লেখক : শ্রাবণী গুহ
ড্রয়িংরুমের শ্বেত পাথরের মেঝেতে অরিনের নিথর শরীরটা কেমন নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছে। আর ওর শরীর ছুঁয়ে পাথরের মত বসে অঞ্জনা শুকনো খটখটে চোখে। ছেলে ঋভু কান্নাভেজা চোখে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে। খবর পেয়ে এক এক করে সব আত্মীয় স্বজনরা আসতে আরম্ভ করেছে। কেউ পুরোহিত মশাইকেও খবর দিয়েছে। উনি শেষ যাত্রার তোড়জোড় শুরু করেছেন।
গুনগুন, ফিসফিস কথা ভাসে বাতাসে। উড়ে এসে ঠোক্কর খায় অঞ্জনার শাড়ির পাড়ে। কিছু কথা গড়াগড়ি খায় জানলা দিয়ে এসে পড়া মেঝের রোদ্দুরে।
“আহা রে! কী বা বয়েস…”
“শুনেছিলাম, খুব ড্রিংক করত?”
“করবে না? ওই তো উশৃঙ্খল একটা মেয়েকে বিয়ে করেছিল…”
“ওই নেশাই ওকে খেল।”
“ইসস! ছেলেটা সবে ক্লাস টুয়েলভে। কী হবে? কে দেখবে?”
“মায়ের তো ওই উড়নচন্ডী দশা। কী আর হবে? উচ্ছন্নে যাবে..”
কথাগুলো হাওয়ার মত উড়ে যাচ্ছিল অঞ্জনার মাথার ওপর দিয়ে বিন্দুমাত্র রেখাপাত না করে। একটা শোরগোল উঠল। “এসে গেছেন ডাক্তারবাবু “, কেউ একজন ডাক্তারবাবুকে ভেতরে নিয়ে এল।
পরিচিত মুখ। পাড়ার মোড়ে বসেন। বেশ কয়েকবার অরিনের জন্য ওনার সঙ্গে কনসাল্ট করেছে অঞ্জনা। অরিনের হাতটা তুলে নাড়ি দেখলেন। মাথা নাড়লেন হতাশায়। বুকে স্টেথোস্কোপ দিয়ে চেক করে তাকালেন অঞ্জনার দিকে। “আমি তো আগেই আপনাকে সাবধান করেছিলাম। আর একটা ড্রাগ শট, মৃত্যু অনিবার্য।”
ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল অঞ্জনা।
কী বলছেন উনি? গলা নামালেন ডক্টর। “দেখুন, আমি পোস্ট মর্টেমের জন্য পাঠাচ্ছি না। শুধু শুধু আপনার বদনাম হবে। পুলিশের হয়রানি সে আলাদা মাথাব্যথা। আপনি বুদ্ধিমতী। আশা করি সব দিক সামলে নিতে পারবেন।”
ডেথ সার্টিফিকেটে লিখলেন, “ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক।” অঞ্জনা মুখ নিচু করেই রইল। থমকে গেল কান্নাফুল চোখের পালকে। প্রায় আধঘন্টা হল, ওরা অরিনকে নিয়ে শ্মশানের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেছে। সেই থেকে তেমনি বসে আছে অঞ্জনা।
বড় বৌদি এসে দাঁড়ালেন। স্নেহের হাত রাখলেন মাথায়। “এবার ওঠ অঞ্জু, সত্যটা মেনে নে। অরি আর ফিরবে না। বরং ঋভুর মুখ চেয়ে নিজেকে শক্ত কর। ওকে মানুষ হতে হবে।”
সম্পূর্ণ অচেনা গলায় একটা অদ্ভুত প্রশ্ন করল অঞ্জনা। “ড্রাগের ডোজটা কোথায় পেল অরিন বলতে পার ?”
