লেখক : অর্পিতা চক্রবর্তী
“কফি হাউসের সেই আড্ডাটা আর নেই, আজ আর নেই”….
গানটা ধরেছে শুভ। গিটারের তাল আর করতালিতে পরিবেশটা বেশ জমজমাট। হঠাৎ পথিক বলে উঠল, “এই গানটা তোর ট্রামে না গেয়ে কফি হাউসের আড্ডায় গাওয়া উচিত ছিল।” ব্যাস, গানের দফারফা। সুর-তাল-ছন্দ সব কেটে একাকার। একরাশ বকুনি খেতে হল বেচারাকে। আসলে পুরো ট্রাম তখন ছন্দে দুলছে। পথিকের এই একটা বাজে অভ্যাস, ভুল সময়ে ঠিক কথা বলা। যা’হোক, পুনরায় সুর তোলার চেষ্টা চলছে। কিন্তু ছন্দ পথিকের ছন্দপতন বলে কথা।
আজ পুরোনো বন্ধুদের ফুল টিম বেরিয়ে পড়েছে কলকাতা ঘুরতে। শুভ, পথিক, সুমন ওদিকে সাহানা জয়িতা আর মিঠু। ওদের বন্ধুত্ব কিন্তু সেই বাচ্চা কালের। আজ কেউ ইঞ্জিনিয়ার, কেউ মাস্টারমশাই, আরও কত কী। আপাতত ব্রহ্মচারী ডিগ্রিধারী ফুরফরিয়া শরিফ ওরা। ওদের আজকের ভেনু কলকাতার বুকে স্মৃতি হাতড়ানো, আর তার জন্য যানবাহন হিসাবে বেছে নেওয়া হয়েছে টিং টিং ট্রামকে। রাজাবাজার ট্রাম ডিপো থেকে শুরু হয়েছে ওদের যাত্রা। ছোটবেলা-বড়বেলা নিয়ে আজ ওদের এক জমজমাট পর্ব। লোক উঠেছে নামছে ওদের গল্প শুনছে। সবাই কিন্তু বেশ মজা পাচ্ছে। আসলে এরকম কিছু এবেলা ওবেলা সবার ঝুলিতেই আছে। স্মৃতিচারণের এই যাত্রা বড়োই মধুর। শুভর গিটার, করতালি, পথিকের বেজার মুখ – সব নিয়ে এগিয়ে চলেছে ট্রাম গাড়ি। টিটি কাকু টিকিট চাইল, টিকিট কাটা হল। আজ যতদূর ট্রাম গাড়ি ছুটবে ওরাও ছুটবে। আসলে পথভোলা পথিক নেমে পড়েছে নস্টালজিয়ার খোঁজে।
কফি হাউস থেকে উদরপূর্তি সেরে ওদের যাত্রা শুরু হয়েছে। কিন্তু মনটা এখন একটু চা-চা করছে। হঠাৎ জয়িতার ঝোলা থেকে বেরোলো ফ্লাস্ক। মালাই চা, সাথে বিস্কুট। উফফ্, ব্যাপারটা পুরো জমে গেছে। সুমন বলল, “এইজন্যই গার্লফ্রেন্ড থাকাটা খুব জরুরি।” কিন্তু বলে বুঝল নারীবাহিনী কতটা সাঙ্ঘাতিক। নিমেষের মধ্যে সুমনের চা গায়েব। পিঠে পড়ল কিল-চড়-ঘুষি। ওদিকে পুরো ট্রামের প্যাসেঞ্জারদের চোখ তখন ঐ চায়ের দিকে। সবার চোখেই চা-তেষ্টা। কিন্তু কী করা যাবে, ওইটুকু চা দিয়ে সবার তৃষ্ণা নিবারণ অসম্ভব।
এলোপাথাড়ি ঘুরতে ঘুরতে এবার ওরা চলেছে ধর্মতলার উদ্দেশ্যে। ট্রামে করে কলকাতা ভ্রমণের আনন্দটাই আলাদা। পথিক হঠাৎ করেই বলে উঠল, “আচ্ছা, গাড়িটা এত বার দাঁড়িয়ে পরে কেন সেটাই বুঝতে পারিনা। সব জায়গায় তো লোক ওঠেও না, নামেও না।” আসলে ব্যাপারটা একটু অন্যরকম। নিজেকে ট্রাম কোম্পানির মালিক ভাবা পথিক মিত্র যেখানে চাইবে, সেখানেই ট্রাম দাঁড়াবে। কল্পনাশক্তির