লেখক : জিনিয়া কর
ঘুমটা ভেঙে গেল কুসুমের। এই এক জ্বালা, রাস্তার উপরে বাড়ি হওয়ায়। সময় নেই, অসময় নেই, দিনরাত নাগাড়ে ভোঁ-ভাঁ চলছে তো চলছেই। প্রচণ্ড বিরক্তি নিয়ে চোখ খুলল কুসুম। ঘরের ভেতরটা অন্ধকার হয়ে গেছে। যদিও বাইরে বিকেলের মরা আলো একতলার জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে এখনও। উপরের ভাড়াটিয়া ছেলেটা গান গাইছে, ভরাট গলা সুরেলা আওয়াজ। কুসুম গান শুনতে ভালোবাসে, বিরক্তি ভাবটা যেন কেটে যাচ্ছে একটু একটু করে। সারা শরীরের ব্যথা নিয়ে উঠে বসলো । দুপুরে তরকারিতে নুন বেশি হওয়ায় আজকেও মার খেয়েছে মনিরুলের হাতে।
মানুষটা বদরাগী, কথায় কথায় মারে। এই নিয়ে বিয়ের পরে পরে, মানে বছর বিশেক আগে একবার দরবার করতে গেছিল মায়ের কাছে। সব কিছু শুনে সবিনা বিবির মাথায় হাত। এত খোঁজ খবর নিয়ে মেয়ের বিয়ে দেওয়া, মেয়ে আবার বলে কি?
“জামাইয়ের বাইরে কুনো সম্পক্য আছে নি? নেশা-ফেসা করে? কুনো বদ স্বভাব আছে নি, এই যেমন এদিক ওদিক… দোস্ত ইয়ার…”
মাথা নীচু করেছিল কুসুম, অর্থাৎ “না।”
খাদিজা বিবি ভয়ানক রকম মুখ চোখ কুঁচকে মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আবার প্রশ্নের ঝড় তুলেছিলেন, “জামাই নামাজ জাকাত করে তো হরবখত? তরে টাকা-পয়সা কিছু দেয়? নাকি দেয় না?”
কুসুম এবারও মাথা নীচু করে থাকে, অর্থাৎ “হ্যাঁ।”
সত্যিই মানুষটা ইসলামের ভক্ত। রোজগারের সিংহভাগ কুসুমের হাতেই তুলে দেয়। যদিও না জিজ্ঞেস করে সেখান থেকে একটা টাকা ভিখারীকেও দেওয়ার জো নেই। ঝামড়ে উঠেছিল খাদিজা বিবি, “ন্যাকামি করো তুমি? কাজকাম কিছু পারবা না, ঘরে আকাম করবা, আর সোয়ামী তোমারে মাথায় তুইল্যা নাচবা?”
ভয়ে ভয়ে কুসুম মায়ের চোখে চোখ না রেখে খুব নীচু গলায় বলেছিল, “না মা, সে কথা না। উনি ওই সময়ও মারেন। যখন তখন মারেন, দোষ না করলেও মারেন।আদর করতে করতেও মারেন।”
খাদিজা বিবি আট আট বার আতুরে গেছে। ঘরে সতীন আছে। সংসারে অন্নবস্ত্রের অভাব আছে, ছেলের নেশাভাংয়ের দোষ আছে। সেই নিয়ে মারপিট আছে। জাকাত কুরবানীর ক্ষমতা নেই বলে সমাজে অসম্মান আছে। এসব হাজারো সমস্যার সামনে কুসুমের সমস্যা তার কাছে বড়ই তুচ্ছ মনে হল। মেয়েকে কঠিন গলায় বলল, “মানায়া লও সংসারে। হাউরি-ননদ নাই, কোন ঝুট ঝামেলা নাই সংসারে, তারপরেও তোমার গাল উঠে না। অত বিবি হইয়া থাকলে চলবা না। বিয়া হইয়া গেছে, এহন নিজের সংসার নিজেই সামলাও।”
