লেখক : দেবাশিস চৌধুরী
একটা বাড়ি। একতলা। বেশ বড়। অনেক গুলো ঘর আছে তাতে। এই বাড়িটা স্বপ্নে প্রায়ই দেখেছি। ছ- সাতবার হবে। আর আশ্চর্য! প্রতি বারই একই রকম। কোন বদল ফের হয়নি। এক ঘর, এক জানলা, এক দরজা, এমনকি বাড়িটার রঙও প্রত্যেক বার সেই এক – কচি কলাপাতার। প্রচুর আলো বাতাস প্রবেশ করে বাড়িটায়। বাড়িটা যেন আমার মনে গেঁথে বসে গিয়ে ছিল।
এই বাড়িটার একটা ঘর আছে। বাড়িটার পিছন দিকের অংশে, দক্ষিণ পানে। অন্য সব ঘরের তুলনায় বেশ বড়। এর তিন দিকে দালান। দক্ষিণ দিকে তিনটে জানলা। সব কটি বন্ধ। তার পরেই বাঁশের বাঁখারি দিয়ে বানানো বাউন্ডারি। অপর দিকে বাঁশ বন। ঘরটার দরজাতে শিকল দেওয়া। আর তাতে ঝুলছে মস্ত একটা ভারি তালা। দুটো কাঠের পাটাতন আড়াআড়ি ভাবে দরজায় পেরেক দিয়ে ঠোকা। মানে এই ঘরে প্রবেশ করতে নিষেধ করা হচ্ছে। হয়ত কোন অশুভর সঙ্কেত।
প্রতিটা স্বপ্নে এই ঘরটাকেই বিশেষ করে দেখতাম। সামনে গিয়ে দাঁড়াতাম। ভিতর থেকে ফিসফিস করে কে যেন বলত, ‘এসেছিস? ভেতরে আসবি না? কত কাল তোকে দেখিনি। আয় না। দাঁড়িয়ে রইলি কেন?’
আপ্রাণ চেষ্টা করতাম পাটাতন দুটো খোলার। কখনও বা সফল হয়েছি। শিকলের তালা ভাঙ্গতে যাব, এমন সময় ঘুমটা ভেঙ্গে যেত। দেখতাম সারা শরীর ঘামে ভিজে জবজব করছে। উঠে বসে ভাবতে থাকতাম স্বপ্নটার কথা। কেন বারবার ঐ ঘরটাই দেখি? একই ঘর। কোন পরিবর্তন নেই। কে আছে ঐ ঘরের মধ্যে? আমাকে ভেতরে আসার জন্য কে অমন কাতর ভাবে ডাকে? আমার পরিচিত কেউ? গলা শুনে মনে হত কোন মহিলা। কে সে? কে? কে? কে? আর ভাবতে পারতাম না। মাথায় প্রচন্ড যন্ত্রণা অনুভব করতাম।
আমার বন্ধুদের বলতাম স্বপ্নটার কথা। ওরা হেসে উড়িয়ে দিত। বলত – ‘ওসব তোর মনের ভুল। বেশি চিন্তা করিস বলে ওরকম মনে হচ্ছে’। কিন্তু আমি নিশ্চিত জানতাম যে ওটা আমার মনের ভুল নয়। প্রত্যেক স্বপ্নে সেই একই বাড়ি! এতটুকু বদল নেই। এ কি করে সম্ভব?
শেষ বার স্বপ্নটা দেখার মাস ছয়েক বাদে আমার এক বন্ধু পার্থর দিদির বিয়ে হয় হুগলি জেলার শিবাইচন্ডি গ্রামে। বেশ বর্ধিষ্ণু গ্রাম। বৌভাতের আগের দিন তত্ব নিয়ে ওখানে যাই। আমি, পার্থ আর ওর ছোট ভাই বিমল। ঠিক ছিল সেদিনটা থেকে পরের দিন বৌভাত সেরে বাকি আত্মীয়দের সাথে ফিরব। আতিথেয়তায় কোন ত্রুটি রাখেননি পাত্রপক্ষ।
বৌভাতের দিন সকালে জলখাবার খেয়ে আমরা তিনজনে বেরিয়ে পড়লাম গ্রাম দেখতে। আমার কেন জানি না বারেবারে মনে হচ্ছিল জায়গাটা আমি চিনি। খুব ভাল করে চিনি। পথ-ঘাট, পুকুর, গাছপালা সবই খুব চেনা লাগছিল। অথচ আগে তো কখনও এখানে আসিনি। কেমন করে তাহলে এটা সম্ভব হল? পার্থকে আচমকা বললাম, ‘জানিস এটা সরকারপাড়া।’
‘তুই কেমন করে জানলি?’
