লেখক : প্রিয়াংকা রাণী শীল
সময়টা বড্ড খারাপ যাচ্ছে। অমাবস্যার রাত। বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। এর মাঝে চলছে কারফিউ। মায়ার অতি কষ্ট হচ্ছে। তার চোখ দুটো যেন এখনই বন্ধ হয়ে যাবে। পেটের এক পাশে তীব্র ব্যথা। এক হাতে ঐ জায়গায়টা সে চাপ দিয়ে ধরে আছে। আর অন্য হাত দিয়ে গাড়ি ড্রাইভ করছে অতি কষ্টে।
মায়ার কিছু করার ছিল না। নইলে এমন ভয়ংকর রাতে কেউ বের হয়! দেশজুড়ে কারফিউ চলছে। রক্ষণশীল দল ও পরিবর্তনশীল দলের মাঝের তর্ক-বিতর্কের জেরে এই কারফিউ। কিন্তু কি করবে মায়া? তার জীবনেই এখন এমন এক কারফিউ চলছে – এটার শেষ না হওয়া অব্দি তার শান্তি নেই। তাই তো নীলের প্রিয় রং নীল রংয়ের একটা শাড়ি পরে আর দেরি করেনি। নিশ্চয়ই নীলও তার প্রিয় রং লাল রংয়ের গোলাপ নিয়ে অপেক্ষায় বসে আছে তার জন্য। বের হওয়ার আগে ফোনে নীলের সঙ্গে কথোপকথনের সময় এমনটাই মনে হয়েছিল মায়ার । নীলও বলেছিল, “এই যন্ত্রণার শেষ চাই।” হয়তো শেষ হবে আজই। আর শেষ হবে চিরদিনের মতো লাল-নীলের ভেদাভেদও।
মায়া ভাবছিল তাই-ই। তার পেটের ব্যথাটা তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। চোখ দুটো যেন বুজে আসছে। কিন্তু মায়া এত সহজে হারার পাত্র নয়। সে সহ্য করে যাচ্ছে। তবুও তার দেখা করতে হবে নীলের সাথে।
কিছুক্ষণ পর মায়া এসে পৌঁছালো নীলের ঠিক করে দেয়া গন্তব্যস্থলে। মায়া দেখলো,নীল বসে আছে। সামনে নীল সমুদ্র। অজস্র জলরাশি তীরে আছড়ে পড়ছে।কোন একটি পাখির আওয়াজও শোনা যাচ্ছে না। শুধু তীরে সাগরের জলরাশির বার বার আছড়ে পড়ার ক্ষীণ শব্দ শোনা যাচ্ছে। শব্দটা বেশ ভালো লাগছে; অদ্ভূতভাবে আপন লাগছে আজ মায়ার কাছে।
মায়া একটু পরে অনেক কষ্টে অস্পষ্ট স্বরে ডাক দিলো,”নী…নী…ল।”
মায়ার গলার স্বর শুনে পেছন ফিরে তাকালো নীল। ঘুটঘুটে অন্ধকারে নীল যেন দেখলো অজানা কোন এক জগৎ হতে আসা এক নারী মূর্তি তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।নীল কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে বললো,
“এলে…”
“হুম।এলাম।”
“তোমায় একটা কথা বলার জন্য ডেকেছি।যদিও এমন দিনে এ কাজটা করা একেবারে ঠিক হয়নি।”
মায়া সাথে সাথে উত্তর দিলো,”না, নীল, ঠিক করেছো- কারণ আমিও চেয়েছি তোমার সাথে দেখা করতে।”
“ওঃ তাই।” কিছুটা তাচ্ছিল্যের সুর টেনে এনে বললো নীল। “তো কেন দেখা করতে চেয়েছো, বলো?” সাথে সাথে জিজ্ঞেস করলো নীল।
অন্ধকারে মায়া দেখলো নীলের হাতে কোন গোলাপ নেই।তার চোখ দুটোও যেন ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছে।ভালভাবে দেখার শক্তিও যেন হারিয়ে যাচ্ছে। পেটের ব্যথাটা যেন ভয়ানক হয়ে উঠছে।মায়া তাই নীলকে বললো,”তুমি আগে বলো…”
নীল তখন বললো,” ঠিক আছে।তবে আমিই বলছি……।” সমুদ্রের দিকে ফিরে নীল তখন বললো,”মায়া, আজকের পর আমি চাইনা আমাদের সম্পর্কটা আর সামনের দিকে এগিয়ে নিতে।”
এরকম একটা কথা শুনার জন্য একেবারে অপ্রস্তুত ছিলো মায়া।কথাটা শুনার পর অনেক নিঃসঙ্গ মনে হলো নিজেকে মায়ার। মায়া নিজেকে একটু শান্ত করার চেষ্টা করলো। তারপর নীলকে জিজ্ঞাসা করলো, “কেন,জানতে পারি?”
