চুপ-শৈশব: আঁচবিলাসী

লেখক: স্বাগতা আচার্য্য

ঠিক যখন চাল ধুয়ে রোদে মেললে দাঁতে দিলেই ঠক্ করে আওয়াজ হতো তখন প্রস্তুতি নিয়ে মুড়ি ভাজতে বসতো ঠাকুমা। গনগনে কাঠের আঁচে মাটির হুলনি (চাল নেড়ে নেবার মাটির পাত্র) চাপিয়ে ঝাঁটার কাঠির গোছায় নাড়লেই চাল উঠতো গরম হয়ে! আটপৌরে শাড়ির পাড় ভিজে ঠাম্মার পিঠে দরদর করে ঘাম নামতো।

তারপর অ্যালুমিনিয়ামের খোলায় বালি চাপাতে হতো। অল্প চালে ফুরফুর করে ফুটে উঠত শিউলি ফুলের মত সাদা সাদা মুড়ি। গরম মুড়ি ছোঁ মেরে একমুঠু নিয়ে সোজা মুখে। খোলায়-বালিতে-মুড়িতে-কাঠের আঁচে সে এক মাখামাখি উষ্ণ গন্ধ!

এর মাঝেই ঠাকুমার উঠতো চায়ের নেশা। তার উনুনও ছিল শৈশব-নিকানো। উনুনের মুখে গুঁজে দিতাম তাল-নারকোলের শুকনো পাতা আর ওপরে কালো সসপ্যানে জল ফুটতো টগবগিয়ে। গুঁড়ো চা ছড়িয়ে সাবধানে ছাঁকতাম চায়েরই প্যাকেটে ফ্রি পাওয়া কাচের গেলাসে। ঠাকুমা উঠে আসতো গেলাস হাতে। আর ওই আগুনমাখা জায়গায় বসতো মা। ফেরত পাওয়া গেলাস ধুতে যাবার সময় তলানিটুক ইতিউতি চেয়ে টুক করে হাঁসুলি হাড়ের মাঝে পাচার করে দিতাম। কষায়-মিঠায় জিভ ভরে উঠতো।

শুকনো খড়ে দোপাক্ (ধান সেদ্ধ করার বড় উনুন) উনুনে কাকভোরে সেদ্ধ হত ধান। আগে ভাপিয়ে রাখা ধান হাঁড়িতে ভরে দু’জন ধপ করে উনুনে বসিয়ে দিত। আগুনে উনুন ভরে উঠলে ঝিটনাকাঠি (খুঁচিয়ে দেবার লাঠিবিশেষ) দিয়ে দিত খুঁচিয়ে। দাউদাউ করে আগুন উঠতো হাঁড়ির ফাঁকে।

মা রান্না করত শুকনো পাতা, কাঠ, খড়, কাঠির জ্বালানিতে। একদিকে ভাঙা টালির ঠেকা দিয়ে ভাতের হাঁড়িতে ফুট উঠতো, আর একদিকে তরকারি। বেশী আগুন হলেই মা কাঠ বের করে নিত। নিবু উনুনে এ‍্যালুমিনিয়াম গেলাসে বসিয়ে দিত জল।

খিদের শৈশবে জ্বলা উনুন ছিল তীর্থভূমি। খাওয়া জোটেনি এমন দিন যেমন ছিল না তেমনি ভোজন বিলাসিতাও অনাবিষ্কৃত ছিল। নুনটুকু ঠিক হলেই কেল্লাফতে। মুহুর্তে থালা সাফ।

এখন আর তীর্থভূমি খিদেয় খুঁজে পাইনা। খাদ্য হয়েছে স্বাদের,পরিমাপের,পুষ্টির। মাপতে হয় খুব হিসেব কষে, জিভও সেইমতো অভ‍্যস্ত।

তবু কাঠ-পাতা জ্বলা আঁচ হানা দেয় ডায়েট নামক পক্ষাঘাতের ফাঁকে বেদুইনের মতো!


ছবি: প্রণবশ্রী হাজরা

লেখকের কথা: স্বাগতা আচার্য্য
নেশায় -আবোলতাবোল পাঠিকা। পেশায় -সেবিকা। নিবাস -পূর্ব মেদিনীপুর।
লেখকের ভাষায় – “যা ভাবি লেখা আসে তার সিকি; হইচই মার্কা মনন। এলোমেলো বুনন। গুণ খুব একটা নেই। কেউ লেখা চাইলে ধড়ফড় করে কেমন। ভুল ক্রুটি নিজগুনে ক্ষমা করে দেবেন। জানাবেন অকপটে। পরের বার শুধরে দেবার আশায় আছি।”

শেয়ার করে বন্ধুদেরও পড়ার সুযোগ করে দিন

One comment

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।