এত কিছু যে আড়াল থেকে শুনছিল কুসুমের সৎমা, এতক্ষণ বোঝা যায় নি। খাদিজা বিবিকে ঝামড়ে উঠতে দেখে সাকিনা বিবিও সামনে এল। গলা যতটা সম্ভব নীচু রেখে, কুসুমের কাঁধে হাত রেখে, কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলল, “পুরুষ মানুষ সারাদিন বাইরে খেটে-ফেটে আসে, তুই যদি ওই সময়ে বিছানায় কাঠ হয়ে পড়ে থাকবি, তাহলে তো রাগ হওয়ার কথাই। জোয়ান মানুষ, ঘরের মেয়ে মানুষে গতরের সুখ না পেলে গায়ে হাত তুলবে বৈকি! বেশি তেরিবেরি করলে সতীনও নিয়ে আসবে। বলে দিলাম কিন্তু।”
এরপরে বিশ বছর কেটে গেছে, বিশ বছরে পাঁচ সন্তানের মা হয়েছে কুসুম। কোনদিনও বাপের বাড়ি গিয়ে মনিরুলের নামে কোনো নালিশ করেনি। মারের চোটে যে দু’বার তার গর্ভ নষ্ট হয়েছে, সে কথা পর্যন্ত জানেনা বাড়ির লোকজন।
আল্লাহ হু আকবর…
মাগরিবের আজান দিচ্ছে সম্মুখের মসজিদে। কুসুম মাথায় ওড়না নিতে নিতে তাড়াতাড়ি রান্নাঘরের দিকে যায়। মানুষটা এসে পড়বে এখনই। নামাজ সেরে ওঠার সাথে সাথেই হাতে চায়ের কাপ না ধরলে আবার মেজাজ গরম হবে তার।
মনিরুল ইসলাম পেশায় দর্জি, বাড়ির সাথেই লাগোয়া দোকান। আয়পত্র খুব বেশি না হলেও মিতব্যয়ী মানুষের অভাব নেই সংসারে তেমন, অন্ততঃ তিনি তাই মনে করেন। ইদানিং দোতলায় একটা ঘর ভাড়া দিয়েছেন সেখান থেকেও আসে হাজার দু’য়েক। টাকাটা গুছিয়ে রাখছেন মেয়ের বিয়ে দেওয়ার জন্য।
একলা পুরুষ মানুষকে বাড়ি ভাড়া দেওয়ার ইচ্ছা মনিরুল সাহেবের ছিল না তেমন। এতে বাড়ির মেয়েবৌদের সম্ভ্রম নষ্ট হওয়ার যথেষ্ট আশঙ্কা থাকে। কিন্তু ভদ্রলোক এমন হাতে-পায়ে ধরলে। তাছাড়াও তিনিও মনে করলেন হাজার দু’য়েক টাকা উপরি আয় হলে মেয়েটাকে পার করার বেলায় সুবিধে হবে। তবে সাবধানের মার নেই। অনেকগুলো শর্তে রাজি করিয়ে নিয়েছেন আগেই। যেমন, দিনের বেলায় তিনি বাড়ি থাকতে থাকতেই একবারই স্নান-বাথরুম-পায়খানার জল তুলে নিয়ে গিয়ে ঘরে মজুত রাখতে হবে, দ্বিতীয়বার আসা যাবে না। কখনও কোন অবস্থাতেই ছাদে ঘুরঘুর করা চলবে না, রাতে হলে অবশ্য ভিন্ন কথা। বাইরে কোথাও গেলে মনিরুল সাহেবকে চাবি দিয়ে যেতে হবে। কারণ যত গুরুতরই হোক না কেন, বাড়ির মেয়েবউদের বিরক্ত করা চলবে না, ইত্যাদি ইত্যাদি। এমন সব অদ্ভুত শর্তগুলো আবার একদম সরকারি কাগজে লিখিয়ে দস্তখত করিয়ে শেষে ভাড়া দিয়েছেন মনিরুল সাহেব। আরো একটা বিশেষ শর্ত, বাড়ির মেয়েমানুষের সাথে কথাবার্তা বলা তিনি বিশেষ অপছন্দ করেন। তাই যে কোনো অবস্থাতে মেয়েদের সাথে আলাপ করা যেন না হয়।
আশীষ রাজী হয়েছিল মনিরুলের সব শর্তে।
নামাজের পর টিভি দেখতে দেখতে এক কাপ চা খেয়ে আবার দোকানে চলে যান প্রত্যেকদিন। মা মেয়েতে কথা হয় সেই সময়ে।
“ইস্তাম্বুল কি রে?”
