পূর্বজন্মের জীব

লেখক : রুবাই শুভজিৎ ঘোষ

।।১।।

এতক্ষণে তার খেয়াল হল সে পথ হারিয়েছে জঙ্গলে। কিসের একটা মোহে সে গভীরে, আরও গভীরে প্রবেশ করেছিল জঙ্গলের। ফিরতে পারবে কি পারবে না সে চিন্তাই করেনি। প্রথমত বিকেলবেলায় হরিণ দেখার লোভে তার আসাই উচিত হয়নি। আকাশটা কালো হয়ে আসছে এখন। কিছুটা সন্ধ্যে হবে বলে, বাকিটা মেঘের জন্য। দ্বিতীয়ত এসেই যখন সে পড়েছিল, তাহলেও জঙ্গলের এতটা ভিতরে তার ঢোকা উচিত হয়নি। জঙ্গলের ব্যাপারে সে একেবারে আনকোরা। বলতে গেলে এটা তার প্রথমবার জঙ্গলে আসা। তাও আবার একা। এখন সে ভাবছে পুরো সিদ্ধান্তটাই ভুল ছিল তার। কিন্তু কেন সে এরকম একটা সিদ্ধান্ত নিল, আর তার পরিণতিই বা কি, সেটা সে বুঝেছিল পরে।
বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুর স্টেশন থেকে পনেরো-ষোলো কিলোমিটার দূরে জয়পুরের জঙ্গল। বিষ্ণুপুর স্টেশনে জয়ের জন্য গাড়ী অপেক্ষা করছিল। স্টেশনে নেমে আধ ঘণ্টার ভিতরেই গাড়ী করে সে পৌঁছে গেল জঙ্গলের ধারের একটা রিসর্টে। এখানে পৌঁছতে দুপুর হয়ে গেছিল। এখন কড়া রোদ। রিসর্টে পৌঁছে একটু বিশ্রাম নেমে ঠিক করেছিল জয়। একদম সকালের ট্রেন ছিল তার, তাই স্নান করা হয়নি। বাথরুমে টাওয়েল, বডি ওয়াশ রাখাই ছিল। স্নান সেরে জয় টাওয়েলটা কোমরে জড়িয়ে বেরিয়ে এলো বাথরুম থেকে। এসি-টার টেম্পারেচার নিজের মত করে বাড়িয়ে কমিয়ে নিল। খিদে পেল তারপর। রুমে দরজার পাশেই দেওয়ালে আটকানো টেলিফোনটা থেকে তার রুমের সার্ভিসে থাকা মায়াকে ফোন করল। রিসর্টে পৌঁছে মায়াই তাকে তার রুম দেখিয়ে দিয়ে গেছে। মায়ার নাম্বারটা ডায়াল করল জয়। রুমের সঙ্গে লাগোয়া ডাইনিং রুম। সেখানে রাখা খাবারের মেনুকার্ডটা থেকে নিজের পছন্দসই খাবারের অর্ডারটা দিল জয়। খাবার আসতে মোটামুটি আধঘণ্টা থেকে চল্লিশমিনিট। সে সময়টুকু জয় রুমের বাইরেটা বসবার জন্য বেরোল। রুম থেকে বেরোতেই সামনের রুমের ট্যুরিস্টটার সাথে চোখাচোখি হয়ে গেল জয়ের। জয়কে দেখে সৌজন্যসুলভ একটা হাসি দিল লোকটা। কিন্তু জয় কোনও সৌজন্য দেখাল না। লোকটার প্রতি অজানা ঘৃণায় তার মন ভরে গেল। অজানা ভয়, অজানা ক্রোধ। কেমন একটা অস্বস্তিতে জয় থাকতে না পেরে রুমের ভেতরে চলে এলো। খাবার আসতে তখনও কিছুটা দেরী আছে। সেই সময়টুকু বিছানায় শুয়ে সে টিভিটা চালিয়ে দিল। কিছুক্ষণ পর তার খাবার চলে এলে খাবার খেয়ে দরজাটা বন্ধ করে একটুখানি শুলো সে। এই নিস্তব্ধ আর আরামদায়ক পরিবেশে কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ল জয়।
 
