লেখক : সমাদৃত দাস
সৌমিত্র জগদীশ চন্দ্র মেমোরিয়াল হাইস্কুলের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র। তার পড়াশোনার পাশাপাশি একটা মস্ত বড় গুণ রয়েছে সেটা হল ফুটবল খেলা। এটা ওর জন্মগত প্রতিভা। কিন্তু সেই সুপ্ত প্রতিভা লুপ্ত হয়ে যাচ্ছে তার পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থার অবনতির কারণে। আসলে ফুটবল খেলতে গেলে দরকার উপযুক্ত কোচিংয়ের। হতে পারে সৌমিত্র অনেক ভালো খেলোয়াড়। কিন্তু উঁচু স্তরে পৌঁছাতে গেলে যথেষ্ট ভালো কোচিংয়ের প্রয়োজন। তো সেটা দেবে কে? যেখানে সংসারে নুন আনতে পান্তা ফুরায় সেখানে…। সৌমিত্র স্কুলের ফুটবল টিমের হয়ে খেলে। এতেই যে তার বড্ড আনন্দ।
দেখতে দেখতে সময় এগিয়ে গিয়েছে। চার চারটে বছর অতিবাহিত হয়েছে। এই কয়েক বছরে অনেক পরিবর্তন এসেছে সৌমিত্র এবং তার পরিবারের জীবনে। যাকে বলে পালা বদল হয়েছে জীবনের। সৌমিত্র এখন অষ্টম শ্রেণির ছাত্র। গত বছর ওর বাবা স্বর্গলোকের অধিবাসী হয়েছেন। বাবা মারা যাওয়ার পর ওদের পরিবারের আর্থিক অবস্থা আরও দুর্বল হয়ে পড়েছে। এমনিতেই যথেষ্ট টানাপোড়েনের মধ্যে থাকত ওরা। কিন্তু এইবার সমস্ত দায়-দায়িত্ব গিয়ে পড়েছে সৌমিত্রর মায়ের কাঁধে। বাবা বেঁচে থাকাকালীন সৌমিত্রদের যখন অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ চলছিল তখনই ওর মা একটা প্রাইমারি স্কুলে মিড-ডে-মিল রান্নার কাজে নিযুক্ত হন। এবং তারপর থেকে আংশিক কষ্ট দূর হয়েছিল সৌমিত্রদের। মানে ওই টেনে হিঁচড়ে কোনোরকমে সংসারটা চলত। কিন্তু এখন বাবা গত হয়েছেন। আগে যেটুকু টাকা দিয়ে তিনি পরিবারটিকে সাহায্য করতেন, এবার সেটাও বন্ধ। সবটাই গিয়ে পড়েছে সৌমিত্রর মায়ের ঘাড়ে। এইবার মায়ের অল্প ক’টা টাকায় কীভাবে দু-জন মানুষের জীবন চলবে? সেটাই বোধহয় এইসময়ের সবচেয়ে বড় প্রশ্ন।
ঈশ্বর বোধহয় যথেষ্ট ভেবেচিন্তেই সৌমিত্র নামক একটি বালককে এই পৃথিবীর আলোর দিশা হয়ে পাঠিয়েছিলেন। তার কারণ সৌমিত্র আগাগোড়াই খুব বুদ্ধিদীপ্ত ছেলে। ব্রেন খুব শার্প। সেটা পড়াশোনাতে হোক কিংবা খেলাধুলাতে। আবার সাংসারিক কাজ-কর্মেও তাই। ওইজন্য পাড়া প্রতিবেশীর মানুষেরা সৌমিত্রর প্রশংসা করে বলেন, এ ছেলে ভবিষ্যতে অনেক উন্নতি করবে। ভালো চাকরি-বাকরি করবে। কিন্তু সৌমিত্র ক্রমাগত ভেবে চলে যে তার জীবনের লক্ষ্য হল ফুটবল প্লেয়ার হওয়া। লক্ষ্য যে তার ওই গোলপোষ্টটাই। চাকরি বাকরি তো সবাই করে। কিন্তু ওর ধ্যান, জ্ঞান, চিন্তা, ভাবনা এবং লক্ষ্য হল ওই গোল সাদা- কালো নিরেট বলটার ওপর।
