ইতিহাসের আর্য্য ও আর্য্যদের ইতিহাস

লেখক : সুজয় রায় চৌধুরী

আজকাল বাড়ি ফিরতে পারিনা মাঝে মাঝে। কবে কখনো যে ছোটবেলার চেনা বাড়িগুলো বা মানুষগুলো চলে গেছে জানতেই পারিনা। অথচ নিজে কোথাও যেতে চাই না। থেকে যাই অজানা অচেনা নিজের পাড়াতেই।


আর্য্যদের অবস্থা কিছুটা সেরকম। কবে কোথা থেকে এসে এখানেই মিশে গেছে নিজেরাই জানেনা। এখানকার মানুষ বদলে গেছে। তারা একই ভাবে বদলে নিয়েছে নিজেদের। তবু থেকে গেছে। আর্য্য শব্দ টা মনুসংহিতা থেকে noble বা মহান হিসেবে স্বীকৃতি পাবার ঠিকই ১১ বছর পরে ১৮৫০ সাল নাগাদ ফরাসী ঐতিহাসিকরা বলেন, এরা ইন্দো-পার্শি একটি যাযাবর জাতি, যারা এসেছেন কিরঘিজ তৃণভূমি থেকে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে তারা তো ডাইনোসরের পিঠে চেপে আসেন নি। তারা যে সময় এসেছেন, সেই সময়ের আগে সুমেরিয় সভ্যতা এবং প্রায় সমসাময়িক মিশরীয় সভ্যতার কথা জানা গেল, আর আর্য্যরা একেবারে উল্কাপাতের মতন ভারতের মাটিতে এসে ইতিহাস গড়ে তুললো, তাই বা কী করে হয়!


যদি ধরেও নিই যে তারা নেহাত ছাপোষা, দেখতে ভালো, ইরানীদের খুড়তুতো ভাই, তাহলেও আসিরীয়দের সাথে তাঁদের বিস্তর ফারাক। আমাদের, অর্থাৎ যাদের নর্দিক আর্য্যদের হাত ধরে ঠাকুর নোনো করতে শেখা, তাঁদের কাছে অসুর হল শত্রুপক্ষ আর জলদস্যু জাতি আলপাইনদের কাছে অসুর হল দেবতার। তর্কের খাতিরে ধরে নিচ্ছি জাতিগত দাঙ্গার ফল। কিন্তু তাই বলে আমাদের দেবতা আর ওদের অসুর এক – এতো কষ্টকল্পনা মাত্র। আর একটা বিষয় ভাবার আছে। আর্য্যরা যতটুকু নথিভুক্ত করেছেন,তা বেদেই হোক বা যেখানেই হোক, সেখানে তারা বাঘ দেখলেন কিন্তু সিংহ দেখলেন না। ইরান থেকে ভারতের মধ্যভাগ অব্দি একটা রোগা সিংহও নেই সেই সময়!


বোমা ফাটিয়েছেন পুনে ডেকান কলেজের উপাচার্য এবং পুরাতত্ত্ববিদ বসন্ত শিন্ডে। দীর্ঘদিন একটি টিম এই এলাকায় গবেষণা চালিয়ে এখন যে সিদ্ধান্তে এসেছেন, তাতে সঙ্ঘ পরিবার ক্ষিপ্ত! প্রথম প্রশ্ন, সংস্কৃত ভাষা এবং বৈদিক হিন্দুবাদের উৎস কি হরপ্পা সভ্যতা? জবাব: না! ভারতীয় জনসমাজে কি এখনও হরপ্পা জিন টিকে আছে? জবাব: হ্যাঁ! নিশ্চয়ই! তা হলে ভারতীয়রা আজ বেশি আর্য্য? না দ্রাবিড়? মানে জনপ্রিয় অর্থে? জবাব: ভারতীয়রা অনেক বেশি দ্রাবিড়! সায়েন্স নামক জার্নালে এই গবেষণা প্রকাশিত হয়েছে। আর সঙ্গে সঙ্গে ভারতীয় সমাজে রাজনৈতিক তোলপাড়!

যদি ঐতিহাসিক সত্যতাকে যাচাই না করে মেনেও নিই, মধ্য এশিয়া থেকে যীশুর জন্মের ২০০০বছর আগে তল্পিতল্পা নিয়ে একদল সভ্য শিক্ষিত লোক নিজেদের ভাষা, পোশাক, বিদ্যা, প্রযুক্তি নিয়ে হিন্দুকুশ পেরিয়ে ভাড়াটে হিসেবে এসেছিলেন, তাহলেও প্রশ্ন হল, তার বহু আগে মিশরীয় সভ্যতা, আর তারও আগে মেসোপটেমিয়া সভ্যতার কথা জানা গেল, আর আর্য্যদের খবর কেউ রাখল না? সোজা ইউএফও থেকে নেমে গটমট করে হেঁটে তো আর আসেন নি? তাঁদের কেন হরপ্পা-মহেঞ্জোদাড়ো থেকে কেউ দেখল না, মনে রাখল না, সেটাও বিভ্রান্তিকর। কারণ হরাপ্পাতে যে গণকবর পাওয়া যায়, তার সময়কাল অনুযায়ী আর্য্যদের সাথে সংঘাতের ফলে, তদুপরি ঘোড়ার ও লোহার ব্যবহার না জানার ফলে আর্য্যরাই হরাপ্পা সভ্যতার মানুষদের পরাস্ত করেন।

