লকডাউন বা একটি রূপান্তরের কাহিনী

লেখক: শুভ্র মৈত্র

তিনমাস আগে যেদিন প্রথম লকডাউন ঘোষণা হলো, মীনাকে সেদিনই আসতে বারণ করে দিয়েছিলেন বঙ্কুবাবু। গিন্নীর খিটখিট একটু ছিল বটে, কিন্তু বঙ্কুবাবু জানেন, ভয় তো বড় মলম, গিন্নীদের সব অনুযোগের ব্যথা তাতেই সেরে যায়। সংসারের প্রতি দায়িত্বশীল বঙ্কুবাবু খারাপ ছিলেন না। পড়ে পাওয়া ছুটির মাঝে পুলিসের চোখ ফাঁকি দিয়ে নানান স্বাচ্ছন্দ্যের ব্যবস্থা করে বাড়ির লোককে চমকে দেওয়ার মধ্যে একটা অ্যাডভেঞ্চার ছিল। যা কিছু সমস্যা, তা ছিল ওই বন্ধ অফ শপটা নিয়েই। নেশায় কেন হাত বাপু? বন্ধুদের কতজনকে যে বঙ্কুবাবু রাজ্যের বেহাল অর্থনীতি আর আবগারি দপ্তরের আয় নিয়ে লেকচার দিয়েছেন!

আমেরিকা, ইতালী, স্পেন এমনকি দেশের কলকাতা, মুম্বাই, দিল্লীও ছিল অনেক দূরে। তাই ভালোই ছিলেন বঙ্কুবাবু। মানুষের সচেতনতার অভাব দেখে খানিক শৌখিন আফশোস করে মন্দ কাটছিল না বঙ্কুবাবুর দিন। না, মীনাকে আর কাজে ডাকেননি। তা বলে টাকাও কাটেননি ওর। যতজন জানতো মীনা বঙ্কুবাবুর বাড়িতে কাজ করে, তার চেয়ে ঢের বেশী লোক জেনেছিল, বঙ্কুবাবু ওর টাকা কাটেননি। বঙ্কুবাবু মানবিক বটে। নিজের জন্য খুঁজেছিলেন বিনোদনের নতুন উপসর্গ। পেয়েও গেলেন। কেন্দ্র বা রাজ্য সরকারকে খানিক গালিগালাজ করে আর ফেসবুক করেও যখন একঘেয়ে লাগছিল, তখন কুড়িয়ে নিলেন ভয়। এসো একটু ভয় ভয় খেলি। বেশ একটু নিরামিষ ভয়, যে ভয়টা পেয়ে খিদে ঘুম দুটোই ভালো হয়।

লকডাউন আরও বাড়লো। ভুরুটা কিঞ্চিৎ কুঁচকে ছিল বটে, তবে সেটাও তেমন মন্দ ছিল না, “সত্যিই তো মানুষের সচেতনতা না এলে আর কী…”। মানবিক বঙ্কুবাবু চাট্টি সমাজসেবাও সেরে ফেললেন এই অবসরে। কয়েক কেজি চাল, আলু, আর খানিক মুখোশ, স্যানিটাইজার বিলি করলেন ক্যামেরার সামনে। ছবিগুলি সোশ্যাল মিডিয়ায় দেওয়ার পরে ঠিক কতগুলো ‘লাইক’ আর ‘কমেন্ট’ জমা পড়লো, মাঝে মাঝে থলি খুলে দেখে নিলেন তা। মীনাকে ডাকেননি। অবশ্য টাকাটা দিয়েছিলেন। আগের মাসে ওর চোখে একটা ভয় দেখেছিলেন বঙ্কুবাবু, উকিলবাবুর বাড়ি থেকে বলে দিয়েছে, আর আসতে হবে না, টাকাও দেয় নি। ইশ্, এরা মানুষ!

