মায়ের প্রতিশোধ

লেখক : রূপালী সামন্ত

কর্নেল সমরজিৎ রায়চৌধুরী, রাশভারী মানুষ। বনেদী বংশের সন্তান। তাঁর শরীরে রাজ রক্ত বইছে। তাঁদের পূর্বপুরুষেরা একসময় দেশে দাপিয়ে রাজত্ব করেছেন। পরে ইংরেজ আমলে তাদের সঙ্গে সন্ধি করতে বাধ্য হলেও শোনা যায় সে সময়েও তাঁরা নিজেদের দাপট বজায় রেখেই রাজ্য চলাতেন। প্রজারা রীতিমত তাঁদের ভয়ে তটস্থ থাকত ও তাঁদের সমীহ করে চলত।

একে রাজপরিবারের সন্তান তায় ভারতীয় সেনাবাহিনীর কর্ণেল হওয়ার দরুন কঠোর নিয়মানুবর্তিতা পুরোপুরি মান্য করে চলতেন। ভোর ভোর উঠে শরীর চর্চা চলত, আমৃত্যু এর অন্যথা হয়নি কোনদিন। খাদ্যাভ্যাস রাজকীয় হলেও তা সময়ে সারতেন। কর্মবিরতিতে, ছুটিছাটা পেলে বা পুজো-পার্বনে মাঝেসাঝেই দেশের বাড়ি চলে আসতেন। দেশে আসলে তাঁর নিজস্ব একটি গাঢ় বাদামী রঙের ঘোড়া ছিল যার পিঠে চড়ে উনি আশপাশ একটু টহল দিতে বেরতেন। সে সময় লোকজন তাঁকে দেখলেই সমীহ করত ও রাজকীয় ভঙ্গিমায় অভিবাদন করত। তিনিও এসব বেশ তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করতেন।

ধমনীতে রাজ রক্ত থাকার দরুন তাঁর শিকারের নেশা ছিল প্রবল। তাঁর ঠাকুর্দার বাবা একবার পরপর তিনটে মানুষ খেকো হত্যা করে রায়চৌধুরী বংশের মুখ আরো উজ্জ্বল করেছিলেন। তার একটি হয়তো এখনো রাজবাড়ীর অন্দরশোভা হয়ে বসবার ঘরের দেওয়ালে ঝুলে আছে। একটি স্টাফড অবস্থায় দাঁড় করান আছে অন্দরে ঢোকার মুখেই। ওটা দেখে বহু মানুষ প্রথমেই থতমত খেয়ে যায়‌। যার চোখ দুটো দেখলে এখনো বুকের রক্ত বরফে পরিণত হতে চায়।

শোনা যায় এই বংশে শারীরিক ভাবে দুর্বল, অসুস্থ, পঙ্গু বা মিনমিনে স্বভাবের মানুষের কোন জায়গা ছিল না। অন্দর মহলের মহিলারাও যথেষ্ট শিক্ষিত, জাঁদরেল এবং দাপুটে ছিলেন। কোন কোন মহিলা পুরুষদের সঙ্গে শিকারেও অংশ নিতেন। তখনকার ব্রাহ্ম সমাজে এঁরা মেলামেশা করতেন। পুরুষদের সঙ্গে তর্ক বিতর্কে পরিবারের মহিলারাও অংশগ্রহণ করতেন। কেউ তো আবার বিলেত থেকে শিক্ষা গ্রহন করেছিলেন।

এহেন পরিবারে কোন এক সময়ে এক অসুস্থ, অপরিণত কন্যাসন্তান জন্ম নিয়েছিল যে স্বভাবতই শান্ত ও একলা থাকতেই বেশি ভালোবাসত। কিন্তু পরিবারের অন্যান্য শিশুদের কাছে সে একজন হাসির খোরাক ছিল। তারা যখন তখন অযথাই তাকে বিরক্ত করত, তাকে নিয়ে হাসাহাসি করত। অসুস্থ শিশুটিকে রাগিয়ে আনন্দ পেত। মাতৃক্রোড় ঘেঁসা অসহায় শিশুটি বাকিদের সঙ্গে পেরে না উঠলে রাগে চিৎকার করে বাড়ি মাথায় করত।

