বুদ্ধজয়ন্তী এবং নীরদবাবু

লেখক : জয়দেব ভট্টাচার্য

আজ বুদ্ধজয়ন্তী এবং আজই সিঁথির মোড় থেকে মূখ্যমন্ত্রীর পদযাত্রা করার কথা। ভোটের আগে তিনি তৃণমূল প্রার্থীর হয়ে ভোট প্রার্থনা করবেন। এবং উপস্থিত জনতাকে বুদ্ধদেবের বাণী শোনানো – ”ওম্ মণিপদ্ধে হুম্”, সঙ্গে সঙ্গে নিজের দলের প্রচার করা। অনবদ্য ব্যবস্থা। এই পরিবেশে মানুষ আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে থাকে। রাস্তায় বেরিয়ে কখন যে কী গণ্ডগোলের মধ্যে পড়তে হবে সেই আশংকায়। স্বাভাবিক যানবাহনের চলাচল ব্যাহত করে মিছিল চলবে। বুদ্ধদেবের ‘অহিংসা ব্রত পালন শ্রেষ্ঠ ধর্মাচারণ’।
অথচ তাঁর শোভাযাত্রায় থাকে যথেষ্ট সশস্ত্র পুলিশ বাহিনী এবং থাকে তাঁর সমর্থকদের দ্বারা বেষ্টিত পাহারা। রাস্তাঘাট সেই সময় স্বাভাবিক থাকবে না।
অশান্ত পরিবেশে থাকে মানুষের ঝামেলায় পড়ার সমূহ আশ


এর মধ্যে মেয়েটাকে অফিসে যেতে হবে। তা নিয়ে বাড়ির সবার দুশ্চিন্তা, বিশেষ করে তার বাবা, নীরদবাবুর। তিনি মেয়েকে বলেন, ‘আজ কি না-বেরলেই নয়?’
বাপের কথা শুনে মেয়ে, সুমিত্রা রেগে বলে, ‘আমার সমস্যা, আমি বুঝে নেব। তোমাদের চিন্তা করতে হবে না। কোনও না কোনও ভাবে ঠিক চলে যাব। তোমরা দুশ্চিন্তা থামাও।’
নীরদবাবু কিছু বলতে পারেন না। মেয়ের রোজগারে সংসার চলে। রুগ্ন মা, সুনীতার চিকিৎসার ব্যয়ভার মেয়ে, সুমিত্রাকেই বহন করতে হয়। মেয়ের কথার ঝাঁঝ বাবা হয়েও চুপ করে সহ্য করতে হয়।
‘গাছের ফুলগুলো কোথায় গেল?’ উনি স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করেন।
‘গাছের ফুল দেখতে হলে সকালে উঠতে হয়ে।’ মেয়ে তার অপিস যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে নিতে তার বাবাকে ঠুকল।
আজ অনেক দেরি হয়ে গেছে ঘুম থেকে উঠতে। ওঠারই ইচ্ছে ছিল না।
সুনীতা ঠেলা দিয়ে জাগায়। ‘আজ কী ওঠার ইচ্ছে নেই?’
ঘুম চোখেই জিজ্ঞাসা করেন। ‘মেয়ে কী আজ ডামাডোলের মধ্যে অপিস যেতে পেরেছে?’
‘শুনলেই তো মেয়ে বেরোচ্ছে।’
মেয়ে অপিস পৌঁছে মা’কেই ফোন করে পৌঁছানো সংবাদ জানায় এবং পরে তা ওদের মা’র কাছ থেকে জেনে নিতে হয়। নীরদবাবুর মাঝে মাঝে আক্ষেপ হয়। মনে মনেই বলেন, ‘আমাকে জানালে কী ক্ষতি হয়!’ কোনও দিন সুনীতা’র কাছ থেকে শুনতে হয়
‘মেয়ে তো অন-লাইনে অপিস করছে। আর বাবু নাকে তেল দিয়ে বেলা করে ঘুমাচ্ছেন।’
রিটায়ার্ড করার পর থেকে নীরদবাবুর ঘুম খুব বেড়ে গেছে। ওনার শরীর ইদানীং ভালো যাচ্ছে না। কোনও কাজে উৎসাহ পান না, তাই বোধহয় ঘুমিয়ে সময় কাটান।
‘আমি অনেক আগেই উঠেছিলাম।’
‘তো মাইক্রোওভেন থেকে চা নিয়ে কেন খাওয়া হয়নি। আমাদের তো দ্বিতীয়বারের চা খাওয়ার সময় হয়ে গেল।’
‘সে কী বেলা বারোটা বেজে গেছে!’
‘চোখ খুলে, ঘড়ির দিকে তাকাও।’ মেয়ের মায়ের মেজাজ চড়ে থাকে। বেশি কিছু বলা যায় না। চাকরি থেকে অবসরের পর ঘরেও ক্ষমতা হারায়।

