ভেতরে ভীষণ শব্দ

লেখক : আলী ইব্রাহিম

ইতির জমিনে আজ আমি হেঁটে বেড়াই। ঘুরি। ফিরি।
অবাধ বিচরণ এই অরণ্যে। সবকিছু ছাড়িয়ে। উচ্ছল। উজ্জ্বল।
এই আমাজন একেবারে নিষ্কন্টক। আমার মতো। কবির মতো।
বাঘ নেই। সিংহ নেই। সাপ নেই। সাপুড়ে নেই।
এই জনপদে একটাই নদী। বয়ে চলে নিরবধি।
তার জল তুলে আমি মুগ্ধ হই। তার সুধায় স্নিগ্ধ হই।
এই নদীতে কুমির নেই। হাঙ্গর নেই। অজগর নেই।
তার স্রোতে একজন কবি ভালোবেসে আকাশ দেখে। সভ্যতা আঁকে।
কবিকে ভালোবেসে আলিঙ্গন করে কবি। বাঁচে অমরত্বের আকাঙ্ক্ষায়।
ইদানিং ঘুমের মধ্যেও সে আমার হাত জাপটে ধরে থাকে।
একজন কবি হারিয়ে যাবে ভেবে। পৃথিবীর সব আরাধনা ব্যর্থ হবে ভেবে।
ওর ধারণা, কবিরা হয়তো পারলৌকিক কোনো মানুষ নয়। কবিরা ঈশ্বরপুত্র।
কবিদের শুধু ভালোবাসতে হয়, কবিদের কষ্ট দিতে নেই। কষ্ট দিতে নেই!
কবিদের আগলে রাখতে হয়, অবহেলা করতে নেই। অপবাদ দিতে নেই!

ইতি আমার ঘর। এই ঘরটা একজন কবির মতো। ছবির মতো।
সুখগুলো সব আলোর সমান। খোলা উঠোনে ঈশ্বর আর্দ্রতা ছড়ায়।
বৃৃষ্টির পুনরুত্থানে কাঠবিড়ালির ছোটাছুটি। আলোকপাখি জ্বলছে এই ঘরে।
ওর দিকে তাকিয়ে মাঝে মধ্যে কাঞ্চনজঙ্ঘা হতে ইচ্ছে করে।
এখনও ঘুমের ঘোরে ওর দু’হাত ধরে স্ট্যাচু অব লিবার্টির মতো সুখি হই।
দিনশেষে রঙপাখিরা ঘর থেকে বের হয়। ঠোঁটে মেরুন লিপিস্টিক।
অথচ সুখি হবো ভেবে আমি দিনশেষে ফিরি তার উঠোনে। এই অরণ্যে।
এই ঘরে নিশ্চিন্তে ফিরতে কোনো অসুবিধা হয়নি আজও।
আমার কোনো জলা নেই। জমি নেই। এই অরণ্যই আমার সব।
রিকসায় চড়লে এখনও সে নিরাপদ বেষ্টনিতে আমার হাত ধরে থাকে।
আমি তখন পাখি হই। কবি হই। ভালোবাসা আমাকে বিপ্লবী করে তোলে।

সেই মুঠোফোনে রাত জেগে কথা বলে যখন প্রেম করতাম,
তখনকার সেই মুখের হাসি এখনও তেমনি অবিচল। বয়ে চলে এই নদীতে।
সারাক্ষণ পাহারা দেয় এই পৃথিবী। কিছু না পাওয়ার মাঝেও যে সুখ আছে,
তার সাথে ঘর না করলে এটা বুঝতাম না।
শুধু দায়িত্ব পালন করার মাঝেও যে জীবন ধন্য হয়,
খুব কাছ থেকে তাকে না দেখলে কখনও বিশ্বাস করতাম না।
জড়তা নেই। অবসাদ নেই। কষ্ট নেই। কবির আকাক্সক্ষায় সুখি হয় সে।
আমি দেবী দেখিনি। আমি হুরপরী দেখিনি। আমি ইতিকে দেখেছি।
আমি ঈশ্বরকে দেখিনি। তোমাকে দেখেছি। তোমাকে দেখেছি।

