লিপিলেখা

লেখক : দীপান্বিতা মিত্র

লেপ ছেড়ে উঠতে ইচ্ছা করছেনা লিপির। মা এসে একবার তাগাদা দিয়ে গেছেন, বেশ ঠাণ্ডা-ঠাণ্ডা আবহাওয়া,লেপটা গায়ে ভালো করে টেনে নিল লিপি, “এবারে গায়ে ঠাণ্ডা জল ঢেলে দেবো…”মা রান্নাঘর থেকে ঘুরে এসে ওকে শুয়ে থাকতে দেখে রেগে লাল!

লিপি ধড়মড় করে উঠে বসলো। আজ স্কুলে অবশ্য খুব ইম্পর্টেন্ট একটা ক্লাস আছে।ম্যাম সকলকে আজ তৈরি হয়ে যেতে বলেছেন। মনে পড়তেই লিপি তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নিল।

বেরিয়েই শ্রীমাকে দেখে মনটা ভালো হয়ে গেলো লিপির।

শ্রীদি , এতো সকালে তুমি কোথায যাচ্ছো গো?

শ্রীমার মুখ উদ্ভাসিত,ওকে জড়িয়ে ধরে বললো, “জানিস,বিক্রম আসছে ,ওর কিসব কাজকর্মের জন্য ইণ্ডিয়ায় আসবে। রবিবার আমাদের এখানে আসবে,বলেছে, মা তাই খুব খুশি। শিব মন্দিরে যাচ্ছি মায়ের পূজোটা দিতে।”

এই রবিবার? ও মা, তবে তো এসেই গেল… লিপিও উচ্ছ্বসিত, বিক্রম দাদাকে দেখেনি কোনোদিন,শুধু গল্প শুনে এসেছে। দেখতে পাবে এই উত্তেজনায় তার ছেলেমানুষ- মুখটা চকচক করে উঠলো।

স্কুল থেকে ফিরেই মাকে আগেই খবরটা দেওয়া চাই “জানো মা,বিক্রম দা আসছে”। মা-ও কপালে হাত ঠেকিয়ে বললেন,”যাক বাবা,সুতপাদি’ ছেলেকে দেখতে পাবে তবে,ছেলে-ছেলে করেই তো জীবনটা কেটে গেলো”

লিপি অবাক হয়না। ছোট্টবেলা থেকেই দেখে আসছে সুতপা আন্টি ভীষণ অন্যমনস্ক। তারজন্য কথাও শুনতে হয় প্রচুর। লজ্জাও পান,লজ্জা পেলে সুতপাআন্টিকে বেশ লাগে দেখতে। ছাদে উঠে আকাশের দিকে তাকিয়ে কি যেন সব চিন্তা করেন। ওদের বাড়িতে তো লিপির অবারিত দ্বার। লিপির মা দেবিকার সঙ্গে সুতপার খুব ভাল বন্ধুত্ব। মাঝে-মাঝেই ওরা গল্প করে ছেলের ব্যাপারে, লিপি শুনেছে। কি বলে অত বোঝার মত বয়েস তখনও ওর হয়নি।

একটু বড় হয়ে ও সুতপা আন্টিকে জিজ্ঞেস করেছিল,কি এতো ভাবো আন্টি?সুতপা আন্টি সেদিন ওকে খুব আদর করতে-করতে বলেছিলেন–এক রাজপুত্তুরের কথা।

কে সে?কোথাকার রাজপুত্তুর?

সুতপা আন্টি খুব হাসছিলেন। বড় মিষ্টি সে হাসি। লিপির খুব ভাল লাগে সুতপা আন্টির ওই হাসিমাখা মুখটা।

বললেন,তুই কৃষ্ণ ঠাকুরের গল্প জানিস না? দু’দুটো মা যার?

লিপি মাথা নাড়ে,সে শুনেছে। মা তাকে গল্পটা বলেছে।

সে-ই রকমের-ই এক রাজপুত্তুর। তারও দুটো মা। সে জানেনা। মা’র খুব মনখারাপ করে, মা তার ছেলের সবসময়ই মঙ্গলকামনা করে…

তারপর ওর গাল টিপে খুব আদর করে বলেন,ও তুই বুঝবিনা সোনা….

