লেখক : লোপামুদ্রা সিংহ দেব
অফিস থেকে বের হতে দেরি হয়ে গেছিল শ্রীজার। বেরিয়ে দেখে আকাশ কালো, এখনই ঝমঝম করে বৃষ্টি নামবে। এদিকে বাসেরও দেখা নেই। কি করবে কিছুই বুঝতে পারছিলনা, এমন সময় একটা বাস এল। কয়েকজন মাত্র যাত্রী। বিভিন্ন স্টপেজে লোক নেমে গেলে মাত্র ৬/৭ জন যাত্রী নিয়ে বাস ছুটে চলল বারাসাতের দিকে। বাইরে প্রচণ্ড জোরে বৃষ্টি শুরু হয়েছে।
ফাঁকা বাস, বৃষ্টি আর রাত হওয়ায় রাস্তাও বেশ ফাঁকা, তাই বেশ জোরেই চালাচ্ছিল ড্রাইভার। হঠাৎ একটা তীব্র আওয়াজ তুলে দাঁড়িয়ে গেল বাসটা। ড্রাইভার, কন্ডাক্টর দৌড়ে নেমে গিয়ে কিছুক্ষণ পর গম্ভীর মুখে এসে জানাল বাসের টায়ার পাংচার, আর যাবেনা। আঁতকে উঠল শ্রীজা। “তবে আমি কি করবো?” কেউ কোন উত্তর দিল না সে কথার। সবাই নেমে পড়ছে দেখে বাধ্য হয়ে ওকেও নামতে হল।
বৃষ্টির জোরও বাড়ছে, সাথে বাতাস। ছাতা ঠিক থাকছেনা। অন্ধকার রাস্তায় মোবাইলের আলোই সম্বল। মানসীদিদিকে ফোন করলো শ্রীজা। ফোনটা বেজে গেল, কেউ ধরল না। তবে কি মানসীদিদিও বৃষ্টিতে আটকে পড়েছে তারই মত? কি করবে ও এখন? এক অজানা ভয় সর্বাঙ্গে।
বাবাকে দেখার জন্য এসেছিল মানসীদিদি। তার আপনজন বলতে কেউ নেই। তাই বাবা মারা যাবার পর তাকে আর যেতে দেয়নি শ্রীজা। আজ দুজনেই দুজনের অবলম্বন।
বিদ্যুতের আলোতে বাঁ-পাশে একটা বাড়ি দেখতে পেয়ে তাড়াতাড়ি সেদিকে এগিয়ে গেল শ্রীজা। গেট খুলে ছোট বাগান পেরিয়ে বারান্দায় উঠে কিছুটা স্বস্তি। কিন্তু বৃষ্টির বেগ আরও বাড়ছে। বারন্দায় জলের ছাট। দু’টো কুকুর শুয়ে আছে, শ্রীজার পায়ের শব্দে বিরক্ত হয়ে ঘেউ ঘেউ করলো দু’বার। তারপর আবার কুন্ডলী পাকিয়ে শুয়ে পড়লো। ভয়ে, ভাবনায়, আর একটু আশ্রয়ের আশায় দরজার কড়া নাড়ালো সে। কারও সাড়া পাওয়া গেল না। মরিয়া হয়ে দরজায় জোরে জোরে ধাক্বা দিতে একটা ক্ষীণকন্ঠ শোনা গেল। “কে?”
শ্রীজা চেঁচিয়ে বললো, “খুব বিপদে পড়েছি, প্লিজ সাহায্য করুন।”
জানলা দিয়ে একটা সরু আলোর রেখা আর এক বৃদ্ধার মুখ দেখা গেল। শ্রীজা হাতজোড় করে বলল, “খুব বিপদে পড়েছি, বাস খারাপ হয়ে গেছে, এদিকে এত বৃষ্টি আর অন্ধকার। বড্ড ভয় করছে।”
বৃদ্ধা জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি একলা?”
