আমার মেটিয়াবুরুজ (পর্ব – ১৩)

লেখক : অনুপম ভট্টাচার্য

এক, দুই করতে করতে শেষে তেরোর গেরোতে পৌঁছে গেলাম। অনেকেই ইনবক্সে জানতে চেয়েছেন, হঠাৎ করে মেটিয়াবুরুজ নিয়ে কেন লিখতে শুরু করলাম। পশ্চিমবঙ্গবাসী হিসেবে আমার রাজ্য আমার সব থেকে প্রিয়, আমার মাতৃভূমি। এক সময়ে এই বাংলা যা ভাবতো, গোটা ভারত সেই ভাবনায় সামিল হতে বাধ্য হতো। শিক্ষা, শিল্প, সংস্কৃতি, সবেতেই পথ দেখাতো বাংলা। তারপর গঙ্গা থেকে কিউসেক কিউসেক জল বয়ে গেছে। বাংলা ক্রমাগত পিছিয়ে পড়েছে সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে। তবুও মেধায়, মননে, প্রতিভায়, হিউম্যান রিসোর্সে আজও বাংলা চাইলেই ঘুরে দাঁড়াতে পারে। তবে সেই ঘুরে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে পথ দেখাতে হবে বাঙালি হিন্দু এবং মুসলিম উভয়কেই। বাংলা যদি মানবদেহ হয়, বাঙালি হিন্দু এবং মুসলিম তার দুই অর্ধ। এক অর্ধের বিকাশ কখনোই সুসম বিকাশ নয়। তাই প্রয়োজন দুই অর্ধেরই সুসম বিকাশ। মনে রাখা দরকার বাঙালি মুসলিম সম্প্রদায়ের বিকাশ ছাড়া কখনোই সামগ্রিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। তাই লেখার কেন্দ্রে বাঙালি মুসলিম, তাই মেটিয়াবুরুজ।

পর্ব এক থেকে বারো, এই দীর্ঘ পথের জার্নি থেকে কয়েকটি পয়েন্ট পরিস্কার করা গেছে। সেগুলো হচ্ছে –

  • মেটিয়াবুরুজের রেডিমেড গার্মেন্টস শিল্পের আধুনিকীকরণ প্রয়োজন। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হলে এই পরিবর্তন জরুরি।
  • একজন আর একজনের ডিজাইন কপি করে চালানোর দিন প্রায় শেষ। যদি রেডিমেড গারমেন্টস শিল্পের লিডার হিসেবে নিজেদের দেখতে চান, তবে নিজস্ব ডিজাইন, তার পেটেন্ট, অনলাইন প্ল্যাটফর্মে এন্ট্রি ইত্যাদি জরুরি।
  • প্রয়োজন পেশা ভিত্তিক পড়াশোনা। তাতে থাকুক ফ্যাশন ডিজাইনিং, ব্র্যাণ্ডিং, অনলাইন ট্রেডিং, মেশিন রিপেয়ারিং ইঞ্জিনিয়ারিং, এমন বিষয়। এই ক্ষেত্রে প্রধান উদ্যোগ নিতে হবে অপেক্ষাকৃত ধনী ওস্তাগরদের। তাঁদের স্পনসরশীপ পেলেই গড়ে উঠবে এই ধরনের ইনস্টিটিউট।
  • প্রয়োজন পরিবারের মেয়েদের ব্যবসার কাজে এগিয়ে দেওয়া। ধর্মের রেফারেন্স থেকে দেখলে দেখা যাবে ইসলামে মেয়েদের ব্যবসায় আসার পথে কোনও প্রতিবন্ধকতা নেই।
    মেয়েদের মধ্যে প্রথম ইসলাম গ্রহণকারী নারী হজরত খাদিজা (রাঃ) একজন সম্ভ্রান্ত ঘরের মহিলা ছিলেন। তিনি সেই সময়ের অত্যন্ত প্রভাবশালী ব্যবসায়ী ছিলেন। তাঁর সেই ব্যবসা দেখাশোনা করতেন নবীজী হজরত মোহাম্মদ (সঃ)। তাহলে ধর্মের দিক থেকেও মেয়েদের ব্যবসায় আসার পথে বাধা নেই।
  • কম বয়সে বিয়ে দেওয়ার প্রবণতা কমবে আধুনিক শিক্ষার বিস্তার হলে। এবং ব্যবসায় মেয়েদের অংশগ্রহণ সুনিশ্চিত করতে পারলে।
  • অনলাইন প্ল্যাটফর্মে পাইকারি ব্যবসার জন্য উদ্যোগ নেওয়া। নিজেদের ওয়েবসাইট ডিজাইন করা থেকে শুরু করে Alibaba, India Mart, Global Sources, Alanic Clothing ইত্যাদি সাইট গুলিতে নিজেদের ব্র্যাণ্ড নথিভুক্ত করা। সাথে রিটেল অনলাইন প্ল্যাটফর্মকে ব্যবহার করা। এই কাজে শিক্ষিত মুসলিম ছেলে মেয়েদের এগিয়ে দেওয়া, উৎসাহিত করা।

