ছোটগল্পকার প্রফুল্ল রায়

লেখক : শৌনক ঠাকুর

“মানুষের জীবন তো আসলে একটা নদীর মতো, স্রোত থাকে, বাঁক থাকে, আবার কোথাও কোথাও অগভীরও হয়।” — প্রফুল্ল রায়ের প্রসঙ্গ এলেই এই বিখ্যাত লাইনটি মনে পড়ে যায়। তবে শুধু উপন্যাস নয়, গল্পকার হিসাবেও তিনি যথেষ্ট সফল। তাঁর গল্পের প্রধান বিষয় হয়ে উঠেছে ‘সবার উপর মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই।’

এই জীবন দর্শনের উপর ভিত্তি করেই প্রফুল্ল রায়ের শ্রেষ্ঠ ছোটগল্পগুলির মেরুদণ্ড তৈরি হয়েছে। প্রতিটি মানুষের মধ্যে থাকে স্নেহ-মায়া-মমতা, তা সে যে কোন ধর্মের, যে কোন বর্ণের, বা যে কোন সম্প্রদায়েরই হোক না কেন। হোক সে সুখী গৃহকোণের সুদক্ষ গৃহিণী কিংবা বারবনিতা।

বারবনিতারাও যে রক্তে মাংসে গড়া মানুষ, তাদের মধ্যেও যে মনুষ্যত্ব রয়েছে, রয়েছে সংসার গড়ার সুপ্ত বাসনা, এগুলি তিনি নিপুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন —একবার নয়, বারবার, বহুভাবে, বহু রকমে। ‘মন্দ মেয়ের উপাখ্যান’ গ্রন্থের ভূমিকায তিনি নিজেই বলেছেন — “পাঁকে মুখ গুঁজে থাকলেও সেই মুহূর্তগুলিতে মনে হয় এরা এক একজন মহিমান্বিত নারী। শ্রদ্ধায় বিস্ময়ে তখন মন আপ্লুত হয়ে যায়।”

‘নরক’ এমনই একটি মেয়ের গল্প। নামকরণের মধ্যেই রয়েছে ব্যঞ্জনা। নরক বলতে বেশ্যালয়কে বোঝান হয়েছে। দেখা গিয়েছে, দিনের আলোয় সম্ভ্রান্ত লোকজন তথাকথিত ভদ্রলোক বেশ্যালয়কে ঘৃণা করে, অথচ রাতের অন্ধকারে সেখানেই তারা ভিড় করে। এই গল্পে নীতিবোধ, দায়িত্বশীলতা আর ভালবাসায় নরকও হয়ে উঠেছে স্বর্গ, বেশ্যালয় হয়ে উঠেছে পবিত্র স্থান, আর বেশ্যাও হয়ে উঠেছে জীবনদায়িনী। এই গল্পের প্রধান চরিত্র ‘সগিয়া’। সে দেহ ব্যবসা করে। আহামরি সুন্দরী না হলেও তার শরীরের মধ্যে একটা অদম্য আকর্ষণ ছিল। জনকপুরে দেহ ব্যবসার জন্য যাওয়ার সময় প্রবল বিপর্যয়ে নৌকা উল্টে যায়। সগিরা সাঁতার কাটতে কাটতে দেখে একজন লোক স্রোতের জলে ভেসে যাচ্ছে। তাকে কোনরকমে সে বাঁচায়। বেশ্যালয়ে নিয়ে এসে সেবা, শুশ্রূষা করে। ডাক্তারের মাধ্যমে সে জানতে পারে, লোকটির নাম শিবশঙ্কর শাস্ত্রী। ওই এলাকায় ধার্মিক, সৎ, চরিত্রবান, মহান একজন ব্যক্তি। এর পরিচয় পেয়ে সগিরা সংকোচবোধ করে। এখানে একটা আশ্চর্য ব্যাপার, ডাক্তারবাবু বলেছেন শাস্ত্রী মশাইকে যেন দুধ খাওয়ানো হয়, অর্থাৎ পানীয় জাতীয় দ্রব্য। কিন্তু অন্ন খাওয়ালে নাকি তার জাত চলে যাবে, ধর্ম চলে যাবে, পুণ্যের ভাঁড় শূন্য হয়ে যাবে। ডাক্তারের বক্তব্য – “বেশ্যার ছোঁয়া অন্ন তার পবিত্র শরীরে ঢুকলে মৃত্যুর পর তার যে নরক বাস হবে, তা অনন্ত। সে পাপের আর প্রায়শ্চিত্ত নেই।” লেখক এখানে ঘুণধরা সমাজের প্রতি চাবুক মেরেছেন। সুস্থ হওয়ার পর দিনের আলোয় সকলের সামনে রিকশা করে শাস্ত্রীমশাই বাড়িতে ফিরে যান। লেখক দেখিয়েছেন, সে বেশ্যা হতে পারে, কিন্তু আসলে জীবনদাত্রী। নিজের জীবন বিপন্ন করে তাকে বাঁচিয়েছে। সাগিরা কোন পৃথক চরিত্র নয়, চিরন্তন মানবিকতার এক দৃষ্টান্ত।

