চিঠি: ডিয়ার মা

লেখক: কুহেলি বাঁক

Dear মা,           
জানো মা, আজ আমাদের সূর্য উচ্চমাধ্যমিক পাশ করল। আমার আজও মনে পড়ে, সূর্যর প্রথম স্কুলে যাওয়ার দিনটা, কত কান্নাকাটি করছিল। স্কুলের আন্টি একপ্রকার জোর করেই ওকে ভিতরে নিয়ে যায়, তারপর বাড়ি ফিরলে কতই না বকাবকি করেছিলাম ওকে। তারপর থেকে আর কাঁদত না। দেখতে দেখতে কত বড় হয়ে গেল ছেলেটা। জানো, আজ ওর পড়ার টেবিল থেকে একটা ডায়েরি পেলাম, কৌতূহলবশেই সেটা পড়ে ফেলি। জানো মা, ডায়েরির প্রথম ঘটনাটা সেই দিনের যেদিন সূর্য প্রথম খাতায় “good” পেয়েছিল, ও কত খুশী হয়ে আমাকে দেখাতে এনেছিল কিন্তু কাজ থেকে ফিরে খুব ক্লান্ত ছিলাম বলে, ওকে বলেছিলাম, “সূর্য যা দেখানোর কাল দেখিও, আজকে আমার ভালো লাগছে না”। ও নীরবে চলে গিয়েছিল।
তারপর একদিন ও একটা কাচের গ্লাস ভেঙেছিল, কতটা যে রেগে গিয়েছিলাম সেদিন, খুব মেরেছিলাম, অথচ ওই গ্লাসে যে ওর হাতটাও কেটে গিয়েছিল, সেটা ও আমাকে দেখায়নি পর্যন্ত! তুমি তো জানো, সূর্যকে কখনোই বাড়ির বাইরে খেলতে যেতে দিতাম না, ও প্রশ্ন করলে বলতাম, “ওদের সাথে তোমার মেশার কোন প্রয়োজন নেই, ওরা ভাল নয়। তুমি বাড়িতেই খেলো”। কিন্তু সে বাড়িতে একা কী খেলবে, সেই প্রশ্নের উত্তর হয়তো দিতে পারতাম না। ও কোনোদিনও এই প্রশ্ন করেও নি, যদি করতো হয়তো আমার কাজ আছে বলে দায়িত্ব শেষ করতাম।
সূর্যর কাছে তখন মুক্ত আকাশ বলতে শুধু বাড়ির ছাদই ছিল। ছাদে বসানো ফুলগাছ গুলোর সাথে কিসব যেন বকত। আজ বুঝতে পারছি, ফুলগুলো ওর জীবনের কিছু ভালো-খারাপ মুহূর্তের সাক্ষী হত, আমি যা জানতাম না, ওরা সেটা জানত। সূর্যর আর একটা স্বভাব ছিল, দরজা বন্ধ করে খুব জোরে সাউন্ড দিয়ে টিভিতে গান শোনা। খুব বকাবকিও করতাম এর জন্য। ও বলত আমার এই ভাবেই গান শুনতে ভাল লাগে। কিন্তু ও যে কান্নার শব্দটা আমার কাছ পর্যন্ত পৌঁছাতে দেবে না বলে এরকম করত, সেটাও আজ জানলাম। কোনদিন লক্ষ্য পর্যন্ত করিনি। তোমার মনে আছে, একটা সময় ও স্কুলে যেত না, সারাদিন ঘুমাত আর চোখ-মুখ ফুলিয়ে ঘুম থেকে উঠত।
জিজ্ঞেস করলে বলত , “এখন স্কুলের চাপ নেই, তাই স্কুলে যাব না। কটা দিন সময় পাচ্ছি তাই একটু বেশী ঘুমাচ্ছি”।
“বাবা! তা বলে ঘুমিয়ে চোখমুখ ফুলিয়ে ফেলবি, এত কুম্ভকর্ণ মার্কা ঘুম রাখিস কোথায়!!!”, আমি বলেছিলাম। তবে ওটা যে প্রেমে ব্যর্থ হয়ে, ডুকরে ডুকরে কেঁদে হয়েছিল, সেটাও আজকেই……আর কত বলব!
জানো মা, যখন তোমার জামাই আর আমি আলাদা হওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম, তখন কটা মাস ওকে দেখিনি পর্যন্ত। কী খেত, কী করত, কীভাবে থাকত কিছুই দেখতাম না, আমি তো শুধু আমার নতুন জীবন সাজাতে ব্যস্ত ছিলাম। ওই সময় ওর ভিতরে কী চলছিল, তার ব্যাখ্যা অবশ্য ডায়েরিতে নেই। কী জানি যদিও থাকত, এত কিছু জানার পর, সেই কথা পড়ার ক্ষমতা আমার থাকত না।
আচ্ছা মা, সূর্য যেদিন প্রথম স্কুলে যায় সেদিন কি আমি ওর কপালে একটা চুমু দিয়ে,কাঁধে হাত রেখে বলতে পারতাম না যে, “এই তো সোনা, আমি তো এখানেই আছি, আমি কোত্থাও যাচ্ছি না”। রোজ গাড়ি না পাঠিয়ে, একেক দিন কি আমি নিজে গিয়ে ওকে স্কুল থেকে আনতে পারতাম না? আইসক্রিম খেতে খেতে ওর সব গল্প শুনতে শুনতে বাড়ি ফেরাটা কি এতই difficult ছিল? বারবার “তোর দ্বারা কিচ্ছু হবে না, ওমুক কে দেখ কত ভাল ছেলে”, “একটা কাজও যদি তোর দ্বারা হয়”, এই সব না বলে শুধু একবার, শুধু একবার, “তুই পারবি,চেষ্টা করে দেখ, আমি তো আছি তোর সাথে”, এসব কি বলতে পারতাম না? ওর সাথে একবার লুকোচুরি খেললে কি আমার খুব সময় নষ্ট হয়ে যেত? পারতাম না, ওই ফুলগুলোর মত ওর বন্ধু হতে? সবার জীবনে, সবথেকে উজ্জ্বল স্মৃতি হয় তার ছোটবেলার স্মৃতিগুলো, আমি কি পারতাম না ওকে কিছু সুন্দর স্মৃতি দিতে? একজন মা কি তার সন্তানের ভালো বন্ধু হতে পারে না? আমি কেন পারিনি? কেন? কেন? কেন??? !!!!
সূর্য এখন আমার কাছে থাকে না, ও হস্টেলে চলে গেছে। সেখানেই হয়তো ও অনেক ভাল আছে। আজ সূর্যর জীবন অনেকটা গোছানো, কিন্তু মায়ের ভালোবাসার জায়গাটা আজও শূন্য। এই শূন্যতা, চাইলেও আজ আমি পূরণ করতে পারব না। কেন জানো? -ওর ডায়েরিতে আমার জন্মদিনের তারিখ লেখা পাতাটায়, বড় বড় করে লেখা ছিল, “I hate you ma, I hate you… কেন তুমি আমার মা হলে, কেন?”    
মা, কথাগুলো শুধু তোমাকেই জানালাম। এখন একটু শান্তি পাচ্ছি। প্রণাম নিও আর ভালো থেকো।

