লেখক: রণজিৎ বিশ্বাস
আজাদ ফিরে এলেও মনে শান্তি পাচ্ছে না। নিজের ঘরে, বিবি বাচ্চাদের কাছে যেতে পারছে না। এ এক অদ্ভুত ফাঁদে পড়ে গেছে যেন।
পরের জমিতে মজুরী খাটে। তাই দিয়ে কোনো রকমে সংসারটা টানছিল। আগে বড় ভাইয়ের সঙ্গে এক সংসারে থাকছিল। বড় ভাবী আসার পর সংসারে অশান্তি ঢুকল। বড় ভাবী ওকে আর ওর বুড়ী আম্মিকে আলাদা করে দিল। একই মাটির দাওয়ায় দুটো চুলা জ্বলল। বড় ভাবীর বড় বেটি সালমাকে আজাদ বড্ড ভালো বাসত। যেদিন খেয়াল করত ওদের ভালো কিছু রান্না হয়নি আজাদ চুপিচুপি নিজেদের রসুই থেকে ওকে কিছু একটা দিতে যেত। ভাবী রাগ করে তুমুল অশান্তি করত। সালমার দুচোখে পানি গড়িয়ে পড়ত, ভয়ে সেটা খেতে পর্যন্ত পারত না।
আজাদের আম্মির বয়েস হচ্ছে, তাই একদিন জোর করে পাশের গাঁয়ের রেহেনার সঙ্গে সাদি দিয়ে দিল। বলল, ‘আমিই বা কদ্দিন? বেটা তোকে দেখবে কে?’
রেহেনা দেখতে হুরী-পরি ছিল না। গতর ভালো, খাটতে ভালো পারত। সারাদিন হেঁসেল সামলে গাই-বলদের দেখভাল করেও ও বহুৎ সুখে সংসার করছিল। শীতের দুপুরে উঠোনের ঘোড়া নিমগাছের তলায় পাটি পেতে ক্যাথা নিয়ে বসত সেলাই করবে বলে। কত রকম ফুল তুলতো ক্যাথায়। সালমা তার আম্মিকে লুকিয়ে চাচির কাছে বসে সেই ফুল তোলা শিখত।
একদিন সালমা চাচিকে ছোট্ট ক্যাথা তৈরী করতে দেখে অবাক হল, জিজ্ঞেস করল, ‘কে শোবে চাচি?’
চাচি মুচকি হাসি হেসে বলল, ‘তোর ভাইরে বেটি।’
সত্যিই ভাই এলো একদিন, আজাদের বেটা। আনন্দের সঙ্গে চিন্তাও এলো মাথায় জট হয়ে। যত বড় হচ্ছিল আজাদের মনে হচ্ছিল সংসার টানা অসম্ভব হয়ে পড়ছে। আম্মা ক’বছর বিধবা ভাতা পেয়ে সংসারে কিছু যোগান দিচ্ছিল। কিন্তু গত বছর ফসলে মড়ক লেগে অজম্মা হল। আমের সিজিনে আম গাছের নীচে পাহারাদারের কাজ করে কিছুটা সামাল দিতে পেরেছিল। তারপর হাসানের সঙ্গে আলাপ করে শুনল, ঠিকাদারের সঙ্গে দিল্লি গেলে রোজগার অনেক।
বাড়ী-ঘর-বিবি-বাচ্চা ছেড়ে দিল্লি যেতে মন চাইছিল না। নতুন জায়গা, নতুন কাজ। বিল্ডিংয়ের কাজ। হাসান ছাড়া ওদের সঙ্গে বাড়ী থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরের মাইদুল, ফিরোজ, গোরা আর ওদের চেনা আরো জনা দশেক ছিল। বাড়ীর বাইরে তো কোনোদিন যায়নি আজাদ। কত মন খারাপ। ওদের বাড়ী থেকে মেন রোডে উঠে স্টেশনের বাস ধরে দিল্লি যাওয়া। সঙ্গে ছোট ছোট ব্যাগ আর বোঁচকা। রেহেনা সব গুছিয়ে দিয়েছিল। সঙ্গে মুড়ি, চিঁড়া, চাল-ভাজা, পোয়া। কত করে বুঝিয়ে দিয়েছিল কোনটায় কী কী আছে। বাসে তুলে দিতে সারা গাঁয়ের মেয়ে-বউ-মরদেরা এসেছিল। ভাবীও এসেছিল, বলেছিল, ‘মনে হচ্ছে যেন হজে যাচ্ছ, এমন করেই একদিন হজটা করে এসো ভাইয়া।’
