জন্মচক্র

লেখক : সুতপা সোঽহং

একটা নীলচে আলো এক ঝলকে ঢুকে পড়ল ঘরে। মেয়েটি হাঁটু মুড়ে বসল। আলোটা বিন্দু হয়ে রির দুই ভ্রুর ঠিক মাঝখানে ছুঁয়ে থাকল। একমিনিট, দু’মিনিট, তিন মিনিট – মেয়েটা অপেক্ষা করতে থাকল। এ অপেক্ষার শেষ আছে। রি জানে। তাই তার বুকের ভেতর কালবৈশাখী ঝড়। ঠিক কাঁটায় কাঁটায় সাত মিনিট। হ্যাঁ, এখন পৃথিবীর একটা সুর তার শরীরে ইনস্টল হয়ে গেছে। রি একটু একটু দুলতে লাগল। রি ভাবল, সুর মানেই কি ছন্দ? সুর মানেই কি তাল? সে জানে না। শুধু জানে এখন সে পৌঁছাবে প্রাক-জীবন পৃথিবীতে। এক নতুন জন্ম হবে তার। এখানকার সমস্ত স্মৃতি সে ভুলে যাবে। এই বিস্মৃতির আগেই সে একবার মনে করতে চাইলো পুরো ঘটনাটা।

একেবারে এক অচেনা গ্রহে মানুষ বলতে সে একাই। তাকে জ্যোতির্বিজ্ঞান শেখানো হয়েছে। নানারকম ভাষা, অংক, দুর্যোগে বেঁচে থাকার কৌশল শেখানো হয়েছে। কিন্তু সুর, তাল, ছন্দ, গান শেখানো হয়নি। পৃথিবীতে হাতে গোনা যে কয়টি মানুষ এখনও বেঁচে আছে, তারা সবাই উচ্চস্তরের বিজ্ঞানী। বাতাস দূষিত হ‌ওয়ার শেষ স্তরে তারাই এক বিশেষ ইনকিউবেটরে নিজেদের বাঁচিয়ে রেখেছে, যেখানে সময়ের মূল্য অনেক। যেটুকু সময় তারা বেঁচে আছে, তার সবটুকু দিয়ে বিশেষ ভাবে বাছাই করা শিশুদের বেঁচে থাকার প্রয়োজনীয় কৌশল শিখিয়েছে। তারপর দু’জন করে পাঠিয়েছে অনুমানের বাসযোগ্য একেকটা গ্রহে। তাদের লিঙ্গ সবসময় একজন পুরুষ ও একজন নারী, যাতে তারা সেই গ্রহ পৃথিবীর মানুষদের বাসযোগ্য হিসেবে সিদ্ধান্তে এলেই প্রজননের মাধ্যমে সেখানে জনসংখ্যা বাড়াতে পারে, এবং মানুষ প্রজাতির অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারে। 

রি‌ও সেই বিশেষ ভাবে বাছাই করা শিশুদের একজন। অন্যান্যদের মত সেও আঠার বছর অবধি শিখেছে বিভিন্ন গ্রহে কীভাবে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হবে। কিন্তু এই গ্রহে সে একা এসে পৌঁছেছে। মহাকাশের ধূমকেতু ঝড়ের সময়ে তাদের মহাকাশযান ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অত্যধিক তাপ ও চাপ সহ্য করতে না পেরে রি এর পুরুষসঙ্গীটি মারা যায়। রি‌ নিজে খুব অসুস্থ হয়ে পড়লেও শেষ পর্যন্ত বেঁচে যায়। কিন্তু মহাকাশযানের অধিকাংশ যন্ত্র খারাপ হ‌ওয়ার কারণে পৃথিবীর বিজ্ঞানীদের সাথে কোন যোগাযোগ‌ই করা সম্ভব হয়নি। রি জানে না এভাবে আর কতদিন একা একা সে বাঁচতে পারবে। তবু জীবমাত্র‌ই বাঁচতে চায়। সমস্ত প্রতিকূলতার মধ্যেই সে নিজের অস্তিত্ব রক্ষা করতে চায়। 