‘খাঁচা’ গল্পটির মধ্যে রয়েছে এক অন্যরকম আবেদন। এই গল্পের ভূমিকাটি অনেক কিছুর ইঙ্গিত দেয় — “সূর্য ডুবে গেলে জলে কালির মতো ফিকে অন্ধকার যখন নামে, সেই সময় এই মেয়ে মানুষেরা নরকের খাসমহলে একের পর এক সন্ধ্যাবাতি জ্বেলে দেয়।” এখানে ‘সন্ধ্যাবাতি’ শব্দটি বিশেষভাবে স্মর্তব্য। কাহিনীটি হ’ল, একসময় আমেরিকার সৈন্যরা ছোট ছোট ঘর তৈরি করে থাকত। তারা চলে যাবার পর ঘরগুলি ত্যক্ত হয়ে যায়। এরকমই একটি জায়গার দখল নেয় হর্ষদত্ত কুন্ডু নামক এক ধনী ব্যক্তি, এবং মেয়েদের বসায়। পরবর্তীকালে সে কেষ্টভাবিনী দাসীকে লিজ দেয়। এই গল্পের মধ্যে দেখানো হয়েছে, দেহ ব্যবসার মধ্যেও কতটা প্রতিদ্বন্দ্বিতা, কতটা প্রতিযোগিতা রয়েছে। এই গল্পের নায়িকা যমুনা। বয়স ২৩-২৪। কিন্তু তার দাম বেশি। সমস্ত খদ্দের প্রথমেই তার খোঁজ করে। লেখক বলেছেন – “নরকেও প্রতিদ্বন্দ্বী কম নেই।” আবার ফুল বিক্রেতা গণেশ যমুনার খোঁজ করে। তখন অন্যান্যরা তার প্রতি ঈর্ষান্বিত হয়। শুধু দেহ ব্যবসা নয়। যমুনার আচার-আচরণ, ব্যবহার সকলের মনের দাগ কেটেছিল। এই গল্পে আর একটি আশ্চর্য ব্যাপার রয়েছে – ‘যস্মিন দেশে যদাচার’, অর্থাৎ যে দেশের যে রীতি। গল্পটিকে বাস্তবসম্মত করার জন্য লেখক দক্ষতার সাথে সেখানকার কথাবার্তা, গালিগালাজ ব্যবহার করেছেন। শুধু মানুষের মুখে নয়, পাখিদের মুখেও। পোষা পাখিকে বলতে শুনি ‘রসের নাগর’, ‘সাতকেলে ভাতার’, ‘পিরিতের আঠা’, ইত্যাদি ভাষা।

