লেখক: শান্তা মুখোপাধ্যায়
ফ্যাকাল্টি ইম্প্রুভমেন্ট প্রোগ্রামের ছুটিতে মর্ত্যে আসা ইস্তক হুতোম বাবুয়ানি বিন্দুমাত্র আর করেন না। নাগের বাজারের কাচে ভাড়া ফ্ল্যাটে আদ্যন্ত ডিসিপ্লিনড জেবন। অনন্ত বাক্য বিস্তারের সহায়তায় মর্ত্যের জ্ঞানলাভ করে চিত্রগুপ্তকে আপডেট দেওয়াই এখন জেবনের উদ্দেশ্য। সকাল সকাল মাইকের চিৎকারে ঘুম ভেঙে গেল। হুতোম বারেন্ডায় এসে দেকেন ফেলু রিস্কাওয়ালা একটা লম্বা লাঠির মাতায় একটা তেরঙা কাপড় দড়ি দিয়ে বাঁদছে। পাশের ফ্ল্যাটের মজুমদার বারেন্ডায় কফির কাপ নিয়ে হাঁকছেন, “ফেলু, ঠিক করে নটটা বেঁধেছিস তো? নইলে আবার….. গেলবার পতাকা তুলতে কি হিমসিম অবস্থা…. সুরেখাদি কিন্তু এরম হলে খুব রাগ করবেন।” ফেলু কি একটা বলল, শোনা গেল না। মজুমদার বললেন, “কি? কি বললি? শোনা যায় না…” ফেলুর চার বচরের ছেলেটা হাফ প্যান্ট আর ছেঁড়া গেঞ্জি পরে মাঝে মাঝেই স্যালুট ঠুকছেল, এবার কি মনে করে গাঁদার মালাটা পরে ফেলল। মজুমদার বারেন্ডা থেকে চিল চিৎকার জুড়ে দিলেন। ফেলুর নজর পড়তে ফেলু ধাঁই ধাঁই করে পিটিয়ে দিলে। বললে, “দিলে তো মালাটা নষ্ট করে? পুজোর মালা….” ফেলুর ছেলে কান্নার বেগটা একটু সামলাল। পুজো যকন, পেসাদ তো একটু পাবেই। তাই ফোঁপাতে ফোঁপাতে জিজ্ঞেস করল” কি পুজো? বাবা?” ফেলু গম্ভীর হয়ে উত্তর দিল, “পতাকা পুজো।”
পতাকা পুজো ব্যাপারটা হুতোমের মাতার উপর দিয়ে চলে গেল। কিন্তু কৌতূহল চেপে রাকা যাচ্চে না! অগত্যা অনন্ত বাক্য বিস্তারকে ফোন। ফোনে অনন্ত বলল, “ও হো, ফ্যালারাম পতাকা পুজো বলেচে বুজি? আজকাল আসলে খুব পুজো হচ্চে তো চাদ্দিকে, এই ধরুন গ্যে কুর্সিপুজো, সৃজনশীলতাপুজো, তাপ্পর ধরুন গ্যে….. আর ছাড়ান দ্যান। গোমাতাপুজো হনুমানপুজো তো জানেনই। ফ্যালারাম গুইল্যে ফেলেচে। আসলে স্বাধীনতা দিবস।” হুতোম বললেন, “রাজা তো নেই? তবে স্বাধীনতা কার থেকে?” অনন্ত হো হো করে হেসে বল্ল, “তাহলে এট্টু ঘুরাই আপনাকে। তবে বুজতে পারবেন স্বাধীনতার ব্যাপারটা…. আসচি। রেডি হয়ে থাকুন।”
