সুবর্ণরেখার বাঁক

লেখক : শান্তিস্বরুপ চক্রবর্ত্তী

     

পথ চলতে চলতে একদিন শেষ হয় সাময়িক পথ চলা,  কিন্তু যেখানে শেষ হয় সেখান থেকে শুরু হয় নতুন করে চলা, আবার নুতন রাস্তা,নুতন নুতন মানুষ, এ এক অদ্ভুত চলার নেশা, কত রকম মানুষ, কত রকম অভিজ্ঞতা জমা হয় ঝুলিতে, তাদের মধ্যেই কেউ কেউ মনে দাগ কেটে যায়। আমার মধ্যে নিজস্বতা বলে কিছু নেই, যা আছে তা এই রাস্তায় চলতে চলতে মানুষের কাছে পাওয়া, প্রকৃতির কাছে পাওয়া।গত কালকেই মুরি তে এসেছি, সন্ধার পর পৌছে কিছুই বুঝতে পারিনি। গেস্টহাউস এর চারদিকে সবুজের সমারোহ, সকালে উঠে অফিসে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়েছি, নঈম বলল স্যার গাড়ি ডেকে দিচ্ছি, আমিই বললাম না থাক হেঁটেই যাব।সূবর্ণরেখা নদীর ধার দিয়ে পাকা রাস্তা, এপাশে মুরি ওপাশে তুলিন, পশ্চিমবাংলা আর ঝাড়খণ্ডের সীমানা।

এখন আগস্ট মাস, মাঝে মাঝেই বৃষ্টি হচ্ছে, সুবর্ণরেখা কানায় কানায় পূর্ণ। হিন্ডালকো কারখানা এবং কলোনি কে ইউ আকৃতিতে বেষ্টন করে বয়ে গেছে সুবর্ণরেখা। শুনেছি একসময় সুবর্ণরেখার বালি থেকে সোনা পাওয়া যেত। রাস্তা থেকে একটু নামলেই নদীর ঘাট, ওপাশে একটা মন্দির আর নদীর তীরে শ্মশান। বড় বড় পাথর জলের উপর পর্যন্ত মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। এ নদী যে আমার অনেক দিনের চেনা, জামশেদপুরএ দোমোহানিতে সুবর্ণরেখা আর করকাই একসাথে মিলে সুবর্ণরেখা এগিয়ে গেছে, আবার ঘাটশিলার কাছে ঘালুডি তে অতি মনোরম সুবর্ণরেখা।নদীর ধার পর্যন্ত নেমে যাই, জলে হাত দিয়ে ফিরে আসি।ছটায় অফিস থেকে ফেরার সময় অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে দেখি বয়ে যাওয়া জলের দিকে, পাখিরা ফিরে যাচ্ছে যে যার আপন ঘরে। ওরা জানে না মাটির বিভাজন। ওই দূরে বানসা পাহাড়ের ওপাশে সূর্য অস্ত যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে। ধীরে ধীরে জলের উপর হামাগুড়ি দিয়ে সন্ধ্যা নামছে। এ ভাবেই শেষ হয় দিন, মাস ও বছর।

হঠাৎ মহামারী গ্রাস করে পৃথিবীকে, কোভিড এর ভয়ে সারা পৃথিবীর মানুষ বিভ্রান্ত, মানুষ যে কত অসহায় তখন বুজলাম। সারা পৃথিবী যেন হঠাৎ থমকে গেল। প্রকৃতির কাছে বিজ্ঞান কত অসহায়।