অরিনের সঙ্গে অঞ্জনার দেখা হয়েছিল কলকাতা ইউনিভার্সিটিতে এম.এ ইকোনমিক্স ফর্ম তুলতে গিয়ে। রোগা,কালো ছেলেটা। মুখের মধ্যে দৃষ্টি কেড়ে নেয় বুদ্ধিদীপ্ত জ্বলজ্বলে চোখদুটো। অঞ্জনা তখন সদ্য প্রেমে ছেঁকা খেয়েছে। খালি খালি বিষাদগ্রস্ত মন। ছেলেটা নিজে থেকে এসেই পরিচয় করল। “হাই, আমি অরিন দাসগুপ্ত।”
ঈশ্বরের লীলা বোঝা ভার… কখন যে অরিন ওর বেস্ট ফ্রেন্ড হয়ে উঠল!
দুজনেরই বই পড়ার নেশা।
বইমেলায় গাদাগুচ্ছের বই কিনে ঘর ভরানো, এক্সচেঞ্জ করে পড়া, লেখকদের লেখার স্ট্যান্ডার্ড নিয়ে চায়ের কাপে তুফান তোলা…তারপর ঝগড়া। তিনদিন কেউ কারুর মুখ দেখাদেখি নেই। পরে অবশ্য অরিনই নিজে থেকে এগিয়ে এসে সারেন্ডার করত। “সরি ইয়ার…আর ঝগড়া করব না।” অঞ্জনার তখন সমস্ত সময় জুড়ে রয়েছে অরিন, শুধু রাতের ঘুমটুকু ছাড়া।
নোট বানাতে অমুক বই লাগবে, লাইব্রেরি থেকে অরিন নিয়ে এসে হাজির। পেনের ইঙ্ক ফুরিয়েছে…অরিন, পিজি একমোডেশন পোষাচ্ছে না, নতুন চাই….অরিন, গ্যাস শেষ? অরিন, এমন কী জ্বর হলেও অরিনকে ফোন করে বলা ওষুধ এনে দিতে। বন্ধুরা খেপাত।
“অরিনকে বরং শ্বশুরবাড়িতে সঙ্গে নিয়ে যাস পণ হিসেবে।”
এম.এ-তে ফ্লাইং কালার নিয়ে পাস করল অঞ্জনা। ফার্স্ট ক্লাস থার্ড। অরিন ফার্স্টক্লাস পেলেও এম.এ-তে মনমত রেজাল্ট হল না।
সবাই বলল, “নিজে আর পড়ল কোথায়? ও তো খালি অঞ্জনাকে বই জুগিয়ে গেছে। পাস করেছে এই ভাগ্যি।”
না! লোকের কথায় কান দেয়নি ওরা।
অঞ্জনা তৈরী হতে লাগল ওয়েস্টবেঙ্গল পাবলিক সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষার জন্য। অরিন রেলওয়ে সার্ভিস কমিশনে পরীক্ষা দিয়ে সেন্ট্রাল রেলওয়েতে জয়েন করে গেল। সেদিন সকাল থেকে মুষলধার বৃষ্টি নেমেছে সারা কলকাতা জুড়ে। অরিনের মন লাগছিল না কাজে। কী ভেবে অঞ্জনাকে ফোন করল।
“চল রাস্তায় সাজি ট্রাম লাইন,
আর কবিতায় শুয়ে কাপ্লেট…
ভিজবি বৃষ্টিতে?”
অঞ্জনাও হয়তো অরিনের কথাই ভাবছিল।
তারপর…
ভিক্টোরিয়ার কালো পরীটা একলা বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে দেখল, দুটো ছেলে মেয়ে ঝুপুস্ ভিজে, জল উড়িয়ে চলে যাচ্ছে কালো পিচের রাস্তায়। সেদিনই প্রপোজ করল অরিন, সিনেমার হিরোর মত হাঁটু গেড়ে বসে, হাতে গোলাপ ফুল নিয়ে।
হিয়া টুপটাপ জিয়া নস্টাল
মিঠে কুয়াশায় ভেজা আস্তিন,
আমি ভুলে যাই কাকে চাইতাম
আর তুই কাকে ভালোবাসতিস…
“বিয়ে করবি আমায়?”