রি পৃথিবীর সময়নির্ধারণকারী যন্ত্রটার দিকে তাকায়। হিসেব কষে বের করে পৃথিবী থেকে এই গ্রহে আসার পর সময় কাটিয়েছে দশ মাস পাঁচ দিন আট ঘন্টা পঁচিশ মিনিট চার সেকেন্ড। গ্রহটা মানুষের বাসযোগ্য করা যাবে, যদি কিছু সমস্যার সমাধান করা যায়। যেমন, এখানে পৃথিবীর হিসেবে প্রতি ছয় ঘণ্টা অন্তর অন্তর ম্যাগনিয়ামের ঝড় ওঠে। এখানে ধুলো বলতে ম্যাগনিয়ামের কণা। রি জ্যোতির্বিজ্ঞানের তথ্য ঘেঁটে দেখেছে, একমাত্র এই গ্রহেই এই ম্যাগনিয়াম নামক বাষ্পীয় ধাতুটি পাওয়া যায়। এর বৈশিষ্ট্যাবলী একেবারেই অন্যরকম। শুধু পৃথিবী কেন অন্যান্য গ্রহের কোনো ধাতুর বৈশিষ্ট্যের সাথে এর মিল নেই। রি ভাবে, কোনক্রমে যদি এই ম্যাগনিয়াম ধাতুর কিছুটা গবেষণাগারে পরীক্ষা করা যেত, হয়ত কত নতুন নতুন তথ্য পাওয়া যেত। যেমন, এক অতি আশ্চর্য ঘটনা সে ঘটতে দেখেছে, যার কোন বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা সে খুঁজে পায়নি। যখন‌ই এই ম্যাগনিয়ামের ঝড় ওঠে, সেসময় সেই ঝড়ের শোঁ-শোঁ আওয়াজের মধ্যে‌ও একটা মন কেমন করা সুর শোনা যায়। প্রথম যেদিন রি ব্যাপারটা খেয়াল করে, প্রথমে ভেবেছিল কানের ভুল। একে তো জনমানবহীন গ্রহ, তার উপরে এমন ভয়ঙ্কর ঝড়। কীভাবে এখানে সুরের সৃষ্টি হবে? কিন্তু এতদিন ধরে এখানে থাকার ফলে ব্যাপারটা গা স‌ওয়া হয়ে গেছে। কিন্তু প্রথম দিনের মত‌ই এখনও তার আশ্চর্য লাগে, যে এই অদ্ভুত সুরটা কীভাবে তৈরি হতে পারে। রি কয়েকবার চেষ্টা করেছে সুরের উৎস খোঁজার জন্য, কিন্তু এই তুমুল ঝড়ে মহাকাশযান থেকে বের হ‌ওয়া খুব‌ই ঝুঁকিপূর্ণ। সব থেকে অবাক করা বিষয় হচ্ছে, এই সুরটা শুনলেই কেমন জানি কান্না পায়। মন হু-হু করতে থাকে।

এই কয়দিন ধরে রি চেষ্টা করছে কোনভাবে যদি সুরটা রেকর্ড করা যায়। নিজেও গুনগুন করে সুরটা তোলার চেষ্টা করছে। কিন্তু কিছুতেই হচ্ছে না। এমনিতেই যতদিন যাচ্ছে, একাকিত্ব যেন চেপে ধরছে। বিজ্ঞানের অত্যধিক প্রযুক্তির মাধ্যমে খাবার, জল ছাড়াও সারাজীবন ক্ষুধা-তৃষ্ণা মেটানো গেলেও একাকিত্ব মেটানোর কোনো যন্ত্র বা প্রযুক্তি তৈরি হয়নি। রি তাই খুব করে সুরটা তোলার চেষ্টার মাধ্যমে অন্যদিকে মনযোগ ডাইভার্ট করতে চাইছে। কিন্তু যতবারই সুরটা রেকর্ড করার চেষ্টা হয়, ততবার‌ই ঝড়ের শব্দ বেড়ে যায়। রি আজ তাই রিস্ক নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ঝড় শুরু হ‌ওয়ার ঠিক আগে স্পেস স্যুট পরে নিয়েছে। আজকে ঝড়ের সময় সে বাইরে বেরোবে। সুরটা কীভাবে সৃষ্টি হয়, সেটাও যেমন খোঁজার চেষ্টা করবে, ঠিক তেমনই সুরটা রেকর্ড করবে।
সময় দেখছিল। ঝড় শুরু হতেই স্পেসশিপের দরজাটা খুলে বাইরে বেরিয়ে এল। মেরুন রঙের ধোঁয়ার মত ম্যাগনিয়ামের ঝড় ব‌ইছে। তার গতি এত বেশি যে রি এর মত ওজনের কাউকে এক নিমেষেই উড়িয়ে নিতে পারবে। কিন্তু তার জন্য রি আগে থেকেই ব্যবস্থা করে রেখেছিল। ক’দিন ধরে মোটা মোটা লোহার থাম পুঁতেছিল, আর তার সাথে আটকে দিয়েছিল মোটা শিকল। নিজের কোমরেও বেঁধে নিয়েছিল বড় একটা বড় লোহার শিকল। মেরুন ধোঁয়ার মধ্যে কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না। তার মধ্যেই রি ফোনে রেকর্ডার অন করে শিকল ধরে ধরে এগোতে লাগলো। সুরটা শোনা যাচ্ছে কিন্তু খুব আস্তে। ঝড়ের দাপটে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকাই খুব মুশকিল, তার উপরে হেঁটে হেঁটে এগিয়ে যাওয়া। তবু রি আপ্রাণ চেষ্টা করছে এগোনোর। আঠার বছর পর্যন্ত ওদের এইসব ট্রেনিং‌ই দেওয়া হয়েছে। ফলে বিভিন্ন গ্রহের ধূলিঝড়ের কৃত্রিম অভিজ্ঞতা তার ভালমত‌ই আছে। দু’হাত মত এগোনোর পর সুরটা একটু তীব্র মনে হচ্ছে। চশমা থাকা সত্ত্বেও ম্যাগনিয়াম কণার জন্য চোখ খোলা যাচ্ছে না। কারণ ম্যাগনিয়াম কণা সম্পর্কে খুব বেশি তথ্য পৃথিবীর মানুষের কাছে না থাকলেও এর অতি অল্প মাত্রা চোখে গেলেই যে পুরোপুরি অন্ধ হ‌ওয়ার সম্ভবনা রয়েছে, সে সম্পর্কে সতর্কতা আছে। তাই রি হেলমেট আর বিশেষ চশমা থাকা সত্ত্বেও চোখ বন্ধ রেখেই অনুমানে সুরের উৎসের দিকে এগোনোর চেষ্টা করছে।