অপরিণত শিশুটির আপন পিতাও তাকে সহ্য করতে পারত না। মা তার সন্তানকে বুকে আঁকড়ে অন্য ঘরে ঠাঁই নিয়েছিল। একদিন তার জন্মদাতা জোর করে তাকে মায়ের কোল থেকে ছিনিয়ে নিজের সঙ্গে শিকারে নিয়ে গিয়েছিলেন। জননী সেদিন অনেক অনুনয় করেছিলেন তার অসুস্থ সন্তানটিকে রেহাই দেওয়ার জন্য। কিন্তু শিশুর পিতার ব্যক্তব্য ছিল শিকারে গেলে শিশুর সাহস ও মনোবল দুইই বাড়বে, সে সাবলম্বী হতে শিখবে। কিন্তু সেবার শিকার থেকে সেই অসহায় শিশুটি আর ফিরে আসেনি। শিশুটির নাকি বাঘের গর্জন শুনে ভয়ে হাতির পিঠ থেকে পড়ে গিয়ে মৃত্যু হয়েছিল। কিন্তু কানাঘুষোয় শোনা গেছে সেদিন ঐ অসহায় একলা শিশুটিকে বাঘের টোপ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল যার পরিণামে মৃত্যু ছিল অবশ্যম্ভাবী।

যদিও কর্ণেল সমরজিৎ রায়চৌধুরীর পিতা স্বর্গীয় অমরজিৎ রায়চৌধুরী একজন যথেষ্ট নরম স্বভাবের ও পরিবারকে সময় দেওয়া উচ্চপদস্থ সরকারী অফিসার ছিলেন। তিনি হিংসা, মারামারি, অন্যের উপর অন্যায় অত্যাচার এইসব একদম পছন্দ করতেন না। তাই তিনি রাজপরিবারের লোকেদের থেকে দূরে নিয়ে গিয়ে নিজের সন্তানদের মানুষ করেছিলেন, যাতে তাদের উপর এর কুপ্রভাব না পড়ে। কিন্তু অদৃষ্টের লিখন তিনি কীভাবে খন্ডাবেন?

রাজরক্তের ধারা রক্ষা করতে এগিয়ে এলেন পুত্র সমরজিৎ। ছোট থেকেই তিনি নিষ্ঠুর প্রকৃতির ছিলেন। অসহায়ের উপর অত্যাচার করে আনন্দ পেতেন। অযথা বিড়াল কুকুরদের বা পাখিদের লক্ষ্য করে ইঁট মেরে নিশানা অভ্যাস করতেন। একবার স্কুলে এক সহপাঠীকে নাকে ঘুসি মেরে রক্ত বার করে দিয়েও কোন অনুতাপ করেননি। এমন মারকুটে স্বভাবের ছেলেকে নিয়ে বাপের চিন্তার অন্ত ছিল না। খুনোখুনির নেশা থেকেই একদিন মিলিটারিতে যোগ দিয়েছিলেন। যেখানে মানুষ খুন করেও সর্বসমক্ষে আনন্দ প্রকাশ করা যায় কারণ তা বৈধ খুন হিসেবে পরিচিত।