“হ্যাঁ ঠাকুমা। অফিস থেকে বের হতে দেরী হয়ে গেছিল। রাস্তায় বাস খারাপ হয়ে গেল। আপনাদের বাড়িটা দেখে একটু আশ্রয়ের আশায় ঢুকে পড়েছি।”
জানলাটা খুলে টর্চের আলোয় ভালো করে দেখে দরজা খুললেন বৃদ্ধা। ভিজে জামাকাপড়ে জড়সড় হয়ে ভেতরে ঢুকল শ্রীজা। টিমটিম করে একটা লাইট জ্বলছে। ঘরের এক কোণে ততোধিক শীর্ণ এক বৃদ্ধ ঘুমোচ্ছেন। বৃদ্ধা বললেন, “আমার স্বামী অসুস্থ। ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমোচ্ছেন। জোরে কথা বলোনা। তুমি তো দেখছি পুরো ভিজে গেছো। এক কাজ করো, পাশের ঘরে গিয়ে ভিজে কাপড়টা ছেড়ে আমার একটা নাইটি পরে নাও। আলনাতেই রাখা আছে।”
শ্রীজা বলে, “না না, আপনাকে ব্যস্ত হতে হবে না। সিন্থেটিক শাড়ি, একটু পরেই শুকিয়ে যাবে।”
“যা বলছি শোন। ভিজে গায়ে থাকলে অসুখ করবে। শাড়ি, ব্লাউজটা দড়িতে মেলে দিও।”
কতদিন পর এমন মধুর শাসন শুনলো শ্রীজা। মা চলে যাবার পর বাবাও বড় চুপচাপ হয়ে গেছিলো। কথা প্রায় বলতই না। আর এখন তো বাবাও নেই।
চেঞ্জ করে আসতেই বৃদ্ধা দু’টো রুটি-তরকারি আর একটা মিষ্টি এনে দিলেন। “খেয়ে নাও। ঘরে যা আছে, তাই দিয়েছি মা।” শ্রীজা না করতে পারল না সেই স্নেহভরা কন্ঠস্বরকে। আর খেতে গিয়ে বুঝতে পারল কতটা ক্ষিদে পেয়েছিলো তার।
ঘরের নিশ্চিন্ত আশ্রয়ে ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল শ্রীজা। হঠাৎ একটা বাজ পড়ার আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেল তার। হ্যারিকেনের আলোয় দেখল একটি ছেলে বৃদ্ধর মাথার কাছে বসে। তাকে অতি যত্নে খাইয়ে দিচ্ছেন সেই বৃদ্ধা ভদ্রমহিলা। হঠাৎ করে ছেলেটির মুখ দেখতে পেয়ে চমকে উঠলো শ্রীজা। এ কি? এ কে? শুভম! শুভম এখানে এল কি করে? কতদিন, ক-তো দিন পর শুভমকে দেখল শ্রীজা। প্রেসিডেন্সির উজ্জ্বল নক্ষত্র, তার একান্ত কাছের মানুষ শুভম হঠাৎ একদিন বেপাত্তা। ক’দিন পর একটা চিরকুট পেয়েছিল শ্রীজা। শুভম লিখেছে,
“আমি বিপ্লবের পথে পা বাড়িয়েছি। সংসারের বেড়াজাল আমার জন্যে নয়। নিপীড়িত, শোষিত, জনগণের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের ন্যায্য অধিকার পাইয়ে দেওয়ার, তাদের মুখে হাসি ফোটানোই আমার জীবনের লক্ষ্য―পারলে আমাকে ক্ষমা করিস।” তারপর আর দেখা হয়নি।
কলেজ থেকে বেরিয়েই চাকরিটা পেয়ে গেছিল শ্রীজা। বাবার শত অনুরোধেও বিয়ে করতে রাজি হয়নি। বোনের বিয়ে দিয়ে বাবাকে আর স্বজন হারানো মানসীদিকে নিয়েই তার সংসার। সহায়সম্বলহীন মানসীও এই সংসারটাকে আপন করে নিয়েছিল। মাস পাঁচেক আগে বাবা মারা যেতে সন্তানস্নেহে শ্রীজাকে আগলে রাখে মানসী।
নিজের অজান্তেই শ্রীজা দাঁড়িয়ে পড়লে অবাক বিস্ময়ে শ্রীজাকে আবিষ্কার করে শুভম। বলে ওঠে, “শ্রীজা, তুই? এখানে? কি করে?”
“সে প্রশ্ন তো আমারও শুভম। শুনেছিলাম তুই ছত্তিশগড়ে চলে গেছিস, আর কেউ তোর কোন খবরই পায়নি এতদিনে।”
বৃদ্ধা খাবার থালাটা রাখতে গেছিলেন। ফিরে এসে ওদের কথা শুনে অবাক হয়ে বললেন, “শুভ, তুই চিনিস মেয়েটিকে?”
“হ্যাঁ ঠাম্মি, এই সেই শ্রী, যার কথা আমি তোমাকে কতবার বলেছি। আর শ্রী, এই আমার ঠাম্মি। তুই তো জানিসই, ট্রেন অ্যাক্সিডেণ্টে মা-বাবা চলে যাবার পর ঠাম্মি, দাদুর স্নেহচ্ছায়ায় আমি বড় হয়েছি। দাদুর অসুখ শুনে আমি থাকতে পারিনি, চলে এসেছি।”
“ও, এই তোমার সেই মনের মানুষ?”