আজ বুদ্ধ জয়ন্তী।
ঘরের আলমারিতে রাখা বুদ্ধ মূর্তিটা বার করে ফুল দিয়ে সাজিয়ে মেয়ের কাজের টেবিলটায় রাখার ইচ্ছে হয়েছিল। শিল্পী তার সমস্ত শ্রদ্ধা, ভক্তি, বিনয় সমর্পন করে এক অনৈসর্গিক সৌন্দর্য্য ও পবিত্রতার অপূর্ব মূর্তি গড়ে তুলছেন। যা এক শান্তির প্রতীক হয়ে আমাদের সামনে ভাস্বর। মূর্তির দিকে তাকালে মন এক স্নিগ্ধ রসে ভরে ওঠে। মহাপুরুষের দিব্যপ্রভায় মাথা নত হয়ে আসে। নিজের মধ্যেও শান্ত শুদ্ধভাব অনুভূত হয়।
সকালের অসন্তোষ উবে যায়। যদিও নিজের মনের মতো পরিবেশে তৈরি করতে নীরদবাবু পারেন না। সময়ের হাতে নিজেকে ছেড়ে দিতে হয়। দিন নিজের নিয়মে চলে। প্রাত্যহিক দিন চলে চলুক। বারান্দার দিকের দরজা বাইরের আলো হাওয়া প্রবেশের পথ।
টবে বেল ফুল গাছ। শুচিস্মিত প্রস্ফুটিত ফুল ক’টা যেন বুদ্ধদেবের জন্য ফুটেছে। তারা তাদের সুগন্ধে সবাইকে উৎফুল্ল, উদ্ভাসিত করার চেষ্টায় ব্যাপৃত এবং যেন হাসতে হাসতে নীরদবাবুর সংসারের ছবি দেখছে।

মেয়ে ফিরলে নীরদবাবু তাকে জিজ্ঞাসা করে, ‘এই ঝামেলার দিনে কী করে অপিস গেলি ও এলি, সে বিষয়ে তো কিছু বললি না।’
‘অটো করে নাগেরবাজার…’ তাকে থামাই। ‘এখন থেকে কোন অটো তো নাগের বাজার যায় না? আগে তো তোকে দমদম স্টেশনে যেতে হবে।’
‘ওটা তো আন্ডারস্টুড।’
‘তুই সব খুলে বুঝিয়ে বল।’
‘এখান থেকে রিক্সা ও অটো করে নাগেরবাজার। সেখান থেকে আবার অটো করে এয়ার পোর্ট এক নম্বর… পরে বাসে..’
‘বাসে কেন গেলি? ওখান থেকেই তো অটোতে চলে যেতিস চিনার পার্ক।’
‘আমি তো আর চিনার পার্ক যাব না?’
‘তাহলে কোথায়?’
‘ইকোস্পেস। বাসে করে ইকোস্পেস।’
‘ওদিকটা ঠিক ভালো করে চিনি না। একদিন ঐ জায়গাগুলো চেনার জন্য বাসে, অটোতে ঘুরে ঘুরে দেখতে হবে। কলকাতায় থেকেও কলকাতা চিনি না।’
‘ওদিকের অনেকটাই দক্ষিণ চব্বিশ পরগনায়।’
মেয়ে ঠিক মতো বাড়ি ফেরায় নীরদবাবু তৃপ্ত। ঘরে বসে অন-লাইনে অফিস করাই ভালো। মেয়েটা চোখের সামনেই থাকে।