দুটো হরিণ জঙ্গলের মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে, পরস্পরের প্রতি সোহাগ প্রকাশ করছে, খেলা করছে। সূর্য অস্ত যেতে আর কিছুক্ষণ। দল থেকে একটু দুরত্বেই আছে সদ্য যৌবনপ্রাপ্ত এই দুজন। আচমকা একটা শব্দে দুজনেরই কান খাড়া হয়ে উঠল। প্রচণ্ড বেগে ছুট লাগাল দুজনে। কিন্তু হঠাৎই কিছু একটা ওদের গতির চেয়ে বহুগুণ বেয়ে ধেয়ে এসে বিদ্ধ করল ওদের একজনকে। সেই হরিণটা ছিটকে পড়ল মাটিতে। আর ঘুম ভেঙে ধড়ফড় করে উঠে বসল জয়।
 
ঘাড়ের কাছে যন্ত্রণাটা যেন টাটকা লাগছে এখনও। অনেকদিন পর স্বপ্নটা দেখল সে। আগে ছোটবেলায় এরকম স্বপ্ন দেখত। ঘুম ভেঙে যেত ভয়ে। কিসের ভয় সে বুঝতে পারেনি কোনওদিন, আজও পারল না। কিন্তু সেই ছোটবেলায় ভয়টা মনের গভীর থেকে কয়েক মুহূর্তের জন্য বেরিয়ে এল, এখন আবার মনের গভীরেই চলে গেল। কিন্তু কেমন একটা অস্বস্তি রয়েই গেল। এসির আরামদায়ক পরিবেশেও সে আরাম পাচ্ছে না। পায়ের ওপর থেকে চাদরখানা সরিয়ে ফেলল। নেমে এলো বিছানা থেকে। দরজা খুলে বাইরে যাবার জন্য পা বাড়াতেই আচমকা বুকটা ধড়াস করে উঠল তার।
দরজার সামনেই দাঁড়িয়েছিল মায়া। জয় দরজাটা খুলতেই জিজ্ঞেস করল, “কিছু লাগবে স্যার?”
“না! তুমি এখন?”
“কিছু লাগবে কিনা জানতে এসেছিলুম। ঘুমোচ্ছিলেন?”
“হ্যাঁ।”
“জঙ্গল দেখতে যাবেন না ?”
“হরিণ দেখার তো খুব ইচ্ছে। কিন্তু এত বিকেলে কি যাওয়া ঠিক হবে?”
“এখনও তো বিকেল হয়নি। ”
জয় আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখল আলো আছে যথেষ্ট। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল পৌনে চারটে। দুপুরটা সবে পড়েছে।
“ঠিক আছে।” জয় বলল, “কিছু লাগলে আমি ফোন করে নেব।”
“ঠিক আছে স্যার।” মায়া যাবার জন্য পেছন ফিরল। যাবার আগে বলল, “তবে এখন জঙ্গলে গেলে হরিণ ঠিক দেখতে পাবেন স্যার।”
মায়াকে কেমন যেন চেনা চেনা লাগছে জয়ের। সেই প্রথম দেখা থেকেই। চেনা লাগছে না ভালো লাগছে সেই পার্থক্যটা ধরতে পারল না সে। মায়ার চোখদুটো কেমন যেন মায়াবী, আর হাসিটাও। জয়ের মনে হল কোথাও যেন সে দেখেছে এগুলো। কিন্তু মনে করতে পারল না। তবে এ নিয়ে আর বেশি ভাবনাচিন্তা না করে রুমে তালা লাগিয়ে সে জঙ্গলের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ল। রাস্তার দুধারেই জয়পুরের এই ঘন জঙ্গল। রিসর্ট থেকে বেরিয়ে রাস্তা পাড় করে জঙ্গলে ঢুকতে হয়, অথবা রিসর্টের পেছন দিক দিয়েও জঙ্গলে প্রবেশ করা যায়। জয় রিসর্টের পেছন দিকটা ধরল।