ইতি
তোমার মেয়ে


লেখকের কথা : কুহেলি বাঁক
হাওড়া জেলার দেউলপুর গ্রামের বাসিন্দা। বর্তমানে কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগে স্নাতকার্থী। সাহিত্য প্রেমী ; নেশা – বিভিন্ন ধরনের কবিতা, গল্প, উপন্যাস পড়া আর টুকটাক লেখালেখি করা।

15 Comments

    • অজ্ঞাতনামা কেউ একজন

      লেখাটা পড়ে খুবই ভালো লাগলো, তোমার মনের অভিব্যক্তি গুলো খুবই সুন্দর ভাবে ফুটিয়ে তুলেছো কিন্তু আরও সুশৃংখল বদ্ধ ভাবে সাজালে পড়তে ও শুনতে আরও ভালো লাগতো…. এটা আমার অভিমত …… বোন …. তোমার কাছ থেকে আরও অনেক অনেক ভালো লেখার আশায় থাকলাম……..

    • সুদীপ ঘোষাল

      দারুন লেখা হয়েছে… অসাধারন….পড়ে খুব ভালো লাগলো। এভাবেই নিজের প্রতিভাকে আরো এগিয়ে নিয়ে চলো।

      • হোসেন আলি মোল্লা

        খুব সহজ করে মনে অভিব্যক্তি কে ফুটিয়ে তোলাই হল ছোট গল্পের মূল উদ্দেশ্য আর তা তোমার লেখার মধ্যে সুন্দর ভাবে পরিলক্ষিত। বেশ ভাল হয়েছে। আরও ভাল কিছু আমাদের উপহার দাও।তোমার সাফল্য কামনা করি।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।

লেখা আহ্বান - বিস্তারিত জানতে ছবিতে ক্লিক করুন