লকডাউন বেড়ে গেল, নইলে উপায়ই বা কী! মাসখানেকের অভ্যাসে পোক্ত হওয়া দিবানিদ্রা শেষে বঙ্কুবাবু বিকেলের আকাশ দেখেন। কী নির্মল ! কত পাখি আসে ছাদে। বঙ্কুবাবু গম খেতে দেন নিয়ম করে, বাজার থেকে নিয়ে এসেছেন। বিনোদনের মাধ্যম পাল্টায় বঙ্কুবাবুর। মানুষের ‘অকারণ’ বাইরে বেরনোর প্রবণতার প্রতি সবিশেষ হতাশা আর ট্রেন থেকে নেমে ‘পরিযায়ী’দের মিশে যাওয়ার ভয় নিয়ে দুশ্চিন্তা — বঙ্কুবাবু বেশ কোয়ালিটি জীবন কাটাচ্ছিলেন। মোটে তো তিনজনের সংসার, বাসন আর কতটুকু। মাঝে মাঝে বৌ-মেয়ের সাথে নিজে হাত লাগান। তাই মীনাকে আর ডাকেন নি, এলে অবশ্য টাকাটা দিয়ে দেবেন ঠিক করেছেন। ওরা যা আনহাইজিনিক!

এর মধ্যে গ্রাম থেকে খবর আসতে শুরু করেছে, মানিকচকে একজন, রতুয়ায় দুই…। অনেক দূরে, কলকাতা বা দিল্লীর থেকেও দূরে। তাই বিনোদনে ঘাটতি পড়েনি, “হবে না, ‘ওরা’ ঢুকে পড়ছে, কোনও টেস্ট করছে না! শালা রোগ ছড়িয়ে দিল। ভোটের জন্য আবার কিছু বলাও যাবে না, এই দেশের ভবিষ্যৎ যে কী!”, লেবুর সরবতে চুমুক দিয়ে ভাবেন বঙ্কুবাবু। লেবুতে ভিটামিন সি, এ সময় খাওয়া ভালো। ছন্দ পতন হলো শহরে ভাইরাস ঢুকে পড়ায়। ওই বালুচরে একজন ‘ধরা পড়ার’ খবর শুনেই মনটায় কেমন খিঁচ ধরলো। যদিও বালুচর, বাড়ি থেকে বেশ দূরে, বঙ্কুবাবুর শেষ ওইদিকটায় যাওয়া লকডাউনের আগে মর্নিং ওয়াকে, তবু…। আচ্ছা লোকটি কি তখনও ছিল? মানে তখনও কি ভাইরাসটা ছিল? আরেকবার হাতটা সাবান জলে ধুয়ে স্যানিটাইজার ঘষলেন বঙ্কুবাবু। এখন বিনোদনের নতুন মোড়ক “দোষী” লোকটির পরিচয় খোঁজা — নিশ্চয়ই বাইরে থেকে ঢুকেছে, চেপে রেখেছিল। এদেরকে জেলে পোরা উচিত। এর মধ্যে তো খুলেও গেছে অনেক কিছু। “এটা একটা লকডাউন হলো? কেউ কিছু মানছেই না! মানুষ যদি নিজে সচেতন না হয়…” বঙ্কুবাবু চার প্যাকেট ক্রীম বিস্কুট গুছিয়ে নিলেন। এখন ফ্ল্যাটে বাইরের লোক ঢোকা বারণ। ঠিকই তো, সবাই তো আর হাইজিন মেন্টেইন করে না! মীনা এসে খবর দিয়েছিল, ইন্টারকমে ডাক শুনেও বঙ্কুবাবু সিরিয়ালের এই এপিসোডটা শেষ করেই নেমেছিলেন নীচে। মীনাকে টাকাটা দিলেন, উনি তো আর অমানুষ নন! কিন্তু অতক্ষণ অপেক্ষাতেই ভয় পেয়েছিল মীনা, ওর চোখে ভয় দেখেছিলেন বঙ্কুবাবু। আরও একটা বাড়ি থেকে বারণ করেছে যেতে।

