লেখক: ইন্দ্রনীল মজুমদার
আমরা উনবিংশ শতাব্দীর জার্মানির একটি ছোট শহরের এক ডাক্তারবাবুর চেম্বারে প্রবেশ করেছি। এই ডাক্তারবাবু জার্মানির বিখ্যাত গটিঙ্গেন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডাক্তারি অধ্যয়ন করে ১৮৬৬ সালে ডাক্তারি পাশ করেছিলেন। কিন্তু যতই পন্ডিত ডাক্তার হন না কেন, ডাক্তারবাবু যতই পরিশ্রম করুন না কেন তবুও তাঁর নামডাক তেমন ছিল না। সারাদিন অক্লান্ত পরিশ্রম করতেন কিন্তু উপার্জন করতেন বড়ই অল্প কেননা তাঁর কাছে পেশেন্ট তেমন আসত না। এসবের ফলেই তাঁর মনের মধ্যে এক নিরাশা ও হতাশা গ্রাস করে। তো, একদিন এই ডাক্তারবাবু নিরাশ মনে তাঁর চেম্বারে বসে আছেন। এমন সময় তাঁর স্ত্রী এসে বলে উঠলেন, “শুভ জন্মদিন রবার্ট, এই দেখো তোমার জন্যে কী এনেছি।”
ডাক্তারবাবু বিস্মিত হন। “আরে! আজ সত্যি তো আমার জন্মদিন। কিন্তু হায়! এমন দিনেও পেশেন্ট কই? আচ্ছা কী এনেছ দেখি।”
“এই দেখো, একটা মাইক্রোস্কোপ যাতে করে তুমি ছোট জিনিসকে বড়ো করে দেখতে পাবে।”
“উরিব্বাস! তাহলে দাও দেখি, সত্যিই খুবই কাজের জিনিস দিয়েছ, কী বলে যে তোমাকে….”
“থাক থাক। আর লজ্জা দিও না। দেখবে তোমার খুব উপকারে লাগবে এই মাইক্রোস্কোপ। এই নাও।”
তা সেদিন ছিল ১১ই ডিসেম্বর। আর সেবার এই মাইক্রোস্কোপ বা অণুবীক্ষণ যন্ত্রের মতো এই অভিনব উপহার পেয়ে খুব খুশি হয়েছিলেন ডা. রবার্ট কখ। হ্যাঁ, এই সেই স্বনামধন্য বিজ্ঞানী – জীবাণু সম্পর্কে গবেষণা করে যাঁরা বিশ্ববিখ্যাত হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম। একটু পরেই আমরা তাঁর বৈজ্ঞানিক কার্যকলাপ সম্পর্কে জানতে পারব। তা, ওই দিনেই জার্মানির কাউস্থাল শহরে ১৮৪৩ সালে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। চিকিৎসক হিসেবে তাঁর তেমন নামডাক না হলেও স্ত্রীর কাছে উপহার পাওয়া ওই মাইক্রোস্কোপ বা অণুবীক্ষণ যন্ত্রটি তাঁর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। চিকিৎসক থেকে তিনি হয়ে ওঠেন এক জীবাণুবিজ্ঞানী। কীভাবে? তিনি হাতের কাছে যা পান তাই ওই অণুবীক্ষণ যন্ত্রের লেন্সের তলায় ফেলে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে লাগলেন। আর সমস্ত কিছুকে এই বড়ো করে ভালোভাবে দেখা বা বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফলে তাঁর কৌতুহলও বাড়তে লাগল। এই পর্যবেক্ষণ করাই যেন তাঁর নেশা হয়ে গেল। এই নেশা বা কৌতূহল এমন এক জায়গায় পৌঁছল যে তিনি রোগী দেখা এমনকি নাওয়া-খাওয়াও ভুলে গেলেন। এদিকে মিসেস কখেরও মাথায় হাত। সর্বক্ষণই ভাবতে লাগলেন, “হায়রে! কী কুক্ষণেই যে মাইক্রোস্কোপটা উপহার হিসেবে দিয়েছিলাম।” কিন্তু হায়! তিনি কি তখন জানতেন যে এই অণুবীক্ষণ যন্ত্রই তাঁর স্বামীকে এক জগদ্বিখ্যাত জীবাণুবিজ্ঞানী থুড়ি জীবাণুবিদ্যার জনক করে তুলবে?
