লেখক : পাঞ্চালী ভট্টাচার্য (বাগচী)
আমাদের পরিবার ছিল একেবারে মধ্যবিত্ত। বাবা ছিলেন হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক—অসাধারণ ব্যক্তিত্বের অধিকারী। বাড়িতে অপ্রয়োজনীয় কথা বলা বা ঝগড়াঝাঁটি তিনি একেবারেই পছন্দ করতেন না। কাকিমা সবসময় মাথায় কাপড় দিতেন, ঘরেও, বাইরেও। আমাদের পোশাক-আশাকও সীমিত, শুধুমাত্র প্রয়োজনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকত। মা ও কাকিমার শাড়ি কেনা হতো টেকসই সুতো দেখে, যেন দীর্ঘদিন টেকে। বাড়িতে ধোয়া শাড়ি নীল দিয়ে শুকিয়ে ট্রাঙ্কে তুলে রাখা হতো যত্ন করে।
মায়ের অনেক গহনা ছিল, কিন্তু দাদার অসুখ এবং বাড়ি তৈরির প্রয়োজনে একে একে সব বিক্রি হয়ে যায়। শুধু বেঁচে ছিল একজোড়া বালা। মা সে নিয়েই গর্ব করতেন—বলতেন, ব্রিটিশ আমলের কারিগর দিয়ে বানানো গহনা, এর মতো আর নেই। তখন তো ভল্টের ব্যবস্থা ছিল না, তাই সেই বালা রাখা থাকত শাড়ির ট্রাঙ্কের নিচে, তার ওপরে শীতের কাপড় চাপিয়ে রাখা হতো, নিরাপদ মনে করে। যখন কোথাও বেড়াতে যেতেন, তখন হাতে পরে নিতেন, আর ফিরেই যথাস্থানে রেখে দিতেন।
এভাবেই সংসার চলছিল। এরই মধ্যে খুড়তুতো দিদির বিয়ের বয়স হয়ে এল—মাত্র ষোলো বছর বয়স, কিন্তু তখনকার সমাজে তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে দেওয়াই রীতি। কাকুর তেমন সামর্থ্য ছিল না, অথচ প্রতিটি বাবাই চায় মেয়েকে ভালোভাবে শ্বশুরবাড়ি পাঠাতে। পরিবারের বড় হওয়ায় সমস্ত দায়িত্ব এসে পড়ল বাবার ওপর।
কাকুর সামর্থ্যের সম্বল বলতে ছিল মায়ের সেই একজোড়া বালা। দুপুরে খাওয়া-দাওয়া সেরে মা কাকুকে নিয়ে গেলেন সোনার দোকানে। বালা বিক্রি করে হাতের পলা, গলার হার, কানের দুল কেনা হলো, যাতে মেয়েকে সাজিয়ে-গুজিয়ে বিদায় দেওয়া যায়। জামাইয়ের জন্য আংটি আর বোতাম দিলেন বাবা।
সেদিন আমার মনটা ভীষণ খারাপ হয়েছিল। মায়ের এত ভালোবাসার বালা চলে গেল! কিন্তু মায়ের মুখে কোনো পরিবর্তন দেখলাম না, যেন কিছুই হয়নি। বোধহয় মায়েরা এমনি হয়। যাই হোক, ভালোভাবে বিয়েটা মিটে গেল, বাড়িতেও আগের মতো স্বাভাবিক জীবন চলতে থাকল।
এরপর একদিন হঠাৎ কলেজে থাকা অবস্থায় মা লোক পাঠিয়ে জানালেন, যেন আমি তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরি। মনে একটু দুশ্চিন্তা নিয়েই ফিরলাম। বাড়ি ফিরতেই মা হাতে একটা জরুরি কাগজ দিলেন—একটি স্কুলে শিক্ষক হিসেবে আমার নিয়োগপত্র। পরদিনই যোগ দিতে হবে। খবরটা পেয়ে আনন্দের চেয়ে দুশ্চিন্তাই বেশি হলো—মায়ের বালা দুটো কি আমি আবার বানিয়ে দিতে পারব? কত মাসের বেতন জমলে সেটা সম্ভব হবে?
চাকরি করার ছয়-সাত মাস পরেও পারলাম না। টাকাগুলো নানা খরচে শেষ হয়ে যায়। তবে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, কোন একদিন অবশ্যই সেই বালা বানিয়ে দেব।
এর কিছুদিন পর একদিন পরিচিত এক দিদি, শ্যামলী, নতুন বউ হয়ে আমাদের বাড়িতে এলেন। মাকে প্রণাম করতে এলেন, মুখভর্তি সুখের হাসি। আমি দেখলাম, গল্প করতে করতে তিনি হাত নাড়াচ্ছেন—সেই হাতে ঠিক মায়ের বালার মতো একজোড়া বালা! মা দেখলেন, কিন্তু কিছু বললেন না।
এরপর অনেক জল গড়িয়েছে জীবনের বয়ে চলায়। কিন্তু আমি কখনো মায়ের সেই বালা ফিরিয়ে দিতে পারিনি। সেই অভিমান, সেই দায় আজও বয়ে বেড়াই।
একদিন অভিমানে বাবাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম— “মায়ের গহনাগুলো কেন রাখতে পারলে না?” বুঝি সংসারের প্রয়োজন ছিল, তবু কি মায়ের শখ-আহ্লাদের কোনো দামই নেই? আর মা-ই বা কেন এমন ছিলেন? কখনো কোনো প্রতিবাদ নেই, সবসময় শুধু এক ভয়, এক দায়িত্ববোধ, কর্তব্য পালন—সভ্যতার শৃঙ্খলায় বাঁধা জীবন।
কাকিমা আর পিসিই ছিল মায়ের সবচেয়ে আপন। আজ মা নেই। সেই বালাজোড়া নেই, নেই সেই ট্রাঙ্ক, এমনকি বদলে গেছে আমাদের পুরোনো বাড়িটাও। ও-বাড়িতে গেলে এখন আর কেউ ভালো করে কথা বলার সময়ও পায় না। আমি যেন এক অদৃশ্য মানুষ হয়ে যাই সেখানে।
কিন্তু আমি অদৃশ্য হয়ে থাকিনি। স্বাধীন ভারতের কারিগরের তৈরি একজোড়া বালা পরে থাকি দুই হাতে—যা আমার মা কখনো পারেননি।
লেখক পরিচিতি : পাঞ্চালী ভট্টাচার্য (বাগচী)
অবসরপ্রাপ্ত প্রবীণ নাগরিক