অনুমানে আরও কয়েক হাত এগোনোর পর মনে হল সুরের উৎস একেবারে আশেপাশেই। রি উত্তেজনায় আর চোখ বন্ধ রাখতে পারে না। খুব ধীরে ধীরে চোখের কোণা দিয়ে দেখার চেষ্টা করে। আর তাতেই যা চোখে পড়ে সে আপাদমস্তক চমকে ওঠে। নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারে না। সামনেই বিশাল উঁচু উঁচু সাতটা ঘর। তাদের উচ্চতা এতটাই বেশি যে মনে হচ্ছে আকাশ ছুঁয়েছে। রি যেন আকাশ থেকে পড়ে। ঝড় না থাকাকালীন সে অনেকটাই আশে পাশে ঘুরেছে। ক‌ই, এই ঘরগুলো তো কখনও চোখে পড়েনি! তাছাড়া এত উঁচু উঁচু ঘর যেখানেই থাকুক না কেন, অনেক দূর থেকেই তা দেখা যাবে। রি একশ ভাগ নিশ্চিত, এমন উঁচু ঘর এখানে আগে ছিল না। থাকলে নিশ্চয় তার চোখে পড়ত। আরেকটা জিনিস দেখে সে অবাক হল। চারিদিকে দুরন্ত গতিতে মেরুন রঙের ধোঁয়া ঝড় ব‌ইলেও ঘরগুলোর চারপাশে সবকিছু একদম স্থির। দেখে মনে হচ্ছে সেই ঝড়ের কেন্দ্র যেন এই ঘরগুলো। আর সেই ঘরগুলো থেকেই মন কেমন করা সুর চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ছে।

রি বুঝতে পারছে না ঘরগুলোতে ঢোকা ঠিক হবে কিনা। হাতে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির অস্ত্র থাকলেও যে বা যারা এই ঘরগুলো তৈরি করেছে, তারা আরও বেশি প্রযুক্তির দিক দিয়ে উন্নততর হতে পারে। রির একবার মনে হচ্ছে এই গ্রহে হয়ত বাসিন্দা আছে, সেই জীবগুলোই হয়ত এমন ঘর তৈরি করেছে। কিন্তু ও যে এতদিন ধরে এখানে বাস করছে, একবার‌ও কেন তাদের সাথে দেখা হল না! নাকি তারা এই ম্যাগনিয়ামের ঝড়ের সময়‌ই শুধু বাইরে বের হয়, আর বাকি সময় নিজেদের কোথাও লুকিয়ে রাখে, যার কারণেই হয়ত রি তাদেরকে দেখতে পায়নি? নানারকম সম্ভবনার কথা ওর মাথায় আসে। ঘরগুলোর আশেপাশে একহাত মত জায়গায় ম্যাগনিয়ামের ঝড় নেই বলে সহজেই চোখ খোলা রাখা সম্ভব হচ্ছে। রি দাঁড়িয়ে ভাবতে থাকে ঘরগুলোতে ঢুকবে কিনা। একদিকে যেমন অন্য প্রাণের অস্তিত্ব থাকার সম্ভাবনায় উত্তেজনা কাজ করছে, আবার অন্যদিকে নিজের প্রাণের ভয়‌ও পাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত কৌতূহল‌ই জয়ী হয়। রি একহাতে অস্ত্র উঁচিয়ে ধীরে ধীরে ঘরগুলোতে ঢোকে। কাছে এলে বুঝতে পারে ঘরের দেওয়াল কোন কঠিন পদার্থ দিয়ে তৈরি নয়। বরং পারদের মত চকচকে এক ধরণের তরল দিয়ে তৈরি। হাত দিয়ে গড়িয়ে যায়। কিন্তু তাতে দেওয়ালের গঠন নষ্ট হয় না। বরং কোথা থেকে সে জায়গা পূরণ হয়ে যায়। রি খুব‌ই অবাক হয়। কিন্তু তার অবাক হ‌ওয়ার আরও বাকি ছিল। ভিতরে কোনো প্রাণী বা জীব নেই। বরং একটা হলোগ্রাম ভিডিও চলছে। রি হাঁ করে তাকিয়ে থাকে।