সুনীতা রান্না ঘরে যায়। সুমিত্রা মা’কে ডাকে। ‘তুমি ঘরে এসে বসো, আমি চা করতে যাচ্ছি।’
‘তুই, তোর কাজ কর। আমি লুচি ভেজে, চা করে তবে আসছি।’ মা মেয়ের কথার উত্তর দেয়।
মেয়ের কাজের মাথা মুন্ডু তিনি বোঝেন যায় না। সারাদিনই প্রায় তাকে ল্যাপটপ নিয়ে বসে থাকতে দেখা যায়।
‘মা, বাবা বসে বসে ঘুমোচ্ছে।’ মেয়ে চিৎকার করে তার মা’কে জানায়। তিনি তখন শুয়ে শুয়ে মোবাইলে মশগুল। অন্য সময় তার কানে কিছু ঢুকত না। কিন্তু আমাকে ধমকানোর একটা সুযোগ পাওয়া গেলে তা কী আর ছাড়া যায়! ঐ ঘরে থেকেই বলে ওঠে।
‘হ্যাঁ, এবার মাথাটা ভাঙো। খাট থেকে পড়লে আর দেখতে হচ্ছে না। বসে বসে না-ঘুমিয়ে, ভালো কর শুয়ে ঘুমোতে পারছো না?’
নীরদবাবু তখন ধ্যানস্থ-বুদ্ধ। কোনোভাবে বিচলিত হতে চান না। জগতের কোনও পুরুষই বোধহয় তার স্ত্রীর সাথে কথায় জিততে পারে না। নীরবতা এক শব্দ প্রতিহত বর্ম।
‘সারাদিনে সামান্য ক’টা কাজ, তাও করে উঠতে পারিনা। কী এক কাল ঘুম যে আমায় ধরেছে, সব সময় ঘুমিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে।’

‘প্রচণ্ড ব্যথা। সকালে কত কাজ করতে হয়েছে।’
কাজের মেয়েকে শুয়ে শুয়েই মেয়ের মা, সুনীতা, নিজের কষ্টের কথা শোনায়। কিছুক্ষণ আগেই বাথরুমের কল থেকে জল পড়ার আওয়াজ শুনে উঠে গিয়ে জলের ট্যাপ বন্ধ করে আসে। কলের নিচে রাখা বালতি জলে ভরে উপচে পড়ছিল। সেটা বন্ধ করতে করতে নিজের মনে বলে, ‘জল পড়ে যাচ্ছে। কেউ কী শুনতে পারে না! একটু উঠে বন্ধ করে দিতে কী অসুবিধা হয়!’ ইদানীং মেয়ে, সুমিত্রার ফুলগাছ পরিচর্যার ঝোঁক হয়েছে।
কাজের মেয়ে বারান্দায় রাখা গাছের টবগুলোয় জল ঢেলে বালতি মগ নিয়ে বাথরুমের দিক থেকে ফিরতে দেখে, সুনীতা স্বর পাল্টে বলেন, ‘বালতি উপচে জল পড়ে যাচ্ছিল। বন্ধ করে তো যেতে পারতে। পরে তো বলবে কল থেকে জল পড়ছে না।’
কপাল ভালো কাজের মেয়ে খুব চুপচাপ কাজ করে। এবং বড় একটা কারো মুখের উপর কথা বলে না। মৃদু হেসে সে নিজের ত্রুটি সংশোধন করে নেয়।

পাড়ার দু’তিনটে ছেলে ভোটের স্লিপ দিতে এসেছিল। একটা দিকের দরজা ভেঙে যাওয়ায় সেটা হুড়কো দিয়ে বন্ধ করে রাখা হয়েছে।
‘ওদিকের দরজাটা ভাঙা। একটু ঘুরে এই দিক দিয়ে এসো।’ বাইরের ঘরের জানলা দিয়ে ভিতর থেকে চিৎকার করে বাইরের ছেলেগুলোকে সুনীতা জানায়।
নীরদবাবু তখন সিঁড়ির ল্যান্ডিংয়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানতে টানতে ঘোলাটে আকাশে বুদ্ধ পূর্ণিমার চাঁদ দেখছিলেন।
নিচে ঘরের বাইরে অন্ধকারে তিনটে ছেলে ভোটারের স্লিপ গুলো মোবাইলের টর্চ জ্বালিয়ে খুঁজছিল। ঘরের ভেতর থেকে সুনীতা ওদের সাথে সৌজন্য সুলভ কথাবার্তা চালায়। ‘ওকে তো চিনতে পারলাম না।’
‘ওর নাম মিহির’ সে তখন কিভাবে ভোট দিতে হবে, ভিতরে কে থাকবে, বোঝাচ্ছিল। দু’টো ব্যালট বক্স থাকবে, লোকসভা এবং বিধানসভার ইত্যাদি। খবরাখবর দেওয়ার পর, তাদের দলের লিফলেট এবং ভোটার স্লিপ দিয়ে ওরা চলে যায়। উপরে উঠে এসে মেয়েকে বলেন, ‘এগুলো যত্ন করে রাখিস। ভোটার স্লিপ আছে। একটা নতুন ছেলে ওদের সংগে এসেছিল। তার বাবা পোষ্ট মাস্টার ছিলেন। ঠিক মনে পড়ছে না।’
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে উপর থেকে ওদের কথা শুনতে পেয়ে তিনি বলেন, “অঞ্জন সাহা।” আর কিছু বলতে যাওয়ার আগেই সুনীতা বলে ওঠে ‘ধ্যাৎ। কিছু জানে না। সব বিষয়ে কথা বলা চাই। তোর নানা যখন কাজ করতো তখন অনেক সময়ে ওনার কথা বলতো। ভালো লোক ছিলেন। এখন নামটা মনে আসছে না।’
স্বামীকে পাত্তা না-দেওয়া, অবজ্ঞা করা সুনীতার স্বভাবে দাঁড়িয়ে গেছে।