প্রাবল্য অধিক হওয়ার সুবাদে এই রকম কিছু ঘটনা আজও ঘটে। আজকাল ক্যাবের রমরমা আর সাথে মানুষের তাড়া – তাই পুরনোকে বাতিল করতে কেউ দু’বার ভাবে না। অথচ শত বছরের ইতিহাসের সাক্ষী এই ট্রাম। বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামের কতো ইতিহাস জড়িয়ে আছে এই ট্রামের সাথে। কত প্রেম, কত বিরহ, বিচ্ছেদ, মিলনের সাক্ষী হয়ে থেকে যাবে ঐ ট্রামলাইন। কবি জীবনানন্দ দাশ এর মৃত্যুর কারণ ছিল এক ভয়ঙ্কর ট্রাম দুর্ঘটনা, যা সচরাচর ঘটে না, কিন্তু সেদিন ঘটেছিল।
ময়দানের পাশ দিয়ে তখন চলেছে ট্রাম গাড়ি। এই একটি জায়গায় কলকাতার এক অনবদ্য রূপ ফুটে ওঠে। ঠিক ভিক্টোরিয়ার সামনে দিয়ে যখন ঐ সাজানো গোছানো টাঙ্গাগাড়িগুলো ছোটে, তখন মনটায় কেমন যেন দোলা লাগে। কথার রেশ শেষ হতে না হতে শুভ একটু ছেলে মানুষের মতই বলে ফেলল, “ভাবছি, আমি বর সেজে এরকম একটা গাড়ি চড়ে বিয়ে করতে যাব। আর তোরা পিছনে বরযাত্রী হয়ে আসবি।” সবাই চুপ, কারও মুখে কোনো কথা নেই।
মিঠু একটু সিরিয়াসলি বলে ফেলল, “আমাদের বাড়ির গলিতে অত বড় ঘোড়ার গাড়ি ঢুকবে না।”
ব্যাস সব শেষ, একে বলে হাতেনাতে ধরা পড়া। মানে অনেক দিন ধরেই মিঠু আর শুভ ডুবে ডুবে জল খাচ্ছে। আজ ট্রাম যাত্রায় উঠে আসল সত্যিটা। ওদিকে হঠাৎ বৃষ্টি এসেছে। আসলে বেশি ঝড়বৃষ্টি হলে আবার ট্রাম দাঁড়িয়ে যাবে। কিন্তু না, সেদিন তেমন কিছুই ঘটেনি। বরং হালকা বৃষ্টিতে প্রেম জমে উঠেছিল। জয়িতা ওর হাতটা বাড়িয়ে বৃষ্টির জল ধরার কপট চেষ্টা করছিল। এদিকে পথিকবাবু ওর সিট ছেড়ে ছুটে গিয়ে জয়িতার হাতটা ধরে ভিতরে ঢুকিয়ে নিয়ে বলল, “এটা ট্রাম, ট্রেন না, পাশ দিয়ে গাড়ি যাচ্ছে। তোর কোথাও চোট লাগলে আমার যে কষ্ট হয়, সেটা তুই এখনও বুঝিস না।”
আরে! এ তো আরও একটি প্রণয়কাহিনী। যাকে বলে একের পর এক সারপ্রাইজ। নস্টালজিয়ার এই ভ্রমণ কোথায় শেষ হয়, সেটাই এখন দেখার। ওদিকে সাহানা আর সুমন এতক্ষণ চুপচাপ শুধু দেখছিল। কিন্তু হঠাৎ মনে হচ্ছে ট্রাম চলছে ট্রামের মনে, ওরা চেয়ে আছে পরস্পরের মুখপানে। তাহলে আজ এই হামসফরের তৃতীয় জুটির সাক্ষী থাকলো টিং টিং ট্রাম।
