লেখক: ইচ্ছেমৃত্যু
‘কিরে গুইরাম বাড়িতে আছিস?’
প্রায় ভেঙ্গে পড়বার মত ঘরের ভাঙ্গা দরজা খুলে বাইরে আসে গুইরাম, হাত কচলাতে কচলাতে বলে, ‘আজ্ঞে বলেন কত্তা বাবু’…
‘এই যে এলাম তোদের খবর নিতে। কেমন আছিস বল’
‘ওই আছি বাবু, আপনাদের দয়ায় কেটে যাচ্ছে…’
‘কাজে গেছিলি? ফিরলি কখন?’
‘কাজ কোথায় বাবু? ঘরেই ছিলম, এ সময় তো মাঠের কাজ নাই… জন খাটতেও কেউ ডাকে না’
‘হ্যাঁ, এই সময়টাতে তোদের বড় অসুবিধে… তাই ভাবলাম দেখি একবার দেখা করে যাই… যদি তোদের কাজে লাগতে পারি…’
‘আজ্ঞে’, হাত কচলাতে থাকে গুইরাম… কি বলবে ভেবে পায় না।
‘আচ্ছা শোন, এই একশ টাকাটা রাখ’… বলে একশ টাকার একটা কড়কড়ে নোট বাড়িয়ে দেন গুইরামের দিকে। গুইরাম অবাক হয়, টাকাটা নেবে কি নেবে না ভেবে পায় না, আমতা আমতা করে বলে ‘বাবু… শোধ করব কি করে, আমাদের টেনেটুনে চলে যাবে এই কটা মাস… জনমজুরি যদি কিছু জোটে বরং… তাইলে উপগার হয়’
‘আরে ধর ধর, এ টাকা শোধ দিতে হবে না’।
লটারি মেলার মত ১০০ টাকা পেতে কার না ভাল লাগে, ইতস্তত করে হলেও গুইরাম হাত পেতে নেয় টাকাটা।
হঠাৎ মনে পড়েছে এরকম ভাবে আগন্তুক বাবুমশাইটি বলেন, ‘আর হ্যাঁ, শোন ভোট তো এসে গেল শুনেছিস। ভোটটা কিন্তু আমাদেরকেই দিস… তুই তো সব জানিস… কি আর বলব!’
এবার ব্যাপারটা পরিস্কার হল গুইরামের। হ্যাঁ, ভোট এসেছে… এই সময় এরকম কিছু উটকো লাভ হয় বটে… ভোটে এটুকুই লাভ তাদের। টাকা নেওয়ার পর যে ইতস্তততাটা ছিল সেটা একদম পরিস্কার হয়ে গেল – এ তো তাদের প্রায় হকের পাওনা – ভোট যে দেবে তার বদলে!
‘ও হ্যাঁ, শুনেছিস বোধ হয় এবার আমাদের সাথে বামেদের জোট – তাই হাত চিহ্ন কিন্তু থাকবে না… কাস্তে হাতুড়িতে ভোটটা দিস – ওদের দিলেই আমাদের দেওয়া হবে। ভুল করিস না যেন’।
‘আজ্ঞে বাবু, মনে থাকবে’
‘কি বলত?’
‘আজ্ঞে ওই ভোটটা কাস্তে হাতুড়িতে দেব’
‘বাহ এই তো… চলি কেমন… ভাল থাকিস’
বাবু চলে যেতেই মাথা গরম হয়ে যায় গুইরামের। একটা পার্টির থেকে রোজগারটা মাঠে মারা গেল। লালপার্টির টাকাটা তো পাওয়া যাবে না। এখন ওই ঘাসফুল যেটুকু দেবে। মনে মনে গজরাতে থাকে খুব। আশাতেও থাকে কবে ঘাসফুল পার্টির লোক আসে।
দিন দুয়েক পর প্রায় একই সময়ে আসেন আরেক বাবু। কথোপকথন প্রায় একই ধরনের হয় – তবে এবারের বাবু গুইরামকে ২০০ টাকা দিলেন। আর বলে গেলেন ‘ভোটের আগের দিন রাতে একটা বোতলও পাঠাবো বুঝলিরে গুইরাম। রাতে বেশ মোজ করে খেয়ে পরের দিন ভোটটা দিস। শোন বোতামটা কিন্তু ঘাসফুলের পাশেই টিপিস… একদম ভুল করিস না’
‘তা আর বলতে বাবু… একদম ভুল হবে না’।
এই বাবুটিও বিদায় নেয়। তিনশ টাকা হল এবার… পাঁচ বছর আগের তুলনায় একটু বেশি পেলেও বাজারদর সেই তুলনায় এত বেড়েছে যে খুশি হতে পারল না খুব একটা। মনে মনে গাল দিতে থাকল একটা পার্টি কমে যাওয়ায়। যাই হোক যা পাওয়া গেছে তাই লাভ।
দিন তিনেক পরের ব্যাপার, ভোট আর দুদিন পরেই… আবার এক বাবু এলেন। গুইরাম তো খুব অবাক। এই তিন নম্বর বাবুটা আবার কোথা থেকে জুটল – হাতে আর হাতুড়িতে কি ভাগ হয়ে গেল! যাই হোক মনে একটু খুশির ঝিলিক দিল – হোক্গে ওদের ভাগ, আমার তো উপরি জুটলেই হবে।