মাটির রাস্তা ধরে হেঁটে চলল সে। এ রাস্তাটা তার কেমন চেনা লাগছে আজ, অথচ সে কোনোদিন এই দিকে আসেনি। অবশ্য রাস্তাটা চেনা লাগছে না ভালো লাগছে সেই পার্থক্যটা করতে পারল না সে। প্রথম প্রথম দু একজনকে দেখতে পেলেও কিছুক্ষণ পর রাস্তা পুরোই ফাঁকা পেল সে। আসলে সে অনেকটাই ভেতরে চলে এসেছে। চারিদিকে এখন চুপচাপ। চুপচাপ না বলে বলা উচিত রাস্তাঘাট, রিসর্ট, মানুষজনের শব্দগুলো এখানে উধাও হয়ে গিয়ে শুধুই জঙ্গলের নিজস্ব শব্দ।
জয় মোহিতের মত এগিয়ে চলল জঙ্গলের আরও ভিতরে। দূরে গাছের আড়ালে হরিণের মত প্রাণীটাকে দেখে সেদিকে এগিয়ে গেল সে। চোখের নিমেষেই সেই প্রাণীটা পলাতক। তার পালানোর পায়ের আওয়াজ শুনে জয় তার পিছু নিল, কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই বুঝতে পারল এই ক্ষিপ্রগতির প্রাণীটার সাথে সে পেরে উঠবে না। কিন্তু একটা জেদ, একটা আনন্দ তাকে পেয়ে বসল। এত দূর এসে সে হরিণ না দেখে যাবে না। আবার অদেখা সেই হরিণটার সাথে লুকোচুরি খেলতেও ভালই লাগছে তার। লুকোচ্ছে অবশ্য হরিণটাই। কিন্তু জয়ের কেমন যেন সেটা চেনা চেনা লাগছে। তবে চেনা লাগছে না ভালো লাগছে সেটা অন্যগুলোর মতই বুঝতে পারল না জয়।
আকাশে প্রচণ্ড মেঘের গর্জনে এবার মুখ তুলে চাইল সে। আকাশটা কালো হয়ে আসছে। কিছুটা মেঘের কারণে, বাকিটা সন্ধ্যে হবে বলে। পায়ের কাছে জ্বালা আর হাল্কা ব্যথা করছে।  পায়ের দিকে তাকিয়ে দেখল, রুমে যে চটিটা ছিল, বিছানা থকে নেমে সেটাই পায়ে গলিয়ে চলে এসেছে। জঙ্গলের বিভিন্ন গাছের কাঁটায় লেগে দুটো পা’ই ছড়ে গিয়ে হাল্কা রক্তারক্তি হয়ে গেছে। ঘুম ভাঙ্গা থেকে তার যেন হুঁশ ছিল না। আকাশে মেঘের গর্জনে তার হুঁশ এলো। কিন্তু হুঁশ ফেরার সাথে সাথেই সে বুঝল মোহিতের মত, অবশের মত রাস্তা না বুঝে, না চিনে সে চলে এসেছে জঙ্গলের অনেকটা ভিতরে। আর ফিরতে গিয়েই বুঝল সে পথ হারিয়েছে।