চমকে ওঠে শ্রীজা। অভিমান জড়ানো গলায় বলে, “ছিলাম ঠাম্মি, কোন এক সময়ে।”
“না রে মেয়ে, আমি তোদের সব কথা জানি। আমার বাবানের মনের ভেতর তুই-ই আছিস। একমাত্র তুই। কিন্তু ও এমন একটা চক্রব্যূহে জড়িয়ে পড়েছে, যে সেখান থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব নয়। শোন, আমি এখানে বসছি, তোরা ভেতরের ঘরে গিয়ে এতদিনের জমা কথাগুলো বলে একটু হালকা হয়ে নে। বাবানের ট্রেন তো ভোররাতে, আমি ঠিক সময়ে ডেকে দেব।”
শ্রীজার হাত ধরে ভেতর ঘরে নিয়ে আসে শুভম। এসে বলে, “শ্রী, কেউ জানতে পারার আগেই আমায় চলে যেতে হবে এখান থেকে। কিন্তু এই অসুস্থ মানুষটাকে ফেলে যেতে মন চাইছেনা রে। জানিস শ্রী, বিপ্লবের যে স্বপ্ন আমাদের দেখানো হয়েছিল, তা যে কতটা মিথ্যে, তা আজ আমরা মর্মে মর্মে অনুভব করছি। কিন্তু একবার যে এই পথে পা বাড়িয়েছে, তার আর ফেরা সম্ভব নয়। ফিরে যেতে চাইলে দলের লোকেদের হাতের বন্দুক গর্জে উঠবে। আবার এদিকে পুলিশ হন্যে হয়ে আমাদের খুঁজে চলেছে, আমাদের অনেক সাথীই পুলিশের হাতে প্রাণ হারিয়েছে। আবার দলের অন্যায় দেখে প্রতিবাদ করলে দলের নেতারা পুলিশের চর বলে। আমিও আর এমন করে পালিয়ে বেড়াতে পারছিনা রে। কত স্বপ্ন দেখেছিলাম এই সমাজকে নিয়ে। আর আজ আমাদেরকেই সমাজের শক্র বলে দাগিয়ে দেওয়া হয়েছে।”
শ্রীজা বলে, “শুভম, এতদিন পরে তোর সাথে দেখা হল তোর দাদু, ঠাম্মির বাড়িতে – এটা এক আশ্চর্য ঘটনা। তবে আমি মনে করি, কারণ ছাড়া কোন কার্য হয় না। হয়ত এই দেখা হবার পেছনেও কোন কারণ আছে। শোন, তোকে তো ফিরতেই হবে, তুই ফিরে যা। তবে মনে রাখিস, তোর শ্রী কেবল তোকেই ভালোবাসে। আমি কথা দিচ্ছি, আমি দাদু আর ঠাম্মির দেখাশোনা করব, ওঁদের কোন কষ্ট হতে দেবনা। ওঁদের কাছে তো আমারও কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। এই ঝড়জলের রাতে আমায় আশ্রয় না দিলে কি যে বিপদে পড়তাম, ভাবতেই ভয় লাগে।”
আজ কতদিন পরে দু’জনে একসাথে। অনেক দিনের না বলা কথারা ভিড় জমায়, শ্রীজার হাতে হাত রেখে চুপ করে বসে থাকে শুভম। স্মৃতিরা টুপটাপ ঝরে পড়ে। মন ছেড়ে দিতে চায়না, তবু হায় চলে যেতে দিতে হয়।
ঠাম্মির হাত শ্রীজার হাতে দিয়ে পথে নামে শুভম।
শ্রাবণ নামে শ্রীজার দু’চোখে। ঠাকুমার হাত শক্ত করে ধরে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করে সে। শ্রীজাকে জড়িয়ে ধরে ঠাম্মি।
লেখক পরিচিতি : লোপামুদ্রা সিংহ দেব
প্রবাসি বাঙ্গালি। বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় গল্প, প্রবন্ধ, কবিতা প্রকাশিত হয়। আঁধার পেরিয়ে (ছোটো গল্পের) প্রকাশিত বই। প্রাপ্তি -'স্বর্ণ কলম' 'অনুরত্ন' ও মানব মুখার্জি স্মৃতি সম্মাননা (from KIMFF ), মধুসূদন দত্ত সম্মাননা (from Mukta Balaka)।