আয়েশা বিরক্ত হয়, “জায়গার নাম।”
“হুম্, সেখানে যাওয়া যায় না?”
“উহু, অনেক দূরে, বিদেশে।”
“বিদেশে? বিদেশে ক্যামনে যায়?”
“এরোপ্লেনে চড়ে।”
“বাতাসে? গুনাহ হয় না ইসলামে?”
“উঃ, আম্মী!” বলে ধমক দেয় আয়েশা।
আবার টিভি দেখে দুজনে। কুসুম চুপ করে থাকতে পারেনা। তার সিরিয়াল দেখতে ভালো লাগছে না। আবার উসখুস করে ওঠে, “এই আয়েশা…।” মায়ের জ্বালায় সিরিয়ালটা কিছুতেই দেখা যাচ্ছে না। টিভিটা বন্ধ করে রিমোটটা দুম করে মায়ের কোলে ফেলে ধুপ ধুপ করে নিজের ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে আয়েশা।
আয়েশার বয়স ১৫ বছর, মাধ্যমিক দিয়েছে। ওর জন্য সম্বন্ধ দেখছে ওর আব্বু। আয়েশারও বিয়ে করার ইচ্ছা খুব। ইস্কুলে যায়, তবে পড়াশোনা ভালো লাগেনা। ঘর বন্ধ করে আয়নায় নিজেকে ঘুরে ঘুরে দেখে। স্বচ্ছ ওড়না গায়ে পেঁচিয়ে নিজেকে আরব্য রজনীর রাজকন্যা মনে করে, নিজের মনেই হাসে, কথা বলে। আয়েশা ঘরে ঢুকে বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ল। চোখ দুটো ছাদের দিকে স্থির। ঠিক ওপরের ঘরেই নতুন ভাড়াটিয়া আশীষ থাকে। তার হাঁটাচলার শব্দ পাওয়া যায় নীচের তলায় আয়েশার ঘর থেকে। আয়েশা নানান কল্পনা করে মানুষটাকে নিয়ে, কাল ছাদে জামাকাপড় মেলতে গিয়ে দরজার ফাঁকে চোখ রেখে তাকিয়ে ছিল অনেকক্ষণ। ভাগ্যিস দরজার দিকে পেছন ফিরে বসেছিল মানুষটা, নইলে ঠিক দেখতে পেত আয়েশাকে। অদ্ভুত মানুষ, রোগা, লম্বা, মাথায় কাঁচাপাকা কাকের বাসা চুল, কাপড় জামায় পরিপাট্য নেই বলেই নাকি বয়স বোঝা যায় না। সারাদিন ঘরেই থাকে। টেবিলে বসে কাগজপত্র নিয়ে কি সব লেখালেখি করে, রোজগারের চিন্তা নেই বোঝাই যায়। মাস পড়লে এক তারিখে নিয়মিত ভাড়ার টাকাটা দিয়ে যায়।
পরের দিন সকালে।
“আয়েশা, মা আয়েশা। উপরের ওই ভদ্রলোক তো এখনো জল নিতে এল না রে। কোন অসুখ-বিসুখ করল নাকি? একটু দেখে আয় তো মা।”
আয়েশার মনে ষোলোআনা ইচ্ছে থাকলেও মাকে সেটা বুঝতে দিলো না। “আমার দরকার নেই। আব্বু জানতে পারলে ছাল তুলে নেবে। তুমি নিজেই গিয়ে দেখে আসো।”
কুসুমেরও অজানা নেই সে কথা, কিন্তু মন মানে না। ভীষণ ইচ্ছে হয় জানতে।
