সম্পাদক : অভীক সিংহ
প্রথমেই সববাংলায় এবং লেখালিখির সাথে যুক্ত সকল পাঠকবৃন্দ, লেখক-লেখিকা, শুভানুধ্যায়ী, এবং কুশীলবদের জানাই শুভ নববর্ষের আন্তরিক প্রীতি ও শুভেচ্ছা। ১৪৩২ বঙ্গাব্দ যেন সকলের সুখময় এবং শান্তিপূর্ণ হয়, এই প্রার্থনা ও শুভকামনা রইল।
স্বামী বিবেকানন্দের একটি বাণী দিয়েই আমার কথা শুরু করছি, “Education is the manifestation of perfection already in man,” অর্থাৎ মনুষ্যের অন্তর্নিহিত শক্তির উদ্ভাসের এবং সত্তার বিকাশের প্রতিরূপই হল শিক্ষা। সময় এবং সমাজের প্রেক্ষিতে এই শিক্ষার মূল অর্থ বারংবার বিবর্তনের চক্রে আবর্তিত হ’তে হ’তে পেয়েছে এক নব্যরূপ। শিক্ষার এই অধুনা নব্যরূপকে পুরাতনপন্থীরা যতই বক্রদৃষ্টিতে দেখুন না কেন, শিক্ষার মূল্য আজও অনস্বীকার্য। জগতজোড়া ক্রমপরিবর্তনশীল শিল্পকেন্দ্রিক জীবিকাসংস্থানের ভিত্তিতে শিক্ষার রূপ বদলেছে, বদলেছে তার মূল্যায়ন। বিশ্বব্যাপী শিল্পকেন্দ্রিকতার দিক থেকে বলতে গেলে চাহিদা এবং সরবরাহ – এই দুটি জিনিসই স্থান-কাল-পাত্র নির্বিশেষে জগতের অর্থনীতির দিকনির্ণয় করে থাকে। যেহেতু শিল্প তথা অর্থনৈতিক বিকাশের পিছনে প্রযুক্তি এবং দক্ষ শ্রমশক্তির অবদান বিশাল, তাই খুব স্বাভাবিকভাবে এই পরিবর্তনের স্রোত এসে আঘাত করেছে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিকে। আজ প্রচলিত বিষয়গুলিতে কর্মসংস্থান সঙ্কুচিত হয়ে যাওয়ার কারণে ছাত্রছাত্রীদের কাছে সেই বিষয়গুলির গ্রহণযোগ্যতাও ক্রমহ্রাসমান। ফলতঃ, জগতের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিতে এই প্রচলিত বিষয়গুলির শিক্ষক-শিক্ষিকাদের চাহিদাও অবরোহণের পথে।
তাহলে কি শিক্ষার মূল্য আজ হারিয়ে যাচ্ছে? না, একেবারেই না। প্রযুক্তিগত উন্নতির কারণে মানুষের কাছে আজ শিল্পকেন্দ্রিক তথা জীবিকাকেন্দ্রিক শিক্ষার পথটা অনেকাংশেই সুগম, সুলভ, এবং অবারিত। যদি মেচেদা থেকে মিচিগান, কক্সবাজার থেকে অক্সফোর্ড, অথবা হাওড়া থেকে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা বিনামূল্যে করায়ত্ত করা সম্ভব, সেক্ষেত্রে একজন গড়পড়তা ছাত্র বা ছাত্রীর কাছে ইউটিউবটাই হয়ে উঠতে পারে একটা আস্ত বিশ্ববিদ্যালয়, যেখান থেকে তারা যাবতীয় শিল্পকেন্দ্রিক তথা জীবিকাকেন্দ্রিক শিক্ষাটা গ্রহণ করতে পারে। তাহলে প্রশ্ন হ’ল, সমস্যাটা কোথায়? সমস্যাটা হ’ল, প্রচলিত বিষয়গুলির শিক্ষক-শিক্ষিকাদের নিজেদের বিষয়গুলিকে করে তুলতে হবে আরও আধুনিক। ভুলে গেলে চলবে না, “শিক্ষার জন্য বাঁচা”-র প্রয়োজন “বাঁচার জন্য শিক্ষা”-র সমানুপাতিক। প্রচলিত বিষয়গুলির মূলভাব অক্ষুণ্ণ রেখেই সেটাকে করে তুলতে হবে অধুনা শিল্পকেন্দ্রিক। উদাহরণস্বরূপ বলি, ইতিহাসে কণিষ্ক, পুরু-আলেকজাণ্ডার, চন্দ্রগুপ্ত-কৌটিল্য – এনাদের কথা শুধুমাত্র পাঠ্যপুস্তক থেকে কণ্ঠস্থ না করিয়ে যদি এক কৃত্রিম বাস্তবের আবহ সৃষ্টি করে ত্রিমাত্রিক অবস্থায় উপস্থাপন করা যায়, তাহলে ছাত্রছাত্রীরা প্রকৃতই অনুভব করতে পারবে সেই সময়টিকে, ইতিহাস তাদের রন্ধ্রে জাগাবে এক অনাবিল শিহরণ। এই শিক্ষার মধ্যে যে আনন্দ, যে অনুভূতি লুকিয়ে আছে, তা প্রাচীনপন্থায় হয়ত সম্ভবপর হবে না। যদি শিক্ষা সময়কে যথাযথ প্রতিফলিত করতে না পারে, মানুষকে ভবিষ্যতের দিকে আগ্রাসনের সাহস যোগাতে না পারে, সে শিক্ষা তো অর্থহীন। একটি বটবৃক্ষ নিজের শিকড় গভীরে বিস্তার করে রাখলেও সে নিজের শাখাপ্রশাখাকে মেলে দেয় মুক্ত আকাশে এক সুদূরপ্রসারী স্বপ্নকে ধাবন করার আশায়। শিক্ষাও এর ব্যতিক্রম নয়। শিক্ষা মানুষকে দেবে এক স্বপ্নউড়ান, যে উড়ানে ভর করে তারা নিছক দিনগত পাপক্ষয়ী জীবিকার বাইরে সৃষ্টি করতে পারবে নিজস্ব এক জগৎ। এই সৃষ্টির খেলাতেই তো হবে তার সত্তার বিকাশ, অন্তর্নিহিত শক্তির বিকাশ – “manifestation of perfection”।
চলুন না, এই নববর্ষে নিজের শিক্ষা, নিজের সত্তা, নিজের শক্তি, নিজের ভবিষ্যতকে দিই সেই বহুকাঙ্ক্ষিত স্বপ্নউড়ান। আরেকবার মনে গভীরে খুঁজে দেখি সেই কারণগুলোকে, যে কারণগুলো আমাদের ভালবাসতে শিখিয়েছিল নিজের প্রিয় বিষয়টিকে, নিজের প্রিয় ভাষাটিকে। এই শাশ্বত অন্তর্দর্শনের পথে আমরা আছি আপনার সাথে, আপনার পাশে, আপনার একনিষ্ঠ সঙ্গী হয়ে। আসুন না, একসাথেই শুরু হোক এক পথচলার, যেখানে বন্ধুর পথে বন্ধু হয়ে থাকবে আপনারই সর্বময় সহচর – লেখালিখি সববাংলায়।
চমৎকার লেখা
অনেক ধন্যবাদ অরিত্র