। এ গদ্যে পদ্যের মেদুরতা। শরীরে কবিতার ঝিম ধরা আমেজ। লেখিকাকে ধন্যবাদ।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।

লেখা আহ্বান - বিস্তারিত জানতে ছবিতে ক্লিক করুন