“লোকটার কি হল? জল ছাড়া একটা মানুষের আবার চলে নাকি? অথচ টাইম কলের জল কখন এসেছে, সকালে আটটাতেই আসে। এখন প্রায় দশটা বাজতে যায়। আর কিছুক্ষণ হলে…” নিজের মনেই বিড়বিড় করে কুসুম। রোজ দিন তো উনি থাকতে থাকতেই আসেন, আজ আবার কি হল? একবার উপরে গিয়ে দেখে আসলে বেশ হত। আয়েশাকে আবার অনুরোধ করে কুসুম। “যা না মা, আব্বু জানতে পারবে না।”
আয়েশা এবার আর দ্বিরুক্তি করে না। পা টিপে টিপে উঠে যায় ছাদের ঘরে। টুক্ টুক্ টুক্ – নরম আঙ্গুলের টোকা খোলা দরজায় পড়তেই আশীষ বিছানায় উঠে বসে। সত্যি সত্যি তার জ্বর এসেছিল রাতে। একলা মানুষ…
“কি ব্যাপার, জল নিলেন না যে আজ? টাইম কলের জল বন্ধ হতে আসে।”
“নাঃ, শরীর টা ভালো নেই।”
“তা সে কথা বলতে হয় না?” বলতে বলতে আয়েশা ঘরে ঢুকে এসে আশীষের কপালে হাত রাখে।
শিউরে ওঠে আশীষ! মনিরুল সাহেব ব্যাপারটা যে ভালো মতন নেবেন না ভালোই বুঝতে পারে। আয়েশার হাতটা সরিয়ে একটা ঢোক গিলে বলে, “না না, আমি এখন ঠিক আছি। আমার জলের দরকার নেই। আসলে জল এখনও আছে ঘরে, তুমি এখন এসো মা।”
আয়েশা ঘরের চারদিকে চোখ বুলায়। “তাড়িয়ে দিচ্ছেন বুঝি?”
আশীষ অপ্রস্তুত হয়। “না না, তাড়িয়ে দেব কেন ? মানে, ওই আর কি! শরীরটা ভাল লাগছে না তো, তাই একটু শুয়ে থাকব।”
আয়েশা তরল হাসে। “বেশ তো, আপনি শুয়ে থাকুন না। আমি জল এনে দি। আর আম্মি কে বলি দু’টো ভাত বেশি করে রাঁধতে। আপনাকে আজ আর উঠে রান্নাবান্না করতে হবে না।”
জ্বরের তাড়সে, মনের উত্তেজনায় বিছানায় এলিয়ে পরল আশীষ।
মনিরুল সাহেব একটু কড়া ধাঁচের মানুষ, তবে অমানুষ তো নন। আশীষের জন্য ডাক্তার ডেকে আনলেন। আর সুস্থ হওয়ার আগে পর্যন্ত খাওয়া-দাওয়ার ভার নিজের হেঁসেলে কুসুমের হাতেই অর্পণ করলেন। তবে কড়া নজরদারি শিথিল হল না। আশীষ সেবা পেয়ে একটু একটু করে সুস্থ হয়ে উঠল যথাসময়ে। মনিরুল সাহেবও নিশ্চিন্ত হলেন। তবে এর পেছনে যে মা মেয়ের কতটা মিথ্যাচার, গভীর ষড়যন্ত্র, আর নিখুঁত অভিনয় আছে, সেটা উনি টের পেলেন না।
সুস্থ হওয়ার পর সেদিন কলে জল ভরছিল আশীষ। কুসুম নিজেকে যথাসম্ভব আড়ালে রেখে আশীষের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল, “আজ এত দেরিতে জল ভরতে এলে যে?”
প্রশ্নের উত্তরে আশীষ একটু মুচকি হাসলো।
“তোমার তো বিয়া করা লাগে, বয়স হইছে তো কম না।”
“আপনাকে কে বলল ভাবী, আমি বিয়ে করি নি?”
