লেখক : প্রিয়াংকা রাণী
।। ১ ।।
সূর্যের আলো তখন বারান্দার দরজার হালকা পর্দা ভেদ করে এসে রুমের ভেতরটা আলোময় করে তুলেছে। আমিশা তখনও শুয়ে ছিল। ঘুমটা ভেঙেছে কিছুক্ষণ আগে।
ঘড়িতে অ্যালার্মটা বাজতেই আমিশা উঠে বসল। সাইড টেবিলে রাখা ঘড়ির অ্যালার্মটা বন্ধ করে দিল। সাথে সাথে চোখ পড়লো টেবিল ল্যাম্পটার দিকে। হালকা আলো এখনো সাইড টেবিলের আশপাশ জুড়ে বিদ্যমান। সকাল হওয়ার কারণে আলোর খেলাটা ঠিকমত বোঝা যাচ্ছে না। ল্যাম্পটার বেসমেন্টে জুড়ে দেওয়া সুইচটা বন্ধ করতে গিয়ে হাসি দিল। সুইচটাতে রং লেগে রয়েছে। এ আর নতুন কি ? প্রতি সকালেই এমনটা ঘটে। তার বাবার হাতে লেগে থাকা রংতুলির রং লেগে থাকে সুইচটাতে। প্রতি রাতে টেবিল ল্যাম্পটার হালকা আলো জ্বালিয়ে দিয়ে আমিশাকে তিনি ঘুম পাড়ান। আর ঐ সুইচ চাপ দিতে গিয়েই রং লেগে যায় । আমিশা তার হাতের বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে মুছে নেয় রংটুকু। তারপর সুইচ চাপ দিয়ে ল্যাম্পটার আলো নিবিয়ে দেয়।
আমিশা এরপর তাড়াতাড়ি বিছানা ছাড়ে। ইউনিভার্সিটি যাওয়ার জন্য তৈরি হতে হবে। সকালে তার বাবা থাকেন না। বাইরে বের হয়ে পড়েন খুব ভোরে। খুবই ব্যস্ত কিনা তাই। হবেই বা না কেন? খুব নামকরা চিত্রশিল্পী বলে কথা। সারাদিন ব্যস্ততা কাটে তার ছাত্রছাত্রী, প্রজেক্ট ইত্যাদির সাথে। এরপর বাসায় আসলে ব্যস্ত হয়ে পড়েন ক্যানভাস আর রংতুলির সাথে। আমিশাও তার ইউনিভার্সিটির ক্লাস, পরে কোচিং শেষ করে আসতে আসতে বিকেল গড়িয়ে যায়। বাসায় এসে আমিশা প্রথমে একটু তার বাবার পেইন্টিং রুমে গিয়ে বাবার কাজগুলো দেখে। আর কিছু গল্প সারে।
রাত্রি তখন প্রায় এগারটা। আমিশা তখনও জেগে । বিছানায় দেয়ালের সাথে লাগানো বালিশে হেলান দিয়ে বই পড়ছে। প্রতিদিনই সে এই সময়ে কিছুক্ষণ বই পড়ে। কিছুক্ষণ বলতে পনের থেকে বিশ মিনিট। এ সময়টুকু শেষ হতে বেশিক্ষণ নেই। আমিশা তার মোবাইল ফোনে একটা অ্যালার্ম দিয়ে রাখে সবসময়। কারণ এরপর সে তার বাবার সাথে কিছুটা সময় কাটায় পেইন্টিং রুমে।
অ্যালার্মটা বেজে উঠেছে। আমিশা হাতের বইটা রেখে দিয়ে উঠে পড়ে। রুম থেকে বের হয়ে তাড়াতাড়ি তার বাবার পেইন্টিং রুমের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। রুমে গিয়ে দেখে তার বাবা পেইন্টিং নিয়ে ব্যস্ত।
‘আসবো,বাবা……’
‘আমিশা, আয় মা……’
‘কি করো মনোযোগ দিয়ে?’
‘সামনে একটা এক্সিভিশন আছে বুঝলি।’
‘তাই………’
‘হুম।’
‘এবার কি বিষয় নিয়ে ?’
‘সুইচ………’
‘সুইচ!’