কাজের একঘেয়েমি কমানোর জন্য মেয়ে,সুমিত্রা, তার মায়ের সঙ্গে খুনসুটি শুরু করে। ‘ও মা। টিকটিকি জ্বালাচ্ছে।’
‘হ্যাঁ, তুই তো খুব নরম মাটি, কেঁচোও তোকে খোঁচায়।’
সুমিত্রা বলে, ‘পেটে খিদে থেকে গেলো।’
‘কেন, ভাত ছিল না! বললি না কেন তখন, আমায় দেওয়া শক্ত হয়ে যাওয়া ভাতগুলো তোকে দিয়ে দিতাম।’ নীরদবাবু বলে ওঠেন।
‘তা খেতামই না।’
‘আমায় তো তাই খেতে হলো।’
সুমিত্রা শুরু করে, ‘মা, আজ একটা ম্যাসিভ এ্যাকসিডেন্ট হতে যাচ্ছিল।’ প্রসঙ্গটা আগে একবার উঠেছিল। সবাই অন্য কাজে ব্যস্ত থাকায় ব্যাপারটা নিয়ে বেশিক্ষণ কথা না-হয়ে চাপা পড়েছিল। মেয়ে তার কাজ থেকে কিছুক্ষণের জন্যে ফ্রী হয়ে আবার প্রসঙ্গটা টেনে আনে। এবারও আলোচনা জমলো না।
সুমিত্রা খাটের উপর চায়ের কাপ রেখে বাবাকে জিজ্ঞাসা করে, ‘বিস্কুট কি দেবো?’
নীরদবাবু বলেন,’ ঝাল নোনতাওয়ালা কিছু থাকলে দে।’ একটা ঝাল-জিরা বিস্কুট ওনার মুখের সামনে ধরে মেয়ে বললো, ‘শুধু ব্রিটানিয়া ও বিক্সফার্মের বিস্কুট আছে।’
‘সে কিরে! তোরা তো কতো ভালো ভালো সব বিস্কুট খেতিস। আমি যখন চাইলাম তখন দিচ্ছিস না।’
‘এটা নিতে হলে নাও, না-হলে কথা বাড়িও না।’ মেয়ে মুখ ঝামটা দিয়ে উঠলো।

‘আজ একটু শান্ত নম্র হয়ে কথা বল। এইদিনে এক মহান পুরুষ, বুদ্ধদেব, পৃথিবীতে জন্মে ছিলেন। তাঁর সম্বন্ধে কী কিছুই জানিস না। তাঁকে স্মরণ করেও তো বিনয়ী হ’। ঔদ্ধত্য বিসর্জন দে।’
আমার কথায় কোনও কান না দিয়ে সে সামনে থেকে সরে যায়। ওর এইভাবে চলে যাওয়ায় তিনি মনে ব্যথা পান। সংসারে আর্থিকভাব পরনির্ভরশীল এক প্রৌঢ়কে কিভাবে থাকা উচিৎ সে বিষয়ে কী বুদ্ধদেব কোথাও বলেছেন? ওনার অষ্টাঙ্গিক মার্গে নিশ্চয়ই আছে। তা জেনে নিতে হবে। নিজের ব্যবহারিক জীবন থেকে শিখেছি, সহ্য শক্তি এবং অপমান হজম করার শক্তি বাড়ানোর প্রয়োজন।