কোন জবাব দিলাম না। ও রাস্তার ধারে একটা বয়স্ক লোককে ডেকে জিজ্ঞেস করল, ‘এটা কোন পাড়া?’
‘সরকার পাড়া গো।’
চমকে ও তাকাল আমার দিকে। চমকে আমিও গিয়ে ছিলাম। ও আমাকে জিজ্ঞেস করল, ‘তুই কি আগে কখনও এখানে এসেছিস?’
‘না।’
‘তাহলে জানলি কি করে যে এটা সরকারপাড়া?’
‘ঐ সিক্সথ সেন্স আর কি।’
হঠাৎই কিছুটা দূরে একটা বাড়ি চোখে পড়ল। পা চালালাম তার দিকে, বেশ জোরেই। পিছনে শুনতে পেলাম পার্থ বলছে, ‘কিরে অমন ঘোড়ার মতন দৌড় লাগালি কেন? দেবু, কি হল?’ কোন জবাব দিলাম না।
আমি তখন যেন নিশির টানের মতন বাড়িটার দিকে এগিয়ে চলেছি। এক সময় বাড়িটার সামনে এসে দাঁড়াই। এই তো সেই বাড়িটা। বারবার স্বপ্নে দেখা সেই বাড়িটা। কচি কলাপাতা রঙের। আশে পাশে আর কোন বাড়ি নেই। ভাল করে বাড়িটা দেখে নিশ্চিত হলাম যে এটাই আমার বারবার স্বপ্নে দেখা সেই বাড়িটা।
পার্থ আর বিমলের দিকে ফিরে বললাম, ‘তোরা বাড়ি ফিরে যা। আমি একটু পরে ফিরব।’
‘তুই কি এই বাড়িতে….।’
গলা চড়িয়ে বললাম, ‘আঃ যা বলছি কর। কথা বাড়াস না। চলে যা। যা বলছি।’
আমার কণ্ঠস্বরে এমন কিছু হয়ত ছিল যে ওরা আর দাঁড়িয়ে থাকার সাহস পেল না। বাড়িটার সদর দরজার সামনে এসে দাঁড়ালাম। তালা দেওয়া নেই। শুধুমাত্র একটা হুড়কো লাগানো। খুলে ভিতরে ঢুকতেই একটা ভ্যাপসা গন্ধে গাটা গুলিয়ে উঠল। সদর দরজাটা খোলাই রাখলাম।
ভেতরে তাকিয়ে দেখি আমার স্বপ্নের সাথে সব মিলে যাচ্ছে, হুবহু। কোথাও এতটুকুও অমিল নেই। নিজের গায়ে চিমটি কেটে পরখ করলাম, স্বপ্ন দেখছি কিনা। না, এতো বাস্তব। কিছুতেই বুঝতে পারছিলাম না যে এটা কিসের সঙ্কেত। ত্রস্ত পায়ে চলতে চলতে এসে দাঁড়ালাম সেই দক্ষিণ দিকের ঘরটার সামনে।
অবাক হয়ে চেয়ে রইলাম ঘরটার পানে। দুটো কাঠের পাটাতন আড়াআড়ি ভাবে দরজায় পেরেক দিয়ে ঠোকা। শিকলে মস্ত তালা। আমার বোধ শক্তি তখন হারিয়ে যাওয়ার উপক্রম। ধীর পায়ে দরজাটার একেবারে সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। কান পাতলাম ওটার গায়ে। কিছুক্ষণ পর স্পষ্ট শুনতে পেলাম ভিতর থেকে মহিলার কণ্ঠস্বর, ‘বাবু এসেছিস? ভেতরে আসবি না? আয় না, আয়। কত দিন তোকে দেখিনি। এতদিন পর মার কথা মনে পড়ল। আয় ভেতরে আয়।’
ছিটকে সরে এলাম দরজার সামনে থেকে। পাগলের মতন পাটাতন ভাঙ্গার জন্য কোন অস্ত্র খুঁজতে লাগলাম। কোণায় রাখা একটা জং ধরা লোহার রড দেখতে পেলাম। ঐটা দিয়ে চাগাড় মারতেই পাটাতনদুটো খুলে যায়। বার তিনেক ঘা মারতে বড় তালাটাও খুলে গেল। বেশ অবাক লাগল ভেবে যে এত সহজে সব খুলে গেল কি করে।