ভালবাসার সাক্ষী হওয়ার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা নিয়ে এগিয়ে চলেছে ট্রাম। কিন্তু মনটা একটু খাই-খাই করছে সবার। মুখগুলো কেমন সব ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। হঠাৎ সাহানার ঝোলা খুলছে, ছড়িয়ে পড়েছে ট্রামময় সুবাস। আলুর দম সহযোগে লুচি, বরাদ্দ মাত্র চার পিস। কিন্তু এ যে লটারি! যদিও প্যাসেঞ্জার তখন নামমাত্র, তবুও যারা আছেন, তাদের অবস্থা কল্পনাতীত। অমন সুঘ্রাণের সাথে লড়াই করা বেশ কঠিন। কিন্তু টিটি কাকু আজ বেজায় খুশি। এতক্ষণ প্রণয় দৃশ্য দেখেছে, এবার জিভের জল সংযত করে ভোজন দৃশ্য দেখবে। কাকুর কড়া হুমকি, “তোমরা খাও-দাও, আনন্দ কর। কিন্তু নোংরা করা চলবে না।” বেশ কথা, ঘটাস ঘটাস ধাক্কা খেতে খেতে, সুস্বাদু উদরপূর্তি, সাথে “প্রেমে ট্রাম না ট্রামে প্রেম” করতে করতে ওরা এগিয়ে চলেছে।
হঠাৎ মিঠু বলল, “আচ্ছা, আমি যদি ভুল না করি, ঐ দূরে বয়স্ক মানুষটি কিন্তু আমাদের ফলো করছেন অনেকক্ষণ ধরে। কিন্তু কেন?”
শুভ বলল, “নো প্রবলেম। দাদুর সাথে গিয়ে আমি কথা বলব। ফলো মি।” একে একে ছয় মূর্তি এসে হাজির দাদুর পাশে। ট্রাম চলছে তার নিজের গতিতে, কিন্তু দাদু কেন ফলো করছেন ওদের?
মিঠুই প্রথম শুরু করল, “আচ্ছা, যদি কিছু যদি মনে না করেন, তাহলে একটা কথা জিজ্ঞাসা করতে পারি? আপনি অনেকক্ষন থেকে আমাদের দেখছেন। যদি কোন প্রশ্ন থাকে, নির্দ্ধিধায় করতে পারেন।”
দাদু বললেন, “আমি S.S.S., মানে সূর্য শেখর সরকার। তোমরা আমাকে দাদু বা S.S.S. – যেভাবে ইচ্ছা ডাকতে পারো। আমি হলাম তোমাদের প্রেমের প্রত্যক্ষ সাক্ষী। ট্রামে ভ্রমণ এবং সেখান থেকে গল্পের উপাদান সংগ্রহ – এটা আমার পুরনো অভ্যাস। তা আমার পরিচয় তো পেলে, এবার তোমাদেরটা বলো শুনি।” একে একে পরিচয় পর্ব সাঙ্গ হল।
দাদু বলল, “তোমাদের মত আমার গল্পটাও ট্রামেই শুরু হয়েছিল। আমি তখন তোমাদের মতই যুবক, আর এখন ৮০+। কলেজ পাশ করে স্কুলমাস্টারের চাকরিটা পেয়ে গেলাম। ট্রামে করে যাতায়াত করতাম। পরিবেশবান্ধব যানবাহন বোঝ, এ হল দূষণমুক্ত যান। যাক সে সব কথা, নিত্যযাত্রার মাঝে পরিচয় হল আমার উনির সাথে। উনি কে বুঝলে? আমার বেটার হাফ। রক্ষণশীল বামুন পরিবারের মেয়ে, কিন্তু সেই সময়েও আমার শ্বশুর মহাশয় ছিলেন যথেষ্ট উদার মনের। মাঝেমধ্যে আমাদের দেখা হয়ে যেত এই ট্রাম গাড়িতে। অবশেষে প্রেমে পড়লাম, ঐ তোমাদের মতই। কিন্তু মনের কথা কই কেমনে? শেষমেশ একটি পত্র লিখলাম, কিন্তু দেব কাকে? তার দেখা যে মেলে না। এর বেশ কিছু দিন পর আমাদের আবার দেখা হ’ল সেই ট্রামে। আমি বুদ্ধি করে পত্রখানি ওনার ব্যাগে চালান করলাম। এরপর কেটে গেল কয়েক মাস। মনে মনে ঠিক করলাম বিবাহ করিলে ওনাকেই করিব, নচেৎ আজীবন ব্রহ্মচারী থাকিব। কিন্তু সমস্যা সেই বামুন-কায়েতের কচকচানি। এতদসত্ত্বেও আমাদের শুভ পরিণয় সম্পন্ন হল। কিন্তু কোথায় জানো?”