নীল উত্তর দিলো ,”সেটা তুমি খুব ভালো জানো…”।
“না……আমি জানি না………।” চিৎকার করে বললো মায়া।
নীল চুপ হয়ে থাকলো।পরমুহূর্তে বললো, “তুমি তো জানো মায়া, আমি নীল ভালবাসি, আর তুমি লাল। তাই তোমার আর আমার আসলে হয় না…আমাদের মিল হতে পারে না।”
মায়া কিছু বললো না। পেটের পাশের ব্যথাটা মুহূর্তে মুহূর্তে যেন তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে উঠছে।
নীল তখনও বলে যাচ্ছে, “……আমি কবি, মায়া । আমার স্বাধীনতা চাই।” সমুদ্রের দিকে হাতের আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে বললো,” ঐ যে সমুদ্র ; তার নীল বুকে হারাতে চাই। অজস্র ঢেউরাশির মতো নিজের কবিত্বকে, কবিতার ছন্দগুলোকে ভাঙতে চাই।” তারপর আকাশের দিকে তাকিয়ে বুক ভরা নিঃশ্বাস নিয়ে বললো, ” বাঁচতে চাই ; আমার কবিতাকে বাঁচাতে চাই।”
মায়ার চোখ দুটো যেনো বন্ধ হয়ে আসছে। নীলের কথাগুলোর সাথে লড়াই করার শক্তি যেন সে হারাচ্ছে ক্রমে ক্রমে। অনেক কষ্টে সে জিজ্ঞেস করলো , ” আমার লাল রং তাতে কি দোষ করেছে, নীল ?”
মুহূর্তে মায়ার কাছে ছুটে এসে নীল বললো, “তোমার লাল রং আমাকে সেই স্বাধীনতা দেয় না, মায়া। তোমার লাল রং শুধু বাঁধন চায়। যেটা আমার কবিতার জন্য হুমকি।”
“যেখানে ভালবাসা থাকবে সেখানে তো বাঁধন থাকবেই নীল। নইলে ভালবাসার প্রাপ্তি কোথায়,বলো?”