একবার পুজোর সময়ে দীর্ঘ ছুটিতে দেশের বাড়িতে এসেছিলেন। এসেই শুনলেন কাছের কোন এক গ্রামে নিকটবর্তী জঙ্গল থেকে এক বাঘিনী প্রায়ই রাতের অন্ধকারে এসে গ্রাম থেকে বাছুর বা ছাগল ছানা তুলে নিয়ে যায়। শোনা মাত্র তাঁর ধমনীতে রাজ রক্ত চলকে উঠল। ঐ বাঘিনীর শিকারের জন্য ভেতরটা নিশপিশ করতে শুরু করল। সেবার পুজো একটু দেরিতে গড়িয়ে গিয়েছিল। আশ্বিন মাস মলমাস হওয়ার দরুন দেবীর বোধন পিছিয়ে কার্তিকের শুরুতে পড়েছিল। ঠিক হল দেবীর ভাসানের পরেই বাঘিনী হত্যা অভিযানে বেরবেন। সেই মতো বাড়ির ভৃত্যদের একটি নধর ছাগ শিশু যোগাড় করতে আদেশ দিলেন।

সদ্য দুর্গাপুজো উপলক্ষে প্রচুর ছাগ শিশু বলি দেওয়া হয়েছিল ফলে কাছাকাছি কোন উপযুক্ত ছাগ শিশু না পেয়ে একটি বয়বৃদ্ধ পাঁঠা হাজির করলে কর্নেল রেগে গিয়ে এমন হুঙ্কার দিয়েছিলেন যে সেটিও হাত ফস্কে প্রাণ ভয়ে এমন দৌড়েছিল যে তাকে আর ধরতে পারা যায়নি। সেই দিন ছিল কোজাগরী পূর্ণিমা। বিশ্বচরাচর চুঁয়ে পড়া চাঁদের জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে। হিম পড়ে চতুর্দিকে ভেজা ভাব। কুয়াশার ওড়নায় প্রকৃতি লাজুক সুন্দরীর রূপ নিয়েছে। এমন দিনে মানুষ থেকে পশু প্রত্যেকেই প্রকৃতির রূপে বিভোর হয়ে যায়। এ সুযোগ কর্নেল হাতছাড়া করতে চাননি।

তাঁদের বাড়িতে বহুদিনের এক পোষ্য সারমেয় ছিল যার নাম ছিল লালি। হালকা লালচে বাদামী রঙের রেশম কোমল পশমে ভরা মিশ্র প্রজাতির লালিকে বছর দশেক আগে শিশু অবস্থায় তিনিই একদিন কোলে করে তাঁদের বাড়িতে এনেছিলেন। সে সময় লালির খুব তেজ ছিল কোন অপরিচিত মানব সন্তান তার সামনে যাওয়ার সাহস পেত না। দশটা বছর পেরিয়ে এখন লালি বৃদ্ধা। মাত্র দুটো মাস আগেই সে তিন চারটে শিশুর জন্ম দিয়ে আরো অক্ষম হয়ে পড়েছিল। তার শিশুদের মাঝে একটি ছিল অপেক্ষাকৃত অসুস্থ ও একটু খোঁড়া। তাকে বুকের কাছে নিয়ে লালি চুপচাপ শুয়ে থাকতো।

সেদিন দুপুরের পর থেকেই কর্নেল সমরজিৎ মদিরা পানে মত্ত ছিলেন। তিনি মনে মনে ঠিক করে রেখেছিলেন আজকেই মোক্ষম সময়। ব্যাটারির জোরালো আলো ছাড়াই প্রকৃতির নরম আলোয় আজি বাঘিনীকে খতম করতে হবে। সেই মতো মনে মনে প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন এবং বিশ্বস্ত লোকজনদের রাতের অভিযানের জন্য তৈরি থাকতে নির্দেশ দিয়েছিলেন।

আজকের এই হালকা কুয়াশা মাখা মনোরম কেমল প্রকৃতিতে নদীর ধারে জল খেতে আসা বাঘিনীকে তিনি শাস্তি দেবেন তার এলাকায় অনধিকার প্রবেশের জন্য। কাছাকাছি গাছের আড়ালে মাচা করে উপর থেকে লক্ষ্য রাখছেন ফাঁকা নদী তটের দিকে। তটিনী তীরের স্বেত শুভ্র কাশের বনে হিমেল হাওয়া দোলা দিয়ে লুকোচুরি খেলায় মত্ত। দীর্ঘ প্রতিক্ষার পর সহসা ঘন সবুজ বনানীর অন্তরালে জঙ্গলের রানী নিজস্ব রাজকীয় ঢঙে দুলকি চালে তৃষ্ণা নিবারণের নিমিত্তে নদীর দিকে অগ্রসর হতেই সেখানে একটি নধর কচি পশু শাবককে একলা বিচরন করতে দেখে একত্রে অবাক ও লোলুপ দৃষ্টিতে নিরিক্ষন করতে লাগল।

