লেখক: কাবেরী তালুকদার
আমার নাম স্বাধীনতা। দেশ আমার ভারতবর্ষ। আমার বয়স এখন চুয়াত্তর। আমার date of birth fifteenth august, nineteen forty seven, at midnight। মানে রাত বারোটা। অবশ্য জন্ম লগ্ন থেকেই আমি জরাসন্ধ। অর্থাৎ দ্বিখন্ডিত। জন্মের সঙ্গে সঙ্গে আমার ভাগ্য নির্ধারিত করা হয়ে গিয়েছিল। আমাকে দুভাগ করে, একভাগ ফেলা হোল পূর্ব দিকে, অর্থাৎ পূর্ব বাংলা, আর একভাগ ফেলা হোল পশ্চিম দিকে, অর্থাৎ পশ্চিম বাংলা।
সদ্য শৃঙ্খল-মুক্ত হতভাগীনি মায়ের কথা কেউ ভাবলো না। তাঁর চোখের জল কেউ দেখতে পেলো না। তিনি দুই দিকের মধ্যকার কাঁটাতারের খুঁটিতে হেলান দিয়ে নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে নীরবে চোখের জল ফেলে চলেছেন। আর আমরাও দুই অংশ চিৎকার করে বলতে চাই কোন অপরাধে আমাদের বিচ্ছিন্ন করলে। দেখো, আমাদের দেশমাতৃকা কেমন বিষাদ প্রতিমার মতো অহোরাত্র অশ্রুপাত করে চলেছেন।
আমার জন্মেরও আগে এক দুরন্ত কিশোর, কবি সুকান্ত বাংলা মাকে দেখে লিখেছিলেন,
“ভারতী! তোমার লাবণ্য দেহ ঢাকে
রৌদ্র তোমায় পরায় সোনার হার,
সূর্য তোমার শুকায় সবুজ চুল
প্রেয়সী, তোমার কত না অহংকার।”
গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার লিখলেন ,“বিশ্ব কবির ‘সোনার বাংলা’, নজরুলের ‘বাংলাদেশ’, জীবনানন্দের ‘রূপসী বাংলা’
রূপের যে তার নেই কো শেষ, বাংলাদেশ।”
বিখ্যাত অসমিয়া গায়ক ভূপেন হাজারিকা গেয়ে উঠলেন,
“সবার হৃদয়ে রবীন্দ্রনাথ
চেতনাতে নজরুল
যতই আসুক বিঘ্ন-বিপদ
হাওয়া হোক্ প্রতিকূল
এক হাতে বাজে অগ্নিবীণা
কন্ঠে গীতাঞ্জলি
হাজার সূর্য চোখের তারায়
আমরা যে পথ চলি।”
আর রবীন্দ্রনাথ তো সবার আগে সু-উচ্চ কন্ঠে গেয়ে উঠেছিলেন “আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি….” এত সুন্দর মায়ের স্তব, দেশমাতৃকার বন্দনা, তবু মায়ের ভ্রু কুঞ্চিত। রাগে দুঃখে আরক্ত মুখ।
আমি স্বাধীনতা। আমাতে আজ মুখ লুকিয়েছেন মায়ের বীর সন্তাদের আত্মারা। বাঘাযতীন, মাতঙ্গিণী হাজরা, ক্ষুদিরাম, প্রফুল্ল চাকী, বিনয় বাদল দীনেশ, মাষ্টারদা এই সব বীরেদের আত্মা। লজ্জায়, ঘৃণায়, কুন্ঠায় তাঁদের আত্মারা হতবাক। এই দেশ কি তাঁদের সেই সোনার বাংলা! স্বাধীন ভারতবর্ষের কদর্য রূপ তাঁদের কলুষিত করেছে। ভারত মাতা ক্রোধান্বিত হয়ে উঠেছেন। শত সহস্র প্রান বলিদানের এই পুরস্কার। নির্ভয়া হত্যাকান্ড, কামদুনি হত্যাকান্ড, নারীর চূড়ান্ত অসম্মান। শিশুহত্যা, শিশুরা সব শ্রমিক, শিক্ষার কোন ব্যাবস্থা নেই, শিক্ষার অপব্যবহার। ছাত্রদের উপর অত্যাচার, বিশৃঙ্খলা। এখন দেশমাতৃকার বুকের উপর চলছে হানাহানি, রক্তপাত, অন্যায় অবিচার। লোভ পরশ্রীকাতরতা নিষ্ঠুরতা শুষ্ক করে দিয়েছে মায়ের চোখ। সেই চোখে এখন জ্বলছে আগুন। যে সন্তানদের ফাঁসিতে মৃত্যুতেও মায়ের বুক ভরে উঠতো গর্বে, এখন তাঁদেরই বিদেহী আত্মাকে মা প্রশ্ন করতে চান, এই স্বাধীনতার জন্যেই কি তোরা, জীবন মৃত্যু পায়ের ভৃত্য করেছিলিস? মুখ লুকিয়ে ফেলে অদৃশ্য আত্মারা। দেশে যুবকদের কাজ নেই, শিশুদের শিক্ষা নেই, পুষ্টি নেই, স্বাধীন ভারতে মানুষ না খেতে পেয়ে আত্মহত্যা করছে। দেশে কোন শিল্প নেই, শিক্ষার সু-ব্যবস্থা নেই, নারীর সম্ভ্রম নেই। শুধু নেই আর নেই। সাধারণ মানুষের বেঁচে থাকা দুর্বিষহ।
সেই বিদেহী আত্মারা চিৎকার করে বলতে চায়, না, বন্দেমাতরম নয়। বলতে চায় ইংরেজ ফিরে এসো। আমরাই আবার তুলে দেবো তোমাদের হাতে এই সাম্প্রদায়িক পুঁজিবাদী-নেতা-সর্বস্ব অনৈতিক স্বাধীনতাকে, আমাদের দেশমাতৃকাকে। কারণ আমার স্বদেশবাসী স্বাধীনতার যোগ্য নয়। শুধু দয়া করে বলতে দিও, মা, তবুও আমরা তোমাকে ভালোবাসি!
ছবি: কুন্তল
লেখকের কথা: কাবেরী তালুকদার
আমার জন্ম কাচড়াপাড়ায়। ওটাই আমার দেশ। পড়াশোনা কল্যানী ইউনিভার্সিটি থেকে, এম. এ সোসিওলজিতে। ক্লাস এইটে প্রথম তারাশঙ্করের ডাকহরকরা ইংরেজীতে অনুবাদ। স্টেটসম্যান পত্রিকায় ছাপা হয়। তখন থেকেই লেখার চর্চা।