।।২।।

কলকাতার অফিসে চাকরি করে জয়। কাজের চাপে শেষ দুমাস চোখের পাতা কতক্ষণের জন্য যে এক করতে পেরেছিল, তা নিয়ে সন্দেহ আছে। কাজের চাপ হাল্কা হতেই তিনদিনের ছুটি নিয়ে জয় এখানে এসেছে। তিনদিনের ছুটিতে কোথায় যাওয়া যায় একদিন ইন্টারনেটে সেটার খোঁজ করছিল। সেই সূত্রেই আরও অনেক জায়গার সাথে সে জয়পুরের জঙ্গলেরও খোঁজ পায়। ইন্টারনেটে ছবিগুলো দেখেই তার ভালো লেগে যায়। ভালো লেগেছিল নাকি চেনা লেগেছিল সেটা অবশ্য বুঝতে পারেনি সে।
যা আশঙ্কা করেছিল তাইই হল। প্রচণ্ড জোরে বৃষ্টি নেমে এলো এবার। সঙ্গে তো ছাতাও আনেনি সে, তাই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভিজতে হল তাকে। এমন সময় তার সঙ্গে লুকোচুরি খেলা হরিণটাকে সে দেখতে পেল। হরিণটার চোখে যেন অনুশোচনার ভাব। এই দুটো চোখের দিকে তাকিয়ে আবার যেন মোহিত হয়ে গেল সে। এই চোখদুটো তার খুব চেনা লাগছে। অবশ্য চেনা লাগছে না ভালো লাগছে বুঝতে পারল না সে। হরিণটার দিকে এক পা এগোতেই, সামনেই একটা বড় গর্ত ছিল, যেটা সে দেখতে পায়নি, সেটাতে পড়ে গেল সে। যন্ত্রণায় প্রায় চিৎকার করে উঠল জয়, প্রায় কোমর অবধি গর্তটায় পড়ে গিয়ে ডান পায়ে বেশ জোরে লাগল তার। উঠবার জন্য যখন সে কাছের কিছু একটা আঁকড়ে ধরতে যাচ্ছিল, তখনই একটা হাত এসে তার হাতটা আঁকড়ে ধরল। তাকিয়ে দেখল মায়া।
“তুমি?” জিজ্ঞেস করল জয়।
“হ্যাঁ! বিকেল শেষ হয়ে সন্ধ্যে হয়ে গেল। আপনি আসছেন না দেখে আমি এলাম।”
মুখে এটা বললেও তার চোখে কেমন অনুশোচনার ভাব।
রিসর্টটা এখানে অনেকটা এলাকা জুড়ে। ভেতরে আলাদা আলাদা অনেক রুম। অন্যান্য রুমের সাথে এখানে আছে মাড হাউস। মেইন বিল্ডিং থেকে বেশ কিছুটা দূরে সম্পূর্ণই মাটির তৈরী বড় বড় আলাদা কিছু ঘর। মাথায় খড়ের অনেকখানি ছাউনি হলেও ভেতরে পাঁচতারা হোটেলের সুবিধা। জয় চারজনের থাকার জন্য যে মাড হাউসটা আছে সেটা নিয়েছিল। মাড হাউসগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় এটা। বাথরুমটাই কতখানি বড়। যথেষ্ট বড় বেডরুমে দুটো খাট, বড় একটা সোফা, তার সামনে কাঁচের টেবিল, অন্যদিকে কাঠের একটা টেবিলের সামনে রাখা দুটো