রূপকথার বইমেলা

লেখক : প্রীতি চক্রবর্তী

ছোট্ট রূপকথা আজ ভীষণ খুশি। এই প্রথমবার সে বইমেলায় এসেছে তার বাবার হাত ধরে। আর পাঁচটা বাচ্চার মতো সে স্বাভাবিক নয়। এই অল্প বয়সেই নাকের উপর ভার জমেছে মোটা কালো ফ্রেমের চশমা আর হাতে ওয়াকিং স্টিক। শরীরে নানা সমস্যা নিয়েও আজ সে উপস্থিত হয়েছে বইমেলায়। শুধুমাত্র বইকেই ভালোবেসে সবথেকে বড়ো প্রতিবন্ধকতাকে জয় করেছে সে।

এই প্রথম তার কবিতা ছাপা হয়েছে “রং তুলি” পত্রিকায়। সাবধানে বাবার সাথে পা ফেলে হেঁটে চলেছে রূপকথা। আর তার বাবা তাকে সবিস্তারে বইমেলার বর্ণনা দিয়ে চলেছেন।

রূপকথা আশপাশের ভিড় টের পায়, ‘বাবা! আমরা কি এসে গেছি বইমেলায়?’

তার বাবা রূপকথার হাত দুটো শক্ত করে চেপে ধরে, ‘হ্যাঁ রে মা। এই আমরা চার নম্বর গেট পেরিয়ে বইমেলায় ঢুকলাম।’

-‘কী কী দেখতে পাচ্ছো বাবা?’

ভিড়ের মধ্যেও নিজের গন্তব্যের খোঁজে ঘাড় ঘুরিয়ে আশপাশটা দেখে নিয়ে তিনি বললেন, ‘ছোটো বড়ো বইয়ের স্টল। আর তাকের উপর রাখা সারি সারি বই।’

কী যেন ভেবে তার মুখে হাসি ফুটে ওঠে, ‘কী কী বই আছে তাকে?’

মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলে, ‘গল্প! উপন্যাস, রূপকথা, হাসি-মজার সব মিলিয়ে মিশিয়ে আছে রে মা। তুই কি কিছু কিনবি?’

-‘বাঃ রে শুধু কিনলেই হবে! বইটা তো পড়েও ফেলতে হবে।’

মেয়ের কথায় হেসে বলে, ‘বেশ বেশ পড়ে শোনাবো তো। আমি নাহলে মা কেউ না কেউ ঠিকই পড়ে শোনাবে।’

-‘আর এই সুন্দর গন্ধটা কীসের?’

বই পাড়ায় এই মিষ্টি গন্ধটা নতুন বইয়ের।

-‘জানো বাবা! আমার এই বইয়ের গন্ধটা খুব ভালো লাগে। কী সুন্দর একটা গন্ধ। আর বইয়ের পাতাগুলো যেন ফুলের পাপড়ির মতো।’

-‘বেশ বেশ, পাকা বুড়ি! এবার তো আঙ্কেলের স্টলে পৌঁছাতে হবে নাকি।’

রূপকথা ধীরে ধীরে বাবার সাথে পা ফেলে, ‘অনেক ভিড় জমেছে বুঝি?’

-‘তা জমেছে। বাচ্ছা বুড়ো সকলেই এসে ভিড় জমিয়েছে মেলায়।’

-‘বাবা! তুমি আমাকে আগে এখানে নিয়ে আসোনি কেন?’

কথাটা পুরো শেষ হওয়ার আগেই তার বাবা মেয়েকে নিয়ে একটা স্টলের সামনে এসে দাঁড়ায়। হোডিংয়ে বড়ো বড়ো করে লেখা রয়েছে “১১৪ নম্বর”।

স্টলের সামনে উপস্থিত এক ভদ্রলোক তাদের করজোড়ে স্বাগত জানান। রূপকথাকে দেখা মাত্রই, রবিন আঙ্কেল তাকে কোলে তুলে নিয়ে, ‘এই তো রূপকথা মা! এতক্ষণ পরে এসেছো? আমি সেই কখন থেকে তোমার জন্য ওয়েট করেছিলাম।’

রূপকথা মৃদু হেসে, ‘স্যরি আঙ্কেল! তোমাকে বোধহয় অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে থাকতে হয়েছে।’

-‘না না, ঠিক আছে কথাবুড়ি! আমাদের ছোট্ট লেখিকার জন্য আমরা তো একটু অপেক্ষা করতেই পারি।’

রূপকথার বাবা তার হাতের ওয়াকিং স্টিকটা শক্ত করে চেপে ধরে, ‘গুড আফটারনুন! রবিনবাবু!’