হাতে হাত রাখল অঞ্জনা।
আশ্চর্য!
বিয়ের দিন সকালে অঞ্জনা চিঠি পেল পাবলিক সার্ভিস কমিশনার পরীক্ষায় পাস করে সেলস ট্যাক্স ডিপার্টমেন্টের জুনিয়ার অফিসারের চাকরিটা পেয়ে গেছে!আনন্দের আর সীমা রইল না দু’বাড়িতেই। রূপকথার রাজ্যে তখন শুধুই ভালোবাসার ঘরবাড়ি।
তারপর?
ফোনটা বাজছে।
ঋভু!
“মা, সব কাজ হয়ে গেছে। আমরা ফিরছি।”
শব্দটা হাতুড়ির ঘা মারল মাথায়।
ফিরছি? কোথা থেকে?
অরিন তো নিজেকে সেই জায়গায় নিয়ে গেছিল, যেখান থেকে আর চাইলেও ফিরে আসা যায় না!
প্রথম প্রথম অফিসের পার্টিতে একটু আড়ষ্টতা বোধ করত অঞ্জনা।পার্টি অবশ্য ক্লায়েন্টই দিত।
টেবিলের নিচে প্যাকেট পৌঁছে যেত বিল পাস হলে। নিতে চায়নি প্রথমে। একটা আদর্শ নিয়ে চাকরিতে ঢুকেছিল। সৎ থাকবে নিজের কাজে। কিন্তু পারল কি? বস স্বয়ং ডেকে বললেন, “দেখ,তুমি যদি না নও, তাহলে একঘরে হয়ে পড়বে। বদলি হতে থাকবে এক অফিস থেকে অন্য অফিস। কেউ বন্ধু হবে না। তার চাইতে মেনে নাও। এটাই সিস্টেম।”
একটু থেমে বলেছিলেন, “অবশ্য ক্যাশ নিতে না চাইলে কাইন্ডও নিতে পার।”
“মানে?” বোকার মত জানতে চেয়েছিল। “মানে হল, কোথাও যদি বেড়াতে যেতে চাও,পার্টি সব ব্যবস্থা করে দেবে। পুজোর সময় ঠাকুর দেখবে, চব্বিশ ঘন্টা গাড়ি থাকবে তোমার সেবায়। এছাড়া গয়না, দামী ঘড়ি, শাড়ি এটা ওটা পেতেই পার।”
“কিন্তু? এতো ঘুষ?”
হা হা করে হেসেছিলেন বস।
“ঘুষ বললে ঘুষ, প্রতিদান বললে প্রতিদান। ক্লায়েন্টের এত এত টাকার বিল আমরা পাস করে দিচ্ছি, বদলে এইটুকু ফেভার তো আশা করতেই পারি।”
হতবাক হয়ে বেরিয়ে এসেছিল কেবিন থেকে। অরিনের সঙ্গেও এই নিয়ে আলোচনা করল।
অরিনের সোজাসাপটা কথা।
“দেখ, এই চাকরিটা পেতে তুমি অনেক পরিশ্রম করেছ। সুযোগ যখন পাচ্ছ, তার সদব্যবহার কর।”
অরিনকে বড় অচেনা লেগেছিল সেদিন। তারপর তো, ধীরে ধীরে অভ্যস্ত হয়ে গেল অঞ্জনা। তবে প্রটেকশন হিসেবে অরিনকেও সঙ্গে নিয়ে যেত পার্টিতে। ফিরতে ফিরতে গভীর রাত। পাড়ার লোক বাঁকা চোখে দেখত বৈকি। তবে পুজোপার্বণে বেশী টাকা চাঁদা দেওয়া, কিংবা কারু চাকরির দরকার হলে তার সুবিধা করে দেওয়া, সামনে কেউ কিছু বলার সাহস পেত না।
শুধু?