হুতোম অপেক্ষা করতে থাগলেন। ইতোমধ্যে মজুমদার পাজামা পাঞ্জাবি শোভিত হয়ে নেবে এয়েচেন। মজুমদার গিন্নি লালপাড় সাদা শাড়ি। ফ্যাটের ছোটরা সাদা পোশাকে ডাঁইরে গেল। অন্যরাও একজন দুজন করে নাবছেন। এমন সময় খবর এল আসচেন, তিনি আসচেন। মজুমদার মালা নিয়ে গেটের মুখে ডাঁইরে রইলেন, গিন্নি চন্দনের বাটি ভুলেচেন বলে আবার উপরে ছুটলেন। বলতে বলতে এসে গেলেন। সুরেখাদি। মজুমদার মালা পরিয়ে দিলেন। দিদি বললেন, “না, না, আজ আমায় মালা পরাবেন কেন? আজ স্বাধীনতা দিবস!” দিদি পতাকা উত্তোলন করতে যাচ্ছেন, চন্দনের বাটি এসে পৌঁচায়নি। দিদি দড়ি ধরে টানলেন, পতাকা ওটে না, আবার টানেন, দড়ি জড়িয়ে যায়, বাবু ঘামেন, বিবি নামেন, আগু পিছু না দেখে টপাস করে টিপ পরিয়ে দেন। দিদি ভ্রূ কুঞ্চিত করেন। তারপর ওনার সর্ব কর্ম সহায়ক হাতকাটা খগেনকে ডাকেন। দড়ি যা জড়িয়েছে…. খগেনও ছাড়াতে পারে না। বরং দিদিকে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করে মজুমদারের পিতৃনামটি নিজের নামে নামাঙ্কিত করবে কি না। দিদি চোখের আগুনে শাসন করেন। মজুমদার এবার মরিয়া হয়ে বলেন, “এই শালা ফেলুর জন্য…. কিচ্ছু জানে না, একটা পতাকা তোলার দড়ি বাঁধার কায়দাও জানে না।” মনে মনে বলেন, “পাই একবার শালাকে… বাপের নাম খগেন করে ছাড়ব।” বাবুর খেয়াল থাগে না, উনিও জানেন না। কিন্তু পতাকা তো না ওটালে চলবে না। মজুমদার মই আনালেন। মইয়ে উটে নিচো থেকে পতাকা হাতে করে তুললেন। খুললেন, পুষ্প বৃষ্টি হল। গিন্নি শাঁক বাজালেন। সুরেখাদি অনুপ্রাণিত ভাষণ দিলেন। সেই ভাষণ অনু অনু হয়ে ঘাসে ঘাসে ফুলে ফুলে প্রাণ ঢেলে দিল! বাচ্ছারা গাইল “সা রে জাহাঁ সে আচ্ছা.… ” মজুমদার পতাকা ধরে ডাঁইরে রইলেন। সব শেষে মজুমদার পতাকাকে বাঁশের সঙ্গে আষ্টে পৃষ্টে বেঁদে তার পতন উন্মুখতা আটকে নিচোয় নাবলেন। দিদি চাপা গলায় মজুমদারকে বললেন, “আপনার লজ্জার বাক্সটা পুরোটাই ব্যাংকে মর্টগেজ আছে বোধহয়, আগামী বছর ছাড়িয়ে এনে স্বাধীনতা দিবস পালন করবেন।” দিদির গাড়ি পরবর্তী উত্তোলনের গুরুভার বহনে নির্গত হল। বাবু ফ্যালারামের খোঁজে হম্বি তম্বি চালাতে লাগলেন, ফেলুকে কোথাও পাওয়া গেল না।
ইতোমধ্যে অনন্ত এসে গেচে। হুতোম বেরোলেন। মেট্রোয় সকালটা স্বাধীনতা দিবসের ছুটি। অনন্ত এটা ওটা করে শ্যামবাজার এসে সহুতোম ট্রামে চাপল। পথে মিছিল। গান হচ্চে। গান্ধী, সুভাষ, নেহেরু হেঁটে যাচ্চেন। হুতোম বললেন, “তোমাদের স্বাধীনতা দিবসে সং বেরোয় বুজি? আমাদেরও বেরোত। দুগগাপুজোয়। জেলেপাড়ার সং।” অনন্ত বলল, “এই, না না! এটা তো প্রভাতফেরী! আর সং না! এঁরা তো মহাপুরুষ! কাপুরষতা নাশে মডেল হয়ে ঘুর্চেন।” হুতোম বোজেন মডেল জরুরী মডেলায়ন যাই হোক না কেন!
