কিছু কথা বুঝে নিতে হয়

লেখক : মুসকান ডালিয়া (জাহানারা বেগম মন্ডল)

আমান তুই আবার মেরেছিস মেয়েটাকে? তোকে আর মানুষ করতে পারলাম না। তেরো বছরের ছেলের উপর রাগে চেঁচিয়ে উঠলেন সোফিয়া।

–আমান চিৎকার করে বলল- বেশ করব মারব। লাটাই ধরতে বললাম, ধরল না কেন?

ততক্ষনে রিয়ানার কাছে গিয়ে ওকে আদর করলেন সোফিয়া।

তারপর বললেন – আজ ওর পিঠের ছাল তুলব, তুই কিছু চিন্তা করিস না বাবু।

রিয়ানা বলে উঠল

–নানা ওকে মারতে হবে না আম্মু। ওর লাগবে তো।

এবার হাসলেন সোফিয়া।

বললেন – তুই এত্ত ছোট একটা বাচ্চা মেয়ে, তবু তোর কত বুদ্ধি। আর ওই গাধাটার যদি একটু বুদ্ধি হত।

হাসতে হাসতে সোফিয়া আম্মুর কোলে তখন গড়িয়ে পড়েছে রিয়ানা।

রিয়ানা যখন বছর তিনেক তখন ওর বাবা হঠাৎ করেই মারা যান হৃদরোগে। তার ঠিক দুই বছর পর মারা যান রিয়ানার মা আমরিন। আমরিন আর সোফিয়া ছিলেন অভিন্নহৃদয় বন্ধু। মারা যাওয়ার আগে সোফিয়ার হাত দুটো ধরে আমরিন বলেছিলেন –“আমার মেয়ে আজ থেকে তোর। তুই ওর দেখাশোনা করিস। আমিতো জানি তুই ওকে নিজের ছেলের চেয়েও বেশী ভালোবাসিস।”

চোখের জলে বুক ভেসে ছিল সেদিন সোফিয়ার। আমরিনের মৃত্যুর সময় রিয়ানার বয়স ছিল মাত্র পাঁচ বছর। রিয়ানার দাদিমা বেঁচে থাকলেও বেশিরভাগ সময় রিয়ানা থাকতো সোফিয়ার কাছেই। সোফিয়ার একমাত্র ছেলে ঠিক রিয়ানার বিপরীত। রিয়ানা যেমন শান্ত হাসিখুশি, ভারী মিষ্টি, আমান তেমনি প্রচন্ড দুষ্টু আর চঞ্চল। কিন্তু রিয়ানাকে ভীষণ ভালোবাসে। প্রতিমুহূর্তে ওদের ঝগড়া হতে থাকে, কিন্তু বন্ধুত্ব অটুট। রিয়ানা নয় আসলে ঝগড়া করে আমানই। সপ্তাহে যে পাঁচদিন স্কুল থাকে সেই পাঁচদিন শান্তি থাকে সোফিয়ার। বাকি দুটো দিন তো ওদের দুজনের খুনসুটিতে অতিষ্ঠ। ঘুড়ি ওড়ানোর প্রচন্ড নেশা আমানের। সেই ঘুড়ির লাটাই ধরে থাকতে হবে রিয়ানাকে। কথা না শুনলে চুল টেনে দেওয়া, নাক খিঁচে দেওয়া অথবা মাথায় ঠাস করে একটা থাপ্পর। রিয়ানা কখনও হজম করে, কখনও ও কাঁদতে কাঁদতে বলে দেয় সোফিয়া আম্মুকে। এভাবেই কাটতে থাকে দিন।

সেদিন সোফিয়া রাগে বলেই ফেললেন

– আরে আমান, রিয়ানা কি সারা জীবন তোর ঘুড়ি লাটাই ধরে থাকবে নাকি? খেলা, পড়াশোনা কি কিছু নেই ওর? পুতুল খেলার বয়স ওর, আর তুই ওকে নিয়ে ঘুড়ি ওড়াচ্ছিস। ওই বা কেন সারাদিন তোর লাটাই ধরে বসে থাকবে এখানে?

–হ্যাঁ থাকবে, থাকতে হবে। আমি সারা জীবন ঘুড়ি ওড়াব, আর ও সারাজীবন লাটাই ধরে থাকবে।

–কেন? ওর বিয়ে দেবো না? ও কি একদিন শ্বশুর বাড়ি যাবে না?