সবাই এক নিঃশ্বাসে গল্পটা শুনছিল। দাদু বলে চলল, “বিয়ে হওয়ার কথা ছিল কালীঘাট ট্রাম ডিপোতে। কিন্তু না, হল মায়ের মন্দিরে। এদিকে দুই বাড়ি তখন অগ্নিগর্ভ। স্থান পেলাম ট্রামের টিকিট কালেক্টর মনিময় দত্তর বাড়িতে। সেখানে কেটে গেলো একমাস। এরপর একটা ছোট্ট ভাড়া বাড়িতে শুরু হল আমাদের জীবন। আমার বাবা এবং আমার শ্বশুর মহাশয় ততদিনে মারাত্মক মনঃকষ্টে ভুগছেন। ট্রাম কোম্পানির সহায়তায় ওনারা আমাদের কাছে পৌঁছলেন। নতুন বৌ নিয়ে শুরু হল আমার সংসার। আমার উনি অবশ্য খুব শিগগিরই বৌমা থেকে হয়ে গেলেন তাঁর শ্বশুর মহাশয়ের আদরের কন্যা। এরপর এক ছেলে এক মেয়ে – সব নিয়ে কেটে গেলো জীবনের বাকি দিনগুলো। একদিন এই ট্রামেই শুরু হয়ছিল আমাদের প্রণয়পর্ব। আর আজ তোমাদের দেখছি আর সেদিনের কথাই ভাবছি। বর্তমানে তোমাদের বয়সী নাতি নাতনী আছে আমার, যদিও তারা কেউ কলকাতায় থাকে না। আর আমার উনি ফাঁকি দিয়ে কেটে পড়েছেন। আমি S.S.S বর্তমানে একা। খাই দাই ঘুরি ফিরি। না আমার ছেলে মেয়ে আর তাদের পরিবার দূরে থেকেও কাছে আছে। ওরা আমার খুব খেয়াল রাখে। শুধু বুড়িটাকে খুব মিস করি। ট্রামে দেখা আর আমাদের হবে না, কিন্তু দেখা তো একদিন হবেই হবে। শত বছরের ট্রামের ঐতিহ্য যদি নষ্ট না হয়, তবে আমাদের প্রেমের ঐতিহ্যও অটুট থাকবে। এ আমার দৃঢ় বিশ্বাস।”
রোমান্টিক প্রেমপর্ব শুনতে শুনতে সবাই তখন মশগুল। হঠাৎ দাদু বললেন, “সবই তো শুনলে। তা যাকে ঘিরে আজকের এই আলাপচারিতা, তার সম্পর্কে কিছু বল শুনি।” কিন্তু না সবাই চুপ। হঠাৎ পথিক বলল, “আজ দাদু হবে বক্তা, আর আমরা হবো শ্রোতা।”
S.S.S. আজ বেজায় খুশি। ট্রামের সাথে তার দীর্ঘদিনের পরিচয়। ট্রাম নিয়ে শুরু হল ওদের দ্বিতীয় রাউন্ডের আড্ডা। বক্তা ইয়ংম্যান দাদু।
“তাহলে হয়ে যাক ট্রামে বসে ট্রামের গপ্পো। তোমরা তো সবাই জানো, প্রথম ঘোড়ায় টানা ট্রাম দিয়েই শুরু হয়েছিল পথচলা। এরপর স্টিম ইঞ্জিন, এবং সবশেষে বৈদ্যুতিক ট্রাম পরিষেবা, যা আজও অব্যাহত। আজ তোমরা যেখান থেকে যাত্রা শুরু করেছ, মানে রাজাবাজার ট্রাম ডিপো, এটি কিন্তু আয়তনে সবচেয়ে বড়। আর সবচেয়ে ছোট কোনটা বলতো?” শিক্ষিত যুব সম্প্রদায় কেউ মাথা চুলকোচ্ছে আবার কেউ ফোন সার্চ করছে। অবশেষে উত্তর হাজির।