কাজাখস্থানের উরাল নদীর তীর থেকে একদিন সকালে “দুচ্ছাই, আর ভাল্লাগেনা”-মার্কা মুখ করে উঠে আসার মতন লোক তারা নন। সেখানেও যে প্রাকৃতিক কষ্ট খুব একটা ছিলো মনে হয় না। অবশ্যই সমুদ্রবন্দর না থাকাটা স্থান ত্যাগের কারণ হতে পারে না। বাইরের শত্রুর আগমনটাও বোধহয় থাকার কথা নয়, কারণ আর কোন সভ্যতার হদিস তো আশেপাশে নেই। একমাত্র যদি না নিজেদের মধ্যে চুলোচুলি হয়ে থাকে।

অবশ্যই অনেকে মনে করেন আর্য্যরা বহিরাগত নন, পাক্কা ভারতীয় বা দিশি। কারণ যাঁরা ঋগবেদ রচনা করলেন, তাঁরা সেটা করার জন্য এদেশে এলেন এটা কী করে হয়। নিজের জন্মভূমিতে শান্তিতে বসে লিখলেই পারতেন। এমন কী স্বামী বিবেকানন্দ নিজেও তাই ভাবতেন। কেউ বলছেন যে, এঁরা এসেছেন জার্মানি বা ইউরোপ থেকে, নিজেদের শ্রেষ্ঠ জাতি প্রমাণের আপ্রাণ চেষ্টা আর কী! যুক্তিগুলো অবশ্য ফেলনা নয়। প্রথমত আর্যরা ঘোড়া, শুয়োর, বাঘ দেখতে পেল, অথচ সিংহ বিলকুল গায়েব?


স্বর্গত অধ্যাপক তপন রায় চৌধুরী বলেছিলেন, “মোক্ষ মুলার বলেছে আর্য্য, সেই থেকে মোরা ছেড়েছি কার্য্য।” কথাটা ফেলে দেবার মতন না। জার্মানদের আর্য্যপ্রীতি ও ভারতীয়দের আর্য্যপ্রীতি দেখলে মনে হয় ঐতিহাসিক রাজনীতি “আর্য্য জনজাতি”-র জনক। নেহাত কেতাবি কল্পনা। আমাদের দেশ কোনদিন ধর্মীয় ইতিহাস পড়েনি, অথচ অন্ধের মতন বিশ্বাস করে গেছে। ধর্মীয় ইতিহাস যদি থাকতো, সে রাজনৈতিক ইতিহাসের মতন রাজার গল্প বলত না, মানুষের গল্প বলত। হিন্দুধর্মের মধ্য থেকে বৈষ্ণবদের উত্থান আমরা জানতে পারলাম না, কারণ অসংখ্য সাধারণ মানুষের সামাজিক জীবনের গল্প সেখানে জড়িত ছিল। অর্থনৈতিক পরিকাঠামো কতবার ধর্ম কে প্রভাবিত করেছে, সে তো আর খুঁজেই পাব না। কিন্তু আর্য্যরা যদি আর্থসামাজিক পরিকাঠামোকে ঘুঁটি বানিয়ে একটা নতুনত্বময় জীবনযাত্রা কে ধর্মের নাম দিয়ে চাপিয়ে থাকে, তাহলে কিন্তু তাঁদের ইতিহাস খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।


এখন কথা হচ্ছে তাহলে আসল কথাটা কী? আজকাল খাচ্ছি, ফেসবুকে ঘুরছি, আর্য্যদেরকে নিয়ে “গর্ব সে কহো হাম হিন্দু”-মার্কা কিছু নয়। তাজমহল তেজো মহালয়া হবার মুখে বহু সত্য পাল্টে যাবে রাজনৈতিক ইতিহাসের চাপে। তাই ইতিহাস কে নিয়ে শুধু পড়বেন না, ভাবুন। ভাবা প্রাকটিস করুন।


লেখক পরিচিতি : সুজয় রায় চৌধুরী
লেখক সুজয় বলে কোনদিনই কেউ ছিল না। মঞ্চে বললে দু'শো লোক শোনে, মাঠে বা মাচায় বললে ৫০০। তাই মাঝে মধ্যে চেঁচিয়ে কূল না পেয়ে, হড়বড় করে যা তা লিখে যায়। পেশায় সরকারি আধিকারিক, উপরি রোজগার সঞ্চালনা, ভালোবাসেন গবেষণামূলক বই, দামি মদ, সুগন্ধি। ইচ্ছে আছে ফরাসী ভাষা, AI, আর প্রোটিন কেমিস্ট্রি নিয়ে রিটায়ারমেন্টের পরে পড়াশোনা করার।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।