কলেজ স্ট্রিট এলে অনন্ত নাবে। ফুটপাথে ছোট্ট তিনফুট জায়গায়ও পতাকা পতপত করে উড়ছে। গান বাজচে। গমগমে ব্যাপার! অনন্ত হাঁটে। মেট্রো স্টেশনের দিকে। বাজার পেরিয়ে, গোস্তের দোকান পেরিয়ে টেলারিং এর দোকান পেরিয়ে আরো আগে। ভ্যাটে ময়লা উপচে পড়চে। গন্ধে টেঁকা দায়। রাস্তার উপরেই রহমত সাবান জল দিয়ে সাইকেল পোষ্কার করচে। রাস্তা জলে থই থই। রাস্তার বাঁ ধারে প্লাস্টিকের ঝুপড়িতে প্লাস্টিকের ঝাঁপ উঠেচে। উন্মুক্ত হয়ে পড়েচে চারফুট বাই সাড়ে ছ’ফুটের তক্তায় সাজানো হাঁড়িকুরি, পাটকরা দুচারটে জামাকাপড়ের গেরস্থালী। উনুন ধরেচে। জলকাদার মধ্যেই রাস্তায় বসে আটা মাখা চলচে। ভ্যানে বসে গুলতানি করচে বাচ্চারা, কমবয়েসী মেয়েরা। বুড়োরা একটু ছায়ার ধার খুঁজে ঝিমাচ্চে। হুতোম রাগতভাবে অনন্তর দিকে তাকালেন। বললেন, “ছিঃ এভাবে মানুষ থাকতে পারে!” অনন্ত বল্ল, “একটু ভুল কর্চেন দাদা, মানুষ মানুষ সবাই কহয়ে কেহই মানুষ নয়, ভাবিয়া গণিয়া বুঝিয়া দেখিলে সকলই ভোটার হয়! মানুষ আর ভোটার এক হল?” হুতোমের বাক্যি হরে গেল।
কালো ছোট গাড়ি, হুতোম জানেন ওগুলো অটো। অটোগুলো বাঁ বাঁ করে ছুটছে। মোড়ের মাথায় কাটা ফল, লস্যি, পুরোনো চশমা, স্বপ্নাদ্য মাদুলি, ধারণের পাথরের পসরা সাজাচ্চে। সাবেকুন বেওয়া পুরোনো চশমা একটা একটা করে পরে দেখছে কোনটা তার দৃষ্টি স্বচ্ছ করে তুলছে। ঠ্যালাওয়ালা লখন কপালের পাথর সরানোর জন্য উপযুক্ত পাথর খুঁজছে ফুটপাথে বসে। মেট্রো স্টেশনের বন্ধ দরজার সামনে উড়চে সেই তেরঙা নিশান। হুতোম জেনেচেন ওটি লালমুখো সায়েবদের তাড়িয়ে ভারত অর্জন করেচে। অনন্ত বল্ল, “তাইলে বুজলেন তো স্বাধীনতা দিবস?” হুতোম বললেন, “পতাকা ওড়াতেই হবে বুজতে পারচি। কিন্তু কে কার অধীন যে স্বাধীনতা পুজো?” বলতে বলতে অটো এসে দাঁড়াল, মাইকে ঘোষণা হতে লাগল, “ভাইয়োঁ আজ স্বতন্ত্রতা দিবস কা পুণ্য অওসর পর হাম আপলোগোঁ কো হার্দিক শুভকামনায়েঁ আদা করতে হুয়ে আচ্ছে দিনোঁ কা সপ্নামে সাথ দিলানে কা বাধাই দে রহা হুঁ। ঝান্ডা উঁচা রহে হামারা….” অটো থেকে ছটাকা দামের কেক বিলি হওয়া শুরু হয়। বাচ্চা কাচ্চা বুড়োরা হুড়োহুড়ি শুরু করল। একটা কেক রাস্তার পাশে দাঁড়ানো চটজড়ানো ময়লা মানুষকে দিতে যেতেই সে চিৎকার করে উঠল, “ম্যায় মেহেদি হাসান হুঁ। তিনবার ফাঁসি গেছি, জানিস? ক্যায়সা ফাইট কিয়া থা আংরেজোঁ কে সাথ! ডিস্ক্যাও, ডিস্ক্যাও! বট বট বট…. এমনি এমনি স্বাধীনতা এসেচে?…. শালা! আমায় কেক দিতে আসিস!…. আজ স্বতন্ত্রতা দিবস হ্যায়! সব সমান হ্যায়। তফাত যাও সারে বুড়বক কাঁহিকা!….” পুলিশ লাঠি ঠুকতে ঠুকতে চেঁচাতে থাকে, “লাইন, লাইন।” রহমতের ছোটছেলেটা কেকের গাড়ির দিকে যেতেই রহমত চ্যাঁচাল, “খবরদার! মত লো উও কেক! জিন্দগীমে বিভেদকা জহর ডালকে আয়া মেঠাই দেনে কে লিয়ে!” বাচ্ছাটা থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। অটোর পিছনে আঁটা সহস্রদল ফুলের ছবি হাওয়ায় নড়তে লাগল।