ডাক্তার কখের চেম্বারখানা বা রোগী দেখার ঘরটা বেশ বড়োই ছিল। তা তিনি করলেন কি ঘরটাকে দু’ভাগে ভাগ করলেন। এক ভাগে চলল রোগী দেখা তো অন্য ভাগে চলল পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার কাজ অর্থাৎ এই দ্বিতীয় ভাগটি হয়ে উঠল এক ল্যাবরেটরি বা গবেষণাগার। আর সে গবেষণাগারের প্রাণ কী ছিল? জন্মদিনে পাওয়া সেই অণুবীক্ষণ যন্ত্রটি।
সে সময় হঠাৎ শুরু হল অ্যানথ্রাক্স রোগের দাপট। এই রোগে আক্রান্ত হয়ে অনেক গৃহপালিত পশু মারা যেতে লাগল। এই রোগের কারণ সম্পর্কে কেউ জানত না আর তাই চিকিৎসাও দূর অস্ত ছিল। ডাক্তার কখ ঠিক করলেন যে তিনি অ্যানথ্রাক্স রোগের কারণ নির্ণয় করবেন। আর এই অ্যানথ্রাক্স রোগের কারণ নির্ণয় থেকে শুরু হলো তাঁর বিজ্ঞান গবেষণার জয়যাত্রা।
রবার্ট কখ অ্যানথ্রাক্স রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত একটি ভেড়ার দেহ থেকে রক্ত নিলেন এবং অণুবীক্ষণ যন্ত্রের তলায় তা রেখে পরীক্ষা করে দেখতে পেলেন যে সেই রক্তে সরু দন্ডাকৃতি অসংখ্য জীবাণু গিজ্গিজ্ করছে। তিনি সুস্থ ভেড়ার দেহ থেকে রক্ত নিয়ে দেখলেন যে সেই রক্তে এ ধরনের কোনো জীবাণু নেই। এসব দেখে ডাক্তার কখ মনে করলেন যে ওই দন্ডাকৃতির জীবাণুগুলোই নির্ঘাত অ্যানথ্রাক্স রোগ ঘটায়। তিনি এ কথা ভেবে আরেকটা পরীক্ষা করলেন। তা হলো, তিনি একটি সূচ নিয়ে তা ফুটন্ত জলে ফেলে জীবাণুমুক্ত করলেন। এবার তিনি সেটি অ্যানথ্রাক্স রোগে মৃত একটি ভেড়ার রক্তে ডোবালেন। তারপর সেই সূচটি ফুটিয়ে দিলেন একটি জ্যান্ত ইঁদুরের দেহে। দিন কয়েকের মধ্যেই দেখা গেল সেই ইঁদুরটি অ্যানথ্রাক্স রোগে আক্রান্ত হল এবং মারাও গেল। হায়! কিন্তু হায় বললে কী হবে? এই ইঁদুরের মৃত্যু থেকে একটা সুখবর বেরিয়ে এলো আর তা হলো কখের অ্যানথ্রাক্স রোগের কারণ সম্পর্কে পরীক্ষা-নিরীক্ষার সফলতা লাভ। রবার্ট কখ নিশ্চিত হলেন যে, দন্ডের আকৃতিযুক্ত জীবাণুগুলি এই মারাত্মক অ্যানথ্রাক্স রোগ ঘটায়।
তিনি এই অ্যানথ্রাক্স রোগ নিয়ে আরও অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালালেন। সেই পরীক্ষায় তিনি দেখলেন যে, অ্যানথ্রাক্স রোগ ঘটায় যেসব দন্ডাকৃতি জীবাণুগুলি সেগুলিকে যদি খোলা বাতাসে কিছুক্ষণ রেখে দেওয়া যায় তবে তাদের কার্যক্ষমতা কমে যাবে। এসব বিবেচনা করে কখ দেশের সমস্ত পশুপালকদের বললেন, “আপনারা অ্যানথ্রাক্স রোগে মরে যাওয়া পশুগুলিকে পুড়িয়ে ফেলুন। তাহলে এইসব জীবাণুরা ধ্বংস হয়ে যাবে আর কোনো রোগ সংক্রমণের