দাদুকে অবশ্য ওসব কিছুই করতে হল না। “কালীঘাট ট্রাম ডিপো, যেখানে বসতে বসতেও বসল না এই অধমের বিবাহ বাসর। তবে হ্যাঁ, মা কালীর ইচ্ছা ছিল অন্যরকম, আর এই অধমের সেটাই শিরোধার্য। কলকাতার এই ট্রাম পরিষেবা কিন্তু ঐতিহাসিক পরিষেবা। দেখা গেছে, বাসের থেকে ট্রামের যাত্রীধারণ ক্ষমতা অনেকগুণ বেশি। যদিও এর ধীরগতির জন্য আছে অনেক অপবাদ, তবুও একটা কথা না বললেই নয়। বিগত দেড়শ বছরের ইতিহাসের সাক্ষী হল এই ট্রাম।ফিওডর পিরোটস্কের অনবদ্য আবিষ্কার পরিবেশ বান্ধব এই যানবাহনটি ৫৫০ ভোল্ট ডিসি পাওয়ার থেকে চলাচল করে। আসলে যদি ট্রামের ইতিহাস নিয়ে বসি, তবে পুরো রাত কেটে যাবে। অবশ্য এটুকু তো না বললেই নয়, আমাদের মহানায়ক থেকে শুরু করে দেশনায়ক – সকলের পদধূলিতেই ধন্য কলকাতার ট্রাম পরিষেবা।”
মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে সবাই তখন শুনছে সবটা। হঠাৎ পথিক বলল, “আচ্ছা দাদু, আপনি তো শুনলাম প্রায়ই ট্রামে করে ঘুরে বেড়ান। কিন্তু কেন? মানে কোন কাজের সূত্রে বেড়াতে হয় বোধকরি।”
দাদু বললেন, “না ভাই, মিথ্যে বলব না। আমি গল্পের রসদ সংগ্রহ করতে বেড়াই।”
উত্তর শুনে সবাই হৈ হৈ করে উঠল আর বলল, “মানে আপনি লেখক?”
দাদু একগাল হাসি হেসে বলল, “আমি লিখি, তবে ওসব লেখক-টেখক কিছু না। আমি জীবনের কথা লিখি আর তার জন্য এই বয়সে ট্রামে চড়ি। একদিন ট্রামে করেই পড়াশোনা, চাকরি, এমনকি প্রণয়পর্ব অবধি সাঙ্গ করেছি। প্রয়োজনে বাসেও চড়তে হয়েছে, তবে ট্রামে চড়ে ঘুরতে আমার বেশ লাগে। আমার নাতি নাতনীরা আসলে ওদের সাথেও বেড়িয়ে পড়ি। এই তোমাদের মত কত মানুষের সাথে আলাপ হয়। কেউ কথা বলে, আবার কেউ এই বুড়ো হাবড়া কে এড়িয়ে চলে। না না, আমি রাগ করি না। আমি জীবনমুখী লেখা লিখি। এই ধর, তোমরা যদি লোকাল ট্রেনে ওঠ, তবে দেখতে পাবে জীবনের রোজনামচা। কিন্তু ট্রেনে এতো ভীড় হয়, যা এই বয়সে আর সইতে পারি না। ট্রাম তূলনামূলক অনেক ফাঁকা। আমি এক কোণে বসে বসে কান পেতে শুনি তোমাদের মত মানুষের কথা। হয়ত তোমাদের মনে হচ্ছে বুড়োটা আড়ি পাতে। কিন্তু না, বিশ্বাস কর, আমি আমার লেখার রসদ সংগ্রহ করি মাত্র। তারপর বাড়ি গিয়ে তাতে একটু মশলা মাখিয়ে একটা গল্প লিখে ফেলি। এই যেমন আজ “ট্রামে প্রেম, না প্রেমে ট্রাম” এই নিয়ে লিখব তোমাদের গল্প। কি আপত্তি নেই তো?”