‘রাজপুত’ গল্পের মূল বিষয় বারবনিতা ও রাজপুত যুবকের ভালোবাসার কাহিনী। সেই সঙ্গে এখানে স্থান পেয়েছে দায়িত্ব, কর্তব্যবোধ, সহমর্মিতাবোধ। ‘জুহু বিচের সেই মেয়েটা’ একটু অন্য ধরনের গল্প। কিভাবে দারিদ্র একজন মা’কে বাধ্য করেছিল শরীর বেচতে, এই পটভূমিকায় এটি রচিত। এছাড়াও ‘শবরী’, ‘জনক’, ‘পিঞ্জর’, ‘দুর্বোধ্য’, ‘জন্মধাত্রী’ , ‘বেলাশেষে’ গল্পগুলি পাঠকের মনে দাগ কেটে যায়। ছোটগল্পের প্রধান বৈশিষ্ট্য শুরুর চমক, সমাপ্তিতে প্রত্যাশা। তাঁর বেশিরভাগ গল্পেই এই সকল বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা গিয়েছে। লেখকের লেখনী শক্তির ও কাব্যিকতার পরিচয় বিভিন্ন গল্পের সূচনাংশে। তেমনই একটি গল্প ‘আকাশের চাঁদ এবং একটি জানালা’। গল্পের সূচনাটির মধ্যে অভিনবত্ব রয়েছে — “এই ছোট্ট মফস্বল শহরটার শেষ মাথায় নরকের খাসমহল একেবারে জমজমাট। এখানে ফুটিফাটা টিনের চালের বস্তির ভেতর দুনিয়ার সবচেয়ে ওঁচা তিরিশ-চল্লিশটি মেয়েমানুষ কতকাল ধরে যে ঘাড় গুঁজে পড়ে আছে!”

তাঁর গল্পের আরেকটি দিক হল উদ্বাস্তু জীবনের দুঃসহ যন্ত্রণা ও সমস্যা। ‘শেকড়’ গল্পে রাজমোহন এবং আব্দুল করিমের মধ্যে কথাবার্তায় বারবার ফুটে উঠেছে দেশভাগের কথা, ভিটামাটি, উচ্ছেদ, দাঙ্গা ইত্যাদি। তাদের জেনারেশন যেমন এসব নিয়ে ভাবনা চিন্তা করে, কিন্তু তাদের পরবর্তী জেনারেশন এসব নিয়ে মাথা ঘামায় না। করিম সাহেবের ভাষায় এই জেনারেশন হল – ‘একেবারে রুটলেসের দল।’ এদিকে বাড়ি বিক্রি করার জন্য রাজমোহনের উপর চাপ আসতে থাকে। সেই আক্ষেপও ধরা পড়েছে তার গলায় — “পূর্বপুরুষের স্মৃতির প্রতি একালের ছেলেমেয়েদের আর কোন ফিলিংস নেই।” এছাড়াও ‘অনুপ্রবেশ’, ‘চর’, ‘রাজা যায় রাজা আসে’, ‘ধুনীলালের দুই সঙ্গী’, ‘স্বপ্নের ট্রেন’, ‘কাছেই আছে’, ‘বিদেশি’, ‘যেখানে সীমান্ত নেই’, চিকন’, চিকন্দিপুর’, ‘অলীক নৌকার যাত্রী’, ‘জনক’, ‘রক্তকমল’, ‘দেশ নেই’, ”স্বাদ’ ইত্যাদি গল্পে পূর্ব পাকিস্তান, মুক্তিযুদ্ধ, মিছিল, স্লোগান, ইত্যাদির চিত্র চিত্রিত হয়েছে। লেখক এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, “দেশ হারানোর সেই যন্ত্রণা আমি চিরকাল ভোগ করে চলেছি।” (মুখোপাধ্যায় সোনালি, ‘প্রফুল্ল রায়ের ছোট গল্প এক দেশ অনেক মানুষ’ করুণা প্রকাশনী, প্রথম প্রকাশ, ২০১৯, কলকাতা, পৃষ্ঠা- ১২)