সৌমিত্রর আরও একটা ভালো গুণ হল স্কুল কামাই না করা। যদি শরীর খুব খারাপ না হয় তাহলে সাধারণত স্কুল কামাই করে না সৌমিত্র। আর স্কুলের গেমস টিচার বলে দিয়েছেন যে স্কুল আরম্ভ হওয়ার ঠিক একঘন্টা পূর্বে সৌমিত্র যেন স্কুলের খেলার মাঠে উপস্থিত হয়। তাহলে প্র্যাকটিসটাও জোর কদমে হবে। আর না হলে বিকালবেলায় স্কুল ছুটি হওয়ার পর প্র্যাকটিস করা সম্ভব নয়। তাই সৌমিত্র কাকভোরে ঘুম থেকে ওঠে। তারপর কিছু না খেয়েই পড়তে বসে। দু-ঘন্টা মন দিয়ে পড়াশোনা করবার পর ভাত খেতে বসে। কোনোরকম শাক সবজি এটা সেটা দিয়ে ভাত মেখে খেয়ে, স্কুল যাওয়ার জন্য তৈরি হয় সৌমিত্র। তারপর স্কুলের দিকে রওনা হয় সৌমিত্র। বেচারার একখানি সাইকেল অবধি নেই। আহারে কী কষ্ট! কী কষ্ট! যদিও ওর বাবা বেঁচে থাকাকালীন একখান ভাঙাচোরা সাইকেল ছিল। কিন্তু এতটাই অর্থাভাব এবং অনটন দেখা দিয়েছিল যে এক প্রকার বাধ্য হয়েই সাইকেলটাও বিক্রি করে দিতে হয়। সাইকেলহীন সৌমিত্র নিজের দুটো পায়ের গতিকে সাইকেলের সমান করে। কীই বা করবে? বড় কষ্ট যে তার। তার বন্ধু-বান্ধবরা মুখ টিপে হাসে এই দৃশ্য দেখে। কত টিটকারি এবং টিপ্পনি কাটে। এই কথার তীর গিয়ে সোজা আঘাত করে সৌমিত্রর হৃদয়ে। ভাগ্যের পরিহাসে এইভাবেই যে অতিক্রান্ত হয় একের পর একদিন।
এই রকম একদিন সৌমিত্র স্কুলের অভ্যন্তরে উপস্থিত ছিল, এবং সেইদিন ছিল হেডস্যারের ক্লাস। সৌমিত্রদের দৈনিক রুটিনে সপ্তাহে একদিন শুক্রবার হেডস্যারের ক্লাস হয়। হেডস্যার একটু ভিন্ন প্রকৃতির মানুষ। তিনি চট করে রেগে যান না। তিনি তাঁর যুক্তি এবং বুদ্ধি দিয়ে কোনো ঘটনাকে বিচার বিবেচনা করেন। তাই হেডস্যার যেমন তাঁর স্কুলের ছাত্রদের খুব স্নেহ করেন আবার ঠিক তেমনই ছাত্ররাও খুব ভালবাসে তাঁকে। তিনি কোনো বিষয় বই ধরে পড়ান না। তিনি সাধারণ জ্ঞান থেকে নানান ধরনের জিনিস বোঝান। ঠিক তেমন আজকের ক্লাসে তিনি বলছেন মনীষীদের উদ্ধৃতি সম্পর্কে। তিনি বলছেন, জানিস তোরা স্বামী বিবেকানন্দের একটা বাণী? “ওঠো, জাগো এবং লক্ষ্যে পৌঁছানো পর্যন্ত থেমো না।” এইটুকু বলবার সঙ্গে সঙ্গে ঢং ঢং করে স্কুল ছুটির ঘণ্টা বাজল। সবাই দ্রুত স্কুল ব্যাগ কাঁধে নিয়ে বাড়ির দিকে ছুটতে শুরু করল। কিন্তু সৌমিত্র খানিকক্ষণ স্কুলের গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে বিবেকানন্দের বাণীটিকে আওড়াতে লাগল। “ওঠো, জাগো এবং লক্ষ্যে পৌঁছানো পর্যন্ত থেমো না।” সৌমিত্র মনে মনে কঠোর প্রতিজ্ঞা করল। নাহ্! তাকে লক্ষ্যে পৌঁছাতেই হবে। আর এখন তার লক্ষ্য হল ওই খেলার মাঠের গোলপোস্টটা।
