আমার মেটিয়াবুরুজ (পর্ব – ১২)

লেখক : অনুপম ভট্টাচার্য

পর্ব ১১ তে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট উল্লেখ করেছি। মেটিয়াবুরুজের রেডিমেড গারমেন্টস শিল্পে মহিলাদের অংশগ্রহণ না করা (অথবা করতে না দেওয়া), রেডিমেড গারমেন্টস শিল্পে আধুনিক চিন্তাভাবনার অভাব এবং ব্যবসার সাথে সংযুক্ত বিষয় গুলি (ফ্যাশন ডিজাইনিং, ব্র্যাণ্ডিং, পেটেন্ট, ম্যানেজমেন্ট এবং অ্যাকাউন্টটিং) নিয়ে আধুনিক শিক্ষার বিস্তার। এর সাথে যুক্ত করতে হবে Machine Engineering। আজকের দিনে যে অত্যাধুনিক এমব্রয়ডারি মেশিন ইত্যাদি রেডিমেড গারমেন্টস শিল্পে ব্যবহৃত হয়, তার আপগ্রেডেশন, রিপেয়ারিং ইত্যাদির জন্য আপনাদের বাইরে থেকে ইঞ্জিনিয়ার ভাড়া করতে হয়। ফলে খরচা বাড়ে। অথচ আপনার ঘরের ছেলেটিকে যদি এই মেশিন ইঞ্জিনিয়ারিং এর শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলা যায়, কাজের নতুন দিগন্ত খুলে যাবে।

আধুনিক শিক্ষা এবং বিজনেস আইডিয়ার বিকাশ হলেই সহজে বন্ধ করা যাবে অল্প বয়সে বিয়ে। কারণ যে কাজ সে জন্ম থেকে দেখে বড়ো হয়েছে, সেটাই যখন তার সিলেবাসে থাকবে, সে সেই শিক্ষা অন্তর থেকে গ্রহণ করতে বাধ্য।

আগের পর্বে আমার অত্যন্ত প্রিয় মানুষ হায়দার আলী ব্যবসায় মেয়েদের অংশগ্রহণ নিয়ে মতামত দিয়েছে। তার বক্তব্যের অংশ বিশেষ কপি পেস্ট করে দিচ্ছি।
“…..বর্তমানে কিন্তু মেয়েরা ব্যবসার সাথে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িয়ে রয়েছে। যারা অনেক বড় ওস্তাগার তাদের বাড়ির মেয়েরা হয়ত সেভাবে জড়িয়ে নেই কিন্ত বেশিরভাগ ওস্তাগার ঘরের মেয়েরা গার্মেন্টস এর বিভিন্ন কাজের সাথে যুক্ত, যেমন এর সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন মেশিন চালানো, প্যাকিং করা, ইস্ত্রী করা ইত্যাদি করে থাকে। মোট কথা ঘরে বসে যতটুকু করা যায় প্রায় সব ই করে”।
একটু বিশ্লেষণ করা যাক। একটু ফিরে দেখা যাক ইতিহাসের পাতা উলটে। আমরা অনেকেই জানি মেয়েদের মধ্যে প্রথম ইসলাম গ্রহণকারী নারী হজরত খাদিজা (রাঃ) একজন সম্ভ্রান্ত ঘরের মহিলা ছিলেন,এবং সেই সময়ের অত্যন্ত প্রভাবশালী ব্যবসায়ী ছিলেন। তাঁর সেই ব্যবসা দেখাশোনা করতেন নবীজী হজরত মোহাম্মদ (সঃ)।
অথচ সুযোগ ছিলো এবং আছে। প্রসঙ্গত এই অংশটি আমার ইনবক্সে জনৈক কারিগর ভাই তাঁর মতামত আকারে দিয়েছেন। আমি কেবলমাত্র তার বক্তব্য আপনাদের সামনে তুলে ধরছি।
“….. মেটিয়াবুরুজ এলাকা নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা হয়েছে, ভবিষ্যতে আরো হয়ত হবে। গত আলোচনায় একটা ব্যাপার উঠে এসেছে সেটা হলো অল্পবয়সে ছেলে-মেয়েদের বিয়ে দেওয়া।
এই ব্যাপারে আলোচনা করতে গিয়ে প্রায় 90% অভিভাবকের অনুযোগ ছিল যে অধিকাংশ ছেলেমেয়েদেরা স্কুলিং শেষ হবার আগে আগেই প্রেম ভালোবাসার মাধ্যমে নিজেদের সঙ্গী বেছে নেয় এবং সেব্যাপারে বাড়াবাড়ি শুরু করে। ফলস্বরূপ খানিকটা বাধ্য হয়েই পড়াশোনার ইতি ঘটিয়ে মেয়েদের বিয়ে দিতে বাধ্য হয়…
আসলেই তো,আদরের ছেলেমেয়ের আবদার কোন বাবা-মা’ই বা ফেলতে পারে!
এই এলাকায় ছোট থেকে পড়াশোনার সাথে সাথে ছেলেমেয়েরা ব্যবসায়িক এবং কাপড় উৎপাদন সংক্রান্ত বিভিন্ন কাজের সাথে পরিচিত হতে থাকে। ছেলেরা ছোট থেকে বাবার সাথে হাটে গিয়ে খরিদ্দারদের সাথে ডিল করতে করতে ব্যবসায়ী হয়ে ওঠে। আবার কেউ কেউ ছোট থেকেই সেলাই, কাজ-বোতাম, প্যাকিং করার মাধ্যমে কারিগর হয়ে ওঠে।