-‘ভেরি গুড আফটারনুন মিস্টার মুখার্জি।’

রবিন বাবু ওনাদের পথ দেখিয়ে স্টলের ভিতরে চেয়ারে বসার ব্যবস্থা করে দেন। কিন্তু রূপকথার যে মন বসে না। মাঝে মাঝেই বাবার হাত চেপে, ‘বাবা! পত্রিকাটা আমি পাবো না?’

মেয়েকে আশ্বস্ত করে, ‘পাবি তো মা। একটু ধৈর্য্য ধর। আঙ্কেল ঠিক সময়ে পত্রিকা তোর হাতে তুলে দেবেন।’

রূপকথা অস্থির হয়, ‘সেটা কখন পাবো বাবা! আমি যে ধৈর্য্য ধরে বসে থাকতে পারছি না। কত অপেক্ষার পর আজ পত্রিকা হাতে পাবো।’

-‘তুই খুব খুশি হয়েছিস রে মা! তাই না?’

রূপকথা বাবাকে জড়িয়ে ধরে, ‘হ্যাঁ বাবা! আমি খুব খুব খুব খুশি হয়েছি। এখন তো আমি দেখতে পাচ্ছি না। সপ্তাহ দুই পর দেখতে পাবো, তাই না?’

রূপকথাকে তার বাবা একবার বুকে টেনে নিয়ে বলে, ‘হ্যাঁ রে মা। তুই আবার দেখতে পাবি। আর কোনো কষ্টই হবে না তোর।’

-‘তখন আর মাকে শুনে শুনে লিখতে হবে না, আমি নিজেই লিখে নিতে পারবো।’

-‘আমি জানি মা তুই পারবি। ঠিক পারবি।’

বাবার বুকে পরম স্নেহে মাথা রেখে বলে, ‘তুমি কষ্ট পেও না বাবা, সব ঠিক হয়ে যাবে।’

বাবা-মেয়ের কথার মাঝে হঠাৎ এসে হাজির হন রবিন আঙ্কেল। রূপকথার বাবাকে একবার ডেকে তিনি বললেন, ‘মিস্টার মুখার্জি আপনি একবার আমার সাথে বাইরে আসুন। কিছু কথা আছে।’

রূপকথা তার ওয়াকিং স্টিকটা শক্ত করে দু’হাতে ধরে, ‘তুমি যাও বাবা আঙ্কেলের সাথে। আমি চুপটি করে বসে থাকবো, প্রমিস।’

রূপকথার কথায় ভরসা করে তার বাবা বেরিয়ে আসেন স্টলের ঠিক উল্টো দিকে। রবিনবাবু একটু দ্বিধা বোধ করলেও, পরে জড়তা কাটিয়ে বলে, ‘আমি অনেকক্ষণ ধরেই জানতে চাইবো ভাবছিলাম কিন্তু জানা হয়ে ওঠেনি।’

-‘সে কী! আপনি নিঃসংকোচে বলুন!’

-‘কথাবুড়ির এমন বিপদ হলো কেমন করে? না মানে সে তো সুস্থ সবলই ছিল।’

-‘ঠিকই ধরেছেন! রূপকথা মা জন্মান্ধ নয়। সে “ইন্ট্রাওকুলার মেলানোমা” অর্থাৎ চোখের ক্যান্সারে আক্রান্ত।’

কথাটি শুনে বিস্মিত হলেন রবিনবাবু। ‘কী! ওইটুকু দশ বছরের মেয়ে এই জটিল রোগে আক্রান্ত?’

রূপকথার বাবা মাথা নামিয়ে, ‘তবে আর বলছি কী! ডাক্তার বলেছেন রূপকথা মা’র আয়ু আর খুব বেশি হলে দুই সপ্তাহ।’

-‘না মিস্টার মুখার্জি! এ হতে পারে না। একটা ফুটফুটে মেয়ে এইভাবে শেষ হয়ে যেতে পারে না। কী বা বয়স ওর! আর ওর লেখা! ওর নিজের থেকেও বেশি প্রাণবন্ত। ডায়েরিটা আমার কাছে আছে।’

-‘জানি। বিষয়টা দুঃখজনক হলেও এটাই সত্যি। রূপকথা মা সামান্য কয়েক দিনের অতিথি।’

রবিন বাবু মৃদু স্বরে, ‘ও কি জানে! ওর অসুখের কথা?’

-‘নাহ্‌। ও শুধু জানে আর কয়েক দিন পর ওর অপারেশন, আর তারপরেই ও আবার সুস্থ হয়ে আগের মতো সব দেখতে পাবে।’

-‘এই সত্যিটা জানার পর আমি আর কথাবুড়ির মুখোমুখি হতে পারবো না। স্যরি মিস্টার মুখার্জি! আপনি এই নিয়ে আমাকে জোর করবেন না।’

রূপকথার বাবা করজোড়ে বলে, ‘প্লিজ দোহাই আপনার! এমনটি করবেন না। আমি চাই ও মৃত্যুর আগে একবার লেখিকা হয়ে জন্ম নিক। তাতেই রূপকথার সার্থকতা।’

-‘কী করতে হবে আমাকে?’