সৌমিত্র এখন ফুটবল খেলাতে জেলাস্তরে পৌঁছে গিয়েছে। এমন কী সৌমিত্র এত সুন্দর ভাবে ফুটবলটাকে নিয়ে খেলিয়ে গোলপোস্টে মেরে গোল করতে পারে, সেই অবিশ্বাস্য খেলা যেই দেখেছেন সেই মুগ্ধ হয়ে গেছেন। কিন্তু, এবার সমস্যা দেখা দিয়েছে অন্য জায়গায়। এতদিন সৌমিত্র হাওয়াই চপ্পল পরে ফুটবল খেলেছে। কোনো জার্সি টার্সি ছিল না। কিন্তু এই ম্যাচটা খেলতে গেলে প্রয়োজন ভালো দামী বুট জুতো, টিমের উপযুক্ত জার্সি ইত্যাদি ইত্যাদি। অথচ ওগুলো এখন দেবে কে? স্কুলে না হয় গেমস টিচার হাতে ধরে ফুটবলের প্রতিটি নিয়ম শিখিয়ে দিয়েছেন। জোরকদমে প্র্যাকটিস করিয়েছেন। কিন্তু পোশাক-আশাক দেবে কে? সৌমিত্র ওর অর্থনৈতিক অবস্থা বর্তমানে জানা সত্ত্বেও বাড়িতে সবটাই খুলে বলেছে। কিন্তু তাতে কোনো লাভ হয়নি। উপরন্তু মায়ের কাছ থেকে মিলেছে বকুনি। সৌমিত্রর অজান্তে ওর চোখে যে কখন বিন্দু বিন্দু জলের ফোঁটা জমে গড়িয়ে পড়েছে, সেটা ও খেয়াল করেনি। এখন সৌমিত্র ভাবতে থাকে কী করবে সে? তাহলে কি সে সত্যি সত্যিই ফুটবল খেলা ছেড়ে দেবে? কিন্তু এটা যে তার কাছে মেনে নেওয়া আর নিজেকে জলাঞ্জলি দেওয়া অনেকটা একই রকম হবে। যে ফুটবলকে সে জন্ম থেকে ভালোবেসে এসেছে, আর আজ তাকে এত সহজে ছেড়ে দিতে হবে? ভাবতে ভাবতে আবারও সৌমিত্রর চোখ দিয়ে অজান্তে জলের ধারা বয়ে গেল। ও ঠিক করল যে আগামীকাল না হয় একবার গেমস টিচারকে সব কথা খুলে বলবে।
অন্যদিন সৌমিত্র যথেষ্ট ফ্রেশ মুডে থাকে। কিন্তু আজকে তার চেহারার মধ্যে যে একটা দুশ্চিন্তার ছাপ রয়েছে সেটা বাইরে থেকে দেখে বোঝা সম্ভব। আজকে সৌমিত্র মায়ের আদেশনানুশারে এক কেজি আলু কিনতে বাজারে এসেছে। বাড়িতে তো এখন সেভাবে রান্নাবান্না হয় না। ওই আলু সেদ্ধ না হলে শাক, কচু এইসব। মানে যেগুলো সস্তায় পুষ্টিকর খাদ্য সেগুলোই অনিচ্ছাসত্ত্বেও খেতে হয় সৌমিত্র ও তার মাকে। আগে মাঝে মধ্যে মাকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করত ছোট্ট সৌমিত্র, যখন সদ্য সদ্য বাবা মারা গিয়েছেন। কিন্তু মা এ ব্যাপারে কোনো উত্তর না দিয়ে অন্য প্রসঙ্গে চলে যেতেন। তখন সৌমিত্রর বয়স অল্প ছিল। তাই বিষয়টা সে বুঝতে পারেনি। কিন্তু আজ সবটাই বুঝতে পারে। এ যে খোদ বিধাতার লিখন। তাকে খণ্ডাবার সাধ্যি আছে কার? যাইহোক সৌমিত্র লক্ষ্য করল তাদের স্কুলের গেমস টিচারও বোধহয় বাজার করতে এসেছেন। তাঁর সঙ্গে সৌমিত্রর চোখা-চোখি হল। সৌমিত্রই শুরু করল, “গুড মর্নিং স্যার”
তিনি বললেন, “হ্যাঁ। গুড মর্নিং!”