‘হুম’
‘অদ্ভূত বিষয়।’ আমিশার বাবা হাসলেন। হাতে রং লেগে থাকা তুলিটা রেখে বললেন, ‘চল, ঘুমাবি। ‘
আমিশা বাবার হাত ধরে হাঁটতে থাকে। একটু পর আমিশার বাবা বললেন, ‘এবারের এক্সিভিশনে পাঁচটা ছবি দেব ঠিক করেছি।’
‘তাই বাবা………’
‘হু, একটা ছবি তোর জন্য। ওটা বিক্রি করে যা আসবে তা তোর। আর বাকি চারটা আমার ড্রইং স্কুলের জন্য ।
‘এক্সিভিশন কবে বাবা?’
‘সামনের মাসে।’
কথা বলতে বলতে আমিশা তার বাবাকে নিয়ে রুমে এসে পড়ে।
‘এবার শুয়ে পড়্, মা।’
আমিশা বিছানায় শুতে শুতে বলে, ‘আমি কি ছোটটি আছি এখন। তুমি এখনও আমায় ঘুম পাড়িয়ে দাও।’
‘অভ্যেস হয়ে গেছে রে, মা।’ আমিশার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলেন আমিশার বাবা।
‘হুম।’
কিছুক্ষণ পর আমিশা ঘুমিয়ে পড়ে। আমিশার বাবা রুমের লাইট নিভিয়ে দেন। আর প্রতিদিনের মতো সাইড টেবিলে রাখা টেবিল ল্যাম্পটা জ্বালিয়ে দেন রং মাখা হাত দিয়ে।
।। ২ ।।
দুই সপ্তাহ পর………
সকাল বেলা। আমিশা তখনও ঘুমিয়ে ছিল। তার বাবার এক্সিভিশন আজ থেকে শুরু হয়েছে। বিকেলে বাবার সাথে সে এক্সিভিশন দেখতে যাবে। দিনটা ছুটির দিন । তাই আমিশা ভাবলো, আজ না হয় একটু দেরি করেই ঘুম থেকে উঠি। হঠাৎ বালিশের কাছে রাখা ফোনটা বেজে উঠে। আমিশা ঘুম ঘুম চোখে ফোনটা রিসিভ করে।
ফোনটা কানে ধরে রেখেছিল সে কয়েক মিনিট। ওপাশ থেকে ভারী গলার মানুষের কণ্ঠ শোনা যাচ্ছে।
‘হ্যালো, আমিশা বলছেন? ‘
‘বলছি।’
‘আপনার বাবা একটা অ্যাক্সিডেন্ট করেছেন। ‘
‘অ্যাক্সিডেন্ট!!!’ আঁতকে উঠলো আমিশা। ‘কোথায় বাবা?’ শোয়া থেকে উঠে বসলো সে।
‘সিটি হসপিটালে।’
আমিশা দ্রুত বের হলো বাড়ি থেকে। হাসপাতালে বাবার কেবিনের সামনে দাঁড়ালো সে। দেখলো, তার বাবার পুরো মুখ জুড়ে ব্যান্ডেজ। রক্তে ভিজে আছে ব্যান্ডেজের বিভিন্ন অংশ। আমিশা কাঁদতে লাগলো অঝোরে। সিনিয়র ডাক্তার এসে জানালো, মাথায় একটা বড়ো ধরনের আঘাত পাওয়াতে অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। তাঁরা চেষ্টা করছেন। তবে কিছুই বলা যায় না। এদিকে গণমাধ্যম ইতোমধ্যেই খবর টেলিকাস্ট করা শুরু করে দিয়েছে।
আমিশা যেন চারপাশ জুড়ে সব অন্ধকার দেখতে লাগলো। এদিকে ডাক্তাররা তার বাবার কেবিনে আসা-যাওয়ার মধ্যে আছে। ডাক্তারদের মুখভঙ্গি, কথাবার্তা সবকিছু আমিশাকে যেন আরও ভয়ংকর কিছু শোনানোর অপেক্ষায় রাখছে। পুরো রাত্রি পার হয়ে গেল। কিন্তু অবস্থার কোন উন্নতি হয়নি। শেষে পরদিন দুপুর পার হতেই ভয়ংকর বার্তা এল আমিশার কাছে। হাউমাউ করে কাঁদার শক্তিও বোধ হয় হারিয়ে ফেলেছিল আমিশা।