লোকটির সঠিক পরিচয় শেষমেশ পাওয়া গেছিল কিনা বা কোথা থেকে নিয়ে এল এই ভাইরাস সেসব ভালো করে জানার আগেই, মানে সপ্তাহ ঘুরতে না ঘুরতেই এ পাড়া সে পাড়া –খবর আসতে লাগলো এখানে, ওখানেও। এই মহিলার খোঁজখবর ভালো করে নেবার আগেই পাশের পাড়ার আরেকজন। “আরে বাজারের রকমারি স্টোর্স এর মালিকের মা…ইশ্ লোকটাকে সেদিনও দেখলাম! আর ওই যে ডাক্তার, সব সময় মাস্ক লাগিয়ে যান, ওরও?” মাথায় একজনের খবর ঠিকঠাক ঢোকার আগেই, আরেকজন, “সিঙ্গাতলার ওই বাড়িটায়…আরে কী বলবো, অজিতের ফ্ল্যাটেই তো। থার্ড ফ্লোরে একজনের…”। তাই? বঙ্কুবাবুর এবার সত্যিই নার্ভাস লাগে, “এই পাড়াতেও? কী বলছিস? কোন বাড়িটা?”

ফ্ল্যাটে ঢোকার মুখে সিকিউরিটি গার্ডের মুখ এতদিন ভালো করে খেয়াল করেননি বঙ্কুবাবু। আসলে ওদের ডিউটি পাল্টায়, মুখও। আজ যে আছে তাকে দেখলেন, কেমন শুকনো দেখাচ্ছে, ওরও কী…? ঘরে ঢুকে মাস্ক, গ্লাভসের ধড়াচুড়ো ছাড়ার ফাঁকেই শুনতে পেলেন, “জানো বাবা, সঞ্চিতার দিদির ধরা পড়েছে, এখুনি ফোন করেছিল”। উফফ, বঙ্কুবাবু আর শুনতে চান না… “বলছি ঠাকুরপোদের পাড়াতেও তো শুনলাম একজনের, তুমি তো আবার গেল সপ্তাহেই গেছিলে…” বঙ্কুবাবুর ভাইয়ের বাড়ি যাওয়া নিয়ে খোঁটা দিতে ছাড়ে না গিন্নী। মোবাইলটা পকেট থেকে বের করে টেবিলে রাখলেন। এখন তো ওটাকেও স্যানিটাইজ করতে হয়। ঠিক সে সময়েই ঝন্টুর নাম টা ভেসে উঠলো। ‘হ্যালো’ — শুনেছিস আমাদের বিকাশের পজিটিভ! –কেমন বিবশ হয়ে পড়েন বঙ্কুবাবু, কাল রাতেও বিকাশের সাথে কথা হলো, খুব খানিক গালমন্দ করেছিল গভমেন্ট এর পলিসি নিয়ে।

আজ অনেকক্ষণ ধরে সাবান ঘষে স্নান করছেন বঙ্কুবাবু। নাহ, পুঁইশাকের জন্য বাজারে অতোক্ষণ না দাঁড়ালেই হতো! বুড়িটা খুব স্লো, দিতে এতো দেরী করে! মুখে তো মাস্কও ছিল না। আর লোকজনও তেমন, সব ঘাড়ের ওপর এসে পড়ে! আরও জল ঢালছেন, আবার সাবান নিলেন হাতে, ঘষে ঘষে সব ভাইরাস ফেলে দেবেন বঙ্কুবাবু আজ। সাদা তোয়ালে দিয়ে মুছছেন মাথা, হাত। ঢোঁক গিলতে গিয়ে কি একটু ব্যথা লাগলো? এতক্ষণ ধরে স্নান করাটা বোধহয় ঠিক হলো না। হাত ছোঁয়ালেন গলায়। বাথরুমের আয়নাটার দিকে চোখ পড়লো বঙ্কুবাবুর। মুখটা অবিকল ঘামে ভেজা মীনার মতো লাগছে…।


ছবি: প্রণবশ্রী হাজরা


লেখকের কথা: শুভ্র মৈত্র
মালদার বাসিন্দা। শিক্ষকতা ও সাংবাদিকতার ফাঁকে সময় পেলে বইয়ে মুখ গোঁজা অভ্যেস। জীবনটা আক্ষরিক অর্থেই পেনফুল, কারণ সংগ্রহে অনেক কলম। সেগুলি সচল রাখার প্রয়াসের ফল এ পর্যন্ত দুটো বই – ‘পুরনো ডাকঘর ফুরনো রিফিল’ (২০১৭) আর ‘দুগ্গাকুড়ুনি এবং…’
(২০২০)।