ছোটবেলায় আমরা দেখেছি বাড়ির মেয়েরা সুঁচ সুতো দিয়ে হাতে বোতাম লাগাতো, এখনও অনেক বাড়ির মেয়েরা বাড়িতে বসে ইন্টারলকের কাজ, স্ক্রিন প্রিন্টিং, ফিউজিং, পেস্টিং সহ মেশিনে বসে বোতাম লাগানোর কাজ করে। অর্থাৎ বাড়ির রোজগারে মেয়েরা সমানভাবে ছেলেদের সাথে কাজ করে…
অথচ আমরা এই বিপুল জনশক্তিকে আরো অনেক ক্রিয়েটিভ কাজে লাগাতে পারতাম।
ওপরেই বলেছি অভিভাবকেরা আদরের ছেলে-মেয়েদের আবদার ফেলতে না পেরে অল্পবয়সেই পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে বিয়ে দিয়ে দেয়, এই অভিভাবকেরাই আবার একটা অদ্ভুত প্যারাডক্সের মধ্যে থাকে। সাধারণভাবে তাদের ধারণা হলো ধর্মের নিয়মানুসারে বিয়ের পর জীবন থমকে যায়, বিয়ের পর মেয়েরা বাইরে যেতে পারে না, চাকরি করতে পারে না, ব্যবসা করতে পারে না! অথচ ধর্ম কোনদিনই মেয়েদের ঘরে আটকে থাকতে বলেনি। মেয়েদেরকে আমরাই ঘরে আটকে রেখেছি আমাদের নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব জাহির করতে।

মেটিয়াবুরুজে যদি একটা ফ্যাশন ইনস্টিটিউট হতো তাহলে হয়তো এই এলাকার মেয়েরা ফ্যাশন ডিজাইনিং নিয়ে পড়াশোনা করে তাদের পরিবারিক ব্যবসাকে বিশ্ববাজারে নতুনভাবে পৌঁছে দিতে পারতো। আধুনিক মেশিনারিজ নিয়ে যদি কোন ডিপ্লোমা ইনস্টিটিউট থাকতো,তাহলে ছেলেরা কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে উৎপাদনে অনেক এগিয়ে যেত।

ফ্যাশনের জগতে ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের ফ্যাশন সেন্স অনেক বেশি,তারা অনেক বেশি রুচিশীল। অথচ মেটিয়াবুরুজের হাজার হাজার কোটির ফ্যাশননির্ভর ব্যবসা,সেই ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিতে মেয়েরাই ব্রাত্য! পুরোটাই কপিপেস্ট নির্ভর! এর থেকে বড়ো দুঃখজনক আর হতাশাজনক ব্যাপার আর কি হতে পারে?
ধীরে ধীরে এই কারিগরনির্ভর ব্যবসা মেটিয়াবুরুজ থেকে হাতছাড়া হতে চলেছে সেটা আজ প্রাচুর্যের মধ্যে বসে টের না পেলেও আজ থেকে দশ বছর পর ঠিকই টের পাবে। হাটনির্ভর ব্যবসাও আগামীদিনে অতীত হয়ে যাবে। ততদিনে এসে যাবে পুরোটাই অনলাইনভিত্তিক এবং ইনোভেটিভ আইডিয়া নিয়ে তৈরি নতুন নতুন কোম্পানি। এখন থেকেই ফ্যাশনের মার্কেটে যুগের সাথে তাল মিলিয়ে না চলে কপিপেস্ট টাইপের ট্রাডিশনাল ব্যবসায় চলতে থাকলে অন্যান্য প্রোডাকশন কোম্পানিগুলো দ্রুত পাল্লা দিয়ে এগিয়ে যাবে।