অন্ত্যজ শ্রেণির মানুষ — যাদের কথা সমাজ ভাবে না, যাদের জীবনযাপনকে সেভাবে কেউ গুরুত্ব দেয় না, তাদেরকেও তিনি তাঁর গল্পের প্রধান চরিত্ররূপে তুলে ধরেছেন। ‘জন্মদাতা’ গল্পে বিষ্টুপদ শ্রাদ্ধের কাজ করে, পিণ্ডদান করে জীবিকা নির্বাহ করে। আবার ভগা মরা পোড়ায়। ‘বাজি’ গল্পে মোটালাল ও ছোটালালের কাহিনী একটু অন্যরকম।

‘শেষযাত্রা, গল্পটি এক প্রথা ভাঙার গল্প। সমাজ বরাবরই মেয়েদের শৃঙ্খল পরাতে, পিঞ্জরে আবদ্ধ রাখতে চেয়েছে, তৈরি করেছে বিধি-নিষেধের বেড়াজাল। কিন্তু কেষ্টভাবিনী সবকিছুকে তুচ্ছ করে ব্রাহ্মণ ডাক্তারবাবুর মুখাগ্নি করতে চেয়েছিল। সে তাকে বাবা বলত। ছেলেরা যদি পারে তাহলে মেয়েরা কেন পারবে না? পাপ-পুণ্যের প্রসঙ্গে সে বলেছে — “লরকে তো ডুবেই আছি। বামুনের মুকি আগুন ঠেকিয়ে আর কত ডুবব। মরার পর আমাদের কি হবে তা লিয়ে ভেবে কি হবে।” শেষের কথাগুলো কতটা আধুনিক এবং কতটা বাস্তবসম্মত। অদৃশ্য ভবিষ্যৎকে নিয়ে না ভেবে বর্তমানকে নিয়ে থাকাটাই তো প্রকৃত জীবন।

জীবন বরাবরই মানুষের পরীক্ষা নেয়। এ পরীক্ষা যে কত কঠিন, কত কঠোর, যার কাছে সবকিছু তুচ্ছ, এমনকি পড়াশোনাও। পরিবারের বোঝা, ক্ষুধার জ্বালায় পড়াশোনা হয়ে ওঠে সেখানে বিলাসিতামাত্র। নেমে পড়তে হয় রাস্তায়। বাধ্য হতে হয় যে কোন কাজ করতে। প্রীতি বলেছে — “সংসার যখন ডুবে যাচ্ছে, পড়াশোনা চালানোর মতো সৌখিনতা তার মানায় না।” ( গল্প: ‘সুদীপ ও একটি মেয়ে’)

দেশের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষের অবস্থান, তাদের অস্তিত্বের নানা সংকট, মানসিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া, চাওয়া পাওয়া, অন্তরের সঙ্গে বাইরের অভিঘাত, লড়াই, জয়লাভ — এই সমস্ত বিষয় তাঁর গল্পে গুরুত্ব পেয়েছে। তাই তাঁর গল্পের পুঙ্খানুপুঙ্খ মূল্যায়ণ করা সত্যি দূরহ। এক একটি গল্প জীবনের এক একটি দিকের নির্দেশ করে। এগুলোকে কোন নির্দিষ্ট কালের সীমারেখায় আবদ্ধ করা যাবে না। এগুলির আবেদন চিরন্তন শাশ্বত। গল্পকার প্রফুল্ল রায়ের বক্তব্য দিয়েই শেষ করা যাক — “এসব রচনা তাই বলে একটি নির্দিষ্ট দলিল হয়ে থাকেনি, বরং হয়ে উঠেছে চিরকালের দুঃখ-সুখমথিত মানব জীবনের আত্মপ্রতিষ্ঠার জীবন্ত কথাচিত্র।” ( প্রসঙ্গত : প্রফুল্ল রায়ের রচনা সমগ্র, দ্বিতীয় খন্ড।)


লেখক পরিচিতি : শৌনক ঠাকুর
শৌনক ঠাকুর। গ্রাম পোঃ দক্ষিণখন্ড থানা সালার জেলা মুর্শিদাবাদ পশ্চিমবঙ্গ। ভারত।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।

লেখা জমা দিতে ছবিতে ক্লিক করুন