কেন অনলাইন প্ল্যাটফর্মে এন্ট্রি নেওয়া জরুরি?
নোটবন্দী, GST থেকে লকডাউন, এই দীর্ঘ পথ পরিক্রমার অভিজ্ঞতা থেকে একটা বিষয় আশাকরি সকলেরই মাথায় ঢুকেছে যে কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য, দুই সরকারের কেউই মেটিয়াবুরুজের রেডিমেড গারমেন্টস শিল্প নিয়ে আলাদা করে কিছু ভাবনাচিন্তা করছে না। অতএব উদ্যোগ নিজেদেরই নিতে হবে। নয়তো সেদিন আর বেশি দূরে নয়, যেদিন মেটিয়াবুরুজের রেডিমেড গারমেন্টস শিল্পের কেবল ধ্বংসাবশেষ পড়ে থাকবে।

আগের পোস্টে অনেকেই বাংলাদেশের রেডিমেড গারমেন্টস শিল্পের কথা বলেছেন। আপনাদের অনেকে হয়তো জানেন এই মুহুর্তে বাংলাদেশ রেডিমেড গারমেন্টস এক্সপোর্ট করার ক্ষেত্রে বিশ্বে তৃতীয় স্থানে আছে। অবাক কাণ্ড কি জানেন? বাংলাদেশের রেডিমেড গারমেন্টস শিল্পের সেন্টারগুলির মধ্যে একটি মীরপুর। সেই মীরপুরে যাঁরা এই ব্যবসার সূত্রপাত করেন, তাঁদের প্রায় সকলেরই পূর্ব বাসভূমি এই মেটিয়াবুরুজ। দেশভাগের পরে এখানকার ওস্তাগরদের একটা অংশ মাইগ্রেট করে বাংলাদেশের মীরপুরে। তাঁরাই এই ব্যবসার জনক। রেডিমেড গারমেন্টস শিল্প বাংলাদেশের ক্ষেত্রে কিভাবে বিস্তার লাভ করেছে বুঝতে গেলে একটু নেট ঘাঁটাঘাঁটি করাই যথেষ্ট। বাংলাদেশে একটা চালু শব্দবন্ধ “গারমেন্টসের মেয়ে”। এই শিল্পের সাথে ওতোপ্রোতো ভাবে জড়িয়ে আছেন মেয়েরা। অধিকাংশ গরীব ঘর থেকে উঠে আসা নারী শক্তি আজ নতুন করে বাঁচার ঠিকানা খুঁজে পেয়েছে রেডিমেড গারমেন্টস শিল্পের হাত ধরে। বাংলাদেশের রেডিমেড গারমেন্টস শিল্পের বিকাশের পেছনে চীনের ভূমিকাও কিছু কম নয়। বাংলাদেশের রেডিমেড গারমেন্টস শিল্প দেশীয় বাজারের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বাজারেও নিজেদের উপস্থিতি বেশ ভালো রকমেই জানান দিচ্ছে। H & M, Wallmart, Zara, Next, Primark C & A প্রমুখ বিখ্যাত গ্লোবাল ব্র্যাণ্ড যৌথভাবে বাংলাদেশের রপ্তানিতে সহায়তা করছে।