একটু হোচট খেলো কুসুম। “ও, বিয়া করছ বুঝি? তাহলে বাপু একা থাকা কেন্? এই যে অসুখ বিসুখে কষ্ট পাও, একটা মাথায় হাত দেওয়ানের লোক নাই। বিয়া করছে যখন, বউ নিয়ে আসো।”
একটু যেন ম্লান হাসলো আশীষ, মায়াকাড়া কষ্টের হাসি। “আপনাদের এতে অনেক অসুবিধা হল। বলুন?”
কুসুম একটু অপ্রস্তুত। চট করে কথা ঘোরাল, “না না, তা কইছি নি? রোজ তো উনি থাকতেই জল নিয়া যাও কিনা, তাই জিজ্ঞাসা করলাম।”
“মনিরুল সাহেব দোকান চলে গেছেন নাকি? আর আয়েশা?”
কুসুমের বুক ধুকপুক করে ওঠে, প্রশ্নটার দুইটা অর্থ হয়। একটা, মানুষটা আয়শাকে খোঁজে, নয়তো আয়েশার অবর্তমানে কুসুমের সাথে একান্তে একটু গল্প করতে চায়। কুসুম চুপ করে আছে দেখে আবার প্রশ্ন করে আশীষ, “আপনার কি একটাই মেয়ে?”
এবারও কুসুম নিরুত্তর। এই প্রশ্নটারও অনেকগুলো উত্তর হয়। কোনটা দেওয়া সমীচীন ভাবতে থাকে কুসুম।
আশীষের জল ভরা হয়ে গেছিল। “আচ্ছা ভাবী, আমি তাহলে যাই।”
আড়াল থেকে হুট করে বেরিয়ে আসে কুসুম, মাথায় ঘোমটা ছাড়া এলোমেলো কুসুম। অপলক চেয়ে থাকে আশীষ। লজ্জা পেয়ে কুসুম ওড়না টানে মাথায়।
“তোমার শরীর দুর্বল। আমি না হয় ঘরে দিয়ে আসি তোমার জলের বালতি দু’টো?”
লাজুক হাসে আশীষ, “কি যে বলেন ভাবী!” বালতি দু’টো তুলে দ্রুত পায়ে উঠে যায় দোতলায়।
আজ স্নান করে উঠে আয়নার সামনে বসে অনেকক্ষণ ধরে চুল বাঁধল কুসুম, চোখে কাজল দিল, গোলাপী রঙের একটা ঝলমলে সালোয়ার পড়ল। মনিরুল সাহেব ঘরে ঢুকে বউয়ের এমন সাজ দেখে কয়েক সেকেন্ড অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন। তারপরে গম্ভীর স্বরে বললেন, “ব্যাপার কি? কোথাও যাও নাকি?” কুসুম চুপ।বিরক্ত হলেন মনিরুল সাহেব, বিড়বিড় করে কি বললেন বোঝা গেল না। খাওয়ার জায়গায় বসে খসখসে গলায় বললেন, “ভাত দাও।”
পরিপাটি করে ভাত বেড়ে খেতে দিল কুসুম। নিজের ভাত রেখে দিল, মেয়ে আসলে একসাথে খাবে বলে। মনিরুল সাহেব কুসুমের দিকে বারবার চাইলেন, কি যেন একটা আনন্দে কুসুমের মুখটা ঝলমল করছে মনে হল, বড্ড আনমনা খেয়ালী। বুকের ভেতরটা ঢিপ ঢিপ করে উঠল যেন, খেতে বসে কোন খুঁত ধরলেন না আজ।
কুসুম আজকাল কাজকর্মে তেমন ভুল করে না। খোশমেজাজে থাকে,গুনগুন করে গান গায়। জানালায় দাঁড়িয়ে আকাশ দেখে, সকালে আশীষের সাথে রোজ গল্প হয়, বেচারির বৌ মেয়েকে নিয়ে চলে গেছে। শুনতে শুনতে নিজের চোখ মোছে।
সেদিন আশীষ শুয়েছিল বিছানায়, কাজ করতে ইচ্ছে করছে না, ফিরে ফিরে কুসুমের মুখটা মনে পরছে। মাত্র একদিন দেখা সেই এলোঝেলো মুখটা। উফ, মানুষ এত সুন্দর হতে পারে? ওই গভীর দু’টো চোখে কত মায়া, কত রহস্য।
“আসি?” একটা দুষ্টু মিষ্টি মুখ উঁকি দিলো দরজায়।
আশীষ একটু প্রগলভ, “তোমারই অপেক্ষায় ছিলাম সুন্দরী।”
“আসলেই চায়ের অপেক্ষায় ছিলেন বলুন।”
“দু’টোই। সুন্দর মুখ আর মিষ্টি চা, বর্ষার দিনের পারফেক্ট কম্বিনেশন।”
“সত্যিই আমি সুন্দর? বলছেন?”