ধাক্কা দিয়ে দরজাটা খুলতেই একটা ভোঁটকা গন্ধ নাকে এল। অনেকটা পচা মাছের মতন। অন্ধকার ঘর। বাইরের স্বল্প আলো শুধু মাত্র এসে পড়ছে। সেই আলোতেই আবিষ্কার করলাম ঘরের মধ্যে আমি ছাড়া আর দ্বিতীয় কোন প্রাণী নেই। তাহলে কার কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম? কেন জানি না মনে হচ্ছিল এই ঘরটা আমার খুব পরিচিত। আগেও এসেছি।
অন্ধকারে তখন চোখটা বেশ সয়ে গিয়েছিল। চারিদিকে তাকিয়ে দেখলাম কয়েকটা আসবাবপত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা সারা ঘরে। তার মধ্যে মাঝারি সাইজের একটা খাট। নীচু হয়ে খাটের তলাতে উঁকি মারলাম। ফাঁকা। উঠে দাঁড়াতেই চমকে উঠলাম। দেখি খাটে শুয়ে সাদা কাপড় পরা এক মহিলা। শীর্ণ, সাদা চুল, অদ্ভুত চোখ দুটো। আমার দিকে দু হাত বাড়িয়ে দিল সে। হাতে এক চিলতেও মাংস নেই, শুধু হাড়।
‘বাবু। আয় কাছে আয়। মার কাছে আসবি না? তোর মা যে তোর পথপানে এতদিন চেয়ে বসে ছিল বাবা। কাছে আয়। আয়।’
আমার তখন সারা শরীর দিয়ে বিদ্যুতের তরঙ্গ বয়ে যাচ্ছে। মাথাটা ঝিমঝিম করছিল। পা দুটো প্রচন্ড ভারি লাগছিল। জোর করে টলমল পায়ে ছিটকে বেরিয়ে এলাম ঘরটা থেকে।
‘কিরে এখন কেমন লাগছে? দেবু?’
ভাল করে তাকিয়ে দেখি, আমি বিছানায় শুয়ে। পাশে পার্থ, বিমল আর ওর দিদির শ্বশুরবাড়ির লোকেরা।
পার্থর দিদির দেওরের সাথে আলাপ ছিল। নাম রবীন। আমাদেরই বয়সী। চোখাচোখি হতেই জিজ্ঞেস করল, ‘ঠিক লাগছে এখন?’
উঠে বসে জবাব দিলাম, ‘হ্যাঁ ঠিক আছি। কটা বাজে গো রবীন?’
‘পাঁচটা। কেন?’
‘আমি এখানে এলাম কিভাবে?’
পার্থ একটা সিগারেট ধরিয়ে বলল, ‘এক ঘন্টা হয়ে যাবার পরও তুই যখন ফিরলি না, তখন আমরা তোর খোঁজে ঐ বাড়িতে যাই। গিয়ে দেখি ভেতরের একটা ঘরের সামনে তুই অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছিস। এবার সত্যি করে বল তো বাড়িটার ভেতরে কি হয়ে ছিল?’
‘আরে কিসসু না। হবে আবার কি? এতদিন বাড়িটা বন্ধ ছিল তো তাই ভেতরে কোন গ্যাস ফর্ম করে ছিল বোধহয়। আর তাইতেই …।’
‘দেবু আমার খুব ভাল করে মনে আছে তুই একবার বলেছিলিস যে একটা বাড়ি তুই বারবার স্বপ্নে দেখিস। এটাই কি সেই বাড়ি?’
‘আরে ধুস। ওটা তো মজা করে বলে ছিলাম।’
‘ঠিক আছে। তা তুই এখন বিশ্রাম করবি না উঠতে পারবি? তেমন হলে না হয় …।’
‘আরে না রে আমি পুরো ফিট। তোরা তৈরি হ, আমি এক্ষুনি আসছি।’ এরপর রবীনের দিকে ফিরে বললাম, ‘রবীন ব্যস্ত নয় তো?’
‘না। কেন?’
‘তোমার ব্র্যান্ডের একটা সিগারেট খাওয়াও তো। বেশ খেতে।’
ঘরের মধ্যে তখন শুধু আমি আর রবীন। সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে রবীন প্রশ্ন করল, ‘কিছু জানতে চাইছ মনে হচ্ছে?’