এতো মেঘ না চাইতেই জল। খুব সাবধানে বাঘিনী খেলায় মত্ত শাবকটির দিকে অগ্রসর হতেই মাচার উপরে রাইফেল তাক করে বসে থাকা কর্নেল সমরজিৎ সচেতন হলেন। টার্গেট লক্ষ্য করে বন্দুক উঁচিয়েছেন সবে কোথা থেকে লালি চিৎকার করে সমরজিতের মনঃসংযোগ নষ্ট করে দিল। বন্দুক গর্জন করল ঠিকই কিন্তু বাঘিনীকে ঘায়েল করল মাত্র। সে ততক্ষণে শাবকটিকে মুখে নিয়ে জঙ্গলের গহীনে অদৃশ্য হয়েছে।

রাগে উন্মত্ত সমরজিৎ জ্বলন্ত অগ্নি দৃষ্টি নিয়ে লালির দিকে তাকাতেই আশু বিপদ আঁচ করে লালিও এক ছুটে বনজ্যোৎস্নার সবুজ অন্ধকারে হারিয়ে গেল। এবার সমরজিৎ প্রমাদ গুনলেন। এতো হিতে বিপরীত হলো। আহত বাঘিনী আরো ক্ষিপ্ত হয়ে মানুষ না হত্যা করে বসে। লালির উপরেও তিনি ক্ষিপ্ত হয়েছেন। তাকে তো তিনি বাড়িতে দেখে নেবেন। সকলকে নির্দেশ দিলেন গ্রামের লোকেদের সাবধানে থাকতে বলো। সন্ধ্যার পর কেউ যেন কোন প্রকারেই বাইরে না বেরয়। যদিও আহত বাঘিনী দুটো দিন অন্ততঃ বিশ্রাম নেবে। তারপর বনের রানীকে দুদিন পরে বেরলেই চিরঘুমে পাঠানো হবে।

এই প্রথমবার কর্নেলের শিকার অভিযান অসমাপ্ত রইল। মনঃক্ষুণ্ণ সমরজিৎ রায়চৌধুরীর সমস্ত রাগ গিয়ে পড়ল লালির উপর। কিন্তু বাড়ি ফিরে তিনি লালিকে কোথাও দেখতে পাননি। এমনকি তার শাবকদেরও কেউ দেখেনি। এই দুটো দিন সমরজিৎ রায়চৌধুরীও দূরবীনে চোখ রেখে জঙ্গলে বাঘিনীর অবস্থান খুঁজেছেন কিন্তু সে দৃষ্টি গোচর হয়নি। এদিকে তৃতীয় দিন ভোরে তার নিজের দক্ষিণ খোলা ঘরের লাগোয়া বারান্দায় কর্ণেল সমরজিৎকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়।

সে মৃত্যু ছিল বীভৎস। বুক থেকে পেট অবধি নখের আঁচড়ে ফালা ফালা। গোটা বারান্দা রক্তে মাখামাখি। কোন শ্বাপদের অতর্কিত আক্রমনেই এমন সম্ভব। দেখলেই বোঝা যায় প্রতিরোধ বা আত্মরক্ষার এতটুকু সুযোগ পাননি। সাধারণত প্রতিদিন ভোরে খোলা ছাদেই যোগাভ্যাস বা শরীর চর্চা করে থাকেন। আজ হয়তো কোন কারনে বারান্দায় গিয়েছিলেন তখনি হঠাৎ আক্রান্ত হয়ে পড়েন। একটা বিকট গগন বিদারক চিৎকারে বাইরের লোক ঘরে এসে ওঁকে এই অবস্থায় পায়।