সত্যিই ওই কথাগুলোর মাথামুণ্ডু কিছুই বোধগম্য হয়না তার।

আর একটু বড় হ’য়ে শ্রীমার কাছে একটু-আধটু যা শুনেছে আর মায়েদের কথাবার্তায় যা বুঝেছে ,ছোটমনে ওর কৌতুহল আরো বাড়িয়ে দিয়েছে।

শ্রীদি বলেছিলো,শ্রীদির মাসির প্রথম ইস্যুর সময়ই খুব প্রবলেম দেখা দেয় ,জীবন-মরণ সমস্যা। মাসি এদিকে” বেবি-বেবি” করে পাগল।

সন্তান প্রসবের সময় অনেক চেষ্টা করেও কিছু করা গেলনা। নাড়িতে জড়িয়ে ছেলে নীল হ’য়ে গিয়েছিল। শ্রীদির মা ,মানে,সুতপা আন্টি তখন তাঁর সদ্যোজাত শিশুপুত্রটিকে বোনের পাশে শুইয়ে দিয়েছিলেন । সেইথেকেই বিক্রম মাসিমণির ছেলে। মেসোবাবু কাজের সুত্রে আমেরিকায়,সেখানেই বাড়ি -গাড়ি সব । এখানে বড় একটা আসা হয়না। শুধু ভিডিও-ভরসা।

মা আর সুতপা আন্টিকেও গল্প করতে শুনেছে,

“শুধু ভিডিওতে দেখে কি মন ভরে,বল?”

মা-ও সমব্যথী। এক-আধবার তো এনে দেখা করিয়ে নিয়ে যেতে পারে!

“সেই যখন সবে নয় বছর কমপ্লিট করেছে,তখন একবার এনেছিল। ” তা প্রায় পনের বছর হতে চললো- ।

অর্থাৎ পনেরো বছর পর বিক্রম দাদা আন্টির সঙ্গে দেখা করতে আসছে। লিপি নিজের মনে বলে।

আজ রবিবার। লিপির উত্তেজনার শেষ নেই,কখন দেখতে পাবে বিক্রম দাদাকে। শ্রীদিদি তো সবসময়ই ভাই-এর প্রশংসায় পঞ্চমুখ। পড়াশুনায় সেরা,ডাক্তারি পড়ছে,খেলাধুলায় চ্যাম্পিয়ন আর আন্টি তো ছেলের গানের অন্ধ ভক্ত—- যখনই ভিডিও করে,গান শোনাতেই হবে।আর লিপির মা সর্বক্ষণ “দ্যাখ দেখে শেখ,তোর থেকে আর কতোই বা বড়?–ইত্যাদি-ইত্যাদি।” এ হেন মানুষটিকে দেখার কৌতুহল হওয়াটা তো খুবই স্বাভাবিক।

হঠাৎই শ্রীদিদিদের বাড়ি থেকে একটা হৈচৈ কানে এলো–লিপি লাফ দিয়ে নেমে পড়ে-‘-তবে বুঝি বিক্রম দাদা এসে গেছে ‘

জানলা দিয়ে উঁকি মেরে তো হতবাক। কি হোলো?মা অমন আটপৌরে শাড়ী পরেই ওদের বাড়িতে ছুটে গেলো কেন?শ্রীদিদি কই? আর ওদের বাড়িতে এতো ভীড়…ডাক্তার আঙ্কেলের গাড়ি…..লিপি কিছুই মেলাতে পারছে না। ওর মাকে ফিরে আসতে দেখে ছুটে নিচে নেমে এসে দ্যাখে মায়ের চোখ ভর্তি জল, বাপিকে বলছে, আজ সকালে হঠাৎ সুতপাদি’র হার্ট এটাক, ডঃব্যানার্জী আসতে-আসতেই সব শেষ।

কাঁচের গাড়ি,ফুল-মালা—আনুষঙ্গিক সব কাজ সম্পূর্ণ,এখন শুধু বিক্রমের আসার অপেক্ষা।শ্রীমা কাঁদতে-কাঁদতে কাকে বলছে,

খুব ভোরে উঠে আগে পূজো করে ছেলের পায়েস রান্না করেছে,সবকিছুই ঠিকঠাক। হঠাৎই ,”শরীরটা কেমন যেন করছে” ,ব’লে মেঝেতেই বসে পড়ে,তারপরই সব শেষ।

গাড়ির হর্ন শোনা গেল। একটুপরেই গাড়ি থেকে নামলো বিক্রম, বিক্রম সিংহ। স্যুটেড-বুটেড একজন সাহেব, লিপির অন্তত তাই ই মনে হোল। জুতো খুলে কাঁচের গাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়াল,হাতে রজনীগন্ধার মালা। মায়ের পায়ে রজনীগন্ধার মালা খুব সন্তর্পনে রাখল, যেন মায়ের ঘুম ভেঙে না যায়,তারপর পায়ের ওপর মাথা রেখে হাপুস নয়নে কান্না।

পেছন থেকে কান্নাভেজা গলায় শ্রীমা বলছে, ”মায়ের হাতের তৈরি পায়েস,একটু মুখে দে। তোর জন্যই করা। মায়ের আত্মা একটু হলেও শান্তি পাবে…..”

