লেখক : দেবাশিস চৌধুরী
শেখরের সাথে আমার বন্ধুত্ব আজ থেকে প্রায় তিরিশ বছর আগে থেকে। কলেজ স্কোয়ারের কফি হাউসে প্রথম আলাপ। ও তখন ছোট গল্প লিখত। বেশ ভালই লিখত। তার থেকেও ওর বড় বৈশিষ্ট্য ছিল মুখে মুখে গল্প বানানো। যে কোন স্থানে, যে কোন পরিস্থিতিতে। ওর এই অসাধারণ প্রতিভার কথা বন্ধু মহল, আত্মীয়দের গন্ডি ছাড়িয়ে বেশ জনপ্রচার পেল। রীতিমতো জনপ্রিয় হয়ে উঠল ও। এমনকি অনেক জায়গায় স্টেজ শোও করত।
আমার মেসের সহবাসিদের কাছে কথায় কথায় একদিন ওর প্রসঙ্গ উত্থাপন করলাম। দেখলাম, শেখরকে ওরা ভাল মতনই চেনে। আমার বন্ধু জেনে ওরা আগ্রহ প্রকাশ করল চাক্ষুষ ওর প্রতিভা দেখার।
অগত্যা শেখরকে নিয়ে একদিন মেসে এলাম। মেসের সবাই ওর সাথে পরিচিত হয়ে বেশ খুশিই দেখলাম। অনিল তো কালবিলম্ব না করে বলেই ফেলল, “আপনার কথা আমরা সবাই শুনেছি। আপনি তো মশাই মুখে মুখে গল্প বানান। তা কিছু নমুনা ছাড়ুন। আমরাও একটু প্রসাদ চেখে দেখি।”
খানিক ভেবে শেখর জবাব দিল, “ওটা তো আছেই। সেটায় পরে আসছি। জানেন এক বছর আগে আমার ব্রেন স্ট্রোক হয়। নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে ফিরে আসি। একটা সময় আমার হার্ট বীট বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সুস্থ হয়ে যাবার পর আমি আবিষ্কার করি যে আমার মধ্যে ঈশ্বর প্রদত্ত এক অলৌকিক ক্ষমতা এসে গিয়েছে। আমি কারুর মাথার ছায়া দেখে তার মৃত্যু দিন বলে দিতে পারি। গত এক বছরে আমি দু জনের মৃত্যু দিন আগাম জানিয়ে দিই। আপনারা হয়ত বিশ্বাস করবেন না দু জনেই নির্ধারিত দিনে মারা যান। একজন পথ দুর্ঘটনায় আর অপর জন হার্ট ফেল করে।”
ঘরে পিন পড়লে শব্দ পাওয়া যাবে এমন নিঃস্তব্ধতা। অনিল থাকতে না পেরে বলেই ফেলল, “তা আমাদের মৃত্যুর কথা বলতে পারেন নাকি?”
“পারি। কিন্তু যদি কোন খারাপ সংবাদ শোনেন তো আমায় কিন্তু দোষারোপ করতে পারবেন না। কারণ রুঢ় সত্য কথাটা আমি জানাতে বাধ্য হই। যদিও এটা আমার কখনোই ইচ্ছা নয় যে কেউ মারা যাক।”
“সে নিয়ে আপনি ভাববেন না। আরে আমাদের ইয়ং বয়স। আমাদের আবার কি হবে? নিন আপনি শুরু করুন।”
“ঘরের সব কটা আলো নিভিয়ে একটা মোমবাতি জ্বেলে দিন। আর আপনারা সবাই মোমবাতির সামনে গোল হয়ে বসুন।” তাই করা হল। আমরা উদগ্রীব হয়ে তাকিয়ে রইলাম শেখরের মুখের দিকে। কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে শেখর বোধহয় প্রার্থনা সেরে নিল। চোখ খুলে তাকাল প্রথম ব্যক্তির মুখের দিকে। তারপর তার ছায়া দেখে বলল, “আপনার এখনও অনেক আয়ু। বাহান্ন বছর সাত মাস।”
এরপর এক এক করে পাঁচ জনের আয়ু ভবিষ্যতবাণী করার পর দেবেশের দিকে চেয়ে থমকে থেমে গেল শেখর। বারবার ওর মুখ আর ছায়া দেখতে লাগল। অস্ফুট স্বরে বলে উঠল, “এনারটা আমি বলতে পারব না। আপনারা দয়া করে জোর করবেন না।”
“আপনি কি খারাপ কিছু সন্দেহ করছেন? বলুন না। কি হল চুপ করে রইলেন কেন?”
“বলছি তো আমায় জোর করবেন না।”
হঠাৎ দেবেশ গলা চড়িয়ে বলে উঠল, “আপনাকে বলতেই হবে। না বললে আপনাকে আমি ছাড়ব না। বলুন কত দিন আয়ু আমার। কম তো? বলুন।”
“ঠিক আছে আমি বলছি। কিন্তু পরে আপনারা আমাকে দোষারোপ করতে পারবেন না। দেবেশবাবু, আপনি কালকের সূর্য দেখতে পাবেন না।”
সবাই প্রায় চিৎকার করে উঠল, “মানে? কি বলছেন কি আপনি?”
“আমার এই দৈব শক্তি যদি সত্যি হয়, তো আমি বলছি যে আজ রাতেই উনি মারা যাবেন। কিভাবে তা জানি না। তবে নিশ্চিতভাবেই মারা যাবেন। আগেই বলেছি আমার গণনা ভুল হয় না।”
সারা ঘরটায় যেন শ্মশানের নিঃস্তব্ধতা ছেয়ে গেল। দেবেশের চোখ বেয়ে তখন নেমেছে জলের ধারা। খানিক পরে শেখর বলল, “আমি বলতে চাইছিলাম না। আপনারাই আমাকে জোর করলেন।”
অনিল একটু রূঢ় ভাবেই বলে উঠল, “দুর মশাই আপনি এখন আসুন। যা শোনালেন আমাদের, এরপর আর ভদ্রতা আশা করবেন না। আপনি এখন বেরোন। আপনাকে ডাকাটাই আমাদের ভুল হয়েছিল।”
শেখর আসন ছেড়ে উঠে গিয়ে ঘরের আলোটা জ্বালিয়ে বলল, “আমি যখন এসেছিলাম অনিলবাবু তখন আপনি আবদার করেছিলেন না আমার মুখে মুখে গল্প বানানোর প্রসাদ চাখবার। তা কেমন লাগল প্রসাদটা?”
আমরা সবাই হাঁ করে চেয়ে রয়েছিলাম শেখরের পানে। “মানে? এটা কি গল্প ছিল?”
“হ্যাঁ মশাই হ্যাঁ। আরে ধুর, আমি কি ভগবান নাকি যে কারুর মৃত্যু আগাম জানিয়ে দেব। ওসব কোন শক্তিই আমার মধ্যে নেই। জাস্ট মুখে মুখে একটা গল্প বানিয়ে ফেললাম। কেমন লাগল বললেন না কিন্তু।”
“অসাধারণ। শেখরবাবু একটা সাজেশন দিচ্ছি, আপনি সিনেমায় নামুন। বেশ নাম করতে পারবেন।”
লেখক পরিচিতি : দেবাশিস চৌধুরী
দীর্ঘকাল কর্মসূত্রে আমি লখনৌতে প্রবাসী। গল্প লেখাটা আমার একটা প্রিয় সখ। আমার গল্প পড়ে সবার মনোরঞ্জন হোক, এটাই আমার কামনা।
ভালো লাগলো গল্পটা।