“অবশ্যই! তুমি বড়ো হয়ে মায়ের মতই সুন্দর হবে। এখন তুমি ছোট।”
আম্মি কে পছন্দ করে না আয়েশা। মা যে সুন্দর আশীষ জানল কিভাবে? ওনার তো পরপুরুষের সামনে পর্দা করার কথা। এইজন্যই আব্বু মায়ের চরিত্র নিয়ে খোঁটা দেয়। মনটা তেতো হয়ে যায় আয়েশার। প্রসঙ্গ পাল্টায়।
“আপনি সারাদিন কি লেখেন?”
“সেটা তো বলা যাবে না তোমাকে।” রসিকতা করে আশীষ।
“কেন? বললে কি হবে? আমি ছিনিয়ে নিয়ে দেখব।”
হাহা করে হাসে আশীষ। “যদি বলি ওসব প্রেমপত্র, আমি আমার প্রেমিকাকে লিখি।”
বালিকা অভিমানী, “আমিও কারোর প্রেমে, কিন্তু তাকে কিভাবে চিঠি লিখি? বলে দেবেন একটু?”
আশীষ আয়েশাকে হাত ধরে খাটে বসায়, “বসো। তোমার কথা বলো। আজ তোমার কথা শুনি।”
“হুহ! আমার আবার কি কথা?”
“এই যেমন তোমার ভাই বোনেদের কথা।”
“আমার ভাই ? হাবিব? সে আট বছর বয়সে মারা গেছিল ছাদ থেকে পড়ে গিয়ে, আতিক আট মাস বয়সে, আর সায়লা তো একদম ছোটো ছিল। বড়ো আপ্পির…”
কুসুম দুপুরে একটু গড়িয়ে নেয়। বহুদিনের অভ্যাস, কোনদিন ঘুম লাগে, কোনদিন লাগেও না। আজ ঘুম থেকে উঠে সারা বাড়িতে আয়েশাকে দেখল না। বাইরে আকাশের রং লাল, বিকেল হয়ে আসছে। ওপর থেকে আয়েশার হাসি আর টুকরো টুকরো কথা ভেসে আসছে। কুসুম পায়েপায়ে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে এল। দরজার সামনে এসে নীচু গলায় ডাক দিল, “আয়েশা, আয়েশা।” আয়েশা আশীষের ঘর থেকে বেরিয়ে প্রজাপতির মতো সিঁড়ি দিয়ে নেমে এল মায়ের পিছুপিছু।
রান্নাঘরের এসেই মেয়ের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ল কুসুম। “তোরে মানায় ওই বুইড়াটার সাথে? তোর বয়স দেখস আর ওর বয়স?”