সৌমিত্র ভাবল এখন কি বলা ঠিক হবে? অত সাত পাঁচ বেশি না ভেবে খোলাখুলি সে বলে দিল – “বলছি স্যার, আগামী মাসে তো ম্যাচ আছে।”
স্যার বললেন, “হ্যাঁ, আছে তো।”
তারপর সৌমিত্র তার দুঃখ কষ্টের কথা সবটাই একপ্রকার নিরুপায় হয়ে খুলে বলল তাদের গেমস টিচারকে। বলতে বলতে সৌমিত্র বার কয়েক হাউ হাউ করে কেঁদেও ফেলেছিল। সৌমিত্রর কথা শুনে ভ্রু কুঁচকে বেশ কিছুক্ষণ ভাবলেন তিনি। তারপরে বললেন, “দেখো, আমার হাতে এই বিষয়গুলো নেই। এক কাজ কর, ফার্স্ট পিরিয়ডের পূর্বে তুমি আমার সঙ্গে একবার দেখা কোরো, কেমন? আমি বিষয়টা নিয়ে ভেবে দেখছি কী করা যায়”
গেমস টিচারের এই আশ্বাসে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল সৌমিত্র। তারপর বাজার করে এনে থলেটা মায়ের হাতে দিল। স্নান ও খাওয়া-দাওয়া সেরে স্কুলের উদ্দেশ্যে রওনা দিল সৌমিত্র।
স্কুলে প্রেয়ার হয় তারপরে কিছুটা সময় গ্যাপ থাকে মানে যেটাকে বলা হয় ফার্স্ট পিরিয়ডের আগে। সৌমিত্র ক্লাসে না প্রবেশ করে সোজা গেমস টিচারের কাছে চলে গেল। তাকে কিছু বলতে হল না, তিনি নিজেই বললেন, “দেখ আমি প্রথমেই বলেছি কিছু করতে পারব না। তবে হ্যাঁ একবার হেডস্যারের কাছে চল। দেখি তিনি কী করতে পারেন”
হেডস্যারের নাম শুনে প্রথম প্রথম একটু বুকটা কেঁপে উঠল সৌমিত্রর। যতই হোক হেডস্যার বলে কথা…। তারপরে তারা দু-জনে মিলে হেডস্যারের কাছে দেখা করল। হেডস্যার সম্ভবত কিছু কাগজপত্র ঘাঁটা ঘাঁটি করছিলেন। ওদের দু-জনকে দেখে একটু কড়া মেজাজে বললেন, “কী হয়েছে?”
সৌমিত্র সাধারণত হেডস্যারের এই রকম গলার আওয়াজ শোনেনি। গেমস টিচার হেডস্যারকে সবটাই খুলে বললেন। মানে সৌমিত্র যা যা বলেছে। শুনে, হেডস্যার গালে হাত দিয়ে বেশ কিছুক্ষণ সময় নিয়ে ভাবলেন। তারপর বললেন, “দেখ বাবা সৌমিত্র, তুই আমাদের ফুটবল টিমের খুব ভালো প্লেয়ার। তুই এই স্কুলকে জেলাস্তরে পৌঁছে দিয়েছিস। এবং আমার এটুকু বিশ্বাস যে তুই…” বলে খানিকক্ষণ চুপ করে গেলেন। প্রসঙ্গ পালটে আবার বলতে শুরু করলেন, “এবার আমি তোকে নতুন পোশাক, বুট জুতো মনে করলে সবটাই কিনে দিতে পারি। কিন্তু আমি দেব না। কেন বল তো?”
প্রথমে নিজের প্রশংসা শুনে সৌমিত্রর চোখ দুটো আনন্দে ডাগর ডাগর হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এখন হেডস্যার তাকে কিছু দেবেন না শুনে ভ্রু কুঁচকে উঠল সৌমিত্রর। ও বলল, “কেন স্যার?”
হেডস্যার একগাল চওড়া হাসি হেসে বললেন, “কারণ তোর মধ্যে যে দারিদ্রতার ছাপ আছে সেটা থাকা দরকার। আমি যদি নতুন পোশাক কিংবা নতুন বুট জুতো কিনে দিই, তাহলে তোর এবং আর পাঁচটা ছেলের মধ্যে কী পার্থক্য থাকল?”
গেমস টিচার হেডস্যারের তালে তাল মিলিয়ে বললেন, “হ্যাঁ, ঠিক ঠিক।”
হেডস্যার বললেন, “আমাদের স্কুলে কিছু পুরোনো জার্সি পড়ে আছে। অনেকটা ছেঁড়া। ওটা তোকে দিয়ে দিচ্ছি। আর বুট জুতো একজোড়া আছে। তবে পায়ের বুড়ো আঙুল বেরিয়ে যাবে কিন্তু। তবে তুই যদি আমাদের স্কুলের ফুটবল টিমকে রাজ্যস্তরে পৌঁছে দিতে পারিস, তাহলে আমি কথা দিচ্ছি তোর পরিবারের সম্পূর্ণ দায় দায়িত্ব আমার। যতক্ষণ পর্যন্ত না তুই প্লেয়ার হচ্ছিস। কী, ঠিক আছে তো?”