-‘রূপকথার লেখা যদি গ্রহণযোগ্য হয়, তবে তা কালির হরফে সাজিয়ে দিন। ব্যাস্ শুধু এটুকুই অনুরোধ।’

-‘বেশ তাই হবে।’

রূপকথা তার ওয়াকিং স্টিকের উপর ভর দিয়ে এক পা এক পা করে স্টলের বাইরের দিকে এগিয়ে আসে। একজন স্বেচ্ছাসেবিকা পরম যত্নে রূপকথাকে নিয়ে মিস্টার মুখার্জি এবং রবিন বাবুর দিকে এগিয়ে আসেন। মিস্টার মুখার্জির নাগাল পেয়েই রূপকথা বলে, ‘স্যরি বাবা! আমি তোমাদের বিরক্ত করতে চাইনি। কিন্তু একা একা বসে থাকতে আমার ভালো লাগছিল না।’

রবিনবাবু হাসি মুখে, ‘আরে কথাবুড়ি! তোমার লেখা নিয়েই আমরা কথা বলছিলাম। আর কী নতুন লিখেছো মা?’

-‘লিখেছি আঙ্কেল! একটা ছোটো গল্প লিখেছি।’

-‘কই রে মা। তুই তো আমাকে বলিসনি।’

-‘এখন বলছি তো বাবা।’

রবিনবাবু বলে, ‘কী গল্প শুনি?’

-‘একটা বাচ্চা মেয়ের গল্প। জানো তো আঙ্কেল! ওই মেয়েটাও আমার মতো চোখে দেখতে পায় না। কিন্তু খুব সুন্দর ছবি আঁকে। ওর মনটা রঙিন হলেও ছবিটা ধূসরই হয়। ওর ড্রয়িংটা অসম্পূর্ণ। ও রাগ করেছে ভগবানের উপর। বলেছে চোখে দেখতে পাওয়া না অবধি ও রং করবে না। কী করে করবে বলো! রং করার জন্য রং উপলব্ধি করাটা তো জরুরী! তাই না? আচ্ছা বাবা! ওর ড্রয়িংটা কোনোদিনও কমপ্লিট হবে না বলো? আঙ্কেল! বলো না, ড্রয়িংটা কমপ্লিট হবে তো?’

সেইদিন রূপকথার ছোট্ট প্রশ্নের কোনও উত্তরই দিতে পারেননি মিস্টার মুখার্জি এবং রবিনবাবু। দশ বছরের মেয়ের একটা ক্ষুদ্র প্রশ্ন মনে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করেছে। রূপকথা পত্রিকায় তার লেখা নিয়ে বাড়ি ফিরেছিল সেই দিন। মিস্টার মুখার্জি বিনা বাক্য ব্যয়ে করজোড়ে বিদায় নিয়েছিলেন বইমেলা থেকে।

বিধিলিপি অনুসারে ঈশ্বরের অভিপ্রায়ে রূপকথার মৃত্যুর আগেই জন্ম নেয় কথাবুড়ি। যে ওয়াকিং স্টিকে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে উঠতে পারলো না, সে এক ছদ্মনামের উপর ভর দিয়ে মানুষের মন ছুঁয়ে নিলো! ডায়েরিটা আজও যত্নে রেখেছেন রবিনবাবু। রূপকথার মা আজও আশাবাদী হয়ে পত্রিকায় কথাবুড়ির গল্প খোঁজে। আর মিস্টার মুখার্জি নিরিবিলিতে মেয়ের ওয়াকিং স্টিক ধরে চোখের জল ফেলেন। নাহ্‌, গল্পের সেই মেয়েটির ড্রয়িং আজও অসম্পূর্ণ। আজও সে ভগবানের উপর অভিমান করে দুহাতে রং মাখেনি। ঠিক যেমন রূপকথা অভিমান করে আর চোখ মেলে চায়নি। বইমেলা হয়, বই আসে, বই যায়। কত শত রূপকথারা সেই ভিড়ে হারিয়ে যায় শুধু বইকে ভালোবেসে। আমরা রঙিন প্রচ্ছদের মোড়কে যে গল্প পড়ি, তা কি শুধুই গল্প? না কি রূপকথার চুপ-কথাগুলো কালো অক্ষরে ঠাসা?

লেখক পরিচিতি : প্রীতি চক্রবর্তী
জন্ম ২০০১ সালে কলকাতায়। ২০২৪ থেকে সক্রিয় ভাবে লেখালেখি শুরু। বিভিন্ন পত্রিকায় এর আগেও লেখা ছাপা হয়েছে। অডিও স্টোরিও লিখেছেন বেশ কিছু। উল্লেখযোগ্য লেখা "শ্যামা", "শ্রী"।

One comment

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।