আয়েশাও সমানে চেঁচিয়ে ওঠে, “কি করেছি আমি? নিজে ফষ্টিনষ্টি করছ, তাই বলো। দুশ্চরিত্রা মেয়েছেলে কোথাকার।”
সন্ধ্যা হচ্ছিল। বাইরের ঘরে মনিরুলের সাহেবের পায়ের শব্দ শুনে চুপ হয়ে গেল দু’জনেই। মনিরুল মিঞা, মা মেয়ের চিৎকার শুনে কিছু সন্দেহ করে থাকবেন হয়ত। চা খাওয়া হয়ে গেলে ডাকলেন মা মেয়ে দু’জনকেই। গম্ভীর অথচ শান্তস্বরে জিজ্ঞাসা করলেন, “আমি আসার আগে কি নিয়ে এত হৈচৈ চলছিল শুনি? আমি ফষ্টিনষ্টি আর দুশ্চরিত্রা শব্দ দু’টো শুনেছি। তাই মিথ্যে কথা বলার চেষ্টাও করবে না দু’জনের কেউ।”
দু’জনেই নিরুত্তর, মাথা নীচু করে রইল। ব্যাপারটা আরও কতক্ষণ চলত, কে জানে। দোকানের একটা কারিগর এসে মনিরুল সাহেব কে ডেকে নিয়ে গেলেন, খদ্দের ডেলিভারি চাইছে।
রাতে বিছানায় শুয়ে ঘুমানোর অনেক চেষ্টা করেও ঘুম আসে না কুসুমের। রাগলে মানুষটার মাথার ঠিক থাকে না, এক এক করে মনে পড়তে থাকে মৃত সন্তানদের কথা! সায়লা তো মোটে তো মাত্র মাসখানেকের ছিল। একটু দুর্বল ছিল, সারাদিন কাঁদত, ভুগত, কোল ছাড়তে চাইত না।
বিছানায় উঠে বসে কুসুম। এভাবে নিষ্ক্রিয়ভাবে বসে থাকলে চলবে না, কিছু একটা হেস্তনেস্ত করতেই হবে। পা টিপেটিপে ঘর থেকে বেরিয়ে রান্নাঘর থেকে ছাদের দরজার চাবিটা নিয়ে সন্তর্পণে ছাদে উঠে যায় সিঁড়ি দিয়ে। দরজায় মৃদু টোকা দিয়ে চাপা গলায় ডাকে, “আশীষবাবু, আশীষবাবু।”
বেশ কয়েকবার ডাকার পর আশীষ বেরিয়ে এল দরজা খুলে। কুসুমকে দেখে পলকে দিশেহারা। চাঁদের আলোয় উদ্ভাসিত ছাদ। হঠাৎ কুসুম আশীষের পায়ের কাছে বসে পড়লো, “আমায় দয়া কর। আমি পাঁচবার মা হয়েছি। একটিমাত্র সন্তান এখনও পর্যন্ত বেঁচে আছে। আপনিই তাকে বাঁচাতে পারেন।”
হতভম্ব আশীষ নিজেও বসে পড়ে কুসুমের মুখোমুখি। “আমি মানে… আমি কি করলাম? আমি কিভাবে বাঁচাব?”
“আমার মেয়েটাকে উনি মেরে ফেলবেন, উনি যদি জানতে পারেন আপনাদের সম্পর্কের কথা।”
আঁৎকে উঠে চাপা চিৎকার করে আশীষ, “আপনি কি বলছেন এসব? আমাদের মধ্যে কোন সম্পর্কই নেই। আমি ওকে একটা বাচ্চা মেয়ের মত ভালবাসি। মনিরুল সাহেব জিজ্ঞাসা করলে আমি সে কথা বলতেও পারি।”
ম্লান হাসলো কুসুম। চাঁদের আলোয় সে হাসি বড়ই করুণ দেখাল।
“হাবিব, আতিক, আর সায়লারা আরও মাসুম ছিল, আরও ছোট ছিল। তাদের ভুল ক্ষমা করেননি মনিরুল সাহেব। আর আয়েশা…” ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো কুসুম।
“কি বলছেন আপনি এসব?”