‘হ্যাঁ। ঐ বাড়িটার সম্বন্ধে বলো। যা জানো সব বলবে। কিচ্ছু লুকাবে না। আমার জানা খুব প্রয়োজন।’
একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে রবীন বলতে শুরু করল, ‘বাড়িটা দেবু ভুতুড়ে। কেউ বাস করে না। এমনকি করতেও পারে না। ঐ বাড়ির একটি ছেলে আর্মিতে চাকরি করত। ১৯৬২র চীনের সাথে যুদ্ধে মারা যায়। ছেলের শোকে ওর মাও কদিন পরে মারা যান। তারপর থেকেই বাড়িটাতে একটার পর একটা অঘটন ঘটতে থাকে। কেউই ঐ বাড়িতে আজ অবধি টিঁকতে পারেনি। এমনকি আশেপাশের কোন মানুষজনও নয়। সবাই বলে যে ঐ বুড়ি নাকি ছেলের ফিরে আসার জন্য এখনও অপেক্ষা করছেন। যেদিন সে ফিরবে, সেই দিনই হয়ত তাঁর আত্মা শাস্তি পাবে। তা তুমি বাড়িটাতে কি দেখলে?’
কোন জবাব না দিয়ে বললাম,’আমাকে আরও একবার নিয়ে যেতে পারবে ওখানে?’
‘আবার যাবে?’
‘হ্যাঁ এক্ষুনি। কেন ভূতে ভয় পাও নাকি?
আমতা আমতা করে রবীন জবাব দিল, ‘না তা পাই না। তবে বলছিলুম কি….।’
‘তুমি না গেলে আমি একাই যাব। রাস্তা আমি চিনি।’
‘না না তা নয়। ঠিক আছে, চল যাচ্ছি। দাঁড়াও টর্চটা সঙ্গে নিয়ে নিই।’
রবীনের সাথে আবার বাড়িটার সামনে এসে দাঁড়ালাম। তখন সবে সন্ধের অন্ধকার নেমেছে। টর্চটা ওর হাত থেকে নিয়ে বাড়িটার ওপর ফেললাম। একটা সাঁই-সাঁই শব্দ করে বেশ জোরে বাতাস বয়ে গেল। অন্ধকার চিরে হঠাৎ যেন চারিপাশটা খুব উজ্জ্বল হয়ে উঠল। টর্চটা রবীনের হাতে ফেরত দিয়ে বললাম, ‘এবার তুমি বাড়ি ফিরে যাও রবীন।’
‘আর তুমি?’
‘আমি?’ আঙুল তুলে, ম্লান হেসে বাড়িটার দিকে দেখিয়ে বললাম, ‘আমি মার কাছে থাকব এখন থেকে।’
‘কি পাগলের মতন যাতা বকছ। চলো বাড়ি চলো। তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে নাকি?’
‘ভাল চাও তো বাড়ি ফিরে যাও রবীন। এক্ষুনি। আমি বলছি ফিরে যাও। যাও বলছি।’
‘না। তোমাকে না নিয়ে কিছুতেই নয়।’
হাঃ-হাঃ করে অট্টহাসি হাসতে থাকলাম। ‘তাহলে টর্চটা একবার আমার মুখের উপর ফেলে দেখো।’
কাঁপা হাতে রবীন টর্চটা জ্বালিয়ে আমার মুখের উপর ফেলল। দেখতে পেল – মাংসহীন একটা মুখ। শুধুই হাড়।
একটা চাপা গোঙানির শব্দ বেরিয়ে এল ওর মুখ থেকে। টলমল পায়ে উল্টো দিকে ফিরে ঊর্দ্ধশ্বাসে মারল ছুট।
আমি ধীরে ধীরে দরজা খুলে বাড়িটাতে প্রবেশ করে ডাকলাম, ‘মা, মা আমি ফিরে এসেছি। আর তোমাকে ছেড়ে কখনও যাব না মা।’
লেখক পরিচিতি : দেবাশিস চৌধুরী
দীর্ঘকাল কর্মসূত্রে আমি লখনৌতে প্রবাসী। গল্প লেখাটা আমার একটা প্রিয় সখ। আমার গল্প পড়ে সবার মনোরঞ্জন হোক, এটাই আমার কামনা।
দারুন হয়েছে। রাতে নিস্তব্ধ পরিবেশে বেশ লাগল
এটা অনেকটা রবি ঠাকুরের ‘নিশীথে’ গল্পের মতো।