শ্রীমার-ই মুখাগ্নি করার কথা ছিল কিন্ত বিক্রম জেদ ধরলো,মাসিমার মুখাগ্নি ও-ই করবে। কারোর কোনো ওজর-আপত্তি কানেই তুললোনা।

শ্রীদিদি ঠিকই বলে,ছেলেবেলা থেকেই ভাই ভীষণ জেদী—। কিন্ত লিপি দেখলো ওর মা ,পাড়ার অন্যান্য আন্টিরা কিন্ত খুব খুশি। সকলেই কমবেশি বিক্রমের প্রশংসা-ই করছেন।

আন্টিকে নিয়ে চলে যাওয়ার পর সব যখন আস্তে-আস্তে খালি হয়ে গেলো, লিপি চুপচাপ সুতপার ঘরের দিকে এগিয়ে গেলো। যেখানকার যেমন সব সেরকমই আছে,শুধু মানুষটা নেই। খালি ঘর,সুতপার চুলের কাঁটা গুলো ড্রেসিং টেবিলের ওপর এখনো পড়ে আছে,সকালে স্নান করতে যাওয়ার আগে হয়তো খুলে রেখেছিল। আলনায় সকালে পুজো করে এসে খুলে রাখা গরদের শাড়িটা এলোমেলো রাখা,পাট হয়নি….

লিপি জোরে একবার নিঃশ্বাস নিলো। সদ্য স্নান করে আসা সুতপা আন্টির গায়ের সেই মিষ্টি-মিষ্টি গন্ধ….চোখের জল আর বাধা মানলোনা, মনে-মনে বললো “….আন্টি,তোমার রাজপুত্তুর এসেছে গো…”

কখন যে ধীরপায়ে মা এসে তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে, সে খেয়াল-ই করেনি। মাথায় স্নেহের স্পর্শ অনুভব করে,দ্যাখে মা তার মাথায় হাত বোলাচ্ছেন।মায়ের চোখেও জল। খুব আস্তে -আস্তে বললেন, ‘ঘরে চল’।

তারপর যে কখন ওরা শ্মশান থেকে ফিরেএসেছে, ও জানেনা।

পরদিন সকালে মা-বাপির সঙ্গে আবার যখন ও ওই-বাড়িতে গেলো,ততক্ষণে নিকটজনেরা

এসে গেছেন, প্রদীপ আঙ্কেল সোফার এককোণে চুপ করে বসে, বিক্রম দাদা পাশে,শ্রীদিদি ওদের দেখে উঠে এলো।মা কালকের সব খোঁজখবর নিলেন পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে। শরীরের দিকে নজর রাখতে বললেন, বিশেষ করে প্রদীপ আঙ্কেলের। শ্রীমা বলল, বাপি খুব আপসেট হয়ে আছে।

ওর এখন নিয়মিত রুটিন হোলো, একবার করে এখানে ঘুরে যাওয়া। প্রথম-প্রথম মায়ের সঙ্গেই আসত, এখন আর দরকার হয়না।

বিক্রম দাকেও আর সাহেব-সাহেব লাগছে না। বরং খুব ঘরোয়া। যা যা আচার-অনুষ্ঠান ,সবকিছুই ঠিকঠাক পালন করছে। সর্বোপরি লিপির সঙ্গে বিক্রমের খুব ভাব হয়ে গেছে। যেটুকু পড়াশুনার সময়, তা বাদে সারাক্ষণ-ই ও বিক্রমের গা ঘেঁষে—।মাঝে-মাঝেই লিপির মা বিক্রম কে বলেন, খুব বিরক্ত করে তোমাকে, একটু বকবে। তারপরই কথা ঘুরে গিয়ে অনুযোগের সুরে লিপিকে বলেন, দাদার থেকে অনেক কিছুই শেখার আছে, কেবল বাজে কথা না বলে একটু অঙ্কটাতো দেখে নিতে পারও।