ঘুণপোকা কখন ঢুকল অরিন আর ওর মাঝখানে টের পেল না!
প্রথম দিন ড্রিংকের গ্লাস মুখে তুলে ওয়াক এসে গেছিল। তারপর অভ্যাস হয়ে গেল।
আর অরিন?
খেয়ালই করল না কখন বোতলের পর বোতল উড়িয়ে দিচ্ছে। বেহেড মাতাল হচ্ছে। টলতে টলতে বাড়ি ফিরছে।
ইতিমধ্যে ঋভু এসে গেছে জীবনে।
অঞ্জনার পায়ে কিছুটা হলেও বেড়ি পড়ল। সারাদিন শ্বাশুড়ি ছেলে সামলান, রাতে আর উনি রাখতে রাজি নন। অগত্যা…
কিন্তু…ততদিনে অরিন নেশার দাস হয়ে পড়েছে।
খবরটা দিয়েছিল অরিনের অফিসের বন্ধুরা।
“বৌদি, একটু অরিনকে নজরে রাখবেন। প্রায় দিন অফিস কামাই করছে।”
অঞ্জনা তখন নিজের অফিসের অডিট নিয়ে ব্যস্ত।
তার ওপর ঋভুর দেখাশোনা। পাগল হবার জোগাড়! তবুও জিজ্ঞাসা করছিল।
“তুমি নাকি আজকাল অফিস কম যাচ্ছ?”
কিছুতেই স্বীকার করতে চায়নি। অঞ্জনাও ভুলে গেল। মাঝে মধ্যে পার্সে কিছু টাকা মিসিং হচ্ছিল, খেয়াল করেনি। বলা যায়,পাত্তা দেয়নি। বেহিসেবি টাকা আসে টেবিলের তলায়, কে আর তার খবর রাখে?
তলে তলে অরিন যে ড্রিংকের সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য ড্রাগের নেশাও করতে শুরু করেছে সেটাই বুঝতে পারেনি। সাধারণত মাসের প্রথমে সংসার চালাবার জন্য মাইনের কিছু টাকা অরিন ওর হাতে তুলে দিত। সেবার মাসের দশ তারিখ পেরিয়ে গেল। অরিন টাকা দিল না। খটকা একটা লেগেছিল। ভাবল হয়তো ভুলে গেছে। সেদিন রবিবারের ছুটি। ঋভুকে খাওয়াছিল অঞ্জনা। ঠিকে কাজের মাসি মানদা এসে বেতন চাইল। ডাইনিং টেবিল থেকে চেঁচাল অঞ্জনা।
“শুনছ, মানদার মাইনেটা দিয়ে দাও তোমার স্যালারি থেকে।” কোন জবাব এল না।
এল মানদা।
“বৌদিমনি দাদাবাবু বলছেন, ওনার কাছে নাকি টাকা নেই। তোমার থেকে নিতে বললেন।”
অঞ্জনার দু’হাত জোড়া ছেলেকে খাওয়াতে গিয়ে।
“দাদাবাবুকে বল আমার পার্স থেকে দিতে।”
গতকালই একটা বড় পার্টির পেমেন্ট পেয়েছে। খামটা ওই ভাবেই রাখা ছিল ব্যাগে। খোলা হয়নি।
টনক নড়ল, যখন ঘরে গিয়ে পার্সে খামটা পেল না।
“শুনছ, বলছি ব্যাগে একটা খামে বেশ কিছু টাকা ছিল। তুমি দেখেছ?”
প্রতুত্তরে, চিৎকারে বাড়ি মাথায় করল অরিন।
“কী ভেবেছ তুমি? আমি চোর? আমি নিয়েছি তোমার টাকা? সাহস তো কম নয় তোমার? বেশী টাকা রোজগার কর বলে কি মাথা কিনে নিয়েছ?” মাথা অঞ্জনারও গরম হল।
“ওহ! তাই বল… জেলাসি! আমি তোমার চাইতে বেশী রোজগার করি বলে খুব গায়ে লাগছে? চোর কোথাকার। আমার পয়সায় যে মদ খাও তার বেলা?”