কথোপকথন প্রায় একই রকম – তাই বিস্তৃত বলার প্রয়োজন নেই। উপসংহার যা হল – এই বাবু ৫০০ টাকার একটা নোট হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন, ‘ভোটটা কিন্তু পদ্মফুলেই দিস। দেখেছিস তো তোদের জন্যে প্রধানমন্ত্রী কত কিছু করছে। এখানে মুখ্যমন্ত্রী আমাদের হলে আর দেখতে হবে না… ভুলিস না, পদ্মফুলের পাশের বোতামটা টিপিস। আমরা জিতে গেলে বিরিয়ানী খাওয়াবো তোদের সবাইকে’।
বিরিয়ানীটা কি বস্তু বুঝল না গুইরাম, তবে আগের বারগুলির মতই বলল, ‘হ্যাঁ বাবু, পদ্মফুলেই ভোটটা দেব’।
গুইরাম খুব খুশি। মোট ৮০০ টাকা। এ বছর ‘ধরন’-এর মরসুমটা বেশি খাটতে হবে না – একটু টেনে টুনে হিসেব করে চালালে একটা মাস নিশ্চিন্তে চলে যাবে। হ্যাঁ, ৮০০ টাকা গুইরামের কাছে অনেক টাকা। মন বেশ ফুরফুরে।
তারপর আসে সেই দিনটা। ভোটের দিন। সকাল থেকেই খুব চিন্তায় গুইরাম – ভোটটা কাকে দেবে! যে সবার আগে এসেছে তাকে? নাকি যে বেশি টাকা দিয়েছে তাকে? নাকি কাল রাতে যার পাঠানো মদটা খেয়ে বেশ মস্তিতে ঘুম হয়েছে তাকে? বেলা বাড়তে থাকে – আর গুইরামের চিন্তা। কার কাছে বিক্রি হবে? বৌয়ের সাথে আলোচনাও করে নেয় একটু – বৌয়ের মতে যে বেশি টাকা দিয়েছে তাকেই ভোটটা দেওয়া উচিত; সেই তো ‘ল্যায্য দাম’ দিয়েছে গুইরামকে। কথাটা বেশ মনে ধরে গুইরামের – তার ‘ল্যায্য দাম’। মোটামুটি মনস্থির করে বিকেলের দিকে ভোটটা দিতে যায়, বিভিন্ন পার্টির বাবুরা তাঁদের নিজ নিজ দলীয় বুথ অফিস থেকে গুইরামকে বললেন ভোটটা তাদের দিতে, সে হাসিমুখে মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল যে ভোটটা তাঁদের পার্টিকেই দেবে।
তারপর লম্বা লাইন পেরিয়ে ইভিএম মেশিনের সামনে দাঁড়ালো গুইরাম – আগে থেকে ভেবে রাখা চিহ্নটা খুঁজতে খুঁজতে তার মনে হল ‘আমার ল্যায্য দাম ৫০০ টাকা। আমার ল্যায্য দাম ৫০০ টাকা! মোটে ৫০০ টাকা?’ মাথাটা কেমন টলে উঠল গুইরামের – ‘মোটে ৫০০ টাকায় বিক্কিরি হয়ে যাব আমি?’ লজ্জায় মুখ দেখাবে কি করে? মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করে তার। কিন্তু বোতাম যে তাকে টিপটেই হবে…পালানোর উপায় নেই। হঠাৎ চোখে পড়ে ঢ্যাঁড়া কাটা চিহ্নটায় – মন বিদ্রোহ করে ওঠে – ‘হালার আমি কারেও ভোট দিমু না’, বলে নোটায় আঙুলের চাপ দেয়!
বুথ থেকে গুইরাম মাথা উঁচু করে, হাসি মুখে বেরোয় – সে বিক্রি হয়ে যায়নি।
(গল্পটি ২০১৬ বিধানসভা নির্বাচনের আগে লেখা)
লেখকের কথা: ইচ্ছেমৃত্যু
জন্ম বর্ধমানের বর্ধিষ্ণু গ্রামে। পেশায় নরম তারের কারিগর আর নেশায় – রীতিমত নেশাড়ু, কী যে নেই তাতে – টুকটাক পড়াশোনা, ইচ্ছে হলে লেখা – সে কবিতা, গল্প, রম্যরচনা, নিবন্ধ যা কিছু হতে পারে, ছবি তোলা, বাগান করা এবং ইত্যাদি। তবে সব পরিচয় এসে শেষ হয় সৃষ্টিতে – পাঠক যেভাবে চিনবেন চিনে নেবেন।
বাহ !!
ধন্যবাদ।
আপনার লেখার মাত্রা বরাবর আলাদা।কিন্তু খুব কম লেখেন।এটাই আক্ষেপ। বেশ ভালো।
ধন্যবাদ। আজকাল আর লেখাই হয় না, সব দোষ এই রুবাই আর অয়নের… 😀 😀
একটা গান মনে পড়ে গেলো, ‘অন্ধকারের উৎস হইতে উৎসাহিত আলো’– এমন চেতনা যেন প্রতিটি ‘গুইরামের’ হয়।