সৌমিত্র বিড় বিড় করে বলল, “অগত্যা।”
সেদিন স্কুল ছুটি হয়ে যাওয়ার পর সৌমিত্র যখন একা একা বাড়ির দিকে ফিরছিল, তখন ও ভাবছিল যে নিশ্চয় হেডস্যারের মাথায় কোনো জবরদস্ত মতলব আছে। অবশ্য মতলবের সিংহভাগটাই তাকে বলেছেন। আসলে তিনি চান তাঁর স্কুল রাজ্যস্তরে পৌঁছাক। আর সেই জন্যই আমাকে এই রকম একটা খুব কঠিন শর্ত দিয়েছেন। সৌমিত্রর ক্ষুরের ধারের মতন তীক্ষ্ম বুদ্ধি, ঠিক হেডস্যারের এই পরিকল্পনাটাকে ধরে ফেলেছে। তবে হেডস্যারের মুখের ওপর এর জবাব দিতে হবে। যেমন করে এর আগেরবার গেমস টিচারের মুখের ওপর জবাব দিয়েছিল খুদে সৌমিত্র। ঠিক তেমনই এইবারও জবাব দিতে হবে। সৌমিত্র একরাশ চিন্তাকে সঙ্গী করে একাকী বাড়িতে ফিরে এল।
সময় বড় অদ্ভুত জিনিস। কখন যে বহতা নদীর স্রোতের মতন বয়ে যায়, খেয়ালই করে না কেউ। এই তো কদিন হল এতসব কান্ডের। কিন্তু এরই মধ্যে পনেরোটা দিন যে কীভাবে কেটে গেল, কে জানে? ওইজন্যই বাংলা ভাষায় একটা প্রবাদ বাক্য রয়েছে “সময় বহিয়া যায় নদীর স্রোতের প্রায়।” তবে বলাই বাহুল্য এই ক’দিনে যেভাবে প্রাণপণ চেষ্টা করে চলেছে সৌমিত্র সেটা সত্যিই প্রশংসনীয়। দিন রাত এক করে শুধু ফুটবল আর ফুটবল। তবে তা বলে কিন্তু পড়াশোনার কোনো ক্ষতি করছে না সৌমিত্র। কাকভোরে ঘুম থেকে উঠে বই-খাতা নিয়ে পড়তে বসে পড়ছে। তারপর খাওয়া-দাওয়া করে খেলতে চলে যাচ্ছে মাঠে। হেডস্যারের নিকট হইতে পূর্বেই ছুটির পারমিশন করিয়ে নিয়েছে সৌমিত্র। এবং খুব সহজেই ছুটি মঞ্জুর হয়ে গেছে তার।
অবশেষে আগামীকাল অপেক্ষার অবসান। এতদিনের প্র্যাকটিস আগামীকাল গিয়ে বর্তাবে ওই সবুজ ঘাসের ওপর। এক প্রকার জীবনকে বাজি রেখে ওই ফুটবল নামক বস্তুটির ওপর নিজেকে সমর্পণ করেছে সৌমিত্র। এখন শেষ পর্যন্ত দেখা যাক জল কতদূর গড়ায়?