জলসভ্যতায় আজকাল কত পাখি ওড়ে! বাইরে বাসন্তী কোকিলের ওড়াউড়ি।
আকাঙক্সক্ষার সহস্রতায় ডুবসাঁতার কাটে ফাগুন। ভেতরে কষ্টের আস্তরণ।
ঘোড়ার পিঠে তারারা প্রাতুর্য পাল্টায়। বৈশিষ্ট্য বদলায়। লালবাগে প্রান্তিক উৎসব।
টিএসসিতে শূন্যতার বড় বড় গর্ত। আর জলগুলো থাকে এই অরণ্যে।
এতো স্নিগ্ধতা! এতো হাসি! সেই লাবণ্য! মুখভর্তি কবিতা। ঠোঁটভর্তি উপমা।
গালভর্তি অযোধা। পৃথিবীতে আমি কোনো জলপাখির মধ্যে এসব দেখিনি।
আমি হিমালয় দেখিনি। আমি ইতিকে দেখেছি। আমি কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখিনি।
আমি প্রশান্ত মহাসাগর দেখিনি। আমি তাকে দেখেছি। তাকে দেখেছি।

কবিরা আজকাল ইতিহাস পাঠের মাঝেও স্বকীয়তা খোঁজে।
সত্যিকারের প্রেমিক হতে গিয়ে মুখ কচলায়। সভ্যতায়।
সত্যিকারের সাধক হতে গিয়ে সবকিছু হারায়। অক্ষমতায়।
তাই অভিধানে এখন আর কবিতা শব্দের মূর্খতা খুঁজি না।
কোনো কবিবন্ধুর সাথে দেখা হলে আর জিজ্ঞেস করি না
আচ্ছা, কবিতা শব্দের যুৎসই কোনো সংজ্ঞা খুঁজে পেলে!
এখন আমি ইতির মধ্যে কবিতা খুঁজি। তার ভেতরে ভীষণ শব্দ করি।
এখন আমি তার মধ্যে জীবনের সার্থকতা কুড়াই। হৃদয় জুড়াই।
তার মধ্যে ডুব দিয়ে দেখি ঈশ্বরের সমস্ত সৌন্দর্য।
পৃথিবী দেখি। পাহাড় দেখি। ঝরনা দেখি। লতাপাতা দেখি।
শেকড় গুল্ম বৃক্ষ দেখি। ছায়ার মতো সারাক্ষণ আমাকে আগলে রাখে।
অথচ রাজ্যের ভেতরে শুভ্রতা পোড়ার গন্ধ। আমি রাষ্ট্রের দুর্বলতায় ডুবে যাই।
আমি তার পাশবিক অত্যাচার উপলব্ধি করি। ভেতরে ঘুরি। ভেতরেই উড়ি।
এই একটি সাম্রাজ্যে একজন কবি অসহায়। তবু নির্দ্বিধায় জলের জীবন আঁকে।

অথচ এই বিষাক্ত নগরে কতরকম মানুষ! রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় প্রাতুর্য বাড়ায়।
কতরকম উদ্দেশ্য তাদের। গিরগিটি স্বভাবে বড় হয় লোভ। ঘৃণায় ক্ষতবিক্ষত!
ভ্রান্তির আগুন ছড়াতে ভালোবাসে রাজনীতি। কুকুরগুলো তবু আগের মতোই আছে।
আগের মতোই বাঁচে। বিড়ালগুলোও আগের মতোই হাঁটে। খায়। হাগে। মাগে।
বাঘও তার থাবার ধরন পাল্টায়নি শুনেছি। অথচ ইঁদুর স্বভাবে বড় হয় মানুষ।
প্রয়োজন হলেই অফিসের কাগজপত্র কাটে। ভেতরে এক। বাইরে আরেক।
সুযোগ বুঝে ছোবল মারে। উলু দিয়ে গলা ধরে। তাদের ঘরে মখমল শীত।
প্রয়োজনে কাঁদে। প্রয়োজনে হাসে। স্বভাবগুলো বিড়াল হয়। মিউমিউ করে।
বোধগুলো কুকুর হয়। ঘেউ ঘেউ করে। মানুষগুলো রাতে সাপ হয়।
খোলস বদলায়। ইতিহাস গড়ে। কাছে থেকেও অনেক দূরে। চেনা মুশকিল।
কবিরা আজকাল মানুষের সংজ্ঞা দিতে ভুল করে। মানুষগুলো সরীসৃপ হয়।
মানুষগুলো সত্যের মতো সুন্দর করে মিথ্যা বলে। হাওয়ায় চলে। এই শহরে।
ভেতরে ভীষণ শত্রুতা। আর বাইরে গলায়গলায়। এই ঈশ্বর! এই শয়তান!