আজাদ চোখের পানি লুকোতে পারেনি। ওর ছোট ব্যাটা শামীমকে কোলে নিয়ে ছাড়তে চাইছিল না। বাস চলতে শুরু করলে সারা গাঁয়ের জন্য মনটা হু-হু করে উঠল। সেই ধান ক্ষেত, সেই পাট ক্ষেত, সেই পুকুর, ঘোড়া নিমগাছ, গাই-বলদ-মুর্গা ওকে হাতছানি দিয়ে ডাকছিল। মৌলবী সাহেবের কথা বার বার মনে হচ্ছিল, এ কেমন কথা, দ্যাশে আর কাজ নাই যে রহিমের ছোট পোলাটাকে বাইরে যেতে হবে? আজাদের বারবার মনে হচ্ছিল, মৌলবী সায়েব যেন আল্লা প্রেরিত দূত।
দিল্লি গিয়ে আজাদ কাজে লেগে গেল। কোনোদিন কলকাতাই দেখেনি সে। কিন্তু দিল্লিতো আর দেখার জন্যে যায়নি। কাজ কাজ আর কাজ। ঠিকাদার মজুরী ঠিক মতোই দিত। দিনের শেষে সবাই মিলে মালিকের ভাড়া করে দেওয়া একটা গোডাউনে হৈ-হৈ করে থাকতো। সবাই মিলে এক সঙ্গে রান্না করে খাওয়া। বাড়ীর কথা কমই মনে পড়ত। হাতে টাকা পেয়ে কী কিনবে আর কী যে কিনবে না তাই নিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়ল। রেহেনাকে তো হাত খুলে কোনো ঈদেই কিছু দিতে পারেনি। একটা বেশ রঙ-চঙে কাপড় কিনল। সুন্দর সুন্দর জরি বসানো চুড়ি কিনল, শামীমের জন্যে মিলিটারিদের মত জামা আর জুতো কিনল। সালমার জন্যে জরির চুড়িদার। মাম্মির জন্যে নামাজ পড়ার ছোট্ট কার্পেট। আর ভাবীর জন্য ? একটা সিল্কের হিজাব। বড় ভাইয়া আর নিজের কিছু কেনার জন্যে আর টাকা রইল না। ভাবল, পরের মাসে পছন্দ মত কিনবে কিছু, সেই সঙ্গে মৌলবী সায়েবের জন্যে একটা সুন্দর ফেজ টুপি।
কিন্তু পরদিন থেকে আজাদদের জীবনে নেমে এলো এক ভয়ঙ্কর অন্ধকার সময়। শুনল সবকাজ-কাম বন্ধ হয়ে গেলো। দেশে এক ভয়ঙ্কর রোগ এসেছে করোনা তাই মালিক গোডাউন বন্ধ করে পঞ্জাব চলে গেল। বাকি কিছু টাকা পাওনা ছিল, ঠিকাদার সময় বুঝে কলকাতা পাড়ি দিয়েছে। ওদের সবাইকে রাস্তায় নামতে হল। ফিরোজ, গোরা, মাইদুলদের কাছে সামান্য টাকা ছিল যেটা খরচ করতেও সবাই ভয় পাচ্ছিল। বেশীর ভাগ দিনই উপোস। মনে হচ্ছিল যেন রোজা রেখেছে। ফুটপাথে শুয়ে দেখছে পথের কুকুরেরা গা ঘেঁষে শুয়ে আছে। পুলিশের ভারী বুটের শব্দে ঘুম ভেঙে যায়। ফিরে যাবার উপায় নেই, ট্রেন বন্ধ। শুনছিল অনেকেই নাকি বাড়ী ফেরার তাড়ায় হাঁটা দিয়েছে। ওরা রাস্তা চেনে না। কতটা দূর তাও জানে না। পথে শেয়াল-কুকুরের উপদ্রব হতে পারে, শেষ সম্বলটুকুও চোর-ডাকাতে কেড়ে নিতে পারে। কিন্তু না খেয়ে খেয়ে ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ছে। দোকান-পাটও বন্ধ। কে একজন বলল ওখান থেকে চার কিলোমিটার দূরের এক গুরুদ্বারে নাকি খাবার খাওয়াচ্ছে । ওরা তড়ি-ঘড়ি বুভুক্ষু হয়ে সেখানে দৌড়োল। আজাদের মনে হল জুম্মাবারে কত অভাবী লোক ওদের মতই মসজিদে এসে ভিক্ষে করে। এখন বুঝল এই খিদে মানুষে মানুষে কতটা মিল এনে দেয়!