‘কোমরের একটা পয়েন্টে প্রচণ্ড ব্যথা হয়। কত জায়গায় তো যেতে ইচ্ছে করে, কিন্তু শরীর এতোই নড়বড়ে যে ঘরের সামান্য কাজটুকুও করতে পারি না।’ মোবাইলে কারো সঙ্গে সুনীতা কথা বলছিল। মেয়ে চায়ের কাপ তার সামনে ধরায়, মোবাইল ছেড়ে সঙ্গে সঙ্গে বলে ওঠে, ‘এর মধ্যে তোর চা করা হয়ে গেলো? বললাম না, আমি উঠে চা করতে যাচ্ছি। তুই কত কাজ করবি!’

দিন ঠিক গড়িয়ে যায়।
‘তুমি কী খাবে না!’
‘খাওয়ার তেমন ইচ্ছে নেই। না, দিয়েই দাও, তাহলে তুমি ফ্রী হয়ে যেতে পারবে।’
‘বাটিগুলো যে কোথায় যায়!’
‘পাড়া বেড়াতে গেছে।’ নীরদবাবুর মুখ ফস্কে বেরিয়ে গেলো। বাটিতে করে একে ওকে জিনিস পাঠানো হয়।
‘তোমার আর কাজ কী! ঘরে বসে মশকরা করো।’
‘হাত থেকে সব পড়ে যাচ্ছে। কোমরের ব্যথায় আবার নিচু হতে পারছি না।’
সুনীতার বিক্ষোভ প্রকাশ হয়।

রাত গভীর। যে যার মতো শুয়ে পড়েছে। নীরদবাববু ঘুম আসে না। দিনে বেশি ঘুমানোর কারণেই হয়তো রাতে ঘুম আসতে দেরি হয়। ছাদে ওঠেন পূর্ণিমার শোভা দেখার জন্য। এখন আকাশ পরিষ্কার। চাঁদের আলোর এক মহিমা আছে। তা দেখতে দেখতে বেশ হালকা লাগে। চারপাশের বাড়ির আলোগুলো নিভে গেছে। দূরে দূরে সামান্য কিছু ঘরের মধ্যে জোনাকির মতো আলো জ্বলছে। এই মনে হচ্ছে প্রদীপ জ্বালা ছোটো বড়ো টিলা ঘেরা এক নির্জন স্থানে বসে আছেন। সঙ্গী মাথার উপর আলোর বলয় ঘেরা চাঁদ। তার মনের ভিতর নানা ভাবনা চিন্তার ঢেউ ওঠে।
ধর্ম কী কোনও কালে সাধারণ মানুষের উপকারে এসেছে। বরং তা তো মানুষে মানুষে বিভেদই সৃষ্টি করেছে। জীবনচর্চা শেখার জন্য কোনও নির্দিষ্ট ধর্মে দীক্ষিত না হয়েও সচেতন জীবনযাপনের মধ্যে দিয়েই অনেক কিছু শিখে নিতে পারে। বুদ্ধদেবের মধ্যপন্থা জীবনেরে অনেক ক্ষেত্রেই আমরা অবলম্বন করে থাকি। তর্কে মীমাংসা যেখানে হওয়ার নয়, সেখানে চুপ করে থাকাই শ্রেয়।

‘বুদ্ধদেব কী করে তার বিশাল সঙ্ঘ, আশ্রম ও বৌদ্ধবিহার চালাতেন? তাঁর ধ্যানস্থ মূর্তি দেখেই আমরা অভ্যস্থ। ধ্যানও তো এক গভীর ঘুম। যখন জাগতিক বিষয়ে কোনও জ্ঞান থাকে না। আমি বেঁহুশ হয়ে শুয়ে থাকলে সেটা হয়ে যায় ‘ঘুম’ আর বুদ্ধদেবের ক্ষেত্রে তা হয় ধ্যান।’
মানুষের দুঃখ নিরসনের লক্ষ্যে কি তিনি পৌঁছাতে পেরেছিলেন! রাজতন্ত্র থেকে মানুষকে মুক্তি দিয়ে বুদ্ধদেব যে বনিকতন্ত্রের আহ্বান করেছিলেন, আজ তার যে রূপ তিনি কী তা তার দূরদৃষ্টিতে তখন দেখতে পেয়েছিলেন!
আড়াই হাজার বছর আগের একটা মহান মানুষের প্রবর্তিত ধর্ম ও দর্শন আজও মানুষের মনে জাগ্রত এবং উজ্জ্বল। তবু এক অর্বাচীনের মনে কিছু প্রশ্ন তৈরি হয়েছে এবং সেই সব প্রশ্ন নমস্য শ্রদ্ধেয় মহান পুরুষের কাছে নিবেদন করতে ইচ্ছে হয়।
বিচলিত মনের শান্তি কাম্য। প্রশ্ন না করে যে থাকতে পারা যাচ্ছে না। এর থেকে মুক্তি কোথায়!