অথচ ইতির ভেতরে যা, বাইরেও তাই। সে এখনও সাদা কালোয় সাবলীল।
ওকে কোনো দিন বিড়াল হতে দেখিনি। ওকে কোনো দিন বাঘ হতে দেখিনি।
সেই প্রথম দিনের হাসি আজও লেগে আছে। অমলিন। নিরহঙ্কারে উত্থিত।
সংসারে। স্বপ্নে। সুখে। স্বস্তিতে। বিশ্বাসে। আপাদমস্তক স্বপ্নিল।
শহরের বিভীষিকা তাকে স্পর্শ করে না। স্বর্গের প্রতিভায় আগলে রাখে আমাকে।
একশ’ এক বছর পরেও কবি হয়ে এই ঘরে ফিরতে কোনো অসুবিধা হয় না আমার।
এই একটি ঘর একদম আরামদায়ক। ঘুমের মতো প্রসারিত। থাকে কাব্যসুধায়।
ইতি কবিতা না লিখেও মহাকবি হয়েছে। দ্বিধা নেই। দ্রাঘিমা নেই। দম্ভ নেই।
শুধু বুক পেতে দিতে পারে নিখাদ ভালোবাসা। সংসারী দায়িত্বে অবিচল।
ওকে দেখে মাঝে মধ্যে বৃক্ষ হতে ইচ্ছে করে। মানুষ হতে ইচ্ছে করে।
ওর গভীরতায় ডুব দিয়ে মাঝে মধ্যে সমুদ্রকে অনেক ছোট মনে হয়।
আমার কবিতাগুলো ক্রমশ নিস্তেজ হয়ে যায় ওর পার্থিবতায়।

তার মতো জলমানুষ দ্বিতীয়টি পৃথিবীতে আছে কিনা আমার জানা নেই।
পরিবারের অমতে বিয়ে করেছিল বলে প্রথম দিন শুধু বলেছিল,
আমার দু’হাত ধরার মতো কিন্তু আর কেউ রইলো না আলী!
শুধু এইটুকু অনুরোধ, কখনও আমার হাত ছেড়ো না। হাত ছেড়ো না।
কষ্ট দিবে, দাও। মাথা পেতে নেব। ভালোবাসা চাও, বুক উজার করে দেবো।
সন্ন্যাসী হতে চাও? এই অরণ্যে হও। বাউল হতে চাও? এই ঘরে হও।

একজন কবি সুখি হওয়ার স্বপ্নে সে সুখি হয়। আমাকে প্রবোধ দিয়ে প্রায়ই বলে,
আমার চাকরিতে আমরা এই বেশ চলে যাচ্ছি তো! তুমি এ নিয়ে চিন্তা করো না।
তুমি কবি হও। তুমি লেখক হও। যা খুশি তাই হও। আমি কিচ্ছু বলবো না।
শুধু অনুরোধ, আমাকে ছেড়ে যেও না। আমাদের মেয়ে ইরাকে বাবাহীন করো না।
প্রেম করে পরিবারের অমতে বিয়ে করে একটি মেয়ে কতটা অসহায় হতে পারে
সেদিন তাকে না দেখলে আমার জানা হতো না। জানা হতো না।


লেখক পরিচিতি : আলী ইব্রাহিম
সহকারী সম্পাদক, দৈনিক করতোয়া, চকযাদু রোড, বগুড়া, বাংলাদেশ।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।

লেখা আহ্বান - বিস্তারিত জানতে ছবিতে ক্লিক করুন