আজাদরা বাড়ী ফিরে আসার কথা, বেঁচে থাকার আশা ছেড়েই দিয়েছিল। একদিন শুনল ট্রেন যাবে। দিল্লি থেকে হাওড়া। কাউন্টারে টিকিট দেবে না। অনলাইনে মিলবে। সবার টাকা জড়ো করে টিকিট কাটল। রেল কোম্পানী তো আর দয়া-দাক্ষিণ্য দেখালো না। ওদের শরীরের পরীক্ষা নিল। কিন্তু সেই যাত্রা যে এতো দুর্বিষহ হতে পারে ভাবেনি। ট্রেনে জল-খাবার কিছুই নেই। অসহ্য গরম আর সময়ের কোনো বাঁধাধরা নিয়ম নেই। তবু শক্তিটা পেয়েছিল নিজের নিজের ঘরে ফিরছে বলে।
কলকাতায় পৌঁছে থানা-পুলিশ হল। তারপর শরীরের পরীক্ষার পর অনেক কষ্টে আজাদ নিজের গ্রামে পৌঁছল। প্রথমে এক চাচার সঙ্গে দেখা। তারপর সারা গাঁয়ে রাষ্ট্র হয়ে গেল আজাদ বেঁচে আছে আর ফিরেও এসেছে। দলে দলে ওর আত্মীয়, বন্ধু আর গ্রামবাসীরা হঠাৎ কঠিন মুখে রুখে দাঁড়াল। ওরা বিধান দিল তুমি এখন এই গাঁয়ে ঢুকতে পারবে না। অবাক হল আজাদ। কয়েক মাস আগে এরাই তাকে কত দুঃখে বাসের কাছে ছেড়ে এসেছিল আর এই ক’দিনেই এরা এতটা পাল্টে গেল? ও এই ক’মাস কত কষ্টে কাটিয়েছে একমাত্র তার জন্মভিটে, গ্রাম আর এই মানুষগুলোর কাছে আসবে বলে আর এখন এরাই তাকে তার নিজের গ্রামে অচ্ছুৎ করে দিয়েছে!
ভিড়ের মধ্যে আজাদ মৌলবী সায়েবকে দেখতে পেল। ও ওনাকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘আস সালামু আলাইকুম মৌলবী সায়েব।’
মৌলবী সায়েব ওয়ালাইকুম আসসালাম বলে বললেন, ‘এরা তো ঠিক কথাই কইছে। তুমি বাড়ী ঢুকতে পারবে না।’
সবাই সমস্বরে ওনাকে সমর্থন করলে আজাদের চোখে পানি এসে গেল। ও শিশুর মত বলতে লাগল, ‘আমি তো এই গাঁয়েরই ছেলে। এটাই আমার জন্মভিটে।’
ব্যাগ থেকে তার নিজের আধার কার্ডটা বার করে মৌলবী সায়েবের সামনে মেলে ধরে বলল, ‘দেখুন, দেখুন আমি আজাদ শেখ আমার আব্বাজান রহিম মিঞা, আপনারা আমায় ভুলে গেলেন? আমার আম্মি জাহানারা বেওয়া, বিবি রেহেনা, বড় ভাইয়া আলাউদ্দিন।’
মৌলবী সায়েব সান্ত্বনা দিলেন, ‘আরে তুমাকে তো আমরা চিনি, তুমাদের তিন পুরুষ থেকেই চিনি কিন্তু তুমি যে এখন দিল্লি থেকে এসেছ?’