লাফাল অরিন। “কোন শালা তোমার পয়সায় খায়? আমি পেচ্ছাপ করি তোমার টাকায়…” কথার চাপানউতর বাড়তেই থাকল। তেড়ে এল অরিন। সপাটে একটা চড় আছড়ে পড়ল অঞ্জনার গালে।
“শালী, বেশ্যা…”
চোখের সামনে চুরচুর হয়ে তাসের ঘরের মতন ভাঙতে দেখল ভালোবাসার ঘর বাড়ি।
“মা, আসব?”
ফিরে এসেছে ঋভু সব কাজ শেষ করে। হাতে মাটির কলসীতে লালকাপড় বাঁধা… অরিনকে… নাহ! ওর অস্থি নিয়ে এসেছে।
বড় বৌদি একটা প্রদীপ জ্বালিয়ে দিলেন ঘরের কোণে আর একটা জলচৌকি পেতে দিলেন। শ্রাদ্ধ হওয়া পর্যন্ত ঐখানেই থাকবে অরিন। হাত রাখল ঋভু হাতে।
“মা, সামলাও নিজেকে।”
ঠোঁট নড়ল অঞ্জনার। “তুই কি আমায় দায়ী করছিস?”
“নাহ! মা। আমি জানি তুমি অনেক চেষ্টা করেছিলে বাবাকে নেশার করাল গ্রাস থেকে ফিরিয়ে আনতে। কত ছোটো হয়েছ লোকের কাছে। হয়ত এই ভালো হল। তুমি মুক্তি পেলে।”
ভাবল অঞ্জনা।
মুক্তি? পেল কি?
সে তো ইচ্ছে করলেই পেতে পারত ডিভোর্স ফাইল করে, যখন অরিন আকণ্ঠ ডুবে গেছিল নেশায়। প্রথম প্রথম মাইনের টাকা, অঞ্জনার ব্যাগ থেকে টাকা চুরি, মায়ের পেনশনের টাকা জোর করে ছিনিয়ে নেওয়া…
মাও প্রশ্রয় দিতেন। লুকিয়ে লুকিয়ে টাকা গুঁজে দিতেন হাতে। আতঙ্কে দিন কাটত অঞ্জনার আর ঋভুর। যতক্ষণ অরিন বাড়িতে থাকত, পক্ষীমাতার মত আগলে রাখত ঋভুকে। অথচ যখন সুস্থ থাকত অরিন, ওর মত স্বামী বা পিতা হয় না।
নানারকমের বই কিনে আনত ঋভুর জন্য, পড়ে শোনাত, পার্কে বেড়াতে নিয়ে যেত। অঞ্জনাকেও বই উপহারে দিত।
ঋভু বলত ,”বাবা সবসময় এমন কেন থাকে না, মা?” কত বুঝিয়েছে অরিনকে।
“ছেড়ে দাও নেশা করা। আমরা তিনজন আবার বাঁচব সুন্দর করে।”
মাথা নাড়ত অরিন।
কিন্তু বিকেল হলেই আবার যে কে সেই! ব্যাপারটা চরমে গড়াল, যেদিন রান্নাঘরের চাকু গলায় ধরে অরিন ছিনিয়ে নিয়ে গেল মায়ের গলার সোনার হার।
শাশুড়ি কেঁদে পড়লেন অঞ্জনার কাছে। ডিভোর্সর কথা চিন্তা করছিল অঞ্জনা। শাশুড়ির মুখের দিকে তাকিয়ে প্রাণ কেঁদে উঠল। কোথায় যাবে এই অসহায় মানুষটাকে ছেড়ে? উনি নিজেও শ্বশুরের ভিটে ছাড়তে রাজি নন। অনেক চিন্তা ভাবনা করে, বন্ধুদের সঙ্গে পরামর্শ করে অরিনকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে নেশা মুক্তি সেন্টারে ভর্তি করে দিল অঞ্জনা। ছয় মাসের কোর্স। প্রতি সপ্তাহে নিয়ম করে দেখতে যেত।