কাঠের চেয়ার এবং একটা আলনা; সোফা আর কাঁচের টেবিলের পাশে একটা ছোট ডাইনিং রুম আর তাতে রাখা একটা বড় টেবিল আর বেশ কয়েকটা চেয়ার। তার রুমের বাইরেটায় বড় দালানে দুটো চেয়ারের সাথে একটা বড় টেবিল রাখা। বেশ কিছুটা দূরে আবার একটা রুম অর্থাৎ আরেকটা মাড হাউস। এইভাবে একটা রুম অনেকটা জায়গা নিয়ে বেশ নিরিবিলি পরিবেশ তৈরী করেছে। জয়ের মাড হাউসটা গেট থেকে অনেকটা ভিতরে, তাই মায়াকে অনেকটা পথ আসতে হল তাকে নিয়ে। কিন্তু এখানে গোটা রিসর্টটাই এমন নিরিবিলি যে আসবার পথে কাউকেই দেখতে পেল না জয়। শুধু নিজের রুমে ঢোকার মুখে একজনের সাথে তাদের দেখা হল। জয়ের সামনের রুমের সেই ট্যুরিস্টটা। অন্ধকারে নিজের রুম থেকে বেরিয়ে বাইরে দাঁড়িয়েছিল। তার চোখে চোখ পড়তেই আগের মতই অজানা ভয় আর রাগ জেগে উঠল জয়ের মনে, সঙ্গে সেই পুরনো অস্বস্তি।
“তাড়াতাড়ি চলো!” মায়াকে বলল জয়।
মায়া বুঝতে পেরে তাড়াতাড়ি জয়ের রুমের দরজাটা খুলে জয়কে নিয়ে ঢুকল। বৃষ্টির জলে ভিজে গেছে দুজনেই। মায়া জয়কে নিয়ে বাথরুমে এলো। তারপর জয়কে সাওয়ারের নীচে এনে সাওয়ারটা চালিয়ে দিল।
এই প্রথম মায়াকে ভালোভাবে খেয়াল করল জয়। বাথরুমের এই কমলাটে আলোয় কেমন মায়াবী লাগছে তাকে। মায়ার উজ্জ্বল কৃষ্ণবর্ণের চেহারার মধ্যে একটা অদ্ভুত সৌন্দর্য। একটা শান্ত, মিষ্টি অথচ রহস্যময়ী আভা তার মুখমন্ডলে। আর বৃষ্টিতে ভিজে মায়ার গা দিয়ে একটা গন্ধ আসছে। গন্ধটা চেনা লাগছে না ভালো লাগছে সেটা আর বোঝার চেষ্টা করল না, শুধু সেই ঘ্রাণ নিতে থাকল সে। সব মিলিয়ে মায়া তার কাছে এক মায়াবী পরিবেশের সৃষ্টি করেছে যেন। তার বারবার মনে হচ্ছে মায়া কোনও মানবী নয়, অন্য কিছু।
সাওয়ারটা চালিয়ে দিয়েই মায়া বাথরুম থেকে বেরিয়ে গেল।, “চান করে নিন তাড়াতাড়ি, নাহলে ঠাণ্ডা লেগে যাবে।”
জয় তার হাতটা ধরতে যাচ্ছিল, কিন্তু ভদ্রতাবোধে সেটা পারল না। মায়া যাবার সময় ঘুরে দেখল একবার, তারপর বাথরুমের দরজাটা বন্ধ করে চলে গেল। জয় তার পরনের ভিজে জামাকাপড়গুলো খুলে বাথরুমের হ্যাঙ্গারে টাঙিয়ে রাখল। তারপর সাওয়ারের নীচে দাঁড়িয়ে রইল একভাবে।
 