বিধাতা বোধহয় আজই ফুটবল ম্যাচের কথা লিখে রেখেছিলেন সৌমিত্রর কপালে। স্টেডিয়াম সেজে উঠেছে। জমজমাট আয়োজন। বহু মান্যি গন্যি ব্যক্তি আজ পদার্পণ করবেন এই স্টেডিয়ামে। সৌমিত্র জীবনে কঠোর প্রতিজ্ঞা নিয়েছে যে হয় এই ম্যাচটা জিতে রাজ্যস্তরে ও খেলবে। আর না হলে ফুটবল শব্দটিকে জীবনের মতন হৃদয় এবং মন উভয় থেকেই মুছে দেবে। রবার দিয়ে। তবে পেনসিলের লেখা রবার দিয়ে মুছলে, সম্পূর্ণটা কিন্তু মোছে না। অতি স্বল্প রেখা হলেও থেকে যায়। ওই অতি অল্প কষ্ট চেপেই ওর বুকে রেখে দেবে। পরে ব্যথা হলে বুঝে নেবে। কী আর করবে? হেডস্যারকে যে সে ওপেন চ্যালেঞ্জ দিয়ে এসেছে। এই খেলা দেখবার জন্য সৌমিত্র ওর মাকে আমন্ত্রণ করেছিল। কিন্তু ওর মা কর্ম থেকে বিচ্যুত হতে চান না। একটি দিন মিড-ডে-মিল রান্না না করলে সরকার যে তার মাইনে কেটে নেবে। তখন? একেই এই টাকাতেই সংসার ঠিক মতন চলে না। নুন আনতে পান্তা ফুরায়। সৌমিত্র প্রবল চেষ্টা করে চলেছে তার ভাগ্যকে ঘুরিয়ে দেওয়ার। ওহ! বলাই তো হয়নি গতকাল রাতে মাঠে খেলতে গিয়ে সৌমিত্র কনুই এবং হাঁটু ছড়ে গেছে। জায়গা দুটোয় প্রবল ব্যথা। ব্যথার থেকেও জ্বালা করছে বেশি। তবে সৌমিত্র মোটেও পিছপা হয়নি।
আর কিছুক্ষণের মধ্যে খেলা পর্ব শুরু হতে চলেছে। খেলাটা হবে মহীশ চন্দ্র বিদ্যাপীঠের সাথে জগদীশ চন্দ্র মেমোরিয়াল হাইস্কুল এর। দুটো টিমই খুব ভয়ংকর। দুটি টিম বলব না। মহীশ চন্দ্র বিদ্যাপীঠকেই বলব। কারণ জগদীশ চন্দ্র স্কুলে আগে ফুটবল টিম প্রচন্ড নড়বড়ে ছিল। কোনোদিন কাপ জেতেনি। এই সৌমিত্রর সৌজন্যে আজ এতটা উন্নতি করেছে এই স্কুল।
দেখতে দেখতে রেফারি বাঁশি বাজিয়ে দিল। খেলা শুরু হল। সৌমিত্র নিজেকে খেলার মধ্যে মনোনিবেশ করল। এটাই হল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। একদম কঠিন কন্সেন্ট্রেশন। তবে ম্যাচ খেলতে নামার পূর্বে সৌমিত্র স্মরণ করে নিল তিনটে জিনিস। এক, স্বামী বিবেকানন্দের সেই উক্তিটি। দুই, হেডস্যারকে চ্যালেঞ্জের কথাটা আর তিন, নিজের পরিবারের বর্তমান পরিস্থিতি। এই তিনটে বিষয় মনে করে ছেঁড়া জার্সি এবং ফুটো বুট জুতো পরে খেলতে নামল সৌমিত্র।
খেলার প্রথম ত্রিশ মিনিট কেউই গোল দিতে পারল না। শুধু তাই নয় প্রচুর চাপের মুখে দুটি টিমই। কেউ কাউকে এক ইঞ্চি জমি ছেড়ে কথা বলছে না। প্রত্যেকেই গোল দেবে দেবে করছে কিন্তু দিতে পারছে না। দেখতে দেখতে হাফ টাইমের বাঁশি বাজল। সৌমিত্রর মুখে এক ফোঁটা হাসি নেই। শুধু বিষণ্ণতা গ্রাস করেছে তাকে। তাদের টিমের এক প্লেয়ার রণদীপও খুব চেষ্টা করে চলেছে কিন্তু মহীশ চন্দ্র বিদ্যাপীঠের প্লেয়ারদের সঙ্গে কেউই যে পেরে উঠছে না।