24 Comments

  1. অজ্ঞাতনামা কেউ একজন

    করোনার বেশ কিছু নিবন্ধ,গবেষণা ধাঁচের সন্দর্ভ,রোম্য রচনা,রোজনামচা গোছের জ্ঞনগর্ভমূলক আত্মম্ভরি রচনা,অভয়বাণী বিতরণ করার সেমি সাহিত্য সৃজন প্রয়াস লক্ষ্য করেছি নানা ই-মাধ্যমে ও মুদ্রিত পত্রিকার ই-সংস্করণে।সব কিছু পড়ার মতো ছিল না বলে কেবল একচোখ দেখা,যাকে লক্ষ্য করাই বলা ভালো।শুভ্র মৈত্রর লেখাটি কিন্তু পড়েছি এবং ওর দেখানো দর্পণে অনেক পরিচিত বিশিষ্ট ও সাধারণ বন্ধুর মুখ দেখেছি।তার মধ্যে নিজের মুখও যে উঁকি দেয়নি তা হলফ করে বলতে পারব না।কারণ আমি তো আমারই সবচেয়ে অচেনাজন!!
    রতন চক্রব।

  2. অজ্ঞাতনামা কেউ একজন

    করোনার বেশ কিছু নিবন্ধ,গবেষণা ধাঁচের সন্দর্ভ,রোম্য রচনা,রোজনামচা গোছের জ্ঞনগর্ভমূলক আত্মম্ভরি রচনা,অভয়বাণী বিতরণ করার সেমি সাহিত্য সৃজন প্রয়াস লক্ষ্য করেছি নানা ই-মাধ্যমে ও মুদ্রিত পত্রিকার ই-সংস্করণে।সব কিছু পড়ার মতো ছিল না বলে কেবল একচোখ দেখা,যাকে লক্ষ্য করাই বলা ভালো।শুভ্র মৈত্রর লেখাটি কিন্তু পড়েছি এবং ওর দেখানো দর্পণে অনেক পরিচিত বিশিষ্ট ও সাধারণ বন্ধুর মুখ দেখেছি।তার মধ্যে নিজের মুখও যে উঁকি দেয়নি তা হলফ করে বলতে পারব না।কারণ আমি তো আমারই সবচেয়ে অচেনাজন!!
    রতন চক্রবর্তী।

  3. Krishna Chakraborty

    ঘরে ঘরে বঙ্কুবাবুরা উদারতা, সমাজসেবা, সাহসিকতা মিশ্রিত ভয় নিয়ে বিরাজ করছে এ ব্যাপারে সন্দেহ নেই। সন্দেহ শুধু ছেলেটা সবার পেটের কথাগুলো টের পায় কী করে ?

  4. Koushik Joardar

    শুভ্র মৈত্রের কলমের নিজস্ব সুর তৈরি হয়েছে, এখানেও সেটা পাওয়া গেল। লেখাটি আয়নার মতো, যার সামনে দাঁড়ালুম।

  5. উমাদাস ভট্টাচার্য

    ফাটাফাটি লেখা / ভয় পাচ্ছি সবাই/ গুটিয়েও যাচ্ছি কিন্তু শুভ্র মৈত্র কলমে তুলে রাখছে সত্যিটা / পরের সত্যি গল্পের জন্য অপেক্ষা…

  6. Aditya Mukherjee

    অ্যাভেঞ্চার থেকে ভয়। সত্যিই এখন কিন্তু ভয় পাচ্ছে সবাই। আর সেই সব কথাগুলোকে নিয়ে লিখতে পারে শুভ্র মৈত্রের কলম। আরও লেখা পড়ার অপেক্ষায় রইলাম…

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।

লেখা আহ্বান - বিস্তারিত জানতে ছবিতে ক্লিক করুন