— না কোত্থাও যাবেনা। আমাদের সঙ্গেই থাকবে। তাহলে এক কাজ কর, তুই ওকে বিয়ে করে নে। তাহলে সারা জীবন ও তোর ঘুড়ির লাটাই ধরতে পারবে।

–ইসস! ওকে নাকি আমি বিয়ে করব। কালো,মোটা, নাক বোঁচা। ওই পাগলিকে আমি বিয়ে করব না।

কথাগুলো বলে হাসতে লাগল আমান। তেরো বছরের কিশোরী মেয়েটা চোখে জল নিয়ে লাটাইটা আস্তে করে বসিয়ে রেখে চলে গেল ঘর ছেড়ে। মুহূর্তে কি হয়ে গেল কিছুই বোঝা গেল না। শুধু সোফিয়া দূর থেকে সব লক্ষ্য করলেন। কেমন করে জলভরা চোখে মেয়েটা ধীরে ধীরে হেঁটে চলে যাচ্ছে নিজের ঘরের দিকে। কিন্তু রাগ করে যে আর আসবে না তারই উপায় কি? চুলের মুঠি ধরে নিয়ে আসবে আমান। ওকে আসতেই হবে। ছুটির দিনে যখন সে ঘুড়ি ওড়াবে তাকে পাশে থাকতেই হবে।

এভাবেই চলছিল দিন। আস্তে আস্তে সময় পেরিয়ে আঠার পেরিয়ে উনিশে পড়ল রিয়ানা। কলেজে ভর্তি হয়েছে। এদিকে একটা চাকরিতে জয়েন করেছে পঁচিশ বছরের আমান।

সেদিন ছিল চাঁদ রাত। ঈদের খুশিতে ঝলমল করছে গোটা পাড়া। ছেলেরা বেলুন, রঙিন কাগজ নিয়ে সবকিছু সাজাতে ব্যস্ত। রিয়ানা চুপ করে নতুন চাঁদের দিকে তাকিয়েছিল ছাদের এক পাশে দাঁড়িয়ে। সেদিন আর ঘুড়ি ওড়ায়নি আমান। অফিস থেকে এসে শুয়ে ছিল চুপ করে। মন খুব খারাপ। মাথাটাও ভীষণ ধরেছে। রিয়ানা ভালো চা বানায়, সাথে ওর হাতের ম্যাসাজ। উফ এক লহমায় সব কষ্ট গায়েব। মাকে বলল রিয়ানাকে ডেকে দিতে। রিয়ানা এলো অনেকক্ষণ পর।

বলল – আমাকে ডাকছিলে?

–হ্যাঁ ডাকছিলাম। এখানে এসে বস। মাথা ধরেছে।

— তুমি বিশ্রাম নাও। আমার আজকে অনেক কাজ আছে, আসছি। আম্মুকে বলো – চা বানিয়ে দেবে।

— আমি জানি তোর কাজ আছে। কিন্তু তোর থেকে বেশি কাজ আমার আছে।

খাট থেকে আচমকা উঠে বসলো আমান। তারপর এগিয়ে গেল জানালার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা রিয়ানার দিকে। আমানকে ওভাবে আসতে দেখে থমকে গেল রিয়ানা। তারপর বলল- কি? কি হয়েছে ? কি বলতে চাও তুমি?

–তোর সঙ্গে রুস্তম এর কিসের সম্পর্ক?

— মানে? কি বলছো তুমি?

—বলছি তোর সঙ্গে রুস্তমের কিসের সম্পর্ক? চোখে চোখ রেখে আবার কথাটা থেমে থেমে উচ্চারণ করলো আমান।

— ও আমাকে ভালোবাসে। মাথা নিচু করে জবাব দিল রিয়ানা।

–আর তুই? তুই ভালবাসিস?

— জানিনা।

দেখ রিউ ,তোর সঙ্গে আমি বেশ কয়েকবার কথা বলতে দেখেছি রুস্তমকে। প্রথমে ভেবেছিলাম একই ক্লাসে পড়িস,তাই। কিন্তু কাল যখন তোর হাতে কিছু একটা দিল। তখন আমার সন্দেহ হল। কি দিয়েছিল তোকে?

— কি দিয়েছিল? তাতে তোমার কি হ্যাঁ?