শ্রীমা লিপির পক্ষ নিয়ে বলে, তুমি কিন্ত একটু বাড়িয়ে বলছো আন্টি। আমাদের লিপি মোটেই পড়াশুনায় খারাপ নয়…

পড়াশুনাটা করে কখন? সারাদিন তো হাতে ওই মোবাইল। খালি আড্ডা,সর্বক্ষণ শুধু চ্যাটিং।

তো ?শ্রীমার মুখে মৃদু হাসি। সময়টাতো বদলেছে আন্টি। তোমরা রাতদিন বুঝি বন্ধুরা মিলে আড্ডা মারতে না?

না রে, আমাদের অতো আড্ডা ছিলনা। শুধু বিকেলে পাড়ার মাঠে …. একটু থেমে বলেন, এখন আর সেই পাড়া-ও নেই। মাঠও নেই।

তবেই বোঝ– শ্রীমা কথাটা লুফে নেয়।–আমাদের কি করার আছে মোবাইল ঘাঁটা ছাড়া…

লিপির মনে-মনে খুব আনন্দ শ্রীমা ওর পক্ষ নিয়েছে বলে। ওদিকে কিন্ত বিক্রম খুব মজা পায় এসব কথায়। হাসে আর বলে,হ্যাঁ,অঙ্ক বই,খাতা আর পেন– নিয়ে এসো তো খুকুমণি।

লিপি আরও রেগে যায়। চোখ পাকিয়ে বিক্রমকে বলে,আমি খুকুমণি নই।বিক্রম তাতে মজা পেয়ে আরো জোরে হাসে আর ও ততোধিক রেগে গিয়ে দুমদুম করে পা ফেলে বাড়িতে চলে আসে,মনেমনে প্রতিজ্ঞা করে ,

কাল থেকে ওই বাড়িতে আর যাবেনা,যাবেই না।আর ওই মহান ছেলেটার সঙ্গে দেখাও করবেনা

পরদিন হলেই আবার কেমন মন উশখুশ….।

বিক্রম দাদা খুব খারাপ না। কি সুন্দর ঝরঝরে বাংলা বলে, একটু হয়তো বিদেশী-টান আছে,তাতে কি? সে তো জন্ম থেকে ওদেশে আছে বলেই। লিপি নিজেকেই বোঝায়। বিক্রমের মুখে একবারের জন্য-হলেও একটা ইংলিশ শব্দ শোনেনি কেউ। সবথেকে আশ্চর্যের,কথায়-কথায় রবীন্দ্রনাথ। মাঝে-মাঝে আবার বসে-বসেই রাইমস্ বানিয়ে ফেলে, লিপি ওকে যত দ্যাখে,ততই অবাক হয়। ক্লাসের সবথেকে প্রিয় বন্ধু ইমনের সঙ্গে সব শেয়ার করে। বিক্রম দাদার গল্প-ও করেছে। ইমনেরও কৌতুহলের শেষ নেই। চোখ বড় বড় করে বলে,এ তো জিনিয়াস রে!

সামনের মাসেই পরীক্ষা শুরু। এবার আইসিএসই পরীক্ষা দিচ্ছে লিপি। আজ একটা বিশেষ দরকারে একবার স্কুলে যেতে হয়েছিল। বাড়ি ফেরার সময় চোখে পড়লো ওই সাদা প্যান্ডেলটা , একটা শোকের বার্তা নিয়ে যেন ঠায় দাঁড়িয়ে। মনে পড়লো কাল রাত্রে বাপি -মায়ের কথা। নিজেদের মধ্যেই বলাবলি করছিলেন–জলজ্যান্ত হাসিখুশীতে ভরা মানুষটা নেই,যেন ভাবাই যাচ্ছেনা। প্যাণ্ডেলটার দিকে তাকান যায় না।

বাপী আঙ্কেলের কথা বলছিলেন। ‘ওই রাশভারী মানুষটার এমন অসহায় অবস্থা!’

বাড়ি ফিরে এসে দ্যাখে, প্রদীপ আঙ্কেল, বিক্রম দাদা আর শ্রীদিদি ওদের বাড়িতে। টেবিলে নিমন্ত্রণের কার্ড। মা বলছেন, এটা কি নিমন্ত্রণ করার মতো খবর?