এর দুইদিন পর আমিশা নিজেকে আবিষ্কার করলো তার বাবার পেইন্টিং রুমে। কেউ একজন তাকে ডাকছে বুঝতে পারলো সে। তাকিয়ে দেখল তার পরিচিত এক বন্ধু। সাথে আরও কয়েকজন। আমিশা আবারও কান্না শুরু করে দিল। তার বন্ধুরা সবাই মিলে তাকে শান্ত করতে চেষ্টা করতে থাকলো।
দুপুরের পর আমিশা তার বেডরুমে গেল। বেডরুমে ঢুকতেই চোখে পড়লো সাইড টেবিলে রাখা টেবিল ল্যাম্পটা। তখনও মৃদু আলোতে চারপাশ জুড়ে অন্য এক পরিবেশ বিদ্যমান। আমিশা ধীরে ধীরে তার কাছে গেল। টেবিল ল্যাম্পটার কাছে যেতেই আবারও ডুকরে কাঁদতে লাগলো আমিশা। বেইসমেন্টের সুইচে লেগে থাকা রং তার দিকে তাকিয়ে আছে অসহায়ের মতো। সুইচটা চাপ দিতে গিয়েও দিতে পারলো না আমিশা।
।। ৩ ।।
কয়েক সপ্তাহ পর……
আমিশার ফোনটা বেজে উঠেছে।
‘হ্যালো।’
‘হ্যালো, আমিশা বলছেন………’
‘বলছি……’
‘আমরা এক্সিভিশন কমিটি থেকে বলছি। আপনার বাবা তাঁর একটা ছবি আপনার জন্য করেছিলেন। ঐ ছবিটা এক ব্যবসায়ী কিনতে চাইছেন। উনি এক লাখ দিয়ে কিনতে চাইছেন। আমরা কি আর একটু দেখবো নাকি তাকেই ছবিটা দিয়ে দিব?’
আমিশা এক মুহূর্ত ভাবলো। সাথে সাথেই বললো, ‘নাঃ, দেবেন না। ঐ ছবিটা আমি একবার দেখতে চাই।’
‘অবশ্যই । কখন আসবেন আপনি?’
‘এক্ষুনি আসছি।’
আমিশা ফোনটা রাখল আর দ্রুত বের হয়ে গেল। বিশ মিনিটের মধ্যেই আমিশা পৌঁছলো নির্ধারিত জায়গায়। এক্সিভিশন কমিটির লোক এসে তাকে নিয়ে গেল। তারপর ছবিটা দেখালো আমিশাকে।
‘এই ছবিটাই আপনার।’ বললো একজন।
দেয়ালে ছবিটা দেখলো আমিশা। হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো ছবিটার দিকে। এ তো তার কাছে শুধু ছবিই নয়। সেই ঘুমন্ত রাজকন্যা, সাথে আলোখেলানো টেবিল ল্যাম্প আর তার বেইসমেন্টের সুইচে লেগে থাকা রং, রাজকন্যার বাবার রঙিন হাত— এ কি শুধু ছবিই হতে পারে আমিশার জন্য? ছবির নিচে ক্যাপশনটাও পড়লো। সুইচ: এক রাজকন্যা আর বাবার প্রতিরাতের গল্প।
আমিশার চোখ তখন জলে টইটুম্বুর হয়ে আছে। মনে মনে বলছে। এ ছবি বিক্রি হবে না। কোনভাবেই না। ফ্রেম বন্দী এ ছবি যে আমার স্তব্ধ হয়ে যাওয়া জীবনের প্রতিরাতের গল্প আর তার প্রতিচ্ছবি।
লেখক পরিচিতি : প্রিয়াংকা রাণী
আমি প্রিয়াংকা।জন্ম বাংলাদেশের চট্টগ্রামে। পড়াশোনা করেছি চট্টগ্রামেই। গল্প, উপন্যাস পড়তে ভালবাসি। আর ভালবাসি গল্প লিখতে। পড়াশোনা করা অবস্থায় স্কুল,কলেজ ম্যাগাজিনে তিনবার আমার লেখা গল্প ছাপানো হয়েছিল।বর্তমানে বাস করছি ইতালিতে। আমার লেখা গল্প পড়ে ভালো না খারাপ লাগলো তা জানালে অনেক বেশি ভালো লাগবে।
ভালো লাগলো।
ধন্যবাদ
বাবা মেয়ের অসাধারণ গল্প।
thanks
Khub shundor apu❣️
thanks
Khub shundor apu❣️
thanks
heart touching story. good job, writer.
thanks