আজাদ হাউ হাউ করে কেঁদে মাটিতে বসে পড়ে দুহাতে দুমুঠো আলগা মাটি তুলে নেয়, বলে, ‘মৌলবী সায়েব আপনি তো জানেন আমি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ি না কিন্তু তিন ওয়াক্ত নামাজ তো পড়িই। আমি সাচ্চা মুসলমান। আমি এই ভারতবর্ষেরই লোক। আমি বাঙালী, আমি এই গাঁয়েরই এই মাটি মেখে বড় হয়েছি, এই মাটিতে হাল দিয়ে সোনার ফসল ফলিয়েছি। ন্যাংটো বয়েস থেকে বন্ধুদের সঙ্গে এই মাটি মেখেই মাঠে ফুটবল খেলেছি, পুকুরে সাঁতার দিয়ে এ-পার ও-পার করেছি, ঘরে আমার বিবি রয়েছে, বাচ্চা রয়েছে, কতদিন তাদের দেখিনি, ছুঁইনি।’
আজাদের কথার মাঝে গাড়ির শব্দ। সবাই বলে উঠল, বিডিও সায়েব, পুলিশ পুলিশ!
পুলিশ এসে গ্রামবাসীদের সঙ্গে কথা বলে আজাদকে ওর বাড়ির কাছের হাই মাদ্রাসায় নিয়ে গেল। কোন ছোট বেলায় আজাদ এখানে পড়তে আসত। প্রথমে কোরআন পাঠ দিয়ে শুরু তারপর আলিমের কিছুটা পড়ে ছেড়ে দিয়ে ওর আব্বার সঙ্গে জমিতে কাজ। আজ সেই মাদ্রাসায় এসে ওর মত আরো অনেককে দেখলো ও। ওরা কেউ ভুবনেশ্বর, কেউ রাজস্থান থেকে কাজে ছেদ দিয়েই ফিরে এসেছে। আজাদ বিডিও সায়েবকে অনেক অনুনয় করল, ‘স্যার আমার এই কাছেই ঘর। ওই যে ঘোড়া নিমগাছটা দেখছেন ওটাই আমার ঘর। এত আপন ছিল আমার গাঁয়ের লোকেরা আজ একেবারে পর হয়ে গেছে। আমাকে এতোদিন পরে ঘরে ঢুকতে দিচ্ছে না। একবার যেতে দেবেন স্যার? আমার বাচ্চা ছেলেটাকে একবার দেখে আসবো?’
বিডিও সাহেব মাথা নাড়েন, বলেন, ‘চোদ্দ দিনের আগে কখনোই না।’
এই থাকার জায়গায় না আছে কোন খাবার, না আছে কোন পানি। বিজলি বাতির কোনো ব্যবস্থা নেই। বনের পশুদের মত ওদের গেটে তালা দিয়ে রাখা হয়েছে। আজাদ শুনল, এত অব্যবস্থার জন্য অন্য কোথায় কয়েকজন নাকি পালিয়ে গেছে। তাই তালা-চাবির ব্যবস্থা।আজাদ হতাশ হয়ে একটা বড় জানলার কাছে দাঁড়িয়েছিল। হঠাৎ দেখলো সালমা একটা ঝোপের আড়াল থেকে ওকে চুপিচুপি দেখছে। আজাদ হাত নেড়ে সালমাকে ডাকল। কিন্তু সালমা ছুট্টে পালিয়ে গেল। সন্ধ্যার সময় গার্ড এসে জানাল, তোমার বাড়ী থেকে লোক এসেছে খাবার নিয়ে। আজাদ দেখলো, অল্প অন্ধকারে রেহেনা মাথায় ঘোমটা টেনে হাতে একটা কাপড়ে বেঁধে ভাত আর একটা বোদনা করে পানি নিয়ে এসেছে। তাও অনেক দূরে দাঁড়িয়ে ও। আজাদের খুব ইচ্ছে করছিল ওকে স্পর্শ করে। দুটো সোহাগের কথা বলে কিন্তু ও যে আজকে সেই আজাদ নেই। কেমন করে যেন পরিস্থিতির চাপে ওর জীবনটাই পাল্টে গেছে।
লেখকের কথা: রণজিৎ বিশ্বাস
কলেজের প্রাক্তন বাংলার অধ্যাপক। কর্মজীবনে নানা কর্মব্যস্ততায় লেখার সুযোগ না থাকায় এখন সদ্য অবসরের পর লেখালিখি করে সময় কাটান। ছোট গল্পের সাথে কবিতাও লেখেন। নিয়মিত গানবাজনার চর্চা করেন ও ছবিও আঁকেন।
আগেই পড়েছিলাম। আবার পড়লাম। খুবই ভাল লাগল।
পরিযায়ী স্রমিকের দুর্দশার কথা পরিস্কার ফুটে উঠেছ। এ
বেশ ভালো লাগল।
বাস্তবতার উপর ভিত্তি করে লেখা অনবদ্য গল্প।