লেখক : অঞ্জনা চক্রবর্তী
‘সকাল থেকে দম ফেলার সময় নেই।’
তেলচিটে কাপড়ে ঘাম মুছতে মুছতে কর্কশ গলায় বলেন শিখাদেবী। ‘তার উপর একশোবার চা — এর এটা দাও রে, ওর ওটা চাই …ফিরিস্তি দিতে দিতেই গোটা জীবন গেল…’
সমরেশ চশমার ফাঁক দিয়ে একবার তাকায় শিখার দিকে। তারপরে আবার চায়ে চুমুক দিতে দিতে খবরের কাগজের পাতা ওল্টায়।
-‘ভাবো তো একবার তোমার যদি দাম্পত্য জীবনটা না থাকতো…আমি থাকতাম না…কোনো কাজ থাকতো না…তোমার কী হত!’
সমরেশবাবু বলেন মুচকি হেসে।
-‘খুব ভালো থাকতাম! নিজের মতো। ওই তো শ্যামলী বৌদিকে দেখো না…কেমন থাকে। মোবাইলে খালি রীলস বানায়…কত কাজের লোক…রান্নার লোক…সব হাতের কাছে…’
-‘ইস আর বোলো না ওনার কথা! কত অসুখ…কত ওষুধ খেতে হয় খবর রাখো…? সেদিনই তো দেখলাম ওদের কাজের লোক এক বান্ডিল…’
-‘হ্যাঁ বিনি পয়সার বাঁদি পেয়েছো আমায়। যার যত জ্বালা আমায় পোয়াতে হবে…’
-‘তোমার জ্বালাও তো আমি পোয়াই গো…’
আটকে গেলেন সমরেশ। ফোঁস করে ওঠেন শিখা।
-‘কী পোয়াও গো…কিছুই চাই না তো আমি…কবে একবার বলেছিলাম কেদারনাথ নিয়ে চলো — ওই মীনাদি কত গল্প করলো বাবা কেদারনাথ দর্শন নিয়ে তাও ভাগ্যে জুটলো না… এমন পাপি আমি।’
পাশ ফিরলেন সমরেশ।
-‘সেবার তো সব ঠিক করেছিলাম। তোমারই তো মামার মেয়ের বিয়ে বলে তুমি যেতে চাইলে না…ভাবলাম হেলিক্যাপ্টার চড়বো…’
-‘হ্যাঁ, তা বাবলির বিয়ে বলে কথা…কতদিন বাদে বিয়ে করলো…ছাড়া যায়! তোমার সাথে বিয়ে হয়েই তো আমার জীবন শেষ হয়ে গেল গো…ও নিজে দেখে বিয়ে করলো বুড়ো বয়েসে…বেশ আছে…কত ঘুরছে…কত খুশি…’
-‘হ্যাঁ সেই! ভেতরে তো জানো না। সামনে দেখলে ওরকমই মনে হয় — সবাই ভালো আছে তুমি যত খারাপ আছো…শুনেছি ওর স্বামী সৈকত এখন ওর পি এ-র সাথে প্রেম করছে…’
-‘সে একটু আধটু সব পুরুষেরই এই রোগ আছে। বুক হাত রেখে কেউ কি বলতে পারবে এই এত বড়ো দাম্পত্য জীবনে বিপরীত লিঙ্গের কাউকেই ভালো লাগেনি! মনে মনে একটা গল্প রচনা হয়নি!’
-‘হ্যাঁ যেমন তুমি! সেদিন যখন টেক্সাস থেকে তাপস আমার সাথে দেখা করতে এলো, বাব্বা! তোমার ওর সাথে কত গপ্পো…শক্তি, সুনীল, জয় গোস্বামী — সব কত কবিতা আওড়ানো…ভাবলাম…এই বোধহয় “দ্বিতীয় পুরুষ” সৃষ্টি হবে…’
-‘বাজে বোকো না দেখি…তবে তাপসদা খুবই রুচিশীল মানুষ। তোমার মতো না — কাঠ-খোট্টা…’
-‘ভাব যদি এটা বিদেশ হত…তুমি কি ওর সাথে চলে যেতে…’
-‘আবার বাজে বকা…’
-‘আমাদের দেশে মনের মিল না থাকলেও যে এঁটে থাকতে হয়…দমবন্ধ পরিবেশেও জতুগৃহ তৈরী হয় কত কত…’
-‘এটাই পথ্য। সংসার সুখ — সামাজিক ইকুইলিব্রিয়াম…নইলে যে সুস্থতা থাকবে না। তুমি আমায় দেখবে আমি তোমায় দেখবো — একটা চুক্তিবদ্ধ প্রথা…মাঝে কিছু থাক না অ-পাওয়া…’
শিখা গিয়ে বসে সমরেশের পাশে। এক তৃপ্তি চোখে মুখে।
লেখক পরিচিতি : অঞ্জনা চক্রবর্তী
সারা বাংলা গল্প প্রতিযোগিতায় পুরস্কার প্রাপ্তি।