ভয় থাকবে না।” এতে দারুণ ফল পাওয়া গিয়েছিল। এখানে মনে রাখা দরকার যে, কখ জীবাণুর বংশবিস্তার ও রঞ্জনকরণ (বা Staining)-এর নতুন পদ্ধতির উদ্ভাবকও বটে। তিনি অ্যানথ্রাক্স রোগের জন্য দায়ী জীবাণুর গঠন কেমন ও এদের বংশবিস্তার কীভাবে ঘটে, সে সম্পর্কে গবেষণা করে এই জীবাণুর নতুন একটি উপপ্রজাতি আবিষ্কার করেছিলেন ১৮৭৬ সালে। এর বছর দুয়েক পর অর্থাৎ ১৮৭৮ সালে, তিনি ক্ষতস্থানের সংক্রমনের সাথে রোগ-জীবাণুর কীরকম সম্পর্ক তা আবিষ্কার করেন। এছাড়াও তাঁর অসামান্য দুটি উল্লেখযোগ্য কাজ হলো যক্ষ্মা ও কলেরা রোগের জীবাণু আবিষ্কার করা। সে প্রসঙ্গে এবার আসা যাক।
তখনকার দিনে যক্ষ্মা রোগের কারণ নির্ণয় করা যায়নি। কখ অ্যানথ্রাক্স রোগের পাশাপাশি যক্ষ্মা রোগেরও কারণ অনুসন্ধান করতে শুরু করলেন। দীর্ঘ এগারো বছর চলল সেই অনুসন্ধানের কাজ। অবশেষে দেখলেন যে এক বিশেষ ধরনের জীবাণু এই যক্ষ্মা রোগের বিস্তার ঘটায়। রবার্ট কখ অণুবীক্ষণ যন্ত্রে যক্ষ্মা রোগের জীবাণুর আকৃতি ভালোভাবে দেখতে লাগলেন। শুধু কি দেখা? তিনি সেই জীবাণু অন্যান্য প্রাণীর দেহে প্রবেশ করালেন আর দেখলেন যে সেই প্রাণীগুলি যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হল আর মারাও গেল। এবার কখ বুঝলেন যে, শুধু মানবদেহে নয়, প্রাণীদেহেও যক্ষ্মা রোগের জীবাণু সংক্রমণ হতে পারে। এই জীবাণুগুলি সংক্রমিত হয় বায়ুর দ্বারা। তিনি যক্ষ্মা রোগের উপস্থিতি নির্ণয়কারী উপাদান ‘টিউবারকুলিন (tuberculin)’ আবিষ্কার করেছিলেন। এই টিউবারকুলিন যক্ষ্মা রোগের জীবাণু থেকেই তৈরি হয়। যক্ষ্মা রোগ নিয়ে তাঁর অসামান্য গবেষণার স্বীকৃতি হিসেবে যক্ষ্মা জীবাণু ‘কখ্স ব্যাসিলাস(Koch’s bacillus)’ নামে পরিচতি লাভ করে।
১৮৮১ সাল। মিশরে ব্যাপকভাবে কলেরা দেখা দিল। রোগীরা কলেরা রোগে আক্রান্ত হবার দশ বারো ঘণ্টার মধ্যেই মারা যেতে লাগল। এতে ইউরোপীয়রাও বেশ আতঙ্কিত হয়ে উঠল। কলেরা যদি ইউরোপে গ্রাস করে বসে তখন কী হবে? এই আতঙ্কের মাঝে কখের মতো বিজ্ঞানী চুপচাপ বসে থাকতে পারেন কি? তিনি এক সহকর্মী ও তাঁর প্রিয় অণুবীক্ষণ যন্ত্রটি নিয়ে জার্মানি থেকে পাড়ি দিলেন মিশরের উদ্দেশ্যে। পৌঁছলেন মিশরের আলেকজান্দ্রিয়া শহরে। রবার্ট কখ আশায় ছিলেন যে যদি কলেরার জীবাণু আবিষ্কার করা যায়। তাঁর সেই আশা পূর্ণ হলো। কলেরা রোগীর রক্ত পরীক্ষা করে তিনি দেখতে পেলেন সেই রক্তে কমা (,) আকৃতির এক নতুন ধরনের জীবাণুর দল। শুধু আকার আবিষ্কার করেই ক্ষান্ত রইলেন না। তিনি বার করলেন যে, এইসব কমা আকৃতির জীবাণুরা জলবাহিত হয়ে বা জলের মাধ্যমে মানুষের পেটে প্রবেশ করে আর কলেরা রোগের সংক্রমণ ঘটায়।