“চাইনা,আমি…………।অমন ভালবাসা আমি চাই না।” চিৎকার করলো নীল।
“কিন্তু নীল, আমার ভালবাসার লাল রংয়ে যে উষ্ণতা আছে,তোমার নীল রংয়ে তা নেই।”
“হ্যাঁ,নেই………কিন্তু আমার নীল রংয়ে ভালবাসার শান্ত রূপটা বিরাজ করে। আমি সেটাই চাই।শুধু নীল রং চাই। তোমার লাল রংয়ের প্রখর উষ্ণতায় আমার কবিতাকে পোড়াতে চাই না। তোমার লাল রংয়ে আমি সহিংসতার রূপ দেখতে পাই, যুদ্ধ দেখতে পাই।”
মায়া এবার পাল্টা জবাব দিলো, ” কিন্তু তোমার নীল রং রক্ষণশীল, পরিবর্তন চায় না।”
“ভুল বললে, মায়া। আমার নীল রং পরিবর্তন চায়। তবে ধীরে ধীরে।…তোমার লাল রং চায় দ্রুত…আর এটাই ডেকে আনে সহিংসতা, যুদ্ধ ; পরিণামে রক্তপাত।”……”উফ!কি কষ্ট দেয় তোমার লাল রং!!” দু’হাত দিয়ে মাথার দু’পাশে চেপে ধরে বলল নীল।
মায়া এবার অনুভব করলো সত্যিই তার কষ্ট হচ্ছে। আসার সময় হঠাৎ গোলাগুলিতে তার পেটের পাশে একটা গুলি এসে বিঁধে যায়।তখন থেকে হাত দিয়ে চেপে রেখেছে সে। আর পারা সম্ভব হচ্ছে না। সত্যিই কি তবে নীল ঠিক বলছে? লাল রং কি খুব কষ্ট দেয়? মায়া যেন তার সমস্ত শক্তি হারাচ্ছে। চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। ঝাপসা চোখে সে দেখতে পাচ্ছে , অন্ধকার কাটতে আর বেশি দেরি নেই। নীল তাকিয়ে আছে সমুদ্রের দিকে। আকাশ, সমুদ্রের নীল রং একটু একটু করে স্পষ্ট হয়ে উঠছে। চারদিকে কোন কোলাহল নেই।শান্ত, স্নিগ্ধ এই পরিবেশ ভালো লাগছে মায়ার; ভীষণভাবে ভালো লাগছে; ভালো লাগছে ঐ নীল রং। মায়ার ইচ্ছে হচ্ছে নীলের হাতটা একটু ধরতে। আর অপার পৃথিবীর এই নীল সৌন্দর্যটাকে নীলের সাথে উপভোগ করতে।
মায়া অনেক কষ্টে উচ্চারণ করলো,”নী……ল।”
অনেকক্ষণ পর মায়ার গলার স্বর শুনতে পেয়ে পেছন ফিরে তাকালো নীল। মায়াকে দেখলো নীল।…দেখলো এই প্রথম ভোরের আলোয়। নীল শাড়ি পড়ে মায়া দাঁড়িয়ে তার সামনে ; দাঁড়িয়ে আছে অপার নীল সৌন্দর্যকে তার শরীরে ধারণ করে।…… এ যে তার স্বপ্নের মায়া; তার কবিতার ছন্দ,সুর – সবকিছু ; তার কবিত্ব ও কবিতার প্রাণ! নীল ছুটে এলো মায়ার কাছে; দু’হাত দিয়ে মায়ার মুখটা ধরে বললো, “তুমি নীল শাড়ি পড়েছো!!!”
“হুম।” অনেক কষ্টে হাসলো মায়া। ক্লান্ত গলায় বললো, “কিন্তু তুমি লাল গোলাপ আনো-নি, নীল!”