রাজপ্রাসাদের ভোগ বিলাস, স্ত্রী পুত্র পরিত্যাগ করে যিনি মানুষের মুক্তির পথ খোঁজার জন্য পথে নেমেছিলেন। তিনি বোধিত্ব লাভ করেছিলেন ঠিক। কিন্তু সবার পক্ষে তো আর বোধিত্ব লাভ সম্ভবপর নয়। মানুষ আজও দুঃখ কষ্ট থেকে মুক্তি পায়নি।

চীনা পরিব্রাজককে গৌতম বুদ্ধ বলেছিলেন, ‘আমি জাগরণ। অন্যেরাও যেন জীবনকে দেখতে শেখে এবং পরিণামদর্শী হয়।’
‘আপনি, একটা সিংহাসন পরিত্যাগ করে লাখও লাখও মানুষের মনের সিংহাসনে বিরাজ করছেন।’
‘ঈশ্বরের অস্তিত্বকে অস্বীকার করেন। অথচ সবার কাছে নিজেই ঈশ্বর হয়ে উঠলেন। জীবনের উপলব্ধিই যদি আসল কথা হয় তবে সেই উপলব্ধি তো প্রত্যেকে নিজের নিজের মতো করে অর্জন করে। এরপরও জানতে ইচ্ছে করে সাধারণ মানুষের জীবনে আপনার অবদান কী!’
‘মানুষের কর্মে আপনার বিশ্বাস। কর্মের ফল ই মানুষের জীবনের সঞ্চয়। ভাগ্যের গোলোক ধাঁধা থেকে মানুষকে মুক্তি দিয়েছেন।’
সংসার দুঃখময়, দুঃখের কারণ, দুঃখ নিবারণের উপায় এবং দুঃখকষ্ট অবসানের জন্য সত্যপথ অনুসরণ করা। এই চাকায় তো আজও মানুষ আবর্তিত। আপনার প্রবর্তিত মধ্যপথও অসংযত ভোগবিলাস ও অপরদিকে অনাবশ্যক শারীরিক কৃচ্ছসাধন – এই দুইয়ের মধ্যে একটা ভারসাম্য বজায় রাখা।
সৃষ্টিকর্তা অর্থাৎ ঈশ্বরের প্রতি আপনার বিশ্বাস ছিল না এবং পুনর্জন্মে আপনার বিশ্বাস ছিল না, অথচ ‘জাতকে’র গল্পগুলো তো একটা মানুষের জন্মান্তরের কাহিনি। কেন এমন হলো!”

‘জ্যোতিষ্মান মহাপুরুষের উপস্থিতিতে নিজে কী মাথা নত করে নিথর নির্বাক হয়ে থাকবো নাকি উজ্জ্বল জ্যোতিতে বিলীন হয়ে যাবো!’ নীরদবাবু মনে মনে ভাবতে থাকেন।

‘বাবা, তুমি ছাদে এসে ঘুমিয়ে আছো! মশায় তো খেয়ে ফেলবে। ওঠো। ঘরে গিয়ে শোও।’


লেখক পরিচিতি : জয়দেব ভট্টাচার্য
একজন অবসর প্রাপ্ত চুয়াত্তার বছরে পা দেওয়া মানুষটির শিল্প সাহিত্যের প্রতি প্রবল টান। তিনি মূলতঃ সময়ের মর্যদা দিতে পারেন না কেননা বেশ কিছুটা পরিশ্রম বিমুখ। এলোমেলো চিন্তায় তার দিনের বেশিরভাগ সময় কাটে। ওই আবেগ তাড়িত মন নিয়ে মাঝে মধ্যে কিছু গল্প লেখার চেষ্টা করেন।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।

লেখা আহ্বান - বিস্তারিত জানতে ছবিতে ক্লিক করুন

দীপায়ন