এ’রকম কিছু সে এক্সপেক্ট‌ই করেনি। সম্বিত ফিরতেই ভিডিওটার দিকে মনোযোগ দেয়। দেখে মানুষের মত‌ই দেখতে একজন একটা যন্ত্র বাজাচ্ছে। সেই মন কেমন করা সুর। শুনতে শুনতেই রির কেমন কান্না পায়। এসবের মানে কী! এই হলোগ্রাম ভিডিওর ব্যবস্থা কে করেছে? কেন করেছে? কী তাদের উদ্দেশ্য? রির কিছুই মাথায় ঢোকে না। রি আরও কাছে এগিয়ে আসে। আর তখন‌ই ওর চোখে পড়ে মেঝেতে একটা বড় বোতাম। সেখানে পায়ে চাপ দিতেই হলোগ্রামের মানুষটা বাজনা বাজানো বন্ধ রেখে উঠে দাঁড়ায়, তারপর গম গম করে বলে ওঠে, “তুমি বা তোমরা কেউ এসেছ নিশ্চয়। বোতাম টিপেছ বলেই আমার এই ভিডিও দেখতে পাচ্ছ। শোনো আমি ৩৪৪৪ঙৎ নম্বর গ্রহের এক জীব। ভবিষ্যত থেকে এসে এই হলোগ্রাম ভিডিওটি এখানে সেট করে যাচ্ছি। এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কোনো জীব যাতে সুর, তাল, ছন্দ, গান না ভুলে যায়, তাই এই সুরের সৃষ্টি করেছি। যখন‌ই কোন উন্নত জীব গান, আঁকা, লেখালেখি, কল্পনা করা ইত্যাদি সৃষ্টিশীল কাজকর্ম ভুলে যাবে বা নিজেদের জীবন থেকে বাদ দেবে, তখন‌ই তাদের ধ্বংসের মুখে পড়তে হবে। আমি যেহেতু ভবিষ্যত থেকে এসেছি, তাই আমি জানি ঠিক কীভাবে ধ্বংস হয়েছে এমন উন্নততর জীবেরা। প্রায় প্রত্যেক গ্রহেই বিজ্ঞানীরা একসময় সর্বেসর্বা হয়ে উঠেছে। তাদের একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠে শিল্পী ও সৃষ্টিশীল মানুষরা। তাই তারা সমস্ত সৃষ্টিশীল কাজকর্মকে নিষিদ্ধ করে কবি, শিল্পীদের হত্যা করে সমস্ত শক্তির রিসোর্সকে নিজেদের গবেষণার কাজে লাগায়। এতে প্রযুক্তির বিশাল সাফল্য এসেছে ঠিক‌ই, কিন্তু জীবেদের মধ্যে আসে অবসাদ, বিষাদ, হতাশার কালো ছায়া। সেই অবসাদ, বিষাদ আর হতাশাতেই এক এক করে সমস্ত উন্নত জীবরা নিজেদের ধ্বংস করতে থাকে। আমি আমার গ্রহের একমাত্র জীবিত সদস্য, যার বৈজ্ঞানিক সাফল্যের জন্য আমাদের গ্রহ প্রযুক্তিতে আকাশ ছুঁয়েছে। কিন্তু নীরস জীবনযাপন এবং অবসাদ থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পারেনি। আমি তাই ভবিষ্যত থেকে এসে অতীতে গিয়ে নিজেকেই হত্যা করি। কিন্তু তার আগে এই গুরুত্বপূর্ণ বার্তা যেন অন্যান্য উন্নততর গ্রহের প্রাণীরা পায়, তার ব্যবস্থা আমি কিছু কিছু গ্রহে এমন ধরণের হলোগ্রাম ভিডিওর মাধ্যমে জানিয়ে যাচ্ছি। সঙ্গে এইখানেই রেখে যাচ্ছি  নিজের মস্তিষ্কের নিউরনে সুর ইনস্টল করার ব্যবস্থা ও একটি টাইমপোর্টাল, যার মাধ্যমে তুমি বা তোমরা নিজেদের অতীতে গিয়ে একদম ঠিক সেই সুর নিজেদের গ্রহে ছড়িয়ে দিতে পারবে। এই ঘরের চার কোণেই রয়েছে একটি করে বোতাম, যা টিপলেই সুর ও সৃষ্টিশীল কাজকর্মের জিন একদিকে যেমন DNA-তে ইনস্টল হয়ে যাবে, ঠিক তেমনই সেই গ্রহে যখন সবে প্রাণের সঞ্চার হবে, সেই সময়ে টাইমপোর্টালে করে পৌঁছে যাবে। শুধু এতে একটাই সমস্যা, যে টাইমপোর্টালে করে অতীতে পৌঁছালে এ সময়ের সমস্ত স্মৃতি তুমি বা তোমরা ভুলে যাবে। সমস্ত বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তি ও বুদ্ধি বিস্মৃত হবে। নতুন জন্মের মত আবার নতুন করে সব করতে হবে। এটিই একটা টাইম-লুপ। যে বা যারা আমার এই হলোগ্রাম ভিডিওর সম্মুখীন হবে, তাদের‌ই এই টাইম লুপ চলতে থাকে অসীম সময় ধরে। ফলে ব্রহ্মাণ্ড থেকে কখনই তারা বিলুপ্ত হবে না। বিভিন্ন পুরাণ গ্রন্থে একে ডাকা হবে জন্মচক্র, জন্মান্তর ইত্যাদি নানা নামে।”