অনুযোগটা নীলের বুকের ভিতর বিধঁলো অনেক তীক্ষ্ণভাবে। হঠাৎ নীল লক্ষ্য করলো, মায়ার নীল শাড়ির রংটা পাল্টে যাচ্ছে ; চোখ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে , তার শরীরটাও অনেক ভারী ভারী লাগছে। মনে হচ্ছে মায়া এখনই পড়ে যাবে। নীল শক্ত করে মায়াকে ধরে রাখতে চাইলো, কিন্তু পারলো না।
মায়ার ক্লান্ত শরীরটা পড়ে আছে বেলাভূমিতে। নীল তার রক্তাক্ত হাতটা ধরে আছে, অপলক চোখে তাকিয়ে আছে মায়ার ক্লান্ত মুখটার দিকে।ভেজা চোখে সে দেখতে পাচ্ছে মায়ার পরনের নীল শাড়িটা লাল রক্তে মিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে, ধারণ করছে অন্য এক রঙে। ভোরের আলো তখন ফুটে গেছে। সমুদ্রের নীল জলের বুক ভেদ করে উঠেছে লাল সূর্য। আর তার লাল আভা ছড়িয়ে যাচ্ছে নীল আকাশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে। সমুদ্রের নীল জলের রং ধারণ করছে বিচিত্র বর্ণে। লাল আর নীল মিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে – এ যেন নানা বর্ণের সমাহার। সেই সমাহারে থাকছে না লাল – নীলের ভেদাভেদ। নীল আজ চাইছে , খুব করে চাইছে – এ ভেদাভেদহীন লাল- নীলের সৌন্দর্যে মন ডুবাতে,মন ভাসাতে ; আর হারিয়ে যেতে……… শুধু মায়ার সাথে।
লেখক পরিচিতি : প্রিয়াংকা রাণী শীল
আমি প্রিয়াংকা।জন্ম বাংলাদেশের চট্টগ্রামে। পড়াশোনা করেছি চট্টগ্রামেই। গল্প, উপন্যাস পড়তে ভালবাসি। আর ভালবাসি গল্প লিখতে। পড়াশোনা করা অবস্থায় স্কুল,কলেজ ম্যাগাজিনে তিনবার আমার লেখা গল্প ছাপানো হয়েছিল।বর্তমানে বাস করছি ইতালিতে। আমার লেখা গল্প পড়ে ভালো না খারাপ লাগলো তা জানালে অনেক বেশি ভালো লাগবে।
খুব ভালো লাগলো পড়ে।এমন আরো অনেক গল্প পড়তে চাই।
ধন্যবাদ। চেষ্টা করবো…………
লালে নীলে মিশে কি অনবদ্য রচনা !! কিছুক্ষণের জন্য হারিয়ে গিয়েছিলাম গদ্য রাজ্যে । খুব সুন্দর।
ধন্যবাদ।
অসাধারন লেখা। আমার খুবই ভাল লেগেছে। লাল আর নীল-এর পার্থক্যটা বোঝার চেষ্টাই করিনি কোনদিন। এভাবে কেউ রঙের সাথে স্বপ্নকে জুড়ে দিতে পারে তা আমার কল্পনার ভাষায়ও বুঝিনি। পাল তোলা নৌকা কখনও বুঝতে পারেনা, ঝড়ের কবলে কতটা যন্ত্রনা, কিন্তু মাঝি ঠিকই তার পাল নামিয়ে নেয় নিজেকে বাঁচানোর আকুতি প্রতি ক্ষণে ক্ষণে। ভাবে এই বুঝি শেষ হল ঝড়। কিন্তু সময় নির্মমভাবে সবকিছু বুঝিয়ে দেয়- “সত্য সমাগত মিথ্যা বিতাড়িত”। আগামীতেও এধরনের লেখা আশা করছি।
ধন্যবাদ , গল্পটা পড়ার জন্য। আরও অনেক বেশি ধন্যবাদ এত সুন্দর মন্তব্যের জন্য। দোয়া করবেন যেন আর ও ভালো লেখা দিয়ে আপনাদের আনন্দ দিতে পারি।
Awesome
অসাধারণ একটা গল্প, খুব ভালো লাগলো পড়ে, এরকম আরো অনেক সু্ন্দর সু্ন্দর কিছু আশা করি।
ধন্যবাদ, গল্পটি পড়ার জন্য। আরো সুন্দর কিছু লেখার চেষ্টা করবো……
খুব সুন্দর
ধন্যবাদ গল্পটি পড়ার জন্য।
চমৎকার প্রেক্ষাপট। আরও গল্পের অপেক্ষায় রইলাম।
ধন্যবাদ । চেষ্টা করবো আরো গল্প উপহার দেয়ার……
Love to read your writings. Hope you will continue this writings,,,,. Wish you all the best
thanks, dear for reading. try my best to continue writings.