একটা হরিণ গুলির আঘাতে ছিটকে পড়ল দূরে। এখনও সে পুরোপুরি মারা যায়নি, ছটফট করছে। তার সঙ্গীটা ভয় পেয়ে লুকিয়ে পড়েছে জঙ্গলের ভেতর, দূর থেকে দেখছে তাকে। হরিণের বাকি দলটাও এদিক ওদিক ছুট লাগিয়েছে। গলায় আঘাত লাগা হরিণটা ছটফট করছে এখনও।
 
সাওয়ারটা বন্ধ করে একবুক নিঃশ্বাস নিল জয়। হরিণের এই দুঃস্বপ্ন বা স্মৃতি যাই হোক না কেন, তার মনে পড়ে গেছে আবার। কেমন যেন শ্বাসরোধ হয়ে আসছে তার। বহুদিন আগে এসব স্বপ্নে দেখত সে। সে অনেক ছোটবেলায়, তারপর বড় হয়ে খুব একটা বেশি এরকম কিছু দেখেনি সে। কিন্তু এখানে আসবার পর থেকে আবার টানা এইগুলো তার মাথায় ভিড় জমাচ্ছে। হঠাৎ আয়নার দিকে চোখ পড়তেই ভয়ে চমকে উঠল সে। তার সারা গা জুড়ে কেমন গোল গোল সাদা সাদা ছোপ। জঙ্গলে কোনও কিছুর ছোঁয়ায় কি চর্মরোগ হল তার? কিন্তু এত তাড়াতাড়ি? ছোপগুলোয় হাত দিয়ে দেখল কোনও জ্বালা, ব্যথা বা এতটুকু অস্বস্তি কিছুই নেই। ভালো করে বডি ওয়াশ দিয়ে সে শরীর ধুল। কিন্তু তাতে তার চামড়ার কিছু এলো গেলো না। ছোপগুলো আগের মতই আছে। দেখে মনে হচ্ছে তার চামড়ায় যেন এগুলো শুরু থেকেই ছিল। কিন্তু মনে হলেই তো হবে না। সে তো জানে তার চামড়ায় এরকম কিছু ছিল না। সারা শরীর জুড়ে তার এইরকম ছোপ, বিশেষ করে পিঠেতে। বাথরুমের ঐ বিশাল আয়নাটায় আবার নিজেকে দেখল সে, দেখল পিঠের ছোপগুলো। এগুলোকে চেনা চেনা লাগলেও তার শরীরে এরকম ছোপ তার একদমই ভালো লাগছে না।
এরপর থেকে জয় আর রুমের বাইরে বেরোয়নি। চাদর চাপা দিয়ে সে বিছানাতেই শুয়ে ছিল। রাতে সে নিজে থেকে ফোন না করলেও মায়া নিজে থেকে তার জন্য খাবার নিয়ে এলো।
“জ্বর হয়েছে নাকি?” জিজ্ঞেস করল মায়া। মাথা নেড়ে হ্যাঁ জানাল জয়। মায়া এগিয়ে এসে কপালে হাত দিল, “কই জ্বর?”
মায়ার স্পর্শটা তার ভালও লাগল, আবার চেনাও লাগল। আস্তে আস্তে নিজেকে যেন চিনতে পারছে জয়। কিন্তু মেনে নিতে পারছে না। মায়া খাবার নিয়ে চলে গেলে সে উঠে খাবার খেতে এলো। হাতের ওপরে ছোপগুলো এই কয়েক ঘণ্টায় আরও বেড়েছে। অথচ এর জন্য তার শারীরিক কোনও অস্বস্তি নেই, যত অস্বস্তি তার মনে। তার এই পরিবর্তন, তার অনেক কিছু মনে পড়া স্মৃতি তার ভাল লাগছে না। কোনওরকমে যেটুকু পারল খেয়ে আলো বন্ধ করে শুয়ে পড়ল সে।
মাঝরাতে দরজা খোলার শব্দে জয় তার ঘুমজড়ানো চোখদুটো একটু তুলে তাকাল। অর্ধচেতন অবস্থায় তার মনে হল একটা প্রাণী তার রুমের দরজাটা ঠেলে ভেতরে ঢুকল। তার নিজের রুমের আলো বন্ধই করা ছিল, রুমের বাইরেও সমান অন্ধকার। দূরের কোনও রুম থেকে আসা যেটুকু আলো তার ঘরে ঢুকেছে, সেই আলোতে প্রাণীটার ছায়া দেখে তাকে যেন হরিণ বলে মনে হল। প্রাণীটা চারপায়ে এসে তার বিছানার কাছে থামল। চাদর থেকে জয়ের যেটুকু পা বেরিয়ে আছে, সেই পায়ের ছড়ে যাওয়া ক্ষতবিক্ষত জায়গাগুলো সোহাগভরে চাটতে থাকল প্রাণীটা।
“কে?” পায়ের কাছে ভিজে স্পর্শে জয় উঠে বসল।
“আমি! মায়া!” মায়ার হাতে ভেজানো একটা স্পঞ্জ। বিছানায় জয়ের পায়ের কাছে মেঝেতে বসে তার পায়ের ক্ষততে মায়া স্পঞ্জটা বোলাচ্ছিল। তার পাশে বাটিতে রাখা তরল কোনও ওষুধ।
জয় উঠে বসল। কোনওকিছু আলাদাভাবে চেনার দরকার নেই তার। সব কিছুই তার চেনা লাগছে এখন, সব চেনা কিছুই তার ভালও লাগছে এখন। সে জানতে পেরেছে নিজেকে, সে চিনতে পেরেছে নিজেকে, চিনতে পেরেছে মায়া কে! মায়াকে সে তুলে আনল বিছানাতে। কেন এই বর্ষাকালে, তার এই জঙ্গলে আসতে ইচ্ছে হল, কেন বিকেলবেলায় সে জঙ্গলে ছুটে গেল, কেন এখান কার সব রাস্তা তার চেনা লাগছিল, জঙ্গলের মধ্যে ঐ হরিণটার চোখের সাথে আসলে যে মায়ার চোখেরই মিল ছিল, সবকিছু এখন পরিষ্কার তার কাছে। সে মানুষের জন্য বানানো সব কাপড়চোপড় খুলে নিল মায়ার পিঠ থেকে। বাইরের থেকে আসা ক্ষীণ আলোয় সে দেখল একইরকম সাদা ছোপ মায়ার কালো পিঠ জুড়ে। এই জঙ্গলে যে চিতল হরিণ আছে, তাদের পিঠেও একই রকম ছোপ। এই আবছা আলোয় মায়াকে আরও মায়াবী লাগছে। বিছানা থেকে নেমে জয় দরজাটা বন্ধ করে এলো।
 