লাগোয়া গাছে নখের আঁচড়ে ছাল খুবলে গেছে, বাইরের বাগানে গাছপালা অবিন্যস্ত। বাড়ির উঁচু করে ঘেরা পাঁচিলেও নখের বড়ো বড়ো আঁচড় কাটা। ক্ষিপ্ত বাঘিনীটা তার বদলা নিয়ে গেছে। ঘরে বাইরে এমন কি কর্মক্ষেত্রেও এমন দাপুটে মানুষটার শেষ পরিণতি এইরকম অসহায় অবস্থায় হবে কেউ ভাবেনি।

আগের দিন সন্ধ্যায়

রাজবাড়ির মানুষজন গৃহলক্ষীর আরাধনার জোগাড়ে ব্যস্ত। দুপুর থেকে মদিরা পানরত কর্নেল সন্ধ্যা লাগতেই শিকারের বেশভূষায় তৈরি হয়ে নিজের রাইফেল ঘাড়ে নিয়ে নীচে নেমে এলেন। নীচের দালানের এক কোনে লালি তার প্রতিবন্ধী বাচ্চাটাকে বুকের কাছে আগলে শুয়ে আছে। অন্য বাচ্চাগুলো মায়ের আশেপাশে খেলে বেড়াচ্ছে। কর্নেল নেমে এসে লালির মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করতেই লালি মাথা তুলে একঝলক দেখেই সচেতন হয়ে গেল।

কর্নেল আলগা করে লালির বুক থেকে তার অসুস্থ বাচ্চাটাকে তুলে নিয়ে আদর করতে করতে সদর দরজার দিকে রওনা হলেন। লালি তখন থেকেই চিৎকার শুরু করেছে। ছুটে সদর অবধি গিয়ে একবার সমরজিতের পায়ে কামড়ানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হলো, তাঁর পা জোড়া শক্ত চামড়ার গামবুটে ঢাকা ছিল। এবার বৃথা আস্ফালন করে চলল। পর পর গাড়িগুলো বেরিয়ে যেতেই ছুটে ঘরে গিয়ে সমরজিতের মায়ের কাপড় ধরে টানাটানি করতে লাগলো। তিনি কিছুই না বুঝে একটু আদর করে আবার পুজোর জোগাড় করতে ব্যস্ত হয়ে গেলেন। সন্ধ্যা লেগে গেছে মায়ের আরাধনার শেষ সময়ের প্রস্তুতি চলছে। ঠাকুরমশাই এলেন বলে।

অসহায় বাচ্চাটাকে নদীর পাড়ে একটা ফাঁকা জায়গায় বসিয়ে একটা মাংসের টুকরো ওর মুখের সামনে দেওয়া হলো। শাবকটা সেটা পরম আনন্দে চেটে চেটে খেতে লাগল। সে জানতেও পারল না তার শিয়রে কখন শমন হাজির হয়েছে। কিছুক্ষণ পরে মায়ের ডাক শুনে তার দিকে একবার নিশ্চিন্তে দৃষ্টি দিতেই ঘাড়ে কামড় পড়ল। আর তাকে মুখে নিয়ে আর এক রায়বাঘিনী জঙ্গলের গভীরে সেঁধিয়ে গেল।

মালিকের ভয়ে লালি ঘন জঙ্গলের আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে ফেললেও তার অসহায় শাবকটার জন্য তার দুটো চোখ দিয়ে ঝরঝর করে জল পড়ছিল। কিছুক্ষণ পরে চুপিচুপি নিজের বাচ্চার ঘ্রান নিয়ে ঠিক বাঘিনীর আশ্রয়ে পৌঁছে গেল। ততক্ষণে তার প্রতিবন্ধী বাচ্চাটা ….। লালি রাগে গর্জে উঠল। এর প্রতিশোধ সে নেবেই। নিজের জাত চেনাতে উঠে পড়ে লাগলো।