ম্লান হেসে প্রদীপ আঙ্কেল বললেন, এবছর ফাগুন মাসেই তো শ্রীমার বিয়েটা দেবার ইচ্ছে ছিল। অর্ক ব্যাঙ্গালোর থেকে ওই সময় ফিরবে,ছুটির দরখাস্ত-ও জমা পড়ে গেছে। শ্রীর তো ঠিক ছিল কিছুদিন অন লাইন সার্ভিস করে, ওখানেই একটা কাজের জোগাড় করে ফেলার। সেই মতোই সব এগোচ্ছিল,হঠাৎ-ই…..

আপনি একটু শক্ত হোন দাদা। এ সময়ে আপনিই তো ওদের বড় ভরসা…

হ্যাঁ,আমি ঠিক আছি। আঙ্কেল জোর দিয়ে বলার চেষ্টা করেন।বৃথা একটু হাসার চেষ্টা ,

অফিস যেতে আরম্ভ করলেই সব ঠিক হ’য়ে যাবে।

কথাবার্তার মাঝখানেই লিপি সকলের অনুমতি নিয়ে ওপরে চলে এলো। ভালো লাগছেনা এসব আলোচনা।খানিক বাদেই মা লুচি আর সুজি নিয়ে ঘরে ঢুকলেন,ঘামে ভেজা মুখ। এই মুখটা লিপির খুব পছন্দের। আদর করে মাকে জড়িয়ে ধরে। মা-ও”ছাড়,ছাড়!” ব’লে মেয়েকে আদর করতে-করতে বলেন,

খেয়ে নে,ঠাণ্ডা হয়ে যাবে ।প্রদীপ দাকেও দিলাম,জানিস,খুব তৃপ্তি করে খেলেন। ছেলে মেয়েকে তো আর এসব দেওয়া যাবে না…. ও-ই একটু ফল-মিষ্টি…

ফুল দিয়ে খুব সুন্দর করে সাজানো হয়েছে সুতপার ছবিটাকে, কপালে ছোট্টকরে সিঁদুরের টিপ। পাশে ফুলদানীতে রাখা আছে তাদের নিজেদের বাগানের ,সুতপার নিজের হাতে লাগানো রজনীগন্ধার স্টিক। আর তারপাশে সুতপার খুব পছন্দের মোমো। চন্দনের গন্ধে চারদিক ম’ ম’ করছে।

শ্রীমা মাকে জল দিয়ে ওঠার পর বিক্রম বসলো। ঠাকুর মশাই-এর শুদ্ধ সংস্কৃত উচ্চারণ যেন গম্ভীর একটা পরিবেশ তৈরি করেছে।বিক্রমের এখনকার মা সুলতা সংস্কৃতে ডক্টরেট । ছেলেকে তিনি ওখানে যতটা সম্ভব সংস্কৃত সম্বন্ধে শিক্ষাদান করার চেষ্টা করেছেন।বলেন,সংস্কৃত না শিখলে বাংলাকে চেনা যায়না।ঠাকুরমশাই-এর সঙ্গে তারও গলায় সুন্দর লাগছে সংস্কৃত মন্ত্র ।

খাওয়ার সময় শ্রীমার সঙ্গেই লিপি বসল। লিপির মা আর বাবা,দেবিকা আর প্রনবেশ খেতে বসলেন না। একটু মিষ্টি-আর জল খেয়ে চলে এলেন ।

“আজ কিছু মুখে তুলতে পারব না, পরে একদিন…..”

দু’একদিনের জন্য এসে অনেকদিন হ’য়ে গেলো বিক্রমের। আজ নিয়মভঙ্গ। সব শেষ। একটা মানুষের জীবনের ওপর একটা মস্ত বড় দাঁড়ি পড়ে গেল। বিক্রম ছবির সামনে দাঁড়িয়ে ভাবছিল। কেউ আকুল হয়ে বলবে না, রোজ একবার করে অন্ততঃ তোর মুখটা দেখাস সোনা!আস্তে-আস্তে সকলেই নিজেদের -নিজেদের কাজের মধ্যে ডুবে গিয়ে বেমালুম ভুলে যাবে , একদিন যে একজন ছিল,তার অস্তিত্ব,তার অনুভূতি…..।একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস পড়লো । চোখের কোণটা কেমন জ্বালা-জ্বালা করছে। ছবিটার ওপর পরম আদরে হাত বোলায় সে।কাল ফিরে যেতে হবে তাকে,যেতেই হবে। অনেক কাজ জমা হয়ে আছে এতোদিনের। শ্রীমা পাশে এসে দাঁড়ায়। ভাই-এর পিঠে হাত রাখে,

খুব কষ্ট হচ্ছে,ভাই?