হুতোম অথৈ জলে পড়ার মত অসহায়ভাবে অনন্তর দিকে তাকালেন। অনন্ত একটা সবজান্তা হাসি হেসে বল্ল, “এবার বুজলেন তো, স্বাধীনতা দিবস ব্যাপারটা?” হুতোমের চোখে সাড়া না পেয়ে বলে, “আরে, পাগলটা বলল না? সব সমান হ্যায়্য! এই দেখুন, সাবেকুন বেওয়া যখন কোনও আমীর উজিরের ফেলে দেওয়া চশমা পরছে, তখন আমির উজিরের যে দৃষ্টি সেই দৃষ্টিই তো পাচ্ছে, না কি? হুঁ হুঁ বাওয়া! সমদৃষ্টি! চশমাটা সে নামমাত্র পয়সায় অধিকার করতেও পারছে তো! এটাই স্বাধীনতা দিবসের মূলকথা!” হুতোম সাহস করে আর জিজ্ঞেস করতে পারেন না কে কার অধীন ব্যাপারটা।
হুতোম বুজতে পারেন কে কার অধীন ব্যাপারটা বোজা খুব সোজা নয়। সেই রূপকথার গল্পে রাক্ষসের প্রাণ ভোমরা যেমন লোহার বাক্সের মধ্যে পিতলের বাক্সে, পিতলের বাক্সের মধ্যে তামার বাক্সে, তামার বাক্সের মধ্যে রুপোর বাক্সে, রুপোর বাক্সের মধ্যে সোনার বাক্সে, সোনার বাক্সের মধ্যে হীরের বাক্সে থাকে, তাকে বার করা সহজ নয়, এও তেমনি। অনন্তকে বলতে বলল, “হাঃ হা, ফ্র্যাকটাল স্ট্রাকচার।” হুতোম হাঁ হয়ে গেলে বলল, “মানে একই স্ট্রাকচার, স্কেল অনুযায়ী আর ডিটেলে যান, গঠন একই থাকবে। ফ্যালারাম মজুমদারের অধীন, মজুমদার সুরেখাদির, সুরেখসদি অমিয়বাবুর, অমিয়বাবু……” হুতম বললেন, “বুইচি। ঐ পাতর কুঁদে বানানো হাতির ভেতর হাতি, তার ভেতর হাতি, তার ভেতর হাতির মতন।” অনন্ত বল্ল, “জিও কাক্কা!” হুতোম বললেন, “কিন্তু স্বাধীন কে?” অনন্ত বল্ল, “এঃ এটা কেউ জিজ্ঞেস করে? সবাই স্বাধীন। কবি তো বলেই গেছেন, ‘স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায় রে কে বাঁচিতে চায়?'”
ছবি: পাভেল পাল
লেখকের কথা: শান্তা মুখোপাধ্যায়
জন্ম হুগলী শহরে। সেখানেই পড়াশোনা। পরে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অফ সায়েন্সে গবেষণা। বিষয় রসায়ন। গবেষনার সূত্রে ইতালি ও জাপান যাওয়ার সুযোগ হয়। পেশা অধ্যাপনা। দুটি ছোটগল্প সংকলন, “সই” ও “আবর্ত”, একটি উপন্যাস “অবিনশ্বর” ও একটি কাব্যগ্রন্থ, “কিছু কথা হয়ত বা কবিতা” প্রকাশিত। সাময়িক পত্র পত্রিকায় এবং আনন্দবাজার রবিবাসরীয়তে লেখা প্রকাশিত। নেশা বই পড়া আর মনে মনে স্বপ্ন বোনা।
হুতোম চশমা আর মেহেদি হাসান।অসামান্য লেখা।শ্লেষের আড়ালে বাস্তবতার চপেটাঘাত
‘হুতোম চশমা আর মেহেদি হাসান ‘ গল্পটা পড়ে খুব ভালো লাগলো..
খুব মজা পেলাম….👌👌