মৃত হরিণটাকে যে লোকটা এসে কাঁধে তুলে নিল, সে আর কেউ না, জয়ের সামনের রুমের সেই ট্যুরিস্টটা, যাকে দেখে কেমন অজানা অস্বস্তি হচ্ছিল জয়ের। লোকটা এককালে প্রচুর পশুপাচারকারী সংস্থার সাথে যুক্ত ছিল। এখন আগের মত অবৈধভাবে পশুহত্যা না করলেও অন্যান্য এইরকম বিভিন্ন অবৈধ ব্যবসার সাথে সে যুক্ত আছে। হরিণটাকে তুলে নিয়ে চলে যাবার পর অন্য হরিণটা বেরিয়ে এল গাছের আড়াল থেকে। তার চোখে কি দুফোঁটা জল? ঠিক বোঝা গেল না।
 
পরদিন সকালে জয়ের রুমে জয়কে পাওয়া গেল না। সারা রিসর্টের কোথাও মায়াকেও পাওয়া গেল না। শুধু জয়ের রুমে বিছানার সামনে মেঝেতে জয় আর মায়ার পড়নের কাপড়চোপড়গুলো পাওয়া গেল। অবশ্য জয় বা মায়ার কারও জিনিসপত্রের কিছুই কিন্তু নিখোঁজ ছিল না। আর পাওয়া গেল জয়ের সামনের রুমের সেই ট্যুরিস্টটার রক্তমাখা লাশ।


ছবি – লেখক

লেখকের কথা: রুবাই শুভজিৎ ঘোষ
লেখকের জন্ম পশ্চিমবাংলায়। পেশায় একটি বহুজাতিক সংস্থার তথ্যপ্রযুক্তিবিদ। নেশায় লেখক এবং পরিচালক। বাঙালির জনপ্রিয় ওয়েবসাইট সববাংলায় এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা তিনি। কবিতা থেকে শুরু করে গল্প, প্রবন্ধ, উপন্যাস, চিত্রনাট্য সবকিছুই লিখতে ভালবাসেন। লিটিল ম্যাগাজিন থেকে শুরু করে বাণিজ্যিক বিভিন্ন ম্যাগাজিনে নিয়মিত লিখেছেন। স্রোত থেকে প্রকাশিত তাঁর কবিতার সংকলন দৃষ্টি এবং বালিঘড়ি। এছাড়া তথ্যচিত্র, শর্ট ফিল্ম বা অন্যান্য বিভিন্ন ধরনের ভিডিও পরিচালনা করেন। ধর্ম এবং বিজ্ঞান তাঁর প্রিয় বিষয়। ভ্রমণ তাঁর অন্যতম শখ। অন্যান্য শখের মধ্যে রয়েছে স্কেচ, ফটোগ্রাফি, ছবি ডিজাইন করা।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।

রুচিশীল ও বিষয়ভিত্তিক আলোচনার জন্য ক্লিক করুন এখানে

sobbanglay forum