গরাদের ওপারে ছটফট করত অরিন। হাত জোর করে ভিক্ষে চাইত। “প্লিজ আমায় বাড়ি নিয়ে চল। আর কখনও নেশা করব না।”
লুকিয়ে চোখের জল মুছত অঞ্জনা। তাও শেষরক্ষা হল না।
কোর্স কমপ্লিট হবার আগেই রাতের অন্ধকারে সেন্টারের পাঁচিল টপকে পালাল অরিন। ভোরবেলা পাড়ার ছেলেরা নেশায় বেহুঁশ অরিনকে গলির মোড় থেকে তুলে বাড়ি পৌঁছে দিল।
কঠিন হল অঞ্জনা। যদিও সেন্টারের লোকরা ফেরত নিতে এসেছিল। ওদের ফেরত পাঠিয়ে দিল। অরিনের ঠাঁই হল সিঁড়ির পাশের ঘরে। এটাচ বাথরুম আছে। অসুবিধা হবে না। সব আসবাব সরিয়ে দিল। শুধু ঘরভর্তি বই আর শোয়ার জন্য একটা খাট। ব্যস।
তালা লাগান থাকত দরজায়। জানলা দিয়ে দু’বেলা মানদা এগিয়ে দিত খাওয়ার থালা। রাতে তালা খুলে ঢুকত অঞ্জনা। সেন্টার থেকে ফিরে সাতদিন পার হয়ে গেছিল। প্রতিরাতে জান্তব অরিন একটু ড্রাগের জন্য। ছটফট করত যন্ত্রণায়।
হাতে পায়ে ধরত।
“প্লিজ একটু দাও… আর পারছি না।” আর পারছিল না অঞ্জনা নিজেও। চোখের সামনে প্রিয়জনের এমন দুর্দশা…
ভাঙতে ভাঙতে খাদের কিনারায় এসে দাঁড়িয়ে ছিল। শুধু পরশু রাতে…আশ্চর্য! হঠাৎ করেই ভীষণ শান্ত হয়ে গেছিল অরিন। আচ্ছা ও কি দেখে ফেলেছিল অঞ্জনাকে ড্রাগের পুরিয়াটা রাখতে? ডাক্তার বলেছিলেন, “আর যদি একবার ও ড্রাগ নেয় অরিন, হার্টফেল করবে।” কেমন হাড় জিরজিরে হয়ে গেছিল অরিন। বুকের খাঁচায় হৃদপিন্ডের ওঠানামা স্পষ্ট দেখা যেত। অঞ্জনা তো মুক্তি দিতে চেয়েছিল অরিনকে এই কষ্ট থেকে। তাই অরিনের প্রিয় বই ‘সঞ্চয়িতার’ ফাঁকে ড্রাগের পুরিয়াটা… দরজা বন্ধ করার আগে তাকিয়েছিল অরিনের দিকে। এক অদ্ভুত হাসি অরিনের মুখে। তাকিয়েছিল একদৃষ্টিতে। চোখ মেলাতে পারেনি অঞ্জনা।
কিছু বলতে চাইছিল কি? ধড়ফড় করে উঠল অঞ্জনা। পাগলের মতো টেনে নামাতে থাকল শেলফের বইগুলো। কোথায় গেল ‘সঞ্চয়িতা’ বইটা? খুঁজতে থাকল অঞ্জনা…
“জানে শুধু জল, চোখ ছলছল
দায় নেই কারো তাই লুকায় আঁচল।
অভিমানী তুই, পাবি না কিছুই
মিছেমিছি মুছে যাবে চোখের কাজল।”
লেখক পরিচিতি : শ্রাবণী গুহ
শ্রাবণী গুহ। লেখালেখি একটা প্যাশন।মনের আনন্দে লিখি।মুম্বাই বাসী।