“হ্যাঁ, আমি ঠিকই বলছি। উনি বাপ না কসাই! ওনার চন্ডাল রাগের শিকার হয়েছে আমার চার চারটি সন্তান। উনি নিজের হাতে মেরে ফেলেছেন আটবছরের হাবিবকে, একমাসের সায়লাকে। এখন আয়েশাই আমার সম্বল, আমার মাতৃত্ব। দয়া করুন, বাঁচান ওকে।”
ভ্রূ কুঁচকে উঠে দাঁড়ায় আশীষ। “বেশ! আমি কালকেই চলে যাব এই বাড়ি ছেড়ে।”
কুসুমের বুকের ভেতর যেন হাহাকার চিৎকার। “না, আপনি চেনেন না ওনাকে। রাতারাতি এভাবে চলে গেলে উনি সন্দেহ করবেন। আপনি হয়ত বেঁচে যাবেন, কিন্তু আমার মেয়েটা বাঁচবে না।”
আশীষ ফিরে তাকালো কুসুমের দিকে, দু’চোখ দিয়ে যেন গলন্ত জ্যোৎস্না গড়িয়ে নামছে মাখনরাঙা উপত্যকা বেয়ে। কুসুম যেন একটা পরী। আশীষ ছুটে এসে জড়িয়ে ধরলো কুসুমকে। “আজ তুমি যা বলবে, আমি তাই দিতে পারি তোমায়। জীবন তো বড় তুচ্ছ।”
খুব ভোরে ওঠার স্বভাব নেই আয়েশার। আজ ঘুম ভেঙে গেল রাস্তায় হট্টগোলে। মহা বিরক্ত হয়ে উঠে এল আয়েশা। ওদের বাড়িতে বারান্দা বলে কিছু নেই, জানালা দিয়ে তাকালে শ্যাওলাপোড়া উঠোন আর দোকানঘরের টিনের চালা ছাড়া আর কিছুই দেখা যায় না। একরাশ বিরক্তি নিয়ে আয়েশা ঘরের বাইরে বেরিয়ে এসে দেখে আধো অন্ধকারে কুসুম রান্না ঘরের দরজার সামনে বসে কোরআন তেলাওয়াত করছে। এত ভোরে মনিরুলের বাড়িতে থাকার কথা, নেই! আয়েশার কেমন যেন মনে হল চারদিকে ভয়ের আবহ, সিঁড়ির হাটখোলা দরজা দিয়ে পায়ে পায়ে ছাদে উঠে এল আয়েশা। ছাদের ঘরের দরজাটাও খোলা। আশীষবাবুও নেই সেখানে। জিনিসপত্রহীন খালি ঘরটা কেমন যেন খাঁ খাঁ করছে। আয়েশা ঘরটাকে বাঁদিকে রেখে ডান দিকের ছাদের পাঁচিল ধরে ঝুকে পড়ল রাস্তার দিকে।
বাড়ির সামনে এই সাত সকালেই প্রচুর মানুষের ভিড় জমা হয়েছে , এক পুকুর রক্তের মধ্যে পড়ে আছে একটা মানুষ। পরনের জামাটা তার বড্ড চেনা। আয়েশা চিৎকার করতে করতে ছুটে এল নীচে,
“আম্মি! উনি মারা গেছেন! আম্মি আব্বুর এক্সিডেন্ট হয়েছে, পুলিশ এসেছে, অসংখ্য লোক। শুনতে পাচ্ছ? আম্মিইইইইইই…”
কুসুমের কানে কোন কথাই গেল না। এক মনে সুর করে কোরআন তেলাওয়াত করতেই থাকল। আল্লাহুম্মা-গফির লি, ওয়ারহামনি, ওয়া আফিনি, ওয়াহদিনী, ওয়ারজুকনি। হে আল্লাহ!
(আমাকে ক্ষমা করুন, আমার প্রতি দয়া করুন, আমাকে পথ দেখান, আমাকে ক্ষতি থেকে রক্ষা করুন এবং আমাকে রিযিক ও পরিত্রাণ দান করুন।)
লেখক পরিচিতি : জিনিয়া কর
গৃহবধূ