বিক্রম ইতিবাচক মাথা নাড়ে। শ্রীমা যেন নিজের মনেই বলে,এই বাড়ির সবকিছুতেই তো মায়ের হাতের ছোঁয়া। বাড়িটা যদি কথা বলতে পারতো,কান্নায় গলা বুঝে আসে তার। সামলে নিয়ে বলে,”বলত, আমিও আজ মাতৃহারা হলাম”…

নিয়মমাফিক নিয়মভঙ্গের কাজকর্ম সুষ্ঠভাবেই সম্পন্ন হয়ে গেছে। লোকজন সবাই যে যার মত চলে গেছে, এখন একটা বিশাল ফাঁক যেন গিলে খেতে আসছে….লিপি নিচে থাকতে না পেরে সুতপা আন্টিদের ছাদে উঠে এল।অস্তমিত সূর্যের দিকে তাকিয়ে সুতপার কথাই চিন্তা করছে লিপি।এমনই একটা দিনে,তখন সবে একটু-একটু শীত পড়বে-পড়বে করছে, হয়তো বা হেমন্তের শেষ, একটা হালকা চাদর (রঙটাও মনেআছে,গঙ্গাজল-গঙ্গাজল)

গায়ে জড়িয়ে সুতপা আন্টি লাল আকাশের দিকে তাকিয়ে গুণগুণ করছিল”রাঙিয়ে দিয়ে যাও গো এবার যাবার আগে….”–কি মিষ্টি গলা!পরে মায়ের মুখে শুনেছে,আন্টি সুচিত্রা মিত্রের ছাত্রী ছিলেন। সে যাই হোক,ও তো পা টিপে-টিপে ছাদে উঠে এসে আন্টির চোখ দুটো চেপে ধরেছে। আন্টি ঠিক বুঝে যান– বলেন,” লিপিলেখা। আমার লিপি….

এখানে একলা এভাবে দাঁড়িয়ে আছো কেন?
লিপি চমকে পেছনে তাকিয়ে দেখে বিক্রম।
ও হেসে বলে,
ওঃ, বিক্রম দা, তুমি তো কাল চলে যাবে । আবার কবে আসবে?
গাঢ় চোখে ওর দিকে তাকিয়ে বিক্রম বলে,তুমি যেদিন ডাকবে!
চমকে উঠে লিপি ঘাড় ঘুরিয়ে ওকে কিছু বলতে যাচ্ছিল,বিক্রম ওর ঠোঁটে আঙুল ছুঁয়ে বলে,
“দোহাই তোদের,একটুকু চুপ কর
ভালোবাসিবারে দে আমারে অবসর….”
লিপির সারা শরীরে তরঙ্গ ছড়িয়ে পড়ল। বুকের মধ্যে এক তীব্র আলোড়ন….

গোধুলির আলোয় প্রকৃতির রঙ লালে-লাল। ঝিরঝিরে মিঠে বাতাস….দূরে কোথাও কোকিলের কুহু ডাক….. কোথায যেন ভেসে যাচ্ছে ও…দূর থেকে যেন শুনতে পাচ্ছে, বিক্রম বলছে, “এবার থেকে আর বিক্রম দাদা নয়, শুধুই বিক্রম।এখন যাও, সন্ধ্যার সময় আর ছাদে থেকনা, নীচে যাও। আমি কাজ সেরে আসছি।
ঘোরের মধ্যে নেমে সোজা এসে দাঁড়াল লিপি সুতপার ছবির সামনে। অস্ফুট স্বরে বললো,আন্টি,তোমার রাজপুত্তুর আমায় সোনার কাঠি ছুঁইয়ে দিয়েছে…. আমি বড় হ’য়ে গেছি….!


লেখক পরিচিতি : দীপান্বিতা মিত্র
কবি ও সাহিত্যিক । ছোটবেলা থেকেই সাহিত্যানুরাগী। ছোট-বড় বহু পত্রিকায় তাঁর লেখা প্রকাশিত হয়েছে ,এবং হচ্ছে।।

সম্প্রতি বইমেলায় তাঁদের তিন-কবির লেখা কবিতা সংকলন 'ত্রিধা ' বিদগ্ধজনের কাছে উচ্চ প্রশংসিত।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।