মেটিয়াবুরুজের ওস্তাগরদের সাথে আরও দুটি দেশের সম্পর্ক জড়িয়ে আছে। দেশ দুটির একটি পাকিস্তান এবং অন্যটি সিঙ্গাপুর। বৃটিশ আমলে রাজকর্মচারী সাহেব এবং তাদের মেমসাহেবদের রকমারি বিলিতি ড্রেসের ফরমায়েশ রক্ষার একমাত্র ভরসা ছিলেন মেটিয়াবুরুজের নামীদামী ওস্তাগররা। সেই সময়ে পেয়ারের মেমসাহেবের একটা গাউনের জন্য সাহেব ২৫০ টাকা (আজকের হিসেবে তা কত, ভাবতেও মাথা ঘুরে যাবে)। এমনকি ড্রেস পছন্দ হলে বখশিশ পাওয়া যেত ১০০ টাকা! ভাবতে পারেন! এমনই গুণী শিল্পী ওস্তাগরদের জন্মভূমি এই মেটিয়াবুরুজ।

বৃটিশ সূর্য যখন অস্তাচলের পথে, সাহেব-মেমসাহেবের দল বাক্স প্যাঁটরা গুছিয়ে ফিরে যাচ্ছেন বা যাবেন নিজেদের হোমল্যান্ড, সেই সময়ে সেই গুণী ওস্তাগরদের একটা অংশ মাইগ্রেট করে পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমান বাংলাদেশ)। কিছু মাইগ্রেট করেন পশ্চিম পাকিস্তানে। আর কিছু অংশ সিঙ্গাপুর এবং বার্মায় (বর্তমান মায়ানমার)। এভাবেই টুকরো টুকরো মেটিয়াবুরুজ এবং তার দর্জি শিল্পের ঐতিহ্য ছড়িয়ে পড়েছে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে।

ফিরে আসা যাক মেটিয়াবুরুজে। তখন ছিলো দোকানদারি কারবার। তখনকার দিনে দর্জিরা ওস্তাগরের দলিজে (দহলিজ) বসে সারাদিনে সর্বোচ্চ ৪ ফোর (প্রহরের অপভ্রংশ) কাজ করতে পারতো। সকাল সাতটা থেকে এগারোটা পর্যন্ত কাজ করলে হতো ১ ফোর এবং মাগরিব মানে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজ করলে হতো ৪ ফোর অর্থাৎ একটা রোজ। এক রোজ ( ১৬ ঘন্টা) কাজ করলে একজন কারিগর মজুরি পেতো আট আনা। তখন চালের মন মাত্র ৪ টাকা।

এই অঞ্চলে হাট নির্ভর ব্যবসা শুরু হয় বৃটিশ আমলের অনেক পরে। ধীরে ধীরে সেই হাট ভিত্তিক ব্যবসার চাবিকাঠি চলে যায় গোটা কয়েক ধনী ওস্তাগর পরিবার পরিচালিত সিণ্ডিকেটের হাতে। এই সিন্ডিকেট (নামান্তরে হাট মালিক) অসীম ক্ষমতাশালী। হাট গুলির মালিকানা মূলত এই সিণ্ডিকেটের হাতেই রয়েছে। হাটে স্টলের বন্টন, বিক্রি সংক্রান্ত দূর্নীতি সম্পর্কে স্থানীয় ব্যবসায়ীরা আমার থেকে বেশি ওয়াকিবহাল। তবু যাঁরা মেটিয়াবুরুজের বাসিন্দা নন, তাঁদের জন্য দু’এক কথা বলা দরকার। তবে এই পর্ব এমনিতেই অনেক বড়ো হয়ে গেলো। তাই আবার আগামী পর্বে। অবশ্যই যদি আপনারা চান তবেই।

চলবে…


আগের ও পরের পর্বের লিঙ্ক<< আমার মেটিয়াবুরুজ (পর্ব – ১২)আমার মেটিয়াবুরুজ (পর্ব – ১৪) >>

লেখক পরিচিতি : অনুপম ভট্টাচার্য
এমন একজন, যে এখনো নিজের পরিচিতির খোঁজে রয়েছে। আশা করি জীবনের দৌড়ে ফিনিশিং পয়েন্ট আসার আগে তার অনুসন্ধান শেষ হবে।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।

লেখা আহ্বান - বিস্তারিত জানতে ছবিতে ক্লিক করুন