এই প্রথমবার চেঁচিয়ে উঠলো রিয়ানা।

আবার বলল–বেশ করেছে দিয়েছে। চিঠি দিয়েছে আমাকে। আমি ভালোবাসি কিনা জানতে চেয়েছে। চিঠিতে আমাকে ফোন নাম্বার দিয়েছ ফোন করার জন্য। বলেছে এই ঈদের দিন থেকে শুরু হোক আমাদের ভালোবাসার জীবন। কেন তোমার কোন আপত্তি আছে? আমি কি সারাজীবন তোমার ঘুড়ির লাটাই ধরে থাকবো? আমার জীবনে কি আর কিছু নেই? ভালোবাসা নেই? কিচ্ছু নেই আমার? আমি কি তোমার হাতের পুতুল নাকি? তুমি যখন যেভাবে নাচাতে থাকবে, আমি ঠিক সেভাবেই নাচতে থাকবো? কেন আমি কি রক্তমাংসের মানুষ না? এভাবে কেন যখন তখন ডাকবে আমায়? আজ থেকে আমাকে আর ডাকবে না তুমি। তোমার অফিসের ছুটির দিনে তুমি একা একা ঘুড়ি ওড়াবে। আমি আর আসবো না। খুব শিগগির আমি রুস্তমকে বিয়ে করছি।

— কি? ভীষণ গম্ভীর গলায় বলে উঠল আমান।

–আমি রুস্তমকে খুব শীঘ্র বিয়ে করছি। আবার ধীরে ধীরে কথাগুলো স্পষ্ট উচ্চারণ করে রিয়ানা।

— তুই এটা করতে পারিসনা রিউ। তুই জানিস না ও ভালো ছেলে নয়।

— তাতে কি? আমিও তো ভাল না। কালো মোটা নাক বোঁচা। আমার সঙ্গে তো খুব ভালো মানাবে, তাইনা? তোমার আপত্তি কিসের? তুমি তো সুন্দর, সুন্দর মেয়ে খুঁজে নাও।

এবার আরো কাছে এগিয়ে আসে আমান। কিন্তু এক ধাক্কায় আমানকে সরিয়ে দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় রিয়ানা।

চিৎকার করে ডাকে আমান। রি — য়া — না …

কিন্তু রিয়ানা দাড়ায় না।সোজা নিজের ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়ে। সোফিয়া ঘরে ঢোকেন। কি হয়েছে কিছুই বুঝতে পারেননি তিনি। মাকে ঘরে ঢুকতে দেখে আমান জড়িয়ে ধরে বলে –

-শুনলে আম্মু, কি বলে গেল রিউ? ও নাকি রুস্তমকে ভালোবাসে, ওকে বিয়ে করবে। তাহলে আমি? আমি কি করবো?

— তো কি করবে ও। তুই বল? ও কি কাউকে ভালবাসতে পারেনা?

— না আম্মু-সারা পৃথিবী দূরে চলে গেলেও ওকে আমি কখনো হারাতে পারব না। তুমি ওকে ফিরিয়ে আনো আম্মু।

–আমি পারবো না.. তুই যা, যদি পারিস তো তুই ফিরিয়ে নিয়ে আয়। অবশ্য সে যদি আসতে চায় তো।

আমান আর দেরি না করে উঠে চলে যায় ছাদে। ও জানে মন খারাপ হলে ছাদই রিয়ানার একমাত্র আশ্রয়। জলেভরা চোখ বন্ধ করে তখন ছাদের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে রিয়ানা। কাছে গিয়ে মৃদু স্বরে ডাকে আমান- রিউ…

রিয়ানা চমকে ওঠে, কিন্তু ঘুরে তাকায় না। আস্তে করে ওর কাঁধ স্পর্শ করে আমান। তারপর আলতো করে টেনে নেয় বুকের ভিতর। রিয়ানা কাঁদছে নিঃশব্দে। চোখের জল এসে বুকের মধ্যে মিশে যাচ্ছে আমানের। বুকে জড়িয়ে ধরে আস্তে আস্তে হাত বুলিয়ে দিতে থাকে মাথায়।