রবার্ট কখ বিভিন্ন রোগের জীবাণু আবিষ্কার তো করেই ছিলেন তার পাশাপাশি রক্ত থেকে জীবাণুকে কীভাবে আলাদা করা যায় সে সম্পর্কেও গবেষণা করেছিলেন এবং রক্ত থেকে জীবাণুকে আলাদা করার পদ্ধতি নির্ণয়ও করেছিলেন। এর সাথে, তিনি জীবাণু বংশ বিস্তার কীভাবে করে তার উপায়ও বার করেছিলেন। তাঁর এই সমস্ত কাজের জন্যে রবার্ট কখকে ‘জীবাণুবিদ্যার জনক (Father of Bacteriology)’ বলা হয়। কলেরার জীবাণু আবিষ্কার করার পাশাপাশি তিনি পানীয় জল, খাবার ও কাপড়ের মাধ্যমে কীভাবে কলেরা রোগ বিস্তার করে সে সম্পর্কে গবেষণার জন্যে ১৮৯১ সালে জার্মানির রাজধানী বার্লিন শহরে সংক্রামক ব্যাধি ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করে তার পরিচালকের পদে অধিষ্ঠিত হন।
বিজ্ঞানী কখ অদৃশ্য জীবাণু জগতের নানান অজানা কথা জানিয়েছিলেন। মানুষ তথা প্রাণীজগতের এইসব অদৃশ্য শত্রুদের ধ্বংস করার উপায়ও নির্ধারণ করেছিলেন। তাঁর গবেষণায় পাওয়া এইসব তথ্য জানার ফলে মারাত্মক সব ব্যাধির হাত থেকে মানুষ তথা জীবজগৎকে বাঁচানো গিয়েছে।
১৮৯৭ সালে তিনি ‘ফেলো অফ রয়েল সোসাইটি’ বা ‘এফ.আর.এস.’ নির্বাচিত হন। চিকিৎসাবিদ্যায় বিশেষ অবদানের জন্যে তিনি ১৯০৫ সালে চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। ১৯১০ সালের ২৭শে মে ৬৬ বছর বয়সে রবার্ট কখ আমাদের ছেড়ে চলে যান। সকলের জন্য খুলে যান জীবাণুবিদ্যার এক অজানা জগতের দ্বার।
তাঁর দেহত্যাগের ১১০ বছর পেরিয়ে গেছে। আমরা সেই চিকিৎসক হিসেবে নিরাশাগ্রস্ত কখকে মনে রেখেছি কি? আসলে সাফল্যকেই সবাই মনে রাখে। তাই নিরাশা, বিষণ্নতাকে দূরে করে, সফলতার পথ খুঁজতে হয় জীবনে। রাবার্ট কখ যা খুঁজে পেয়েছিলেন। আর তাই আমরা রবার্ট কখকে ডাক্তার হিসেবে নয় মনে রেখেছি ‘জীবাণুবিদ্যার জনক’ হিসেবে। আর বিজ্ঞান জগতে তিনি অধিষ্ঠিত হয়ে আছেন বিশ্বের অন্যতম ‘শ্রেষ্ঠ জীবাণুবিদ’ হিসেবে আর থাকবেনও। কেননা জীবাণু, ভাইরাস – এইসব অদেখা, অচেনা জগতের বাসিন্দাদের সাথে মানুষের সংঘাত যে লেগেই ছিল, রয়েছে আর থাকবেও।
তথ্যসূত্র:
দেশ বিদেশের বিজ্ঞানী-অমরনাথ রায়, আনন্দ পাবলিশার্স।
ছোটদের বিজ্ঞানকোষ(প্রথম খণ্ড), বাংলাদেশ শিশু একাডেমী।
লেখকের কথা: ইন্দ্রনীল মজুমদার
বিজ্ঞানে স্নাতকত্তোর ও বিজ্ঞান লেখক। বিজ্ঞানকে জনপ্রিয় করতেই মূলত তাঁর লেখালিখি।