ইতিমধ্যেই বাংলাদেশের টিশার্ট,জগার্স, থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট মেটিয়াবুরুজ হাটে জাঁকিয়ে বসে হটকেকের মতো বিক্রি হচ্ছে। অর্থাৎ লোকাল উৎপাদনে একটা আঘাত। বারাসাত, মধ্যমগ্রাম, দমদম, বিরাটি সংলগ্ন এলাকায় প্রচুর গোডাউন রয়েছে, যারা বাংলাদেশ থেকে কাপড় এনে লোকালি এবং অনলাইনের বিভিন্ন ট্রেডিং ওয়েবসাইটের মাধ্যমে সারা দেশে ব্যবসা করছে। মানে সেই হাটভিত্তিক ব্যবসায় বড়ো একটা ঘাটতি তৈরি হচ্ছে।

দুটো জনপ্রিয় কোম্পানির অতীত বলে যাই। ‘নোকিয়া’ কোম্পানির নাম শোনেনি বা ওদের মোবাইল ব্যবহার করেনি খুব কম মানুষই আছে। একটা সময়ে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী সারা বিশ্বে কেউ ছিলনা। আতশবাজি,মানুষের যৌবন হোক বা ব্যবসা। প্রতিটি জিনিসেরই একটা পিক টাইম থাকে,সেই সময়ে তেড়েফুঁড়ে সবকিছু ছাড়িয়ে ওপরে উঠতে থাকে। সিম্বিয়ান অপারেটিং সিস্টেম আনার পর নোকিয়া কোম্পানির ম্যানেজিং টিমও ভেবেছিল আমরা অপ্রতিরোধ্য, আমরা ধ্রুব। কিন্তু এন্ড্রয়েড আসার পর স্যামসাং সহ অন্যান্য কোম্পানি যখন নিজেদের ফোনে এন্ড্রয়েড অপারেটিং সিস্টেম ইনস্টল করা শুরু করলো ঠিক তখন নোকিয়া নিজেদের ইউনিক প্রমান করার জন্য জনপ্রিয় কম্পিউটার অপারেটিং সিস্টেম ‘উইন্ডোজ’ ইনস্টল করে মোবাইল বের করলো। ফলাফল আমরা সবাই জানি। অনেক চেষ্টা করে,মাইক্রোসফট ব্র্যান্ডিং করেও দাঁড়াতে পারলো না। রিসেন্টলি নোকিয়া এন্ড্রয়েডে ফিরে আসলেও অনেক দেরি হয়ে গেছে। আরেক জনপ্রিয় মোবাইল নির্মাতা কোম্পানি ব্ল্যাকবেরির সাথেও একই ঘটনা ঘটে।

মেটিয়াবুরুজের হাটভিত্তিক রেডিমেড গার্মেন্টসের পিকটাইম অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে। এখনই সময়ের সাথে নিজেদের আপডেট করে সঠিক সিদ্ধান্ত না নিলে এই এলাকার ঐতিহ্যবাহী কমিউনিটি বেসড রেডিমেড গার্মেন্টস ব্যবসা অচিরেই হারিয়ে যাবে।
মানুষ বলে ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেবার কথা। কিন্তু “ইতিহাসের সবথেকে বড় শিক্ষা হলো মানুষ ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয় না”-
হতাশা পাশে রেখেই বলি,মেটিয়াবুরুজের বড়ো বড়ো ব্যবসায়ীর মধ্যে দুই চারজন ও যদি একটু উদ্যোগ নেন,তাহলে এই এলাকায় অন্ততপক্ষে একটা হলেও ফ্যাশন ইনস্টিটিউট গড়ে উঠবে। এবং বিপুল সংখ্যক দক্ষ জনশক্তি নিয়ে নতুন আঙ্গিকে বিশ্ববাজারে নিজেদের মেলে ধরবে।”

চলবে…


আগের ও পরের পর্বের লিঙ্ক<< আমার মেটিয়াবুরুজ (পর্ব – ১১)আমার মেটিয়াবুরুজ (পর্ব – ১৩) >>

লেখক পরিচিতি : অনুপম ভট্টাচার্য
এমন একজন, যে এখনো নিজের পরিচিতির খোঁজে রয়েছে। আশা করি জীবনের দৌড়ে ফিনিশিং পয়েন্ট আসার আগে তার অনুসন্ধান শেষ হবে।

শেয়ার করে বন্ধুদেরও পড়ার সুযোগ করে দিন

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।