হলোগ্রাম ভিডিওটি শেষ হয়। রি অবাক বিস্ময়ে ভাবতে থাকে এখন তার ঠিক কী করা উচিত। বছরের পর বছর ধরে একাকী লক্ষ্যহীন বেঁচে থেকে হতাশা, অবসাদে মৃত্যু, ও সমস্ত জীবের ধ্বংস হ‌ওয়ার অপেক্ষা করা, নাকি ভবিষ্যৎ থেকে আসা এই অন্য গ্রহের জীবটির কথা শুনে আবার পৃথিবীর একদম প্রাক-জীবন অবস্থায় ফেরত যাওয়া। ভাবতে গিয়ে অসতর্কে রির পায়ের তলা থেকে বোতামটা সরে যায়। ফলে সেই আগের হলোগ্রাম ভিডিও‌ শুরু হয়। সেই মন কেমন করা সুর বাজতে থাকে। সেই হৃদয় মথিত সুরে রির আবার চোখে জল আসে। আহা! এমন সুরের অস্তিত্ব‌ই যদি মানুষ না জানে, তবে সেই জীবনের মূল্য কী! বাজনা শুনতে শুনতেই রি সিদ্ধান্ত নেয়, সে এই সুরের জিন নিজের DNA-তে ইনস্টল করবে এবং প্রাক-জীবনে ফেরত যাবে। তাতে যদি বারবার জন্ম নিতে হয়, জন্মচক্রে ও টাইম লুপে পড়তে হয়, তাও ঠিক আছে। ঘরের কোণে থাকা টাইম পোর্টালের বোতাম টেপার আগে সে মনে মনে একবার গুণগুণ করে ওঠে সুরটি। তার কাউন্টডাউন শুরু হয়ে গেছে বিস্মৃতি ও জন্মচক্রের।


লেখক পরিচিতি : সুতপা সোঽহং
সুতপা সোঽহং এর জন্ম ১১ই মে, ১৯৯২ সালে। শিলিগুড়ি নিবাসী। সরকারি প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতার পেশায় যুক্ত। বিভিন্ন পত্রিকায় ও লিটল ম্যাগাজিনে নিয়মিত লেখালেখি করেন। প্রকাশিত ব‌ইয়ের সংখ্যা দুইটি। প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'জলের কোলাজ' ২০২৪ সালের 'রেনেসাঁস শারদ সম্মান' এ ভূষিত হয়েছে। তিনি লেখালেখির পাশাপাশি চিত্রশিল্পে ও সমাজসেবায় যুক্ত।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।