দুদিন ধরে আহত বাঘিনীর উপরে ক্ষুধা তৃষ্ণা ভুলে লালি তীক্ষ্ণ নজর রাখছিল। যেই সন্ধ্যায় বাঘিনীটা একটু উঠে গেছে অমনি তার অলক্ষ্যে তার একটা বাচ্চা মুখে করে তুলে নিয়ে সোজা পালিয়ে এলো। বেশি দেরি করা যাবে না, যা করবার তাড়াতাড়ি করতে হবে। যে কোন সময়ে বাঘিনী তার বাচ্চার খোঁজে চলে আসতে পারে। রাজবাড়ির পিছনের দেওয়ালের ভাঙা অংশটা লালি জানত। সেখান দিয়ে বাচ্চাটাকে মুখে করে এনে উপরের দক্ষিণ খোলা ঘরটার লাগোয়া বারান্দার এক কোণে রেখে দ্রুত সেখান থেকে সরে পড়ল।

নিজের বাচ্চার শরীরের ঘ্রান নিয়ে একসময় আহত বাঘিনীটা রাজবাড়ির পিছনের দেওয়ালের ও’পাড়ে হাজির হলো। শাবকের গায়ের তীব্র গন্ধ তার নাকে ঝাপটা মারছে। বাচ্চাটাকে বাঁচাতে হবে, এখানেই কোথাও আছে। মা তার সন্তানকে বাঁচাতে যে কোন বিপদের ঝুঁকি নিতে পারে। একসময় বাঘিনীটা দেওয়ালের ভাঙ্গা অংশ দিয়ে অনায়াসে ভেতরে ঢুকে পড়ল। তারপর অতি কষ্টে সামনের গাছ বেয়ে বারান্দায় লাফিয়ে নামল। তখন ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে।

এদিকে ঘরের ভিতরে একটা বোটকা গন্ধে কর্নেলের ঘুম ভেঙে গেছে। বারান্দায় কারো পায়ের আওয়াজ। তিনি উঠেই সোজা দরজা খুলে খোলা বারান্দায় পা রাখলেন। নিয়তি তাঁকে আরেক মায়ের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। এইবার বাঘিনীর জ্বলন্ত দৃষ্টির সামনে তিনি অসহায়। মুহূর্তেই সমস্ত রাগ নিয়ে এক দুগ্ধপোষ্য শিশু সন্তানের মা তাঁর উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাঁকে ধারাল নখের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত করে ফেলল। সেই মুহূর্তে নিজেকে সঁপে দেওয়া ছাড়া কর্নেলের আর উপায় ছিল না।

——– X ——–

সমরজিতের আর্ত চিৎকারে লোকজন উঠে পড়েছে। জঙ্গলের রানী তার সন্তানকে মুখে নিয়ে উপর থেকে ঝাঁপ দিয়ে পাঁচিলে পড়েই জঙ্গলের আড়ালে হারিয়ে গেল। ঘর ভর্তি লোকের ফাঁক দিয়ে শুধু লালি এঘরে উঁকি দিয়ে তার বেইমান মালিককে একবার দেখে গেল। সে চোখে তখন একদিকে ছিল ঘৃণার আগুন, আর অন্যদিকে বদলার শান্তি। তারপর থেকে লালি ও তার সন্তানদের রাজবাড়ির আশপাশে আর কেউ কোনদিন দেখেনি।

লেখক পরিচিতি : রূপালী সামন্ত
আমি ভিন্ন স্বাদের ছোট বড়ো গল্পকার। বিভিন্ন সামাজিক পত্র পত্রিকায় আমার লেখা বেশ কয়েক বছর ধরে প্রকাশিত হচ্ছে। বিগত বইমেলায় আমার একক প্রেমের সংকলন ও বর্তমান বইমেলায় আমার একক রহস্য সংকলন প্রকাশিত হয়েছে।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।