হঠাৎ মহিলা মহল চিৎকার করে বলল, “হিপ হিপ হুররে, থ্রি চিয়ার্স ফর দাদু।”
আনন্দ, হাসি, নতুন বন্ধু S.S.S. – এসব নিয়ে নস্টালজিয়া এই ভ্রমণ থেকে যাবে সবার মনপ্রাণ জুড়ে। যেখান থেকে যাত্রা শুরু হয়েছিল, আপাতত সেই রাজাবাজারে ট্রাম ঢুকছে টিং টিং করে। দাদু অবশ্য একটু আগেই নেমে গেছেন। এরপর ট্রামকে টাটা করে সবাই চলল যে যার বাড়ির পথে। কাল থেকে শুরু হবে আবার সেই রোজনামচা। দাদুর থেকে শোনা ট্রামের ইতিহাস বড্ড মনে পড়ছে। সত্যিই তো ট্রামের চেহারারও পরিবর্তন হয়েছে। রং এর প্রলেপ লেগেছে তার গায়ে। আজকের ট্রাম বেশ ঝাঁ চকচকে পরিষ্কার। কিন্তু শোনা যাচ্ছে ট্রাম পরিষেবা নাকি বন্ধ হয়ে যাবে। শুভ অবশ্য এই ব্যাপারটার ঘোর বিরোধী, বাকিদেরও একই মত। ঐতিহাসিক এই পরিষেবার সাথে জুড়ে আছে দাদুর মত কত মানুষের স্মৃতি। মিঠু সেদিন খুব ক্ষিপ্ত হয়ে বলেছিল, “আমরা বড় হিসেবি, জানিস? যেখানে লাভ নেই, সেখান থেকে আমরা পাততাড়ি গোটাই। কিন্তু ইতিহাস আমাদের জীবন্ত দলিল। তাকে যতই অস্বীকার কর না কেন, সে ততই ফিরে আসে। লাভ ক্ষতি সে দেখে না, সে শুধু শোনায় জীবনের জয়গান।”
“ট্রামে প্রেম, না প্রেমে ট্রাম” গল্পটি কিন্তু শেষ পর্যন্ত সুপার হিট হয়েছিল। S.S.S. এমনিতেই একজন বিখ্যাত লেখক। তবু এই বয়সে এমন প্রেমকাহিনী লেখা, সত্যিই ভাবা যায় না। নস্টালজিক সেই ভ্রমণ সেদিন দিয়ে গেছে দাদুর মত বন্ধু, যা অনেকেরই ভাগ্যে জোটে না। ট্রাম সম্পর্কে মানুষটা সেদিন গড়গড় করে যা বলে গেলেন, তা মনে রাখা এবং বলা এই বয়সে একপ্রকার অসম্ভব। সেদিনের পর থেকে অদ্যাবধি অটুট রয়েছে অসমবয়সী সেই বন্ধুত্ব। সব ঠিকঠাকই চলছিল, কিন্তু একটা ফোন সবকিছু উলটপালট করে দিল। ট্রামে চেপে গল্পের রসদ সংগ্রহ করে ফেরার সময় দাদু চলন্ত ট্রামেই অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরিবারের সবাই চলে এসেছে। দাদুর নতুন ইয়ং বন্ধুবান্ধবীরাও হাজির। কিন্তু না শেষ রক্ষা হল না। S.S.S. আর গল্প লিখবে না। তিলোত্তমার বুকে চলবে ট্রাম, কিন্তু গল্পের উপাদান সংগ্রহ করতে কেউ সেই ট্রামে উঠবে না। আজ দাদুর লেখা প্রতিটা গল্প শুধু হিট না, একেবারে সুপার-ডুপার হিট। গাড়িটা ভেঁপু বাজিয়ে এগিয়ে চলেছে, দাদু সেখানে একা শুয়ে আছেন। পিছনের বড় গাড়িটায় দাদুর পরিবার আর তার পেছনের গাড়িতে পথিক এবং বাকি সকলে। আজ S.S.S. সবাইকে ছেড়ে চললেন তাঁর শেষ ঠিকানায়। উনি বলতেন, “যমালয়ের জীবন্ত মানুষ হয়ে নয়, তবে সত্যি সত্যি একদিন পাড়ি দেব সেই দেশে, যে দেশে আমার বুড়িটা আছে। আর সেদিন হবে ঝগড়া। ঐ যমরাজ না কে যেন আছেন ওখানে, তাঁর সাথেও হবে এক হাত। বুড়ি আমাকে ছেড়ে পালিয়েছে, এবার এই বুড়ো ওনাকে বোঝাবে কত ধানে কত চাল।”
ভাবনার সুর কেটে গেল। টিং টিং শব্দে এগিয়ে আসছে ট্রাম। একই রাস্তার পাশ দিয়ে ছুটে চলেছে শববাহী গাড়ি আর ঠিক তার গা ঘেঁষে চলেছে ট্রাম। সাহানা চিৎকার করে বলে উঠল, “দাদু, ঐ দেখো ট্রাম, এই নাও তোমার ডাইরি আর পেন। লিখে ফেলো দেখি সুপার-ডুপার কিছু একটা।”
কিন্তু না এসব আর কিছুই হবে না। ওদের সবার চোখগুলো তখন জলে চিকচিক করছে। পৃথিবীতে সব সম্পর্কের তো আর নাম হয়না, থাকে না কোনো রক্তের সম্পর্ক। তবে সেদিনের ঐ এক বেলার ট্রামের ভ্রমণ বলে গেছে না বলা অনেক কথা। সৃষ্টি করে গেছে কিছু মধুর সম্পর্ক। দাদুর প্রিয় ট্রাম গাড়িটা হয়ত বলে গেল “বিদায় বন্ধু, আবার দেখা হবে নতুন কোন রূপে।”
আর ওদের S.S.S ও বুঝি বলে গেল, “বড্ড জ্বালিয়েছি তোমায়, রাগ করো না। আর আসব না, তোমাকে আর জ্বালাব না। আমি চললাম, রেখে গেলাম “ট্রামের সাতকাহন”। তোমাতেই শুরু হয়েছিলাম আর আজ তোমাতেই শেষ হলাম। বিদায় বন্ধু।”
ট্রাম বামদিকে আর দাদু ডানদিকে চলে গেল। না, আর ওদের রাস্তা মিলবে না। তবে অদৃশ্য একটা গাঁটছড়া কোথাও যেন রয়েই গেলো।
S.S.S. চলে গেছেন প্রায় ছ’মাস হয়ে গেলো। কিন্তু ওনার লেখা “ট্রামের সাতকাহন” আজ বইপ্রেমীদের মুখে মুখে। দাদু তাঁর লেখায় শুধু ট্রামের ইতিহাস লেখেননি, লিখেছেন জীবনের সাতকাহন। চলতে চলতও শেখা যায়, দেওয়া যায় প্রেমের বার্তা। দাদু পেরেছেন, হয়ত আরও কেউ পারবে। প্রকৃত শিক্ষক বুঝি এমনই হন, ঠিক ঐ S.S.S. এর মত।
লেখক পরিচিতি : অর্পিতা চক্রবর্তী
আমি অর্পিতা চক্রবর্তী, খুব সাধারণ একজন গৃহবধূ। মনের কল্পনা আর জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে লেখালেখি করি। মানুষের ভালোবাসা আমার কলমের অনুপ্রেরণা।