বয়ে যায় সুবর্ণরেখার ধারা একই ছন্দে, মানুষ ছাড়া এই গ্রহের সবকিছু স্বাভাবিক। মানুষেরই সবসময় কিছু হারানোর ভয়।আমি মাঝে মাঝেই গিয়ে বসি জলের ধারে, এখন বুজলাম মৌনতার মধ্যেই সবচেয়ে বেশি সরব থাকে আমাদের  অন্তরতা। ওপারে আজও শশ্বানে জ্বলছে চিতা, স্বচ্ছ জলের মধ্যে আকাশের জলছবি, পাখিরা ফিরে গেছে যে যার আপন ঘরে।হঠাৎ মোহভঙ্গ হয়, পিছন থেকে কেউ যেন বলে একটা বিড়ি দিবি। আমি পিছন ফিরে দেখি একজন লোক, মুখে খোঁচা দাড়ি, খালি গায়ে কংকালসার শরীর, মাথায় রুখু চুল। আমি প্রথমে হতবম্ব, তারপর ওর দিকে সিগারেট এর প্যাকেট বাড়িয়ে দিলাম, ও আমার দিকে স্থির দৃষ্টি তে তাকিয়ে আছে, আমি বললাম নাও, ও নিশ্চুপ। আমি একটা সিগারেট বের করে ওর দিকে বাড়ালাম, আমার হাত থেকে একটা সিগারেট নিয়ে হালকা হাসল। তখন আমি সাহস পেয়ে ওকে জিজ্ঞাসা করলাম তোমার নাম কি, ও ভরাট গলায় বলল আমি সুবর্ণ। আমি বললাম,  তোমাকে তো আগে দেখিনি এখানে, ও বলল আমি তোকে দেখেছি, তুইতো মাঝে মাঝে নদীর ধারে এসে দাঁড়িয়ে থাকিস, কিন্তু তোমাকেতো আমি কোনোদিন দেখিনি, আমি এখানেই থাকি, নদীর সঙ্গে কথা বলি, আকাশের সঙ্গে কথা বলি, গাছের সঙ্গে কথা বলি, ওরা সবাই আমাকে চেনে, আমার কথা বোজে, মানুষের সঙ্গে কথা বলা আমার শেষ হয়ে গেছে। আমি একাই হাসি, একাই কাঁদি আবার একা একা ঘুরে বেড়াই, কিন্তু তুই এখানে কেন আসিস? আমি কেন আসি সে তো আমি জানি না, ও গুন গুন সুরে গান ধরল, খ্যাপা তুই চিনলি নারে, তোর মনের ভিতর মানুষটাকে, সে চলে তোর আগে আগে, তুই চলিস তার পিছে পিছে, খ্যাপা তুই চিনলি নারে, তোর মনের ভিতর মানুষটাকে। যতই নিজে ভাবো চালাক, সে যে হাসছে শুধুই ভিতর বসে, তোর ভাবনার অঙ্ক মিলবে নারে, সে যে উত্তর কষে বসে আছে, খ্যাপা তুই চিনলি নারে, তোর মনের ভিতর মানুষটাকে।আমি কেন আসি জানো? আমি নদী ভালবাসি, আমি পাহাড়, জঙ্গল  ভালবাসি, আমি পাখীর ওড়া দেখতে ভালবাসি, তাই আমি এখানে আসি। এইমাত্র তুমি যে গান গাইলে আমার খুব ভালো লেগেছে।হঠাৎ একটা পাখি উড়তে উড়তে সুবর্ণর মাথাই এসে বসলো, আমি দেখে থ,
সুবর্ণ বলল তুই আজ ঘরে ফিরতে পারিসনি, যা ঐ গাছের ডাল টাতে বোস, কাল তোর ঘরে যাবি, পাখিটা সঙ্গে সঙ্গে উড়ে গিয়ে গাছের ডালটাতে বসল।

তুমি কে!

আমি সুবর্ণ, সেই কত বছর ধরে এখানে আছি, তখন নদীতে অনেক জল ছিল, চারদিকে ঘন জঙ্গল, জঙ্গলে কত পশু পাখি, তার মাঝে ছিল আমাদের কয়েকটি ঘর মোলডহরী, আমরা কত গাছ কেটেছি, কত পশু পাখি মেরেছি, ঐ শহর থেকে কত লোক এসে বান্দুক দিয়ে বাঘ মেরেছে, বারাসিঙ্গা, হরিণ মেরেছে, আস্তে আস্তে আমাদের মোলডহরী শেষ হয়ে গেল, বাঘ, বারাসিঙ্গা, হরিণ, খরগোশ সব শেষ। 

হয়ে গেল, নদীর জল অনেক কমে গেল, শুধু আমি আজো ঘুরে ঘুরে দেখি ভালুকবাদা, সোনডিহি, মকাইচষা, খেজুরবনা সব গাঁ শেষ হয়ে গেল।আমি যাই, এই বলে সুবর্ণ নদীর দিকে নেমে গেল,আমি আলোআঁধারিতে স্পষ্ট দেখতে পেলাম সুবর্ণ জলের উপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চিতার আগুনে সিগারেট ধরিয়ে হারিয়ে গেল।আমি জোরে ডাকলাম সুবর্ণ, কিন্তু আমার গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোল না। তখন সাঁঝতারা সুবর্ণরেখার ক্ষীন জলধারায় দোদূল্ল্যমান। কোনোরকমে রাস্তাই উঠে এলাম।
তারপর আনেকবার রাত্রিতে গেছি নদীর ধারে, কিন্তু আর কোনোদিন সুবর্ণর দেখা পাইনি।আজ আনেকদিন হয়ে গেল মুরি ছেড়ে চলে এসেছি কিন্তু সেই সন্ধ্যার স্মৃতি আজও জাজ্বল্যমান।


লেখক পরিচিতি : শান্তিস্বরুপ চক্রবর্ত্তী
আমি লিখতে ভালোবাসি, প্রকৃতির সানিদ্ধে আমি খুজেঁ পাই আমার সত্তাকে, খুজেঁ পাই আমার খুশির ইন্ধন, ভালো থেকো সবাই।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।