হাফ টাইম যেন নিমেষেই কেটে গেল। আবার দুটো টিম খেলতে শুরু করেছে। প্রচন্ড রেষারেষি চলছে দুটো টিমের মধ্যে। দাঁত কিড়-মিড় কিড়- মিড় করছে। যেন পারলে জ্যান্ত চিবিয়ে খায়। তবে অবিশ্বাস্য ভাবে আচমকা একটা গোল দিয়ে খেলার শিরোনামে চলে এল মহীশ চন্দ্র বিদ্যাপীঠ। জগদীশ চন্দ্র মেমোরিয়াল স্কুল রীতিমতো অবাক হয়ে গেল। কিছুক্ষণের মধ্যে আবার একটা গোল দিয়ে দিল মহীশ চন্দ্র। হাফ টাইমের পর দু’ দুটো গোল, ভাবা যায়? মহীশ চন্দ্র টিমের দর্শকরা গ্যালারি থেকে রীতিমতো ফেটে পড়ল, যেন তারা জয়ী হয়ে গিয়েছে। ভাবটা এমন। খেলার আর মাত্র কুড়ি মিনিট বাকি। হঠাৎ করে আচমকা রণদীপ ব্যাক ফুটে একটা গোল দিয়ে দিল। খেলা যেন নব্বই ডিগ্রি কোণে ঘুরে গেল। জগদীশ চন্দ্র টিমের প্লেয়াররা যেন একটু বল পেল শরীরে। একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস নিতে পারল তারা। আর মাত্র খেলা শেষ হতে দশ মিনিট বাকি। মাত্র পাঁচ মিনিটের মধ্যে সৌমিত্র আরও একটি গোল দিয়ে গোল শোধ করে দিল। রীতিমতো স্কাই ফ্লাইং। যেন অগ্নিগোলা ধেয়ে এল মহীশ চন্দ্র টিমের ওপর। আর মাত্র পাঁচ মিনিট বাকি। এইটুকুর মধ্যে একটা গোল দিতে পারলেই কেল্লা খতম। আর হাতে মাত্র তিন মিনিট। সময় যেন ফুটবলের গতির থেকেও ছুটছে। রুদ্ধশ্বাস খেলা চলছে। কে জয়ী হবে, সেটা স্পষ্ট করে বোঝা যাচ্ছে না এখনও। শেষ পর্যন্ত সৌমিত্র ডিফেন্ড স্টাইলে বিপক্ষ টিমের প্লেয়ারদের চক্রব্যুহের মধ্যে দিয়ে ভাসিয়ে দিল বলটাকে। আরও একটা গোল। সৌমিত্র স্লিপ কেটে মাঠে শুয়ে পড়ল। এইবার হেডস্যারের চোখে বিন্দু বিন্দু চোখের জল দেখা গেল। আজ স্বপ্ন পূরণ সৌমিত্রর। পুরো মহীশ চন্দ্র টিম হতবাক হয়ে গেল সৌমিত্রর শেষ মুহূর্তে খেলা ঘুরিয়ে দেওয়া দেখে। অবশেষে বিজয়ী জগদীশ চন্দ্র মেমোরিয়াল হাইস্কুল। সারা মাঠে প্রতিধ্বনিত হল একটা কথাই, থ্রি চিয়ার্স ফর সৌমিত্র!! হিপ হিপ হুররে!! আর হেডস্যার বুকে জড়িয়ে ধরলেন সৌমিত্রকে ওই স্টেডিয়ামে। সৌমিত্র বাড়িতে এই খবরটা জানাতে ওর এক বন্ধুকে পাঠাল। সত্যিই অনবদ্য ও অতুলনীয় খেলেছে সৌমিত্র। এইবার শুধু হেডস্যারের কথা রাখবার পালা।
লেখক পরিচিতি : সমাদৃত দাস
লেখক পরিচিতি:- লেখক এবং সম্পাদক সমাদৃত দাস এর জন্ম ২০১০ সালের ২৬ শে আগস্ট মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুর শহরে। ছোট্ট থেকেই বই পড়ার উদ্দীপনা তাঁর মনে জাগে। বই পড়তে পড়তেই লেখালেখির দিকে আগ্রহের বহিঃপ্রকাশ। তাঁর প্রথম প্রকাশিত ছোটগল্প শারদীয় উড়োজাহাজ ১৪৩০ এ প্রকাশ পায়, নাম "দাদার গুপ্তধন"। এছাড়া আরও বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য গল্পের নাম হল, "দীপর বিলের সন্নিকটে", "স্বপ্নের থিওপানি জয়", "তনুর জীবনের লক্ষ্য", "জন্মদিনের উপহার" "সুজয়ের নতুন স্কুল" ইত্যাদি। তাঁর প্রথম সম্পাদিত সংকলন "শৈলজা"। তাঁর লেখা প্রথম একক বই "অর্ধেক আকাশ" প্রকাশিত হয়েছে এই কলকাতা বইমেলায় সকল গুণীজনের হাত ধরে। সম্পাদক বর্তমানে স্কুল পড়ুয়া ছাত্র।