বলে- আমার পাগলী, তুই কি জানিস না তোকে আমি কতখানি ভালোবাসি? সব কথা কি বলতে হয় রে? আমি জানি তুইও আমাকে ভালবাসিস, সেই ছোট্ট ছয় বছর বয়স থেকেই। তুই আমার জন্যই নিজেকে তৈরি করেছিস। আমার ভালোলাগা, মন্দলাগা, আমার কষ্ট হলে তুই মাথায় হাত বুলিয়েছিস। আমার দুঃখ হলে কেঁদেছিস। খেলেছিস আমার সাথে। আমি তোকে ভাত মেখে খাইয়ে দিয়েছি নিজের হাতে। তোকে স্কুল কলেজে ভর্তি করেছি, তোর প্রতিটি কাজে তোকে সাথে করে সব জায়গায় নিয়ে গেছি নিয়ে এসেছি। বল- তুই আমি তাহলে কার জন্য বেঁচে আছি এতদিন? আমার আজীবনের ভালবাসাকে অন্য কেউ নিয়ে যাবে-এটা কি করে হয়?

—তুমি আমাকে ভালোবাসো না। কালো মোটা নাকবোঁচা মেয়েকে তুমি ভালোবাসতে যাবেই বা কেন?

–উফফফ পাঁচ বছর আগের কথা এখনো মনে আছে তোর? আরে পাগলী, আমি তো মজা করে বলেছিলাম। তুই কি কালো? ওই দেখ -আকাশ বুকে মেঘগুলো কি সুন্দর এগিয়ে যাচ্ছে, দেখেছিস? আর যখন সেই মেঘ থেকে বৃষ্টি পড়ে তখন আরো সুন্দর লাগে। তুই তো আমার সেই বৃষ্টির রঙ রিউ। তোর নাকটা বোঁচা কোথায়? দেখ আমার চোখের আয়নায়- তুই আমার থেকে অনেক অনেক সুন্দর। আর মোটা? তা অবশ্য ছিলিস এক সময়। গোলুমোলু মিঠাই। এখন কিন্তু স্লিম, দারুন লাগে।

আমানের কথার ধরনে হেসে ফেলো রিয়ানা।

বলে –আমারও কিন্তু একটা শর্ত আছে?

— কি শর্ত?

–আমি আর লাটাই ধরতে পারব না।

— দরকার নেই। আমার মনের ইচ্ছেঘুড়ি তোর আকাশে উড়িয়ে দিয়েছি আজ।

বলতে বলতে রিয়ানার কপালে একটা দীর্ঘ চুমু দিল আমান। তারপর নাক টেনে দিয়ে বললো-

–সব কথা কি মুখে বলতে হয় রে পাগলি? কিছু কথা বুঝে নিতে হয়। আমি যেমন বুঝেছিলাম, তুই আমাকে ভালবাসিস। আমি জানতাম- আমি আসলে তুই না করতে পারবি না। তুই আমাকে ফেরাতে পারিস না।

ছাদের সিঁড়ি থেকে সোফিয়া দেখলেন- দুটো ছেলে মেয়ে হাতে হাত রেখে তাকিয়ে আছে আকাশের নতুন ঈদের চাঁদের দিকে। তিনি প্রার্থনা করলেন -ওরা সুখী হোক। ওদের মধ্যে কি হল তা জানার দরকার নেই।

তিনি নিজেও জানেন , কিছু কথা বুঝে নিতে হয়।


লেখক পরিচিতি : মুসকান ডালিয়া (জাহানারা বেগম মন্ডল)
নাম- মুসকান ডালিয়া। জন্ম-১৯ নভেম্বর। হুগলি জেলার ডানকুনি থানার অন্তর্গত ডানকুনি গ্রামে জন্ম আর বেড়ে ওঠা। বিবাহিতা, দুই সন্তানের জননী। স্নাতক দক্ষিণেশ্বর হীরা লাল মজুমদার মেমোরিয়াল গার্লস কলেজ থেকে। সাহিত্যের প্রতি ভালবাসা সেই ছোট্ট থেকেই। ছোট্ট থেকেই কবিতা লেখার শুরু। স্কুলের দেওয়াল পত্রিকায় প্রথম লেখা প্রকাশ। এরপর বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় লেখা। গৃহবধূ, দুই সন্তানের জননী। সাথে শখের মেকআপ আর্টিস্ট। গল্প, বড় গল্প, উপন্যাস, কবিতা, প্রবন্ধ আমি সবকিছুই লিখতে ভালোবাসি। লেখাই জীবন, লেখাই বেঁচে থাকার রসদ। তাই এক কথায় - "যদি প্রেরণা দাও, এক আকাশ গল্প লিখতে পারি